Monday 26 June 2023

‘ওয়াগনার’-কান্ডের ভূরাজনৈতিক ফলাফল কি হতে পারে?

২৭শে জুন ২০২৩

রুশ শহর রস্টোভের রাস্তায় প্রিগোজিনের 'ওয়াগনার' বাহিনীর ট্যাংক। ভ্লাদিমির পুতিন ‘ওয়াগনার’এর বিদ্রোহকে ১৯১৭ সালের গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। ১৯১৭ সালের সেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই; এবং তা গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে বেশ কয়েক মাস লেগেছিলো। যেটা এখন দেখতে হবে তা হলো, আগামী কয়েক মাসের মাঝে ‘ওয়াগনার’কে উদাহরণ ধরে রুশ বাহিনীর অন্যান্য অংশ থেকে কি কি দাবি উত্থাপিত হয়।

গত ২৩শে জুন রাশিয়ার ভাড়াটে সামরিক বাহিনী ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন ঘোষণা দেন যে, তার সেনারা সুবিচার আদায়ের লক্ষ্যে মার্চ শুরু করেছে। ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন থেকে সরে গিয়ে তারা রুশ শহর রস্টোভের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং মস্কো অভিমুখে রওয়ানা দেয়। এর মাঝে রুশ বিমান বাহিনী তাদেরকে টার্গেট করে বোমাবর্ষণ করে। মাত্র ২৪ ঘন্টার মাথায় প্রিগোজিন ঘোষণা দেন যে, তিনি তার বাহিনীকে ইউক্রেনে ফিরিয়ে নিচ্ছেন এবং বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্ততায় রাজি হয়ে তিনি রাশিয়া ছেড়ে বেলারুশে চলে যাচ্ছেন। ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর এক দিনের এই নাটক কেনই বা ঘটলো এবং এর ফলাফলগুলিই বা কেমন হবে, সেব্যাপারে নিশ্চিত হতে যে আরও অনেকদিন লাগবে, তাতে সকলেই একমত। তথাপি ঘটনার ব্যাপারে অনেকেরই কিছু বিশ্লেষণ এবং মতামত রয়েছে, যা আলোচনায় আসছে।

‘ওয়াগনার গ্রুপ’ আলোচনায় আসলো কিভাবে?

মার্কিন ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স’এর এক লেখায় জর্জ ফ্রীডম্যান প্রশ্ন করেছেন যে, ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে কি করছিলো? একটা ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের কর্মকান্ড একেবারেই আলাদা। সেখানে তারা নিয়মিত সেনাবাহিনীর সমান্তরালে যুদ্ধ করেছে। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনকে পরাজিত করতে না পারার কারণেই ‘ওয়াগনার’এর মতো ভাড়াটে যোদ্ধাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করতে হয়েছিল; যা কিনা পরবর্তীতে দ্বন্দ্ব এবং বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছে। ‘ওয়াগনার’কে কাজে লাগানোটাই ছিল বড় সমস্যা।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র এক লেখায় সামরিক বিশ্লেষক জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ‘ওয়াগনার’কে রুশ নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করেছে; যেখানে তারা রুশ রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হয়ে কাজ করেছে। তবে এই বাহিনীতে রুশ সামরিক বাহিনী এবং সামরিক ইন্টেলিজেন্স ‘জিআরইউ’এর সদস্যরা কাজ করেছে। আর ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে তারা এমন একটা বাহিনী মোতায়েন করতে পেরেছিল, যা কিনা অনেক ক্ষেত্রেই রুশ সেনাবাহিনীর চাইতে বেশি কার্যকর ছিল। রুশ বিচার বিভাগের সহায়তাতেই ‘ওয়াগনার’ সাজাপ্রাপ্ত আসামীদেরকে এই বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল। মোটকথা রাশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র ‘ওয়াগনার’কে সকল ধরণের সহায়তা দিয়েছে। আর এই সহায়তার ক্ষেত্রে প্রথমেই ছিলেন ‘জিআরইউ’এর জেনারেল ভ্লাদিমির স্তেপানোভিচ আলেক্সেইয়েভ। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছের লোক ইউরি কোভালচুক এবং সের্গেই কিরিয়েঙ্কো ‘ওয়াগনার’ তৈরির সপক্ষের চিন্তাগুলিকে সাজিয়েছিলেন। তবে রাশিয়ার ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘এফএসবি’ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই বাহিনীকে ব্যবহারের বিপক্ষে ছিল। এই দুই গ্রুপকে ঠান্ডা করতে গিয়ে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ‘ওয়াগনার’ সেনাদের মোতায়েন করার পর দু’টা ভিন্ন কমান্ড কাঠামো গঠন করতে হয়েছিল।

‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন কেন এই কাজটা করলেন, সেটার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন ‘কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টার’এর সিনিয়র ফেলো তাতিয়ানা স্তানোভায়া। টুইটারে এক বিশ্লেষণে তিনি বলছেন যে, প্রিগোজিনের বিদ্রোহ রাশিয়ার সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা ছিল না। ক্রেমলিনের শক্তিধর ব্যাক্তিদের চাপের মুখে তিনি ইউক্রেনে একঘরে হয়ে পড়েছিলেন এবং ‘ওয়াগনার’কে টিকিয়ে রাখা তার জন্যে কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো। তিনি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিলেন; যাতে করে ‘ওয়াগনার’এর কাজ, নিরাপত্তা এবং অর্থায়নের ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চয়তা তিনি পেতে পারেন। তিনি ইউক্রেনে তার সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের ব্যাপারটাকে তুলে ধরে তার দাবি আদায় করতে চেয়েছিলেন। তবে আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, তার অবদানগুলির কারণে তিনি এই সমস্যা থেকে বেঁচে বের হয়ে আসতে পেরেছেন; কিন্তু রাশিয়াতে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের বিনিময়ে।

প্রিগোজিনের বিদ্রোহ রাশিয়ার সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা ছিল না। ক্রেমলিনের শক্তিধর ব্যাক্তিদের চাপের মুখে তিনি ইউক্রেনে একঘরে হয়ে পড়েছিলেন এবং ‘ওয়াগনার’কে টিকিয়ে রাখা তার জন্যে কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো। তিনি ইউক্রেনে তার সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের ব্যাপারটাকে তুলে ধরে তার দাবি আদায় করতে চেয়েছিলেন। তবে আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, তার অবদানগুলির কারণে তিনি এই সমস্যা থেকে বেঁচে বের হয়ে আসতে পেরেছেন; কিন্তু রাশিয়াতে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের বিনিময়ে।

ইউক্রেন যুদ্ধের উপরে কি প্রভাব পড়বে?

‘পলিটিকো’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধে গত শীতে যখন ইউক্রেনিয়রা পাল্টা আক্রমণ করে খারকিভ এবং খেরসন পুনর্দখল করে নেয়, তখন ক্রেমলিন যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থানগুলিকে শক্তিশালী করতে ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর সদস্যদের মোতায়েন করে। শীতের মাঝে ‘ওয়াগনার’ সদস্যরা যখন ফ্রন্টলাইন ধরে রেখেছিল, তখন রুশরা নতুন সেনা এবং রসদ যোগাড় করতে পেরেছিল। এছাড়াও বাখমুতের যুদ্ধে ‘ওয়াগনার’ সেনারা বড় ভূমিকা রেখেছিল।

২৪শে জুন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি এক বার্তায় বলেন যে, এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, রুশ নেতৃত্ব কোনকিছুরই নিয়ন্ত্রণে নেই। একদিনের মাঝে তারা অনেকগুলি শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এবং দেখিয়ে দিয়েছে যে, রাশিয়ার শহর এবং অস্ত্রের ভান্ডার দখল করে নেয়াটা কত সহজ।

তবে জেলেন্সকি ‘ওয়াগনার’এর ঘটনা থেকে কতটা সুবিধা নিতে পারবেন, তা প্রশ্নবিদ্ধ। ‘রুসি’র রাজনৈতিক বিশ্লেষক মার্ক গ্যালিয়টি ‘ইন মস্কোস শ্যাডো ১০৫’ নামের এক নিয়মিত পডকাস্ট বিশ্লেষণে বলছেন যে, এই ঘটনায় ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে বড় কোন পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয়না; কারণ অন্ততঃ এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে রুশ সেনাদের মাঝে অস্ত্র ছেড়ে দেবার বা যুদ্ধ থেকে সরে আসার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এছাড়াও ‘ওয়াগনার’কে থামাবার জন্যে যেহেতু কোন রুশ ইউনিটকে ইউক্রেন থেকে সরাবার প্রয়োজন হয়নি, তাই এই ঘটনার সরাসরি সুবিধা ইউক্রেন খুব কমই পাবে। বরং প্রিগোজিনের কারণে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে নেতৃত্বের কোন সমস্যা যদি হয়ে থাকে, সেটা এখন নেই; যা ইউক্রেনকে খুশি করার কথা নয়।

ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণ কি দুর্বল হলো?

‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের অধীন ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর সদস্যরা যেভাবে রুশ জমি দখল করে ফেলতে পারলো, মস্কোর ২’শ কিঃমিঃএর মাঝে পৌঁছে গেলো, এবং জনগণের সমর্থন পেলো, তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে দিচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার খুব শক্ত ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়। রস্টোভ শহরে ‘ওয়াগনার’এর পক্ষে মানুষের সমর্থন দেখিয়ে দেয় যে, ক্রেমলিনের ক্ষমতাধর প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কমান্ডার জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভএর উপর জনগণের আস্থা কমে গেছে। অপরদিকে মার্ক গ্যালিয়টি বলছেন যে, যদিও বেশিরভাগ বিশ্লেষকেরাই বলবেন যে, এই ঘটনার মাধ্যমে পুতিনের নেতৃত্ব দুর্বল হয়েছে, তথাপি ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে খুব সম্ভবতঃ এর চাইতে ভালো কিছু করার ছিলো না; কারণ একদিকে তিনি সমস্যাটার সমাপ্তি টেনেছেন এবং একইসাথে প্রিগোজিনকে কিনে নিয়েছেন। কারণ ‘ওয়াগনার’ বনাম রুশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ পুরো রাষ্ট্রের জন্যে মারাত্মক হতো। বিশেষ করে ক্রেমলিন নির্দেশ দিলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রুশ ভাড়াটে বাহিনীর উপর গুলি করতে কতটা প্রস্তুত ছিলো, সেটা বরং পুতিনের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো।

ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে খুব সম্ভবতঃ এর চাইতে ভালো কিছু করার ছিলো না; কারণ একদিকে তিনি সমস্যাটার সমাপ্তি টেনেছেন এবং একইসাথে প্রিগোজিনকে কিনে নিয়েছেন। কারণ ‘ওয়াগনার’ বনাম রুশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ পুরো রাষ্ট্রের জন্যে মারাত্মক হতো। বিশেষ করে ক্রেমলিন নির্দেশ দিলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রুশ ভাড়াটে বাহিনীর উপর গুলি করতে কতটা প্রস্তুত ছিলো, সেটা বরং পুতিনের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো।

তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলছেন যে, প্রিগোজিন খুব সম্ভবতঃ পুতিনের কঠোর বক্তব্য আশা করেননি। কারণ তিনি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীর ভূমিকা নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। মার্ক গ্যালিয়টি বলছেন যে, শেষ পর্যন্ত এটা মনে হয়নি যে, রুশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ব্যাপক হারে ‘ওয়াগনার’এ যোগ দিয়েছিলো। হয়তো সেটা প্রিগোজিনের সরে দাঁড়ানোর পিছনে একটা কারণ হতে পারে। মস্কোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীগুলিকে ‘ওয়াগনার’ পরাজিত করতে পারতো কিনা, সেখানেও সন্দেহ রয়েছে। কারণ যদিও রুশ সেনাবাহিনী ‘ওয়াগনার’এর মতো দ্রুতগামী কোন বাহিনী নয়; তথাপি সেনাবাহিনীর ভারি অস্ত্রের বিরুদ্ধে ‘ওয়াগনার’এর হাল্কা বাহিনী কতটুকু সফল হতো, তা প্রশ্নবিদ্ধ। আর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রিগোজিন কি করতেন, সেটা কি নিশ্চিত? তবে জনগণের একটা বড় অংশ ‘ওয়াগনার’কে থামাবার চেষ্টা করেনি; যা কিনা রাষ্ট্রের নেতৃত্বের দুর্বলতা তুলে ধরে। তথাপি প্রশ্ন থেকেই যায়, রুশ ইন্টেলিজেন্স ‘এফএসবি’ কি করছিলো? নিঃসন্দেহে এখানে ‘এফএসবি’র কাজে ঘাটতি ছিলো কিনা, তা খতিয়ে দেখার ব্যাপার হবে। তবে পুতিনের নেতৃত্বের অধীনে ‘এফএসবি’কে ব্যার্থতার জন্যে খুব বড় কোন খেসারত না-ও দিতে হতে পারে। কারণ এর আগেও ‘এফএসবি’ অনেক ভুল করলেও পুতিন তাদের কিছু করেননি।

গ্যালিয়টি বলছেন যে, প্রিগোজিন ১৯৯০এর দশক থেকেই ক্রেমলিনের সমর্থন পেয়ে ধাপে ধাপে উঠে এসেছেন। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রিগোজিন ব্যাক্তিগতভাবে লাভবান হলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে ক্রেমলিনেরই ইচ্ছার ফলাফল। এটা অসম্ভব নয় যে, প্রিগোজিন বেলারুশে বসে আফ্রিকায় ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড পরিচালনা করবেন। কারণ আফ্রিকাতে রুশ প্রভাব ধরে রাখার পিছনে ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আর রুশ সরকারের সমর্থন রয়েছে বলেই অনেক ক্ষেত্রে ‘ওয়াগনার’ সফলতা পেয়েছে। সমস্যা পুতিনের নিজেরই সৃষ্টি। কারণ তিনি প্রিগোজিনের সাথে রুশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের দ্বন্দ্বকে চলতে দিয়েছেন। আর এই দ্বন্দ্ব বাজে আকারে পরিণত হবার আগেই তিনি হস্তক্ষেপ করতে ব্যার্থ হয়েছেন।

জর্জ ফ্রীডম্যান প্রশ্ন করছেন যে, ‘ওয়াগনার’এর কারণে যদি ধরে নেয়া হয় যে, পুতিন দুর্বল হয়েছেন, তাহলে এই দুর্বল হওয়ার অর্থ প্রকৃতপক্ষে কি, সেটা দেখতে হবে। যদি তার রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়, তার অর্থ হলো, তিনি খুব সহজেই কোন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিতে পারবেন না। আর যদি তার নির্দেশনা দেয়ার সক্ষমতা কমে যায়, তাহলে রুশ সামরিক বাহিনীর কমান্ড ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু এর অর্থ দাঁড়াবে অন্য কেউ পুতিনকে তার স্থান থেকে সরিয়ে দেবে। অথচ এখন পর্যন্ত এমন কোন ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে না যে কিনা পুতিনকে সরাবার মতো অবস্থানে এসেছে। আর এরকম কেউ না আসার আগ পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না যে মাত্র একদিনের ব্যার্থ অভ্যুত্থানে পুতিন দুর্বল হয়েছেন। জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, একদিক দিয়ে চিন্তা করলে রুশ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের উপরে পুতিনের নিয়ন্ত্রণ আরও বেড়ে গেলো। কারণ ক্রেমলিনের কোন দলই বেঁচে থাকার জন্যে পুতিনকে ছাড়া শক্তিশালী নয়।

রাশিয়া এবং ইউক্রেনে ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড শেষ হয়ে গেছে; যদিও বাকি বিশ্বে হয়তো তা এখনও বিদ্যমান। এমনও হতে পারে যে, প্রিগোজিনের সাথে ক্রেমলিনের শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তিই হয়েছে। তবে শোইগু নিঃসন্দেহে ‘ওয়াগনার’কে রাশিয়াতে থাকতে দেবেন না। সংস্থাটার ইউনিটগুলি হয়তো রুশ সামরিক বাহিনীর মাঝে বিলীন হয়ে যাবে।

বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার অবস্থান দুর্বল হবে কি?

তাতিয়ানা স্তানোভায়া মনে করছেন যে, প্রিগোজিনকে হয়তো পুতিন ছেড়ে দিয়েছেন এই শর্তে যে, তিনি বেলারুশে চুপচাপ থাকবেন। তবে মার্ক গ্যালিয়টি বলছেন যে, আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, রাশিয়া এবং ইউক্রেনে ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড শেষ হয়ে গেছে; যদিও বাকি বিশ্বে হয়তো তা এখনও বিদ্যমান। এমনও হতে পারে যে, প্রিগোজিনের সাথে ক্রেমলিনের শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তিই হয়েছে। তবে শোইগু নিঃসন্দেহে ‘ওয়াগনার’কে রাশিয়াতে থাকতে দেবেন না। সংস্থাটার ইউনিটগুলি হয়তো রুশ সামরিক বাহিনীর মাঝে বিলীন হয়ে যাবে।

বিশ্বব্যাপী কোন কোন দেশে ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর কর্মকান্ড রয়েছে, তার একটা তালিকা তুলে ধরেছে ‘ডয়েচে ভেলে’। ইউক্রেনে ২০১৪ সালে সর্বপ্রথম ‘ওয়াগনার’এর সদস্যদের দেখা যায় রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের হিসেবে প্রিগোজিনের নেতৃত্বে প্রায় ৫০ হাজার সদস্য ছিল। বিদ্রোহের সময় তিনি নিজেই বলেছিলেন যে, তার সাথে ২৫ হাজার সদস্য রয়েছে। বাখমুতের যুদ্ধে এই গ্রুপের সদস্যরা বড় ভূমিকা রেখেছিল; যেখানে অনেকেই ছিল সাজাপ্রাপ্ত আসামি অথবা সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া সেনাসদস্য। ২০১৫ সাল থেকে ‘ওয়াগনার’এর সদস্যরা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে বলে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে; কারণ গ্রুপের কিছু সদস্য একনায়ক বাশার আল-আসাদের বিরোধীদের হাতে নিহত হয়েছে। গৃহযুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে সেখানে ৫ হাজারের বেশি ‘ওয়াগনার’ সদস্য ছিল বলে ধারণা করা হয়; যাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

তবে ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড সবচাইতে বেশি ছড়িয়ে রয়েছে আফ্রিকাতে; যেখানে গ্রুপের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে ব্যাপক। উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে ‘ওয়াগনার’ জড়িয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ত্রিপোলি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত জেনারেল খলিফা হাফতারের অধীনে ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’র পক্ষে ‘ওয়াগনার’ সদস্যরা নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ করছে বলে জানা যায়। একসময় প্রায় ২ হাজারের মতো ‘ওয়াগনার’ সদস্য লিবিয়াতে ছিল। এখান থেকেই সুদানসহ আফ্রিকার অন্যান্য দেশে ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন কর্মকর্তারা অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, সুদানে ‘ওয়াগনার’এর সদস্যরা সেদেশের সামরিক শাসকদের সহায়তায় খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।

২০২১ সালে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির ক্ষমতা নেয়া সামরিক শাসকেরাও ‘ওয়াগনার’কে সেদেশে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। জাতিসংঘ অভিযোগ করছে যে, মালির সামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগী হিসেবে ‘ওয়াগনার’ সেখানে মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত। এছাড়াও মধ্য আফ্রিকার দেশ সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকেও রয়েছে ‘ওয়াগনার’এর শক্ত অবস্থান। এবছরের ফেব্রুয়ারিতে সেদেশে রুশ রাষ্ট্রদূত এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ১ হাজার ৮’শ ৯০ জন রুশ সামরিক উপদেষ্টা সেখানে কাজ করছে। ‘ওয়াগনার’এর সদস্যরা সেখানে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট ফস্টিন আরসাঞ্জএর নিরাপত্তায় কাজ করছে। এর বিনিময়ে ‘ওয়াগনার’ সেদেশের খনিজ সম্পদের ভাগ পেয়েছে বলে বলছেন কেউ কেউ। এছাড়াও ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ২০১৯ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ‘ওয়াগনার’ কাজ করছে। সেদেশের স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদেরকেও প্রশিক্ষণ দিয়েছে ‘ওয়াগনার’।

‘ওয়াগনার’এর পর কি?

জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, কাউকে কাউকে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা বানানো ষড়যন্ত্র। যদি তা-ই হয়, তাহলে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট, রুশ জেনারেল স্টাফ, পুতিনের অফিসের স্টাফ, এবং ‘ওয়াগনার’এর কিছু লোককেও এই প্রকল্পে যুক্ত করতে হবে। এতগুলি ব্যক্তি যদি এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানে, তাহলে সেটা গোপন থাকার প্রশ্নই আসে না। অপরদিকে মার্ক গ্যালিয়টি বলছেন যে, মার্কিন ইন্টেলিজেন্স জুনের মাঝামাঝি থেকেই ‘ওয়াগনার’এর ব্যাপারে বিদ্রোহের মতোই কিছু একটা আশা করছিলো বলে শোনা যাচ্ছে; যা প্রকৃতপক্ষে অবাস্তব নয়। কারণ ইন্টেলিজেন্স সংস্থাগুলি সর্বদাই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা ধারণা রাখার চেষ্টা করে। এটাকে আলাদাভাবে দেখার কিছু নেই।

‘রুসি’র জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর উৎপত্তি একটা চিন্তা থেকে; যার মাঝে রয়েছে বাণিজ্যিক সংস্থার নিজস্ব বাহিনী তৈরি করা; যেমন ‘গ্যাজপ্রম’ এবং ‘রসকসমস’ তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করছে। এগুলির বিশেষত্ব হলো, সংস্থাগুলি বিশ্বব্যাপী তাদের আয় থেকেই এই বাহিনীগুলিকে চালাবে। সমস্যা হলো, অর্থায়নের জন্যে এই বাহিনীগুলি রুশ সরকারের উপরে সরাসরি নির্ভরশীল না থাকায় এগুলির উপরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্যে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সমরাস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে; যা কিনা প্রিগোজিনের ‘ওয়াগনার’এর সাথে দ্বন্দ্বের কারণ হয়েছে।

‘পলিটিকো’ বলছে যে, পুতিন তার ভাষণে ‘ওয়াগনার’এর বিদ্রোহকে ১৯১৭ সালের রুশ গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা দিয়েছেন, যখন বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ছিল রাশিয়া। তবে এখানে আরও ভালো উদাহরণ ছিল ১৯৯১ সালের অগাস্টে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গরবাচেভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা; যখন কট্টরপন্থীরা গরবাচেভের সংস্কারের বিরোধিতা করেছিল। তবে সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় সমাজতান্ত্রিক সরকারের উপর জনগণের আস্থা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল; যার ফলশ্রুতিতে কয়েক মাসের মাঝে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ‘ওয়াগনার’এর একদিনের বিদ্রোহ হয়তো রুশ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের উপর ভ্লাদিমির পুতিনের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে দিয়েছে; কিন্তু তা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্যার সমাধান দেয়নি। সেখানে যথেষ্ট সক্ষম একটা বাহিনীর অভাব থেকেই যাচ্ছে; যা কিনা যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার জয়লাভ করাকে চ্যালেঞ্জের মাঝে ফেলছে। পুতিন ‘ওয়াগনার’এর বিদ্রোহকে ১৯১৭ সালের গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। ১৯১৭ সালের সেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই; এবং তা গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে বেশ কয়েক মাস লেগেছিলো। যেটা এখন দেখতে হবে তা হলো, আগামী কয়েক মাসের মাঝে ‘ওয়াগনার’কে উদাহরণ ধরে রুশ বাহিনীর অন্যান্য অংশ থেকে কি কি দাবি উত্থাপিত হয়।

No comments:

Post a Comment