১৩ই জুন ২০২৩
গত ১১ই জুন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের টেলিগ্রাম সোশাল মিডিয়ার এক পোস্টে বলা হয় যে, তারা কৃষ্ণ সাগরে একটা রুশ সামরিক জাহাজের উপরে ইউক্রেনের সুইসাইড ড্রোন বোটের হামলা প্রতিহত করেছে। ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপোল বন্দর থেকে ৩’শ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে রুশ গোয়েন্দা জাহাজ ‘প্রিয়াজোভিয়ে’র উপর ৬টা দ্রুতগামী ড্রোন বোট হামলা করে। সেসময় জাহাজটা কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সাগরের নিচ দিয়ে যাওয়া ‘তুর্ক্স-স্ট্রিম’ এবং ‘ব্লু-স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনের নিরাপত্তা প্রদানের কাজে নিয়োজিত ছিল বলে বলা হয়। এছাড়াও রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, ঠিক সেসময় মার্কিন কৌশলগত গোয়েন্দা ড্রোন বিমান ‘আরকিউ-৪ গ্লোবাল হক’ কৃষ্ণ সাগরের মাঝামাঝি দিয়ে উড়ছিলো। ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২০ সালে চালু হওয়া ‘তুর্ক্স-স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইন ইউক্রেনকে বাইপাস করে কৃষ্ণ সাগরের তলদেশ ও তুরস্ক হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করে। অপরদিকে ‘ব্লু-স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া তুরস্কে গ্যাস রপ্তানি করে থাকে। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই গ্যাস পাইপলাইনের উপরে যেকোন সংঘাতের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট।
রুশ গোয়েন্দা জাহাজের উপর এই হামলা সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিতীয়বার ঘটলো। গত ২৪শে মে আরেকটা গোয়েন্দা জাহাজ ‘আইভান খুরস’এর উপর তিনটা ইউক্রেনিয় ড্রোন বোট হামলা করে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বার্তায় বলা হয় যে, হামলার সময় জাহাজটা সমুদ্র তলদেশের গ্যাস পাইপলাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তুরস্কের অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাঝে বসফরাস প্রণালি থেকে ১’শ ৪০ কিঃমিঃ উত্তর-পূর্বে অবস্থান করছিলো। সেই হামলা রুশরা প্রতিহত করার কথা বলে এবং একটা ড্রোন বোট ধ্বংস করার সপক্ষে একটা ভিডিও প্রকাশ করে। তবে ইউক্রেনিয় সামরিক বাহিনী একটা ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে ড্রোন বোট থেকে ধারণ করা ফুটেজ দেখানো হয়। এই ভিডিওতে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, অন্ততঃ একটা ড্রোন বোট ‘আইভান খুরস’ জাহাজের পিছনে বাঁ দিকে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে হামলার পর জাহাজটার সেভাস্তোপোল বন্দরে ফিরে আসার ছবি সোশাল মিডিয়াতে প্রকাশ হলে বিশ্লেষকেরা ধারণা করেন যে, জাহাজটা খুব সম্ভবতঃ তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি অথবা রুশরা খুব দ্রুতই ক্ষতির অংশটা মেরামত বা রং দিয়ে ঢেকে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
ইউক্রেনিয়দের প্রকাশ করা ভিডিওর ফলশ্রুতিতে কিছু পশ্চিমা বিশ্লেষক তাদের যুক্তি থেকে সরে আসতে বাধ্য হন; যারা বলেছিলেন যে, হয়তো রুশরা নিজেরাই ইউক্রেনিয়দের নাম দিয়ে এই হামলা করে থাকতে পারে। তারা মানতে পারছিলেন না যে, তুরস্কের মতো একটা ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে ঢুকে একটা রুশ জাহাজের উপরে ইউক্রেনিয়রা হামলা করতে পারে। একইসাথে জায়গাটা ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা সমুদ্র উপকূল থেকে প্রায় ৪’শ কিঃমিঃ দূরে। এতটা দূরত্ব পার হয়ে একটা জাহাজের উপরে হামলা করার সক্ষমতা ইউক্রেনের আছে কিনা, তা নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলেন। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য এবং ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক এইচ আই সাটন ‘কোভার্ট শোরস’ নামে তার ওয়েবসাইটে এক বিশ্লেষণে বলেন যে, এই হামলা ইউক্রেন করেছে এটা প্রমাণ করতে পারলে রুশরা বলতে পারবে যে, ইউক্রেনিয়রা ‘তুর্ক-স্ট্রিম’ এবং ‘ব্লু-স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনের উপরে হামলা করতে চাইছে।
অনলাইন ম্যাগাজিন ‘দ্যা ড্রাইভ’এর সামরিক সেকশন ‘দ্যা ওয়ার জোন’এর এক লেখায় হাওয়ার্ড অল্টম্যান বলেন যে, ‘আইভান খুরস’এর উপর হামলা করা বোটগুলি রুশ নৌঘাঁটি সেভাস্তোপোলের উপর হামলায় ব্যবহার করা বোটগুলি থেকে আলাদা। ২০২২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে এবং ২০২৩এর মার্চের সেই হামলাগুলিতে ব্যবহৃত বোটগুলি ঘন্টায় প্রায় ৮০ কিঃমিঃ বেগে ছুটতে পারতো। প্রায় আড়াই লক্ষ ডলার ব্যয়ে সেই বোটগুলি তৈরি করার জন্যে গত নভেম্বরে জনগণের কাছ থেকে অর্থ চাওয়া হয়েছিল।
ইউক্রেনিয় ড্রোনগুলি যদি সর্বোচ্চ ৮০ কিঃমিঃ গতিতেও ছোটে, তাহলেও ইউক্রেনের উপকূল থেকে রুশ জাহাজ ‘আইভান খুরস’এর উপরে হামলা করতে কমপক্ষে ৫ ঘন্টা লাগার কথা। এই লম্বা সময় পর একটা চলমান জাহাজকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে ইউক্রেনিয়দেরকে ভিন্ন ইন্টেলিজেন্স উৎস খুঁজতেই হবে। তুর্কি ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক ইয়োরুক ইশিক টুইটারে এক বিশ্লেষণে দেখান যে, ২৪শে মে রুশ জাহাজ ‘আইভান খুরস’এর উপর হামলার সময় কৃষ্ণ সাগরের আকাশে ব্রিটিশ ‘আরসি-১৩৫ডব্লিউ রিভেট জয়েন্ট’ গোয়েন্দা বিমান দু’টা ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’ ফাইটার বিমানের প্রহড়ায় উড়ছিল। একইসাথে আকাশে ছিল মার্কিন গোয়েন্দা ড্রোন ‘আরকিউ-৪বি গ্লোবাল হক’। রুশ টেলিগ্রাম চ্যানেল ‘রাইবার’এর এক বিশ্লেষণে বলা হয় যে, কৃষ্ণ সাগরের উপর এত গোয়েন্দা কর্মকান্ড এবং একই দিনে ‘আইভান খুরস’এর উপর হামলার মাঝে হয়তো যোগসাজস থাকতে পারে। হাওয়ার্ড অল্টম্যান এই মতের সাথে একমত না হলেও তিনি প্রশ্ন করেন যে, প্রায় ৪’শ কিঃমিঃ দূরে ইউক্রেনিয়রা কিভাবে এই হামলা করতে পারলো? ইউক্রেনের কাছাকাছি আরও বহু রুশ জাহাজ ছিল; সেগুলির উপর হামলা না করে এত দূরের চলমান টার্গেটের উপর এত ছোট বোট দিয়ে কিভাবে হামলা করা সম্ভব? হয়তোবা এখানে অন্য কোন ‘মাদারশিপ’এর ব্যবহারও থাকতে পারে।
রুশ জাহাজের উপরে হামলার স্থানগুলি ‘তুর্ক-স্ট্রিম’ এবং ‘ব্লু-স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনের ওপর; যা পুরো ব্যাপারটাকে ঘোলাটে করে ফেলেছে; যদিও পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা অনেকেই মানতে নারাজ যে, রুশ গোয়েন্দা জাহাজগুলি গ্যাস পাইপলাইনের নিরাপত্তা দিচ্ছে। তথাপি মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘ইয়র্কটাউন ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো স্টিফেন ব্রাইয়েন এক লেখায় সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে, পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্স সহায়তা ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে ৪’শ কিঃমিঃ দূরে গভীর সমুদ্রে একটা চলমান জাহাজ খুঁজে বের করে আক্রমণ করা সম্ভব কিনা। যেহেতু কৃষ্ণ সাগরে পশ্চিমা গোয়েন্দা বিমান সর্বদাই কাজ করছে এবং ইউক্রেনকে ইন্টেলিজেন্স সরবরাহের মাধ্যমে সহায়তা দিচ্ছে, কাজেই এটা সন্দেহের উর্ধ্বে নয় যে, ইউক্রেনিয় এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকতে পারে। ব্রাইয়েনএর মতে, এর আগে বল্টিক সাগরের তলদেশে ‘নর্ড স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র যেমন জার্মানিকে হামলাকারী কে ছিল, সেব্যাপারে চুপ থাকতে বাধ্য করতে পেরেছিল, সেটা ‘তুর্ক-স্ট্রিম’এর উপর নির্ভরশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে করতে গেলে দু’টা ন্যাটো সদস্য দেশ তুরস্ক এবং হাঙ্গেরির সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে।
No comments:
Post a Comment