Sunday 4 June 2023

সংযুক্ত আরব আমিরাত কি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিন্ন পথে চলেছে?

০৪ঠা জুন ২০২৩

এপ্রিল ২০২৩। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল ধাফরা সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন 'এ-১০ থান্ডারবোল্ট' যুদ্ধবিমান। চার দশকের পুরোনো এই বিমানগুলিকে যখন রিটায়ার করা হচ্ছে, তখনই এগুলিকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। অপরদিকে অত্যাধুনিক সকল যুদ্ধবিমানকে হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে অথবা ইউরোপে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মোতায়েন করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বিমান বাহিনী সর্বমোট আড়াই স্কোয়াড্রন বিমান মোতায়েন রাখার টার্গেট রেখেছে। একেকটা স্কোয়াড্রনে ১২টা করে যুদ্ধবিমান থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে থাকবে সর্বমোট ৩০টা বিমান।

গত ৩১শে মে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, দু’মাস আগে দেশটা মধ্যপ্রাচ্যে এবং এর আশেপাশের অঞ্চলে নিরাপত্তায় নিয়োজিত যৌথ নৌ বহর ‘কম্বাইন্ড ম্যারিটাইম ফোর্সেস’ বা ‘সিএমএফ’ থেকে নিজেদের নাম সরিয়ে নিয়েছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, আমিরাতের এই সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়; যা অত্র অঞ্চলের নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পারে। ‘সিএমএফ’এর অধীনে অঞ্চলটা একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক নৌ বাণিজ্যের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পথ, তেমনি ২০১৯ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মাঝে উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে বেশ কিছু বাণিজ্যিক জাহাজের উপরে হামলা হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমিরাত ‘সিএমএফ’এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সদস্য দেশ।

‘সিএমএফ’ কি এবং এর উদ্দেশ্য কি?

‘সিএমএফ’এর ওয়েবসাইট বলছে যে, ২০০১ সালে স্থাপিত এই সংস্থাটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত কয়েকটা যৌথ নৌবহরের সমন্বয়; যার মাঝে রয়েছে ওমান উপসাগর ও ভারত মহাসাগরে নিরাপত্তা দেয়া ‘কম্বাইন্ড টাস্ক ফোর্স ১৫০’ বা ‘সিটিএফ-১৫০’, চোরাচালান দমনে কাজ করা ‘সিটিএফ’-১৫১’, পারস্য বা আরব উপসাগরে নিরাপত্তা দেয়া ‘সিটিএফ-১৫২’, লোহিত সাগর ও আদেন উপসাগরে নিরাপত্তা দেয়া ‘সিটিএফ-১৫৩’ এবং ম্যারিটাইম নিরাপত্তা বিষয়ক ট্রেনিং উইং ‘সিটিএফ-১৫৪’। পুরো ‘সিএমএফ’এর কমান্ডার হলেন মার্কিন নৌবাহিনীর একজন ভাইস এডমিরাল; এবং তার ডেপুটি হলেন ব্রিটিশ রয়াল নেভির একজন কমোডোর। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ‘সেন্ট্রাল কমান্ড’এর অধীনে ৫ম নৌবহরের কমান্ডারই এই যৌথ বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে থাকেন। আর এই পুরো বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স হলো বাহরাইন। এর সদস্যসংখ্যা এখন ৩৮। ‘সিএমএফ’এর সদস্য দেশগুলির মাঝে রয়েছে - মধ্যপ্রাচ্যের ১০টা দেশ - বাহরাইন, মিশর, ইরাক, জর্দান, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন; আফ্রিকার ৩টা দেশ - জিবুতি, কেনিয়া, সেইশেল; ভারত মহসাগরের দেশ ভারত ও পাকিস্তান; পূর্ব এশিয়ার ৬টা দেশ - মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান; ওশেনিয়ার অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড; ইউরোপের ১২টা দেশ - ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, গ্রিস, নরওয়ে, তুরস্ক; এবং আমেরিকার ৩টা দেশ - যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রাজিল।

তবে একই অঞ্চলের বা অঞ্চলের বাইরের কিছু উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্র এই বাহিনীতে নাম লেখায়নি, যেখন ইরান, রাশিয়া এবং চীন। যৌথ এই বাহিনীর বেশিরভাগ দেশই যুক্তরাষ্ট্রের খুবই কাছের বন্ধু। এই বাহিনীতে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেশ রয়েছে ১৪টা। বাহিনীর ১২টা ইউরোপিয় দেশ এবং এশিয়ার কিছু দেশ মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির উপরে নির্ভরশীল। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ছাড়া এই বাহিনীতে নাম লেখানো বেশিরভাগ দেশই ‘সিএমএফ’এর অধীনে সর্বদা সামরিক জাহাজ মোতায়েন রাখে না। তবে অদ্য অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশই নিজেদের নৌবাহিনীর জাহাজ দিয়ে এই বাহিনীতে অংশ নেয়। অর্থাৎ ‘সিএমএফ’এর মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলি নিজেদের সামরিক শক্তি তেমন একটা মোতায়েন না করেই আঞ্চলিক দেশগুলির সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক পত্রিকা ‘আল মনিটর’ ব্যাখা দিয়ে বলছে যে, এই যৌথ নৌবহরের সদস্য দেশগুলি যখন সম্ভব হয় তখন তাদের জাহাজ বা বিমান দিয়ে অংশ নেয়; অন্য সময় সেগুলি অন্য কোন দরকারি কাজে অংশ নেয়ার জন্যে এই অঞ্চল থেকে সরিয়ে নেয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ছাড়া এই বাহিনীতে নাম লেখানো বেশিরভাগ দেশই ‘সিএমএফ’এর অধীনে সর্বদা সামরিক জাহাজ মোতায়েন রাখে না। তবে অদ্য অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশই নিজেদের নৌবাহিনীর জাহাজ দিয়ে এই বাহিনীতে অংশ নেয়। অর্থাৎ ‘সিএমএফ’এর মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলি নিজেদের সামরিক শক্তি তেমন একটা মোতায়েন না করেই আঞ্চলিক দেশগুলির সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে আমিরাতের অসন্তোষ

‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, গত ২৭শে এপ্রিলে এবং ৩রা মে ইরানিরা দু’টা তেলবাহী জাহাজ দখল করে নেয়; যার মাঝে ছিল ‘নিওভি’ নামের একটা জাহাজ, যা কিনা দুবাই থেকে আমিরাতের ফুজাইরাহ বন্দরে যাচ্ছিলো। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আমিরাতের ‘সিএমএফ’ ছাড়ার কেন্দ্রে রয়েছে এই ইস্যুর ব্যাপারে হতাশা; কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইরানের হুমকির ব্যাপারে কোন কিছু করতে ব্যার্থ হয়েছে। তবে আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের কোন সমস্যা হয়নি; বরং মিডিয়া এই ব্যাপারটাকে ভুল দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ‘রাইস ইউনিভার্সিটি’র ‘বেকার ইন্সটিটিউট ফর পাবলিক পলিসি’র ফেলো ক্রিশ্চিয়ান আলরিকসেন ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলিকে রক্ষা করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র উদাসীন ভূমিকা নিয়েছে বলে আবু ধাবিতে অনেকেই মনে করছেন। তবে মার্কিন সামরিক বাহিনীর পত্রিকা ‘স্টারস এন্ড স্ট্রাইপস’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন কর্মকর্তা মনে করিয়ে দেন যে, আমিরাতিরা বলছে যে, তারা দুই মাস আগেই ‘সিএমএফ’ ছেড়ে গেছে; কিন্তু ইরানিরা তো দু’টা জাহাজ দখল করেছে সেই সময়ের অনেক পর।

‘আল মনিটর’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, হরমুজ প্রণালিতে দু’টা জাহাজ ইরানিরা দখলে নেবার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ঘোষণা দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র অত্র অঞ্চলে সামরিক টহল বৃদ্ধি করবে। গত ৩রা মে ‘নিওভি’ নামের জাহাজটা যখন ইরানিরা দখলে নিচ্ছিলো, তখন মার্কিন একটা ড্রোন বিমান আকাশ থেকে তা অবলোকন করছিলো। কিন্তু মার্কিনীরা বলছে যে, তারা জাহাজের নাবিকদের কাছ থেকে সহায়তার কোন আবেদন পাননি। এর আগে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা তিনবার আমিরাতের উপর ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা করে। এর মাঝে শেষের দু’টা হামলা ছিল আমিরাতে অবস্থিত মার্কিন ‘আল ধাফরা’ সামরিক ঘাঁটির উপরে। এটা ছিল আমিরাতের ভূমিতে হুথিদের প্রথম আক্রমণ। আমিরাতিদের যথেষ্ট অনুরোধ সত্ত্বেও ঘটনার এক মাসেরও বেশি সময় পর যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর একটা ডেস্ট্রয়ার এবং ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান পাঠায়; যার একটা উদ্দেশ্য ছিল সেখানে মার্কিন সেনাদের নিরাপত্তা দেয়া। মার্কিনীদের এই সিদ্ধান্ত আমিরাতিদের খুশি করতে পারেনি। ২০২১ সালে মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরিয়ে নেয় এবং তারা নৌবাহিনীর শক্তিও কমিয়ে নিয়েছে। পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বলছেন যে, রাশিয়া এবং চীনের হুমকিকে মোকাবিলা করতেই যুক্তরাষ্ট্রকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে ফেলায় তা অত্র অঞ্চলের দেশগুলির মাঝে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে।

‘কিংস কলেজ, লন্ডন’এর এসোসিয়েট প্রফেসর আন্দ্রেয়াস ক্রীগ ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, আবু ধাবির চোখে যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবেই আঞ্চলিক নিরাপত্তার নিশ্চায়ক হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে জানান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। একারণে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা চাপের মাঝে রয়েছে। আমিরাত একারণে নিজেদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না; যতটুকু সম্ভব তারা নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে চাইছে। আমিরাতিরা দেখাতে চাইছে যে, তারা একটা সার্বভৌম দেশ; যারা যেকোন যৌথ বাহিনীতে স্বেচ্ছায় ঢুকতে বা বের হতে পারে। একইসাথে আমিরাতিরা যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও রাশিয়া এবং চীনের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। তারা বরং ওয়াশিংটনকে বার্তা দিতে চাইছে যে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আমিরাত গুরুত্বপূর্ণ; এবং দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমিরাতের একটা শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে।

জানুয়ারি ২০১৮। আমিরাতি সেনাদের সাথে মার্কিন সেনাদের যৌথ সামরিক মহড়া। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমিরাতের সামরিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়নি। আর আমিরাত এখনোও মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এছাড়াও আমিরাতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী সামরিক চুক্তি রয়েছে।


আমিরাত কি যুক্তরাষ্ট্রকে ছেড়ে যাচ্ছে?

‘আল মনিটর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আমিরাত যে ‘সিএমএফ’ ছেড়ে যাচ্ছে, সেটা তারা যুক্তরাষ্ট্রকে অফিশিয়ালি জানায়নি। মার্কিন ৫ম নৌবহরের মুখপাত্র কমান্ডার টিম হকিন্স বলছেন যে, তার জানা মতে এখনও আমিরাত ‘সিএমএফ’এর সদস্য হিসেবে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমিরাতের সামরিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়নি। মার্কিন ‘সেন্ট্রাল কমান্ড’এর ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, গত ২২শে মে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব আমিরাতের বাহিনীর মাঝে ‘ইনট্রেপিড মেভেন ২৩-৩’ নামে একটা সামরিক মহড়া শেষ হয়েছে। এতে ১’শ জন মার্কিন ম্যারিন সেনা ও নৌসদস্যের সাথে আমিরাতি বাহিনীর ‘প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড’ এবং ‘জয়েন্ট এভিয়েশন কমান্ড’এর সেনারা অংশ নেয়। এছাড়াও ‘আল মনিটর’ বলছে যে, এক সপ্তাহ আগেই মার্কিন নৌবাহিনীর একটা ডেস্ট্রয়ার আমিরাতি নৌবাহিনীর একটা জাহাজের সাথে ওমান উপসাগরে ‘পাসেক্স’ মহড়ায় অংশ নিয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা চাইছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করুক।

আমিরাত এখনোও মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। ২০০১ সালের ‘৯-১১’এর ঘটনার পরপরই ২০০২ সালের ২৫শে জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্র আমিরাতের ‘আল ধাফরা’ সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করে আসছে। ‘মিলিটারি ডট কম’ বলছে যে, ১৯৯০এর দশক থেকেই মার্কিনীরা গোপনে এই ঘাঁটি ব্যবহার করে আসছিলো; এবং শুধুমাত্র ২০১৭ সালের অগাস্টে যুক্তরাষ্ট্র এই ঘাঁটি ব্যবহার করার কথা স্বীকার করে। আফগানিস্তান এবং ইরাকে মার্কিন সামরিক অভিযান চালাতে এই ঘাঁটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। মার্কিন সামরিক সূত্র বলছে যে, মার্কিন বিমান বাহিনীর রিফুয়েলিং ট্যাংকার, এয়ারবোর্ন রাডার বিমান, কৌশলগত গোয়েন্দা বিমান ছাড়াও ফাইটার বিমান ও কৌশলগত গোয়েন্দা ড্রোন বিমান এই ঘাঁটি ব্যবহার করেছে। বর্তমানে এই ঘাঁটিতে মার্কিন বিমান বাহিনীর ‘৩৮০তম উইং’এর অধীনে বেশকিছু মার্কিন সামরিক সদস্য রয়েছে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন। মার্কিন বিমান বাহিনীর ওয়েবসাইট বলছে যে, এখানে বর্তমানে ‘এমকিউ-৯ রীপার’ ড্রোন মোতায়েন রয়েছে।

এছাড়াও আমিরাতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী সামরিক চুক্তি রয়েছে। ২০১৭ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ‘ডিফেন্স কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট’ বা ‘ডিসিএ’ নামে এই চুক্তি মূলত ১৯৯৪ সাল থেকে চালু থাকলেও সেবারই প্রথম এই চুক্তি জনসন্মুখে আনা হয়। এই চুক্তির মাঝে যৌথ সামরিক মহড়া ছাড়াও রয়েছে স্পেশাল ফোর্সের সহযোগিতা এবং আমিরাতের সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম জমা করে রাখার ব্যবস্থা। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র বড় কোন সামরিক মিশন শুরু করলে আমিরাতের ঘাঁটিতে রেখে দেয়া যুদ্ধ সরঞ্জাম দিয়েই মার্কিন সেনারা যুদ্ধ করবে। ‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, দুই দশকে আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের বড় সামরিক অভিযানগুলিতে সরাসরি সহযোগিতা করেছে; যার মাঝে রয়েছে আফগানিস্তান, লিবিয়া, সোমালিয়া, বসনিয়া, কসোভো, ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়াতে সামরিক মিশন। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিতে এক দশকের উপরে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন রেখেছিল আমিরাতিরা।

জুন ২০১৯। আরব আমিরাতের নেতা মোহাম্মদ বিন জায়েদের সাথে বৈঠক করছেন ব্রিটিশ সামরিক উপদেষ্টা লেঃজেঃ লরিমার। ব্রিটিশরা অনেকেই বলেন যে, ব্রিটেন কখনোই মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যায়নি। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের এই ক্ষুদ্র দেশগুলির প্রত্যেকটাতেই ব্রিটিশ নাগরিকেরা সামরিক বাহিনীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন রয়েছে। অর্থাৎ এই দেশগুলির উপর ব্রিটেনের প্রভাব এখনও যথেষ্ট; যদিও ব্রিটেন এই দেশগুলির নিরাপত্তা দিতে সক্ষমতা হারিয়েছে বহু আগেই।


আরব আমিরাতের উপর ব্রিটেনের প্রভাব

১৯৭১ সালের ২রা ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্ম হয়। ঊনিশ শতক থেকেই ব্রিটেন পারস্য উপসাগরে নিজেদের অবস্থানকে শক্ত করে এবং উপসাগরের সকল বন্দরে নিজেদের পক্ষের লোক তৈরি করে। ভারতে অবস্থিত ব্রিটিশ নৌবাহিনী পারস্য উপসাগরে নিরাপত্তা দেয়ার মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলের উপরে প্রভাব বিস্তার করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফত ধ্বংসের পর ব্রিটেন এই অঞ্চলে সৌদি আরব এবং ইরাকসহ অনেকগুলি দেশ তৈরি করে। একইসাথে পারস্য উপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলগুলিকে সেই দেশগুলির অন্তর্গত না করে আলাদা আলাদা ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তৈরি করে; যার মাঝে ছিল কুয়েত, বাহরাইন, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলি ইরাক, সৌদি আরব এবং ইরানের হুমকির কারণে ব্রিটেনের সামরিক সহায়তার উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়। ওমানও ছিল ব্রিটেনের নিরাপত্তার উপরে নির্ভরশীল। এই রাষ্ট্রগুলিকে রক্ষার ছুতোয় ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্যে বেশ কয়েকবার সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেছিল। তবে ১৯৫৬ সালে মিশরে মার্কিন সমর্থিত সরকার সুয়েজ খালকে সরকারিকরণ করার পর ব্রিটেন সুয়েজ খালের পূর্বের সকল সামরিক ঘাঁটি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটেন ১৯৬১ সালে কুয়েত এবং ১৯৭১ সালে বাহরাইন, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্ম দেয়। সেই বছরই ব্রিটেনের সামরিক বাহিনী মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যায় এবং নতুন মার্কিন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

তবে ব্রিটিশরা অনেকেই বলেন যে, ব্রিটেন কখনোই মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যায়নি। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের এই ক্ষুদ্র দেশগুলির প্রত্যেকটাতেই ব্রিটিশ নাগরিকেরা সামরিক বাহিনীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন রয়েছে। অর্থাৎ এই দেশগুলির উপর ব্রিটেনের প্রভাব এখনও যথেষ্ট; যদিও ব্রিটেন এই দেশগুলির নিরাপত্তা দিতে সক্ষমতা হারিয়েছে বহু আগেই। ২০১৫ সালের নভেম্বরে ব্রিটেন ঘোষণা দেয় যে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে তাদের সামরিক নৌঘাঁটি তৈরি করতে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে বাহরাইনে ‘জুফাইর’ নামের এই ঘাঁটি উদ্ভোধন করা হয়। ২০১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা দেয় যে, তারা ওমানের দুকমে আরেকটা নৌঘাঁটি খুলতে যাচ্ছে। এই ঘাঁটিগুলির উপরে নির্ভর করে ব্রিটিশ রয়াল নেভি পারস্য উপসাগরে একটা নৌ স্কোয়াড্রন মোতায়েন রেখেছে; যার মাঝে রয়েছে একটা ফ্রিগেট, একটা রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার, তিনটা মাইন ধ্বংসকারী জাহাজ এবং বড় আকারের একটা মাইন ওয়ারফেয়ার কমান্ড জাহাজ।

মার্কিন নৌবাহিনীর ৫৫ মিটার লম্বা 'সাইক্লোন-ক্লাস' প্যাট্রোল জাহাজ। যুক্তরাষ্ট্র বেশ অনেকদিন ধরেই পারস্য উপসাগরে ১০টা এরকম প্যাট্রোল জাহাজ মোতায়েন রেখেছিল। ছোট, তবে শক্তিশালী এই জাহাজগুলি নিয়মিতভাবেই ইরানের ‘আইআরজিসি’ নৌবাহিনীর বোটগুলির সাথে উত্তেজনায় লিপ্ত হতো। তবে তিন দশকের পুরোনো এই জাহাজগুলির সর্বশেষ দু’টা ডিকমিশনিং করা হয় গত এপ্রিল মাসে। এগুলির স্থলে যুক্তরাষ্ট্র আর কোন নতুন যুদ্ধজাহাজ সেখানে মোতায়েন করেনি।


মধ্যপ্রাচ্যে নামমাত্র সামরিক শক্তি রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র

মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ রয়াল নেভির স্কোয়াড্রনের চাইতে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি খুব একটা বড় নয়। যুক্তরাষ্ট্র বেশ অনেকদিন ধরেই পারস্য উপসাগরে ১০টা ৫৫ মিটার লম্বা ‘সাইক্লোন-ক্লাস’ প্যাট্রোল জাহাজ মোতায়েন রেখেছিল। ছোট, তবে শক্তিশালী এই জাহাজগুলি নিয়মিতভাবেই ইরানের ‘আইআরজিসি’ নৌবাহিনীর বোটগুলির সাথে উত্তেজনায় লিপ্ত হতো। তবে তিন দশকের পুরোনো এই জাহাজগুলির সর্বশেষ দু’টা ডিকমিশনিং করা হয় গত এপ্রিল মাসে। এগুলির স্থলে যুক্তরাষ্ট্র আর কোন নতুন যুদ্ধজাহাজ সেখানে মোতায়েন করেনি। এর ফলে পারস্য উপসাগরে স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শুধুমাত্র ৬টা ছোট আকারের ৪৬ মিটার লম্বা ‘সেন্টিনেল-ক্লাস’ কোস্ট গার্ড প্যাট্রোল বোট এবং ৪টা মাইন ধ্বংসকারী জাহাজ রয়েছে। এগুলিকে সহায়তা দেয়ার জন্যে রয়েছে হেলিকপ্টার বহনে সক্ষম একটা ফ্লোটিং বেইস জাহাজ ‘লুইস বি পুলার’। মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি কম বলে নিয়ম ভেঙ্গে মার্কিন ম্যারিন কোরের একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এই জাহাজের কমান্ডার। উপসাগরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে এই জাহাজগুলির সাথে কিছুদিনের জন্যে যুক্ত হয় মার্কিন নৌবাহিনীর একটা ডেস্ট্রয়ার। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে ঘটা করে ঘোষণা দিয়ে একটা সাবমেরিন প্রেরণ করে। আগের সকল নিয়ম ভঙ্গ করে সাবমেরিনটা সুয়েজ খাল অতিক্রম করে। সাধারণতঃ মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন কখনও জানান দিয়ে কোথাও যায় না। অর্থাৎ সাবমেরিন মোতায়েনের বিষয়টা ছিল নিতান্তই তথ্যযুদ্ধের একটা অংশ।

শুধু নৌশক্তিই নয়; যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার বিমান শক্তিও কমিয়ে ফেলছে। গত মার্চে মার্কিন বিমান বাহিনী তাদের মধ্যপ্রাচ্য অপারেশনের জন্যে কংগ্রেসের সামনে বাজেট পেশ করে। এতে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বাজেট দেয়া হয়। বিশ্বব্যাপী তাদের অপারেশ চালাতে মার্কিন বিমান বাহিনীর বাজেট হলো ৭০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাজেটের মাত্র ১০ শতাংশ তারা মধ্যপ্রাচ্যে খরচ করছে। অপদিকে বিমান বাহিনী চীনকে নিয়ন্ত্রণে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুয়াম এবং নর্দার্ন মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের ঘাঁটি গড়তে বেশি খরচ করতে চাইছে। তিন বছরে মার্কিন বিমান বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বাজেট ৩০ শতাংশ কমিয়ে ফেলেছে।

গত মার্চে মার্কিন বিমান বাহিনী কংগ্রেসের এক শুনানিতে বলে যে, এপ্রিল মাসে মধ্যপ্রাচ্যে ‘এ-১০ থান্ডারবোল্ট’ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হচ্ছে। ‘এয়ার এন্ড স্পেস ফোর্সেস ম্যাগাজিন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চার দশকের পুরোনো এই বিমানগুলিকে যখন রিটায়ার করা হচ্ছে, তখনই এগুলিকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। অপরদিকে অত্যাধুনিক সকল যুদ্ধবিমানকে হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে অথবা ইউরোপে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মোতায়েন করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বিমান বাহিনী সর্বমোট আড়াই স্কোয়াড্রন বিমান মোতায়েন রাখার টার্গেট রেখেছে। একেকটা স্কোয়াড্রনে ১২টা করে যুদ্ধবিমান থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে থাকবে সর্বমোট ৩০টা বিমান। ২০২২এর নভেম্বরে মার্কিন বিমান বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে অত্যাধুনিক ‘এফ-২২’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করলেও তা ছিল স্বল্প সময়ের জন্যে।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি আরও কম। কয়েক বছর ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর কোন প্রথম সাড়ির ইউনিট মোতায়েন রাখা হচ্ছে না। দ্বিতীয় সাড়ির ন্যাশনাল গার্ড এবং রিজার্ভ সেনাদের দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর মূল যুদ্ধ সক্ষমতা হলো ‘টাস্ক ফোর্স স্পারটান’ নামের ছোট একটা বাহিনী। গত নভেম্বর মাসে এই বাহিনীর কমান্ডার হন পেনসিলভানিয়া ন্যাশনাল গার্ডের অন্তর্ভুক্ত ২৮তম পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার। এর আগে এই বাহিনী ছিল যথাক্রমে কানসাস ন্যাশনাল গার্ডের ৩৫তম পদাতিক ডিভিশন, ভার্জিনিয়া ন্যাশনাল গার্ডের ২৯তম পদাতিক ডিভিশন এবং টেক্সাস ন্যাশনাল গার্ডের ৩৬তম ডিভিশনের অধীনে।

মার্চ ২০২৩। 'বানি ইয়াস' নামে আমিরাতের জন্যে ফরাসিদের তৈরি করা 'গোউইন্ড-ক্লাস'এর কর্ভেট। যুক্তরাষ্ট্র যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের সামরিক শক্তি কমিয়ে ফেলছে, তখন আমিরাত একদিকে যেমন আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে সমঝোতার পথ দেখছে, তেমনি নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছে। শুধু তা-ই নয়, বহুদিনের শত্রুতা ভুলে গিয়ে আমিরাতিরা তুরস্ক থেকে ড্রোন কিনেছে।


আমিরাতিরা নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে

যুক্তরাষ্ট্র যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের সামরিক শক্তি কমিয়ে ফেলছে, তখন আমিরাত একদিকে যেমন আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে সমঝোতার পথ দেখছে, তেমনি নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছে। গত ডিসেম্বরে আমিরাতি নৌবাহিনীর জন্যে ৪টা ‘ফালাজ-৩-ক্লাস’এর ফাস্ট প্যাট্রোল ভেসেল তৈরি করা শুরু হয়েছে। গত মার্চে আমিরাতি নৌবাহিনী ঘোষণা দেয় যে, তারা ইন্দোনেশিয়া থেকে ১৩ হাজার টনের একটা বড় আকারের উভচর যুদ্ধজাহাজ অর্ডার করেছে। এর আগে ২০১৯ সালে আমিরাতি নৌবাহিনী ফ্রান্স থেকে ২টা ‘গোউইন্ড-ক্লাস’এর কর্ভেট অর্ডার করে; যার প্রথমটা গত মার্চে সমুদ্রে ট্রায়াল শুরু করেছে। ২০২২ সালে আমিরাত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ৯৬টা ‘টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স’ বা ‘থাড’ নামের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র কেনে।

শুধু তা-ই নয়, বহুদিনের শত্রুতা ভুলে গিয়ে আমিরাতিরা তুরস্ক থেকে ড্রোন কিনেছে। গত সেপ্টেম্বরে খবর প্রকাশিত হয় যে, আমিরাতিরা তুরস্ক থেকে ২০টা ‘বায়রাকতার টিবি-২’ অস্ত্রবাহী ড্রোন ডেলিভারি পেয়েছে; যা কিনা মোট ২ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ১’শ ২০টা ড্রোন অর্ডারের অংশ। আর সবচাইতে বড় সিদ্ধান্তটা ছিল যখন ২০২১এর ডিসেম্বরে আমিরাতিরা ১৯ বিলিয়ন ডলার খরচে ফ্রান্স থেকে ৮০টা ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান অর্ডার করে। অনেকেই মনে করছেন যে, আমিরাতে চীনা কোম্পানিকে ‘ফাইভ-জি’ প্রযুক্তির টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের কাজ দেয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র যখন আমিরাতকে ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তখনই আমিরাত এই সিদ্ধান্ত নেয়। আমিরাতের এই সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশটার সম্পর্কের অবনতির কথা আলোচিত হতে থাকে।

আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি পারস্য উপসাগরের নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে একেবারেই অপ্রতুল। মাঝে মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার একটা যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে; অথবা এক জোড়া দূরপাল্লার বোমারু বিমান মধ্যপ্রাচ্যের উপর দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। নৌবাহিনীর সক্ষমতা কমিয়ে ফেলায় সেটার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে ২০টার মতো ড্রোন বোট। বিমান বাহিনী মোতায়েন করেছে চার দশকের পুরোনো ‘এ-১০’ যুদ্ধবিমান; যেগুলি ইতোমধ্যেই রিটায়ার করা শুরু হয়েছে। এই সামরিক শক্তি এবং সাময়িক মহাড়াগুলি আমিরাতের মতো মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্র দেশগুলিকে নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্ত করে পারেনি।

জন্মের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্র এই দেশগুলি একটা পশ্চিমা শক্তির (প্রথমে ব্রিটেন; পরে যুক্তরাষ্ট্র) উপর নির্ভরশীল থেকেই বাঁচতে শিখেছে। এছাড়াও তাদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্রিটিশ নাগরিকেরা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে এই দেশগুলির নীতি লন্ডনের ভূরাজনৈতিক চিন্তা থেকে আলাদা হতে পারেনি। জনসংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় আমিরাত নিজেদের নিরাপত্তা দিতে বিদেশী ভাড়াটে সেনার উপরে নির্ভর করেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, আঞ্চলিক নিরাপত্তার দায়িত্বও তাদেরকেই নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাক। কারণ এই মুহুর্তে চীন এবং রাশিয়ার বিপক্ষে মোতায়েন করা সামরিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করতে অপারগ; তাই দ্বিতীয় সাড়ির সামরিক শক্তি দিয়েই তারা কাজ চালাতে চাইছে। এমতাবস্থায় আমিরাত যখন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নীতির উপর চাপ সৃষ্টি করছে, তখন বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতিকে ব্যালান্স করেই ওয়াশিংটনকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি কোথায় কতটুকু মোতায়েন থাকবে, সেই সিদ্ধান্তের উপর আমিরাতের ব্রিটিশ ঘরানার চিন্তার প্রভাব কিছুটা হলেও পড়বে। একইসাথে তা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নগামী প্রভাবকে তলানিতে নিয়ে ঠেকাবে।




সূত্রঃ
‘U.A.E. Says It Exited U.S.-Led Naval Force’ in The Wall Street Journal, 31 May 2023
‘UAE declares withdrawal from naval alliance, but US says otherwise’ in Stars & Stripes, 31 May 2023
‘US not notified yet of UAE's withdrawal from Gulf maritime coalition’ in Al-Monitor, 31 May 2023
‘UAE withdraws from US-led maritime coalition’ in Al-Jazeera, 31 May 2023
‘UAE says it has stopped taking part in U.S.-led Gulf maritime coalition’ in Reuters, 31 May 2023
‘Combined Maritime Forces (CMF)’ (https://combinedmaritimeforces.com/)
‘US pulls missile batteries from Middle East’ in DW, 19 June 2021
‘Exercise Intrepid Maven 23.3 Concludes in the United Arab Emirates’ in US Central Command, 02 June 2023 (https://www.centcom.mil/MEDIA/NEWS-ARTICLES/News-Article-View/Article/3414558/exercise-intrepid-maven-233-concludes-in-the-united-arab-emirates/)
‘380th Air Expeditionary Wing Fact Sheets’ in US Air Forces Central (https://www.afcent.af.mil/Units/380th-Air-Expeditionary-Wing/Fact-Sheets/Article/445043/380th-air-expeditionary-wing/)
‘380th Air Expeditionary News (https://www.afcent.af.mil/Units/380th-Air-Expeditionary-Wing/News/Tag/95930/al-dhafra-air-base/)
‘US to deploy fighter jets, Navy destroyer to UAE after missile attacks’ in Al-Monitor, 02 February 2022
‘The US and UAE forge a new path on defense [Commentary]’ by Danny Sebright in Defense News, 18 May 2017
‘British bordering practices in the Middle East before Sykes-Picot: giving an edge to zones’ by Richard Schofield in Egypte/Monde arabe, 18-2018
‘Britain and the Gulf Sheikhdoms, 1820-1971’ by James Onley in Center for International and Regional Studies, Georgetown University School of Foreign Service in Qatar, 2009
‘UK builds first permanent Middle East base for 40 years’ in BBC, 01 November 2015
‘Multi-million pound joint venture announced between Britain and Oman’ in UK.GOV (https://www.gov.uk/government/news/multi-million-pound-joint-venture-announced-between-britain-and-oman)
‘Operation Kipion’ in Royal Navy (https://www.royalnavy.mod.uk/news-and-latest-activity/operations/red-sea-and-gulf/operation-kipion)
‘Last Cyclone Patrol Ships Leave U.S. Navy, Many Will Serve in Foreign Forces’ in USNI News, 26 April 2023
‘New Coast Guard Cutters arrive in Bahrain’ in Defense Visual Information Distribution Service, 23 August 2022
‘Watch: U.S. Navy Ships In Tense Encounter With Iranian Military Speedboats’ by NBC News, 21 June 2022 (https://www.youtube.com/watch?v=ctcprlGxedY)
‘US B-52 Bombers Fly Over Middle East Amid Tensions With Iran’ in Voice of America, 05 September 2022
‘U.S., Partner Aircrews Conduct Middle East Presence Patrol’ in US Department of Defense, 09 June 2022
‘Two US B-52 bombers fly across Middle East, CENTCOM announces’ in Al-Arabiya News, 11 November 2022
‘Air Force may shrink Middle East presence, proposed budget cut shows’ in Air Force Times, 14 March 2023
‘A-10s Headed to CENTCOM to Bolster Air Force Presence’ in Air & Space Forces Magazine, 23 March 2023
‘Alaska-Based F-22s Deploy to CENTCOM Amid Iran Threat’ in Air & Space Forces Magazine, 02 November 2022
‘U.S. Navy Ships Supports UAE Pilot Training in Arabian Gulf’ in US Fleet Forces Command, 23 February 2023 (https://www.usff.navy.mil/Press-Room/News-Stories/Article/3312577/us-navy-ships-supports-uae-pilot-training-in-arabian-gulf/)
‘US Deploys Guided-Missile Submarine Amid Tensions With Iran’ in Voice of America, 08 April 2023
‘Task Force Spartan Crisis Response Task Force trains in Kuwait’ in Army Reserve, 11 May 2023
‘28th ID assumes command of Task Force Spartan mission’ in Pennysylvania National Guard, 22 November 2022
‘35th Infantry Division assumes authority of Task Force Spartan’ in Defense Visual Information Distribution Service, 20 March 2022
‘29ID assumes authority of Task Force Spartan’ in Virgina National Guard, 23 July 2021
‘Western allies join US' experimental drone task force in Middle East’ in Al-Monitor, 11 January 2023
‘ADSB begins construction of UAE Navy’s Falaj 3-class ship’ in Naval Technology, 03 January 2023
‘UAE Procures LPD from Indonesian Shipbuilder PT PAL’ in Naval News, 06 March 2023
‘Despite Biden's assurances, Middle East militaries are buying their own weapons to take on Iran at sea and in the air’ in Business Insider, 22 September 2022
‘U.S. to resupply Saudi and UAE missile defense systems’ in Reuters, 03 August 2022
‘Exclusive: Turkey sells battle-tested drones to UAE as regional rivals mend ties’ in Reuters, 21 September 2022
‘UAE receives first batch of Turkish armed drones’ in Al-Monitor, 21 September 2022
‘UAE buys record 80 French Rafale jets in $19bn arms deal’ in Al Jazeera, 03 December 2021
‘New Gowind Corvette for the UAE Starts Sea Trials’ in Naval News, 23 March 2023

No comments:

Post a Comment