Monday 10 April 2023

ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তি; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাচ্যুত… কেন?

১০ই এপ্রিল ২০২৩

ফিনল্যান্ডের শীর্ষ তিনজন রাজনীতিবিদ - সানা মারিন, পেটারি অরপো এবং রিক্কা পুররা। সানা মারিনের প্রধানমন্ত্রীত্ব দেখিয়ে দেয় যে, ব্যাক্তিগত জীবনে স্বাধীনচেতা হয়ে জনগণের জন্যে উদাহরণ সৃষ্টি করাটা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে যথেষ্ট নয়। আবার তা এও দেখিয়ে দেয় যে, পশ্চিমা নারীবাদীদের মধ্যমণি হওয়ার জন্যে একজন নারীকে শুধুমাত্র জনপ্রিয় নেতা হলেই চলবে না, তাকে ব্যাক্তিগত জীবনেও স্বাধীনচেতা হতে হবে। সানা মারিনের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়েই রাষ্ট্র পরিচালনা এবং নারীস্বাধীনতার এক অদ্ভুত মিশ্রণের উদাহরণ হয়েছে ফিনল্যান্ড; যার পিছনে নিঃসন্দেহে পশ্চিমা মিডিয়ার প্রভাব ছিল যথেষ্ট।

ন্যাটোতে ফিনল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তি সত্ত্বেও ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিনের মধ্য-বামপন্থী ‘সোশাল ডেমোক্র্যাট’ দল ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে রক্ষণশীল ‘ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টি’র নেতা পেটারি অরপো নির্বাচনে বিজয় পেয়েছেন। হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনী লড়াইয়ের ফলাফল শেষ পর্যন্ত আসে ফিনল্যান্ডের সবচাইতে বড় মিডিয়া ‘ওয়াইএলই’এর কাছ থেকে। পেটারি অরপোর দল ২০ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ ৪৮টা আসনের মালিক হয়েছে। ২০১৯ সালে তারা পেয়েছিল ৩৭টা আসন। এরপর রয়েছে ডানপন্থী ‘ফিনস পার্টি’, যারা ২০ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪৬টা আসনের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে। ২০১৯ সালে তারা পেয়েছিল ৩৯টা আসন। আর সানা মারিনের মধ্য-বামপন্থী ‘সোশাল ডেমোক্র্যাট’রা পেয়েছে ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট। ‘বিবিসি’ বলছে যে, সানা মারিন তার দলের আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৪০ থেকে ৪৩এ নিলেও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। এর পিছনে বড় কারণ ছিল তার বামপন্থী কোয়ালিশনের তিন দল, ‘সেন্টার পার্টি’, ‘লেফট এলায়েন্স’ এবং ‘গ্রিন লীগ’; যারা সব মিলিয়ে ২০টা আসন হারিয়েছে। অপরদিকে ডানপন্থীরা তাদের আসন ১৮টা পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে।

এবারের নির্বাচনে ডানপন্থী ‘ফিনস পার্টি’র জনপ্রিয়তা ছিল দেখার মতো। পার্টির নেতা ৪৫ বছর বয়সী রিক্কা পুররা অন্য যেকোন রাজনীতিকের চাইতে বেশি ভোট পেয়েছেন। তিনি ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। অনেকেই বলছেন যে, তার দলের বেশি ভোট এসেছে নবীন ভোটারদের কাছ থেকে। সোশাল মিডিয়া, বিশেষ করে ‘টিকটক’এ ডানপন্থী দলের প্রচার ছিল অনেক বেশি।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ সরকার প্রধান হিসেবে সানা মারিন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন। তার কোয়ালিশনে ছিল ৫টা দল; যাদের সকল নেতাই ছিল মহিলা। যেহেতু ফিনল্যান্ডের সকল দলই দেশটার ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তিকরণে একমত ছিল, সেকারণে পররাষ্ট্রনীতি দেশের নির্বাচনে কোন প্রভাব ফেলেনি। বরং মূল আলোচ্য বিষয় ছিল অর্থনীতি এবং সরকারি ঋণ।

‘সিএনএন’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি মূলতঃ দেশটার প্রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণে। আর এই পদটাতে রয়েছেন দেশটার সবচাইতে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ সাউলি নিনিস্ত্রো। ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে ন্যাটোর দিকে ধাবিত করার পিছনে নিনিস্ত্রোর ভূমিকাই ছিল সবচাইতে বেশি। ফিনল্যান্ডের বামপন্থীদের মাঝে একটা অংশ সেটা অপছন্দ করলেও প্রায় সকল রাজনৈতিক দলই সেই নীতিকে অনুসরণ করেছে। বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সানা মারিন তার দলের চাইতে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। তবে এবারে পার্শ্ববর্তী সুইডেনের মতো ফিনল্যান্ডেও ডানপন্থীরা বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সানা মারিনের সরকারের সবচাইতে বড় সমালোচনা ছিল তার সরকারের ঋণের পরিমাণ। ফিনল্যান্ডের ঋণ এখন দেশটার জিডিপির ৭০ শতাংশ। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় তা খুব বেশি না হলেও ফিনল্যান্ডের অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল সংস্কৃতিতে এটা অনেকটাই অগ্রহণযোগ্য। এর সাথে তুলনা করলে ব্রিটেনের সরকারি ঋণ প্রায় ৯৫ শতাংশ; আর ফ্রান্সে ২০২৩ সালের শেষে তা ১’শ ১৩ শতাংশ হতে চলেছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় মারিনের বিরোধীরা যেখানে সরকারের বাজেটকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলেছেন, সেখানে মারিন বাজেট সম্পর্কে কোন কথা না বলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কম হবার মাঝেই আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন।

‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সানা মারিনের ব্যক্তিগত জীবন মিডিয়াতে আলোচিত হয়েছে যথেষ্ট। বিশেষ করে পার্টিতে গিয়ে গান ও নৃত্য করার পাশাপাশি মদের গ্লাস হাতে তার ভিডিও সোশিলা মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়লে তার ব্যাপারে জনমত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পশ্চিমা দেশগুলিতে অনেক স্বাধীনচেতা নারীরা সানা মারিনের পক্ষে কথা বললেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সানা মারিনের কার্যকলাপ ভিন্ন হওয়া উচিৎ ছিল কিনা, তা নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। সানা মারিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ৫৩ বছর বয়সী পেটারি অরপো ১৯৯০এর দশক থেকে রাজনীতিতে রয়েছেন; আর সানা মারিনের মতো ‘রক স্টার’ ইমেজ নেই তার। যদি রক্ষণশীলরা একটা কোয়ালিশন গঠন করতে পারে, তবে অরপোই হবেন ফিনল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। সরকার গঠন করতে গেলে ফিনল্যান্ডের পার্লামেন্টের ২’শ আসনের মাঝে ১’শর বেশি আসন প্রয়োজন। ফিনল্যান্ডের ‘ইউনিভার্সিটি অব টুরকু’র প্রফেসর ভেসা ভারেস ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, অরপো হয়তো রিক্কা পুররার ডানপন্থীদের সাথে কোয়ালিশন করতে চেষ্টা করবেন। তবে ডানপন্থীরা রাজনীতিতে খুবই অনভিজ্ঞ। একারণে সানা মারিনের ‘সোশাল ডেমোক্র্যাট’দের সাথে কোয়ালিশনের সম্ভাবনা যথেষ্ট। তবে সমস্যা হলো, সানা মারিন নিজেই তাদের দলের মাঝে বামপন্থী গ্রুপের একজন। তিনি রক্ষণশীলদের পছন্দ করেন না।

ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকাতে নারীবাদী সাংবাদিক জো উইলিয়ামসএর লেখা প্রকাশিত হবার পর ফিনিসরা অনেকেই লিখিতভাবে তাদের বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। উইলিয়ামস তার লেখায় বলেন যে, ফিনল্যান্ডে নারী নেতৃত্বের প্রতি বিদ্বেষের কারণেই ডানপন্থীরা বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচনে জিতেছে। কারণ ফিনল্যান্ডে অনেকেই সানা মারিনের স্বাধীনচেতা ব্যাক্তিগত জীবনকে পছন্দ করেনি। এই লেখার জবাবে এক প্রতিবাদপত্রে আনা হোমেন বলছেন যে, সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া তিনজন রাজনীতিবিদই নারী - রিক্কা পুররা, সানা মারিন এবং ‘ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টি’র এলিনা ভালটোনেন। মারিন তার ক্ষমতা হারিয়েছেন তার সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যয় নীতির কারণে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়তো একজন পুরুষই হবেন। কিন্তু তাদের সাথে অর্থমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়তো মহিলাই হবেন। আরেক প্রতিবাদপত্রে পল ফেয়ারচাইল্ড বলছেন যে, উইলিয়ামস এড়িয়ে গেছেন যে, ফিনল্যান্ডের পার্লামেন্টে ৯টা দলের মাঝে ৭টারই নেতৃত্ব মহিলাদের হাতে। এর কারণ হলো, ফিনল্যান্ডের জনগণ তাদের নেতারা মহিলা কি পুরুষ, যেটা নিয়ে চিন্তিত নয়; বরং তাদের কথা এবং কাজ নিয়ে চিন্তিত। আর ফিনল্যান্ডের রাজনীতি হয় মধ্য-বাম বা মধ্য-ডানের মাঝেই সীমাবদ্ধ। তাই সানা মারিন হয়তো আবারও ক্ষমতায় যাবার কাছাকাছিই থাকবেন। ফিনল্যান্ডের জনগণ অনেকেই দেশের সরকারি ঋণের ব্যাপারে চিন্তিত। উইলিয়ামস তার লেখায় ডানপন্থীদের অর্থনৈতিক নীতিকে হাস্যকর বলে আখ্যা দিয়েছেন। অথচ তিনি যেটা বুঝতে পারছেন না তা হলো, ফিনল্যান্ডে যা ডানপন্থী, ব্রিটেনে তা বামপন্থীদেরও অনেকের মাঝেই অনুপস্থিত। বিশেষ করে ফিনল্যান্ডের শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যনীতি ব্রিটেনে কল্পনাই করা যাবে না। কাজেই ফিনিস রাজনীতি ১৯৩০এর দশকের ‘ফ্যাসিস্ট’দের দিকে চলে যাচ্ছে, এটা চিন্তা করাটা অনুচিত।

পশ্চিমা লিবারাল মিডিয়াতে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিনের ব্যক্তিগত স্বাধীনচেতা ইমেজ যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, ততটা গুরুত্ব পায়নি তার সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। তার ব্যাক্তিগত স্বাধীনচেতা জীবনকে যতটা হাইলাইট করে আলোচনার জন্ম দেয়া হয়েছে, তার সিকিভাগ গুরুত্বও পায়নি তার রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা। ডানপন্থী দলগুলি সহ ফিনিস পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ বেশিরভাগ নেতাই মহিলা হওয়া সত্ত্বেও সানা মারিনের ক্ষমতাচ্যুত হওয়াটা নারীবাদীরা মেনে নিতে পারেনি। আবার ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে কিছু পশ্চিমা মিডিয়াতে সানা মারিনের ‘বিশেষ ভূমিকা’কে হাইলাইট করা হলেও পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয় যে, ফিনল্যান্ডের পরররাষ্ট্রনীতিতে প্রেসিডেন্টের ভূমিকাই সর্বোচ্চ। একারণেই ফিনল্যান্ডের সকল রাজনৈতিক দলই প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছেন; শুধু সানা মারিনই নন। সানা মারিনের প্রধানমন্ত্রীত্ব দেখিয়ে দেয় যে, ব্যাক্তিগত জীবনে স্বাধীনচেতা হয়ে জনগণের জন্যে উদাহরণ সৃষ্টি করাটা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে যথেষ্ট নয়। আবার তা এও দেখিয়ে দেয় যে, পশ্চিমা নারীবাদীদের মধ্যমণি হওয়ার জন্যে একজন নারীকে শুধুমাত্র জনপ্রিয় নেতা হলেই চলবে না, তাকে ব্যাক্তিগত জীবনেও স্বাধীনচেতা হতে হবে। সানা মারিনের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়েই রাষ্ট্র পরিচালনা এবং নারীস্বাধীনতার এক অদ্ভুত মিশ্রণের উদাহরণ হয়েছে ফিনল্যান্ড; যার পিছনে নিঃসন্দেহে পশ্চিমা মিডিয়ার প্রভাব ছিল যথেষ্ট।

No comments:

Post a Comment