Monday 17 April 2023

সুদানে আবারও সংঘাত পশ্চিমাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বেরই ফলাফল

১৭ই এপ্রিল ২০২৩

সুদানের খার্তুম বিমানবন্দরে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমান থেকে ধোঁয়া উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও দেশটার অর্থনৈতিক দৈন্যতা এবং পশ্চিমা দাতা সংস্থা ‘আইএমএফ’এর কঠোর শর্ত বাস্তবায়নের ফলাফলস্বরূপ সুদানের রাস্তায় গণবিক্ষোভ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে সামরিক বাহিনীর সাথে মিলিশিয়া বাহিনী ‘আরএসএফ’এর উত্তেজনা নিয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো বেশকিছুদিন ধরেই।

পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদানে নতুন করে আবারও সংঘাত শুরু হয়েছে। ১৫ই এপ্রিল দেশটার সামরিক বাহিনীর সাথে শক্তিশালী মিলিশিয়া ‘র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’ বা ‘আরএসএফ’এর সদস্যদের ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। ‘আরএসএফ’এর সদস্যরা বলছে যে, তারা তিনটা বিমানবন্দর এবং প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ দখল করে নিয়েছে। সোশাল মিডিয়াতে বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, মিলিশিয়ারা মেরোউই বিমানবন্দরে মিশরের বিমান বাহিনীর কয়েকটা ‘মিগ-২৯’ যুদ্ধবিমানসহ বেশ কয়েকজন মিশরীয় সেনাকে আটক করেছে। এছাড়াও মিলিশিয়াদের গোলার আঘাতে রাজধানী খার্তুমের বিমানবন্দরে সৌদি এয়ারলাইন্সের একটা এয়ারবাস বিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। খার্তুমে মিলিশিয়াদের উপর সুদানের বিমান বাহিনীর ‘মিগ-২৯’ বিমানকে রকেট নিক্ষেপ করতে দেখা যায় বিভিন্ন ভিডিওতে। এছাড়াও পূর্বাঞ্চলের বন্দর শহর পোর্ট সুদানের রাস্তাতেও ট্যাংক দেখা গেছে এবং বিভিন্ন মিডিয়াতে গোলাগুলির শব্দের কথাও বলা হয়। ‘বিবিসি’ বলছে যে, এ পর্যন্ত প্রায় ১’শ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে; আরও প্রায় ১১’শ আহত হয়েছে। ‘আরএসএফ’এর এক বিবৃতিতে বলে হয় যে, সুদানের সেনাবাহিনী খার্তুমে ‘আরএসএফ’এর ‘সোবা’ ক্যাম্প ঘিরে ফেলে এবং সকল প্রকারের অস্ত্র দিয়ে হামলা করে। অপরদিকে সুদানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাবিল আবদাল্লাহ বলেন যে, ‘আরএসএফ’এর সদস্যরা খার্তুমে কয়েকটা সেনা ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছে।

২০২১ সালের অক্টোবরে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখলের পর থেকে সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবং ‘আরএসএফ’এর প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পশ্চিমা দেশগুলি সামরিক সরকারের সাথে কাজ করছিলো, যাতে করে নির্বাচনের মাধ্যমে সেখানে একটা অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক সরকার স্থাপন করা যায়। ২০১৯ সালে দীর্ঘদিনের একনায়ক ওমর আল-বশিরএর সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে দেশটায় অস্থিরতা লেগেই আছে। আবদাল্লা হামদকএর নেতৃত্বে গঠিত একটা বেসামরিক সরকার জনগণের আকাংক্ষা বাস্তবায়ন করতে না পারার ফলে অনেকেই ধারণা করছিল যে, কিছু একটা ঘটবে; যা ২০২১ সালের অক্টোবরে সামরিক অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও দেশটার অর্থনৈতিক দৈন্যতা এবং পশ্চিমা দাতা সংস্থা ‘আইএমএফ’এর কঠোর শর্ত বাস্তবায়নের ফলাফলস্বরূপ সুদানের রাস্তায় গণবিক্ষোভ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে সামরিক বাহিনীর সাথে মিলিশিয়া বাহিনী ‘আরএসএফ’এর উত্তেজনা নিয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো বেশকিছুদিন ধরেই। ১৪ই এপ্রিল ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ‘আরএসএফ’ প্রায় এক মাস ধরেই তাদের ইউনিটগুলিকে সংগঠিত করছিল। ১৫ই এপ্রিল ‘আরএসএফ’এর প্রধান জেনারেল হামদান দাগালো, যাকে অনেকেই হামেদতি বলে ডাকে, তিনি ‘আল জাজিরা’কে বলেন যে, তার বাহিনী সকল সামরিক ঘাঁটি দখল করার আগ পর্যন্ত থামবে না। তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল আল-বুরহানকে একজন ‘অপরাধী’ বলে আখ্যা দেন এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের অভিযোগ তোলেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিংকেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, সুদানের প্রধান কর্তাব্যক্তিরা কিছুদিন আগেই বেসামরিক নেতৃত্বে যাবার জন্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন। এই পথে যথেষ্টই অগ্রগতি হয়েছে। দু’দিন আগেই তিনি জেনারেল বুরহানের সাথে কথা বলেছেন এবং জেনেছেন যে, এখনও কিছু ইস্যুর সমাধান হয়নি। এখানে কিছু পক্ষ সেই অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে চাইছে। তিনি বলেন যে, বর্তমানে সেখানকার পরিস্থতি ভঙ্গুর। তবে সেখানে বেসামরিক নেতৃত্বে যাবার জন্যে প্রকৃত সুযোগ বর্তমান। অপরদিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে উভয় পক্ষকেই সহিংসতা বন্ধ করে আলোচনার পথে অগ্রসর হবার কথা বলা হয়।

সুদানের সামরিক শাসক জেনারেল বুরহানের সাথে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও। সুদানের সামরিক বাহিনীর দীর্ঘদিনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগকে উপেক্ষা করেই পশ্চিমা দেশগুলি সুদানে গণতন্ত্রায়নের কাজ করে যাচ্ছে; যা কিনা সুদানের সামরিক বাহিনী এবং মিলিশিয়াগুলিকে অধিকতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কর্মকান্ডে আগ্রহী করেছে।



সুদানে গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা

মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে ‘আরএসএফ’কে রুশ-সমর্থিত মিলিশিয়া বলে আখ্যা দিয়ে তাদের দারফুর যুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারগুলিকে তুলে ধরা হয়। 'নিউ ইয়র্ক টাইমস'এর এক প্রতিবেদনে 'আরএসএফ'এর নেতা জেনারেল হামদান দাগালোর ইতিহাস তুলে ধরা হয়; যেখানে বলা হয় কিভাবে তিনি উট বিক্রেতা থেকে মারাত্মক যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে একসময় ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন করেছেন। একনায়ক ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে তিনি নিজেকে গণতান্ত্রিক নেতাও বলতে শুরু করেছেন। এমনকি সুদানের শীর্ষ নেতাও বনে যেতে চান তিনি। এছাড়াও রাশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন এবং রুশ ভাড়াটে সামরিক সংস্থা 'ওয়াগনার গ্রুপ'কেও তিনি আলিঙ্গন করেছেন স্বর্ণের খনিগুলি পাহাড়া দেবার জন্যে। ২০১৯ সালে ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও পরবর্তীতে তার 'আরএসএফ' বাহিনীই রাস্তায় জনগণের উপরে হামলা চালিয়ে ১'শরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। ২০১৯ সালে তিনি 'নিউ ইয়র্ক টাইমস'কে বলেছিলেন যে, যারা তার মিলিশিয়াকে 'জানজাউইদ' বলে থাকে, তারা মিথ্যা কথা রটাচ্ছে। কারণ 'জানজাউইদ' অর্থ হলো ডাকাত দল, যারা রাস্তায় মানুষের সকল কিছু লুটে নেয়। বর্তমানে অনেকেই এই বাহিনীর সংখ্যা ৭০ হাজার থেকে ১ লক্ষ বলে ধারণা করেন। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি প্রচুর সম্পদের মালিকও বনে গেছেন।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ বা ‘সিএসআইএস’এর সিনিয়র এসোসিয়েট এবং মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিআইএ’এর প্রাক্তন সদস্য ক্যামেরন হাডসন ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, বর্তমানে পশ্চিমাদের নেতৃত্বে সুদানে চলমান গণতন্ত্রায়নকে সামরিক বাহিনী এবং ‘আরএসএফ’ উভয়েই তাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছে। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান শান্তি আলোচনায় বেসামরিক নেতারা ছিলেনই না; যা কিনা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সুদানে ক্ষমতা কাদের হাতে রয়েছে। তবে এই সংঘাতের ব্যাপারে কেউই অবাক হয়নি। এই পক্ষগুলি নিজেদের সামরিক লক্ষ্যগুলি কিছুটা বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত হয়তো আলোচনায় বসবে না। যুক্তরাষ্ট্র সুদানের নেতৃত্বকে একত্রে বসাতে বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার কথা বলেছে; কিন্তু তাদের উপরে চাপ সৃষ্টি করেনি; বা তাদের বিরুদ্ধে শক্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ডেপুটি ডিরেক্টর এবং মার্কিন সরকারের রাজস্ব দপ্তরের আফ্রিকা বিষয়ক প্রকল্পের প্রাক্তন প্রধান বেঞ্জামিন মসবার্গ সুদানের সহিংসতা শুরু হবার মাত্র তিন দিন আগে ১২ই এপ্রিল এক লেখায় বলেন যে, দেশের সামরিক বাহিনী এবং ‘আরএসএফ’ মিলিশিয়ার মাঝে দ্বন্দ্বের অবসান না হলে দেশটা বড় রকমের সহিংসতার মাঝে পতিত হতে পারে। মসবার্গ তার লেখায় দেশটাকে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবার পশ্চিমা প্রকল্পের উদ্দেশ্যগুলির পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলছেন যে, সুদানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সাথে তিনটা ব্যাপারকে সবচাইতে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন; যার প্রথমটা হলো অর্থনৈতিক সংস্কার; দ্বিতীয়টা হলো নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার এবং তৃতীয়টা হলো দেশটার ব্যাপক দুর্নীতি দূরীকরণ। অর্থনৈতিক সংস্কারের ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলছেন যে, পশ্চিমা দাতা সংস্থাগুলি সুদানকে কতটা সহায়তা দেবে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থাকা উচিৎ। বিশেষ করে আইএমএফএর শর্তগুলি বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার উপর ভিত্তি করে অর্থ ছাড়ের কথা বলেছেন তিনি। এই শর্তগুলির মাঝে একটা হলো নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার। নিরাপত্তা বাহিনীকে পুরোপুরিভাবে বেসামরিক নেতৃত্বের অধীন করা ছাড়াও বাহিনীর আকার ছোট করা জরুরি। বাহিনীর অস্তিত্বের জন্যে নতুন একটা উদ্দেশ্য ঠিক করা এবং সেই উদ্দেশ্য অনুযায়ী বাহিনীর আকার ঠিক করার মাধ্যমে এর ব্যয় সংকোচন করা প্রয়োজন। ‘আরএসএফ’ মিলিশিয়াকে সামরিক বাহিনীর অংশ করার পিছনেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাহিনীর সংকোচনের বিষয়টিকে এড়িয়ে যাবার বিরুদ্ধে বলেন তিনি।

'আরএসএফ'এর প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো এবং সুদানের সামরিক শাসক জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। ‘আরএসএফ’ যেখানে বলছে যে, ১০ বছর সময়ের মাঝে তাদেরকে সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ, সেখানে সেবাহিনী বলছে এত সময় না নিয়ে মাত্র দুই বছরের মাঝেই সেটা করা সম্ভব। যে ব্যপারটা পরিষ্কার তা হলো, সামরিক বাহিনী চাইছে ‘আরএসএফ’কে দ্রুত সামরিক বাহিনীর অধীনে নিয়ে এসে মিলিশিয়ার নেতাদের ক্ষমতাকে খর্ব করতে। তবে সবচাইতে বড় সমস্যা হলো, মার্কিনীরা সুদানের গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে এই ব্যাপারটাই চাইছে।


‘আরএসএফ’ এবং সামরিক বাহিনীর স্বার্থের দ্বন্দ্ব

তবে সামরিক বাহিনীর আকার সংকোচনের মাঝে সেখানে ‘আরএসএফ’এর সদস্যদেরকে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সেব্যাপারে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। ২০০৩ সাল থেকে সুদানের পশ্চিমাঞ্চলে দারফুরে বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে দমন করতে দেশটার একনায়ক ওমর আল-বশির আঞ্চলিক ‘জানজাউইদ’ মিলিশিয়াকে নিয়োগ করেছিল। এরাই পরবর্তীতে সরকারের কাছ থেকে ‘আরএসএফ’ নামে স্বীকৃতি পায় এবং রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে যায়। ‘বিবিসি’ বলছে যে, সামরিক বাহিনী আর ‘আরএসএফ’এর দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে ‘আরএসএফ’কে কত সময়ের মাঝে সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সেব্যাপারে দুই পক্ষের ভিন্ন চিন্তা। ‘আরএসএফ’ যেখানে বলছে যে, ১০ বছর সময়ের মাঝে তাদেরকে সামরিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ, সেখানে সেবাহিনী বলছে এত সময় না নিয়ে মাত্র দুই বছরের মাঝেই সেটা করা সম্ভব। ‘বিবিসি’র এই প্রতিবেদনে যে ব্যপারটা পরিষ্কার তা হলো, সামরিক বাহিনী চাইছে ‘আরএসএফ’কে দ্রুত সামরিক বাহিনীর অধীনে নিয়ে এসে মিলিশিয়ার নেতাদের ক্ষমতাকে খর্ব করতে। অপরদিকে ‘আরএসএফ’এর নেতৃত্ব চাইছে না ক্ষমতা ছেড়ে দিতে। তবে সবচাইতে বড় সমস্যা হলো, মার্কিনীরা সুদানের গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে এই ব্যাপারটাই চাইছে। ব্যাপারটা যে রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বে রূপ নিতে পারে, সেটা বেঞ্জামিন মসবার্গ তার লেখায় উল্লেখ করেছিলেন। অর্থাৎ এই সংঘাতের সম্ভাবনা কারুর কাছেই অজানা ছিল না।

মসবার্গ সুদানে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমস্যাগুলিকে তুলে ধরেছিলেন। আইএমএফএর কঠিন শর্তগুলি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সুদানের জনগণ যে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেই কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ এমনভাবে এগুনো, যাতে করে আইএমএফএর চাপে সুদানের জনগণ গণতন্ত্রায়নের বিরুদ্ধে না চলে যায়। আবার সুদানের সামরিক বাহিনী এবং ‘আরএসএফ’ মিলিশিয়া কেউই তাদের ক্ষমতা ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক নয়। এই সংস্থাগুলির যথেষ্ট পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষমতাও রয়েছে; যেগুলি তারা ছেড়ে দিতে অনিচ্ছুক। ‘আরএসএফ’সহ মিলিশিয়াদের হাতে সুদানের স্বর্ণ ক্ষণিগুলি রয়েছে। আবার সুদানের সামরিক বাহিনী বিভিন্ন ব্যবসায়িক কোম্পানির মাধ্যমে আয় করে থাকে। মসবার্গ বলছেন যে, সুদানের নেতৃত্বের উপরে যথেষ্ট পরিমাণে চাপ সৃষ্টি করে এবং আঞ্চলিক বন্ধু দেশ মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রভাবকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ সুদানের গণতন্ত্রায়নকে ত্বরান্বিত করা। তবে সুদানের মানবাধিকার লংঘন করা ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলিকে এই গণতন্ত্রায়নের মাঝে রাখার ব্যপারে মসবার্গ কিছু বলেননি। বিশেষ করে দারফুর অঞ্চলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকা ‘আরএসএফ’কে সামরিক বাহিনীর অংশ রাখাকে তিনি প্রশ্ন করেননি। বরং গণতন্ত্রায়নের জন্যে আপাততঃ মানবাধিকারের বিষয়গুলিকে দীর্ঘমেয়াদে দেখার কথা বলেন তিনি।

জানুয়ারি ২০২৩। ইস্রাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেনের সাথে সুদানের সামরিক শাসক জেনারেল আল-বুরহান। জো বাইডেন সরকার তাদের সুদান নীতিতে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’, লোহিত সাগরের নিরাপত্তা, এবং চীন ও রাশিয়ার প্রভাব কর্তনের উপরেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ মার্কিনীদের কাছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুদানের সামরিক নেতারা ঠিক একারণেই ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে; যাতে করে ইস্রাইলি লবি যুক্তরাষ্ট্রকে সুদানের সামরিক সরকারের পক্ষে রাখতে সহায়তা দেয়।

সুদানের সামরিক নেতৃত্বের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় ওয়াশিংটনের নীতির সমালোচনা করেছেন সুদানি গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিহাদ মাশামুন। তিনি বলছেন যে, জো বাইডেন সরকার তাদের সুদান নীতিতে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’, লোহিত সাগরের নিরাপত্তা, এবং চীন ও রাশিয়ার প্রভাব কর্তনের উপরেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ মার্কিনীদের কাছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুদানের সামরিক নেতারা ঠিক একারণেই ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে; যাতে করে ইস্রাইলি লবি যুক্তরাষ্ট্রকে সুদানের সামরিক সরকারের পক্ষে রাখতে সহায়তা দেয়।

লোহিত সাগরের নিরাপত্তাও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। ভূমধ্যসাগর ও ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী হবার কারণে লোহিত সাগরের গুরুত্ব যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র লোহিত সাগরের দক্ষিণে বাব এল-মান্ডেব প্রণালির পাশে জিবুতিতে তার সামরিক ঘাঁটির নিরাপত্তা নিশ্চিতেও অত্র অঞ্চলে তার প্রভাব ধরে রাখতে চাইছে। এরই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে রাশিয়া বা চীন সমুদ্রপথের উপর যুক্তরাষ্ট্রের এই নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করুক। ঠিক একারণেই সুদানের সমুদ্রবন্দর পোর্ট সুদানে রুশ নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা সুদানের সামরিক নেতৃত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের আরও কাছে টেনে এনেছে। মার্কিনীরা চেয়েছে সুদানিরা যেন রাশিয়াকে কোনভাবেই নৌঘাঁটির সুবিধা না দেয়; বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শাসকদের ক্ষমতায় টিকে থাকা মেনে নিয়েছে। এছাড়াও সুদানের সামরিক নেতৃত্ব চীনের সাথে সম্পর্ক গভীর করেছে; যা ওয়াশিংটনের প্রভাবকে কমাতে সহায়তা করছে।

জিহাদ মাশামুন বলছেন যে, বাইডেন প্রশাসন স্থিতিশীলতাও ধরে রাখতে চাইছে, আবার সুদানে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। বাইডেন প্রশাসনের এই অদ্ভুত নীতির সফলতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন করেছেন। তবে সুদানের সর্বশেষ পরিস্থিতি মাশামুনের দুশ্চিন্তাকেই প্রতিফলিত করছে।

সুদানের ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের অদ্ভুত নীতির সাথে ইউরোপিয়দের চিন্তার পার্থক্য রয়েছে। ইউরোপিয়রা ওয়াশিংটনের নীতিকে পরিবর্তন করে বেসামরিক নেতৃত্বের সাথে সামরিক নেতৃত্বকেও মেনে নিতে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করছে; যদিও ওয়াশিংটনে গণতান্ত্রিক আদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে অনেকেই সুদানের সামরিক নেতাদের, বিশেষ করে ‘আরএসএফ’এর নেতাদের ক্ষমতাচ্যুত দেখতে আগ্রহী। পর্তুগালের ‘অটোনমাস ইউনিভার্সিটি অব লিসবন’এর সহকারী অধ্যাপক ফেলিপ দুয়ার্তে ‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, সুদানে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ‘আরএসএফ’এর প্রধান জেনারেল হামদান দাগালো; কারণ তিনিই সুদানে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। ফেলিপ দুয়ার্তে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের শুধুমাত্র বেসামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব না দিয়ে কারা কারা পশ্চিমাদের সাথে আলোচনার জন্যে যথেষ্ট নমনীয়, সেটা দেখা উচিৎ। কারণ নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে নমনীয় হওয়ার অর্থই হলো এই নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষা করবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নমনীয় সামরিক নেতাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়, তাহলে সেটা সুদানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে কমাতে সহায়তা করবে।

সুদানের সীমানা প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের দখলীকৃত ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সীমানা; যা একসময় সুদান এবং শাদএর সীমানা হিসেবে পরিচিতি পায়। ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের এঁকে দেয়া সেই সীমানাকে কেন্দ্র করেই সুদানে বহুদিন গৃহযুদ্ধ চলেছে। আঞ্চলিক মিলিশিয়া ‘আরএসএফ’এর শক্তিশালী হবার কারণ ছিল সুদানের ভৌগোলিক অখন্ডতার প্রতি হুমকি। সুদানের সামরিক সরকারগুলি দেশটার ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা করতে সকল প্রকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও পশ্চিমারা সুদানকে ছেড়ে যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ গণতান্ত্রিক আদর্শ নয়, বরং নিজেদের স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। পশ্চিমাদের মাঝে প্রভাব ধরে রাখার এই প্রতিযোগিতাই সুদানের রাজনীতিকে করেছে অস্থির।


সুদানের রাজনীতিতে পশ্চিমা স্বার্থ

সুদানের সামরিক বাহিনীর দীর্ঘদিনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগকে উপেক্ষা করেই পশ্চিমা দেশগুলি সুদানে গণতন্ত্রায়নের কাজ করে যাচ্ছে; যা কিনা সুদানের সামরিক বাহিনী এবং মিলিশিয়াগুলিকে অধিকতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কর্মকান্ডে আগ্রহী করেছে। মার্কিনীরা মোটামুটিভাবে ‘আরএসএফ’এর বিরুদ্ধে বললেও ব্রিটিশ এবং ইউরোপিয়রা সুদানে সামরিক ও বেসামরিক সকলকেই আলোচনার টেবিলে দেখতে ইচ্ছুক। সুদানের রাজনীতিতে ব্রিটেন ও ইউরোপের প্রভাব অনেক পুরোনো। সুদানের সীমানা প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের দখলীকৃত ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সীমানা; যা একসময় সুদান এবং শাদএর সীমানা হিসেবে পরিচিতি পায়। ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের এঁকে দেয়া সেই সীমানাকে কেন্দ্র করেই সুদানে বহুদিন গৃহযুদ্ধ চলেছে। এর মাঝে ২২ বছর যুদ্ধের পরে দক্ষিণ সুদান যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে আলাদা দেশ হয়েছে। আর দারফুরে ১৭ বছর ধরে যুদ্ধ চলেছে; যেখানে ফ্রান্সের মদদপুষ্ট শাদ সরাসরি জড়িত ছিল। দারফুরের বিদ্রোহীদের দমন করতে সুদানের সরকার ‘জানজাউইদ’ মিলিশিয়াদের ব্যবহার করেছিল; যারা পরবর্তীতে ‘আরএসএফ’ নামে সুদান সরকারের স্বীকৃতি লাভ করে।

আঞ্চলিক মিলিশিয়া ‘আরএসএফ’এর শক্তিশালী হবার কারণ ছিল সুদানের ভৌগোলিক অখন্ডতার প্রতি হুমকি। সুদানের সামরিক সরকারগুলি দেশটার ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা করতে সকল প্রকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও পশ্চিমারা সুদানকে ছেড়ে যায়নি। নীল নদের উপরে এবং লোহিত সাগরের পাশে অবস্থিত সুদানের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব সর্বদাই বেশি। সুদানকে দেয়া ‘আইএমএফ’এর ঋণ মওকুফ এবং দেশটাতে বেসামরিক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টাটা সেই ভূরাজনৈতিক গুরুত্বেরই প্রমাণ। কিন্তু ওয়াশিংটন ও ইউরোপ সুদানের গণতান্ত্রিক সরকারের গঠনের ব্যাপারে একমত হতে পারেনি। ওয়াশিংটনে অনেকেই সুদানের সরকারে সামরিক নেতৃত্বকে দেখতে না চাইলেও ইউরোপিয়রা বেসামরিক ও সামরিক সকলকেই সুদানের রাজনৈতিক কাঠামোর অংশ করতে চায়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ গণতান্ত্রিক আদর্শ নয়, বরং নিজেদের স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। পশ্চিমাদের মাঝে প্রভাব ধরে রাখার এই প্রতিযোগিতাই সুদানের রাজনীতিকে করেছে অস্থির।

No comments:

Post a Comment