Saturday 1 April 2023

মস্কোতে শি জিনপিং… কে কি পেলো

০১লা এপ্রিল ২০২৩

মস্কোতে ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে শি জিনপিং। চীনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র হলো সবচাইতে বড় পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র তার কতটা সম্পদকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মোতায়েন করবে, আর কতটা সম্পদ চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করবে, সেটাই বরং বেইজিংএর কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একারণেই ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে চীনের ধোঁয়াশা বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমারাও নিশ্চিত করতে চাইছে যাতে করে আপাততঃ চীনাদের এই অবস্থানে কোন পরিবর্তন না আসে।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর মস্কোতে দুই দিনের আলোচনা শেষে ২১শে মার্চ এক যৌথ বিবৃতিতে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে দায়িত্বপূর্ণ আলোচনার কথা বলা হয়। তবে ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চীনের শান্তি প্রস্তাবকে মূল স্তম্ভ ধরে নিয়ে আলোচনার কথা বললেও অভিযোগ করেন যে, ইউক্রেন এবং পশ্চিমারা সমস্যা সমাধানে ইচ্ছুক নয়। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, শি জিনপিং তার সফরে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চীনা প্রস্তাবের উপরেই সবচাইতে গুরুত্বারোপ করেছেন। যুদ্ধ বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোন পদক্ষেপ না দেখাতে পারলেও শি জিনপিং শান্তির দূত হিসেবে তার বৈশ্বিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। একইসাথে তিনি একটা আলোচনার জন্ম দিয়েছেন যে, দুই দেশের সহযোগিতায় চীন বড় ভাইয়ের ভূমিকা নিয়েছে; যেখানে রাশিয়ারই চীনকে বেশি প্রয়োজন। তবে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, চীন পশ্চিমা হুমকিকে উপেক্ষা করে রাশিয়াকে সামরিক সহায়তা দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। তথাপি পশ্চিমাদের সাথে চীনের যখন প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন চীনারা মস্কোকে দুর্বল দেখতে চায় না। অপরদিকে পুতিন খুব সম্ভবতঃ আলোচনার ফলাফল নিয়ে খুশিই থাকবেন; কেননা ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জ্বালানি বাণিজ্যসহ বহু ইস্যু নিয়ে দুই নেতার মাঝে আলোচনা হয়েছে। গত ১০ বছরে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়ে ১’শ ৯০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। রাশিয়া চীনের কাছ থেকে কৃষি এবং জ্বালানির ক্ষেত্রে সহায়তা পাবে; অন্যদিকে চীন রাশিয়ার কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে তেল ও গ্যাস পাবে। পশ্চিমা অবরোধের মাঝে এটা রাশিয়ার জন্যে একটা ‘লাইফলাইন’।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, আলোচনার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল, পুতিন এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে চীনা মুদ্রা ইউয়ানকে ব্যবহার করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। যদিও উভয় পক্ষই বলছে যে, দুই দেশের মাঝে এটা কোন রাজনৈতিক বা সামরিক জোট নয়, তথাপি তারা উভয়েই পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে একমত পোষণ করছেন। তারা ‘সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’ বা ‘এসসিও’, ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’ এবং ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ‘ব্রিকস’এর আওতায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা ছাড়াও ন্যাটো এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার মাঝে ‘অকাস’ চুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

‘রাশান একাডেমি অব সায়েন্সেস’এর চীন বিশ্লেষক আলেক্সান্ডার লুকিন চীনা সরকারি মিডিয়া ‘সিজিটিএন’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, শি জিনপিংএর মস্কো সফর তেমন বড় কোন ঘটনা হতো না, যদি বিশ্বের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকতো। নতুনভাবে ক্ষমতায় আসীন হবার পর থেকে শি জিনপিংএর এটা প্রথম রাশিয়া সফর; যার একটা প্রতীকি অর্থ রয়েছে। লুকিনের কথায়, রাশিয়া এবং চীনের একমত হবার মূল জায়গাটা হলো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা। শি জিনপিংএর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, পৃথিবীর একটা অংশ নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে থাকবে; আর বাকি অংশ নিরাপত্তার কিছুই পাবে না, সেটা অনুচিত। রাশিয়াও ঠিক এই ব্যাপারটার সাথেই একমত। কারণ রাশিয়াও বলে যাচ্ছে যে, ন্যাটো তার নিরাপত্তা বৃদ্ধি করছে, যা কিনা রাশিয়া এবং চীনের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি তৈরি করছে; এটা অন্যায়। অপরদিকে তাইওয়ানের ‘সুচাউ ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ভিক্টর গাও ‘সিজিটিএন’কে বলছেন যে, চীন এবং রাশিয়ার মাঝে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সফর ছিল এটা। এই সফরে দুই দেশের মাঝে সকল ক্ষেত্রে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। একইসাথে এই সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোন ঘটনা যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার কথা বলা হয়েছে। আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের জন্যে চীনের শান্তি প্রস্তাব। চীনের প্রস্তাবকে সন্মান জানিয়ে রাশিয়াও যুদ্ধ বন্ধে আলোচনার পথকে প্রসারিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। ভিক্টর গাও বলছেন যে, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই মুহুর্তে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চীনের শান্তি প্রস্তাব ব্যাতীত মানজাতির কাছে আর কোন শান্তি প্রস্তাব নেই। চীনের এই প্রস্তাব হয়তো ইউক্রেন যুদ্ধের আরও বিস্তৃতি বা এর পরিসর পারমাণবিক অস্ত্র পর্যন্ত যাওয়া বন্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’ বলছে যে, শি জিনপিং পরিষ্কার করেছেন যে, তিনি কোন বিষয়গুলিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাথে বিশাল বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও চীনের দৃষ্টি এখন সেদিকে নয়। তাদের প্রাধান্য হলো বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তনের দিকে; যা গত ৭০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে চলছে। চীনারা অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি ছাড়াও তাদের কূটনৈতিক অবস্থানকে জানান দিচ্ছে; যার মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব এবং ইরানের মাঝে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে চীনের মধ্যস্ততার ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘স্টিমসন সেন্টার’এর সিনিয়র ফেলো ইউন সুন ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, পশ্চিমা অবরোধের যাঁতাকলে রাশিয়া কেন চীনকে পাশে চাইবে, সেটা খুবই পরিষ্কার। অপরদিকে ভূরাজনৈতিক কারণেই চীন রাশিয়াকে পাশে চায়। বিশেষ করে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার মাঝে দুই দেশের লক্ষ্য একইরকম হওয়ার কারণে তার একত্রে হাঁটছে। তবে ইউরোপিয়রা যাতে এক্ষেত্রে মস্কোর সাথে চীনের সম্পর্কোন্নয়নকে খারাপ চোখে না দেখে, সেজন্য শি জিনপিং নিজেকে শান্তির দূত হিসেবেই বেশি উপস্থাপন করতে চাইছেন। সামনের দিনগুলিতে চীনারা হয়তো ইউক্রেনের সাথেও আলোচনায় বসতে পারে। এতে বিশ্ব চীনকে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্ততাকারী হিসেবে চিনবে। তবে ইউন সুন মনে করেন না যে, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা বা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাটাই চীনের মূল উদ্দেশ্য। আর একটা সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারার মতো সক্ষমতাও চীনের নেই। চীনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র হলো সবচাইতে বড় পররাষ্ট্রনীতির চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র তার কতটা সম্পদকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মোতায়েন করবে, আর কতটা সম্পদ চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করবে, সেটাই বরং বেইজিংএর কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একারণেই ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে চীনের ধোঁয়াশা বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমারাও নিশ্চিত করতে চাইছে যাতে করে আপাততঃ চীনাদের এই অবস্থানে কোন পরিবর্তন না আসে।

2 comments:

  1. "পশ্চিমারাও নিশ্চিত করতে চাইছে যাতে করে আপাততঃ চীনাদের এই অবস্থানে কোন পরিবর্তন না আসে।" - এই ব্যাপারটা যদি পরিষ্কার করে বলেন।

    পশ্চিমাদের তৈরি করা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আইন মেনে চলা ওয়ারলর্ডগুলির মাৎস্যন্যায় এর যুগে আমরা প্রবেশ করছি?

    এই 'মাল্টিপোলারিটি' বিশ্বব্যবস্থায় কি কোনো মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. পশ্চিমারা আপাততঃ চাইছে যাতে চীন রাশিয়াকে অস্ত্র না দেয়।

      পশ্চিমাদের এই স্বেচ্ছাচারিতার মাঝে আমরা রয়েছি ঔপনিবেশিক সময় থেকে। আগে এটা নিয়ন্ত্রিত হতো লন্ডন থেকে। আর ১৯৪৫-পরবর্তী সময়ে এই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবার কারণে ওয়াশিংটনে তৈরি করা কিছু নিয়ম-নীতি ও ইন্সটিটিউশন বাস্তবায়িত হচ্ছে।

      মাল্টিপোলার অর্থ হলো আগে একটা নিয়মে চলতো; এখন তিন-চারটা বা আরও বেশি নিয়মে চলবে এবং সেগুলির মাঝে প্রতিদিন চারবার করে দ্বন্দ্ব হবে।

      Delete