Tuesday 25 April 2023

যুক্তরাষ্ট্রে কেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আস্থা হারাচ্ছে জনগণ?

২৫শে এপ্রিল ২০২৩

মার্কিন জনগণের রাষ্ট্রীয় ভিতগুলির উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটা যথেষ্টই গভীর। মার্কিন জনগণ এখন কোনকিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। মানুষ বিভিন্ন বিশ্লেষণকে বিশ্বাস করতে পারছে না; যার ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে এবং সাধারণভাবে কোনটা সত্য, আর কোনটা সত্য নয়, সেটার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কিছু সত্যের উপরে স্থির না থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় যেকোন সমস্যা, তা কোভিড-১৯ হোক, দারিদ্র্য, অভিবাসন, জলবায়ুই হোক, সেগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হবে।

গত ১৩ই এপ্রিল ‘রয়টার্স’ এবং গবেষণা সংস্থা ‘ইপসস’এর করা এক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে বলা হয় যে, মার্কিন জনগণের মাঝে ৫৬ শতাংশই মনে করছেন যে, এক সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আদালতে গর্ভপাত বিষয়ে যে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, তা ছিল রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল যে, ‘মিফেপ্রিসটাইন’ নামক গর্ভপাত ঘটানো ঔষধ, যা একসময় মার্কিন সরকার বিক্রি করা অবৈধ ঘোষণা করেছিল, তা এখন বিক্রি করা যাবে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, এই জরিপের ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মার্কিন জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার উপরে মারাত্মকভাবে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই মতামত ২০২৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের উপরে প্রভাব ফেলবে তা প্রায় নিশ্চিত। মার্কিন রিপাবলিকান রাজনীতিবিদদের অনেকেই নির্বাচনী প্রচারণার সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তারা নির্বাচিত হলে গর্ভপাতকে নিষিদ্ধ করবেন, অথবা ভীষণভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন। প্রাক্তন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে থাকার সময় বেশকিছু ফেডারেল বিচারককে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের জুন মাসে সুপ্রীম কোর্টের এক নির্দেশনায় গর্ভপাতের অধিকার খর্ব করার পর অনেকেই আদালতের রুলিংকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বলে আখ্যা দিয়েছিল। আর ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের নির্বাচনে আশানুরূপ বিজয় অর্জন না করার কারণ হিসেবে সেই রুলিংকে অনেকেই উল্লেখ করেছিলেন।

মার্কিন জনগণ যেকোন আইনী বিষয়ের মাঝেই রাজনৈতিক প্রভাবের গন্ধ পাচ্ছে। একমাস আগেই ‘রয়টার্স’ এবং ‘ইপসস’এর আরেক জরিপে উল্লেখ করা হয় যে, মার্কিন জনগণের অর্ধেকই বিশ্বাস করছে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী পর্ণতারকাকে অর্থ দিয়ে চুপ থাকতে বলেছিলেন কিনা, সেব্যাপারে সরকারি যে তদন্ত চলেছে, তা মূলতঃ রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। এমনকি ডেমোক্র্যাট ঘরানার এক-তৃতীয়াংশও সেটাই ভেবেছিল।

বিচার ব্যবস্থার উপর মার্কিন জনগণের আস্থার অভাবটা অবশ্য নতুন নয়। ২০২২ সালের জুন মাসে মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘গ্যালাপ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ১৯৭৩ সাল থেকে তারা মার্কিন সুপ্রীম কোর্টের উপর জনগণের আস্থা নিয়ে জরিপ চালিয়ে আসছে। সেখানে দেখা যায় যে, ১৯৮৫ এবং ১৯৮৮ সালে ৫৬ শতাংশ মানুষের আস্থাই ছিল বিচার ব্যবস্থার উপরে জনগণের সর্বোচ্চ আস্থা। আর কখনোই তা ৫০ শতাংশ অতিক্রম করেনি। আর ২০০২ সালের পর থেকে তা নিম্নগামী। ২০০৮ সালে ৩২ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৩০ শতাংশ জনগণের আস্থা পেলেও ২০২২ সালের জুনে তা ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে; যা কিনা ইতিহাসের সর্বনিম্ন।

শুধু বিচার ব্যবস্থাই নয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম অংশ মিডিয়া, যাকে কিনা জনগণের বিবেক হিসেবে মনে করা হয়, সেই মিডিয়ার উপরেও জনগণের আস্থা ভয়াবহভাবে কমে গিয়েছে। গত জুলাই মাসে ‘গ্যালাপ’এর এক জরিপে বলা হয় যে, মাত্র ১৬ শতাংশ মার্কিন জনগণ পত্রিকাকে এবং মাত্র ১১ শতাংশ জনগণ টেলিভিশনের খবরকে যথেষ্ট বিশ্বাস করে থাকে; যা কিনা ইতিহাসের সর্বনিম্ন। ‘গ্যালাপ’ বলছে যে, ১৯৭৯ সালে এই বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল প্রায় ৫১ শতাংশ। কিন্তু ১৯৮১ সাল থেকে তা ব্যাপকভাবে কমতে থাকে। ১৯৯০ সালে ৩৯ শতাংশ জনগণ পত্রিকার খবর বিশ্বাস করতো; আর ১৯৯৩ সালে ৪৬ শতাংশ জনগণ টেলিভিশনের খবর বিশ্বাস করতো। ২০০৬ সালের পর থেকে উভয়ের বিশ্বাসযোগ্যতাই ৩০ শতাংশের নিচে চলে আসে; আর ২০২০ সাল থেকে তা ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।

মার্কিন সরকারের উপরে আস্থাও মারাত্মভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২২এর জুনে গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ’এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ১৯৫৮ সালে মার্কিন সরকারের উপরে ৭৩ শতাংশ জনগণের আস্থা ছিল; যা ১৯৬৪ সালে ৭৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকেই তা পড়তে থাকে। ১৯৮০এর দশকে রোনাল্ড রেগ্যানের সময়ে সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ; ১৯৯১ সালে জর্জ বুশ সিনিয়রের সময় সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ; আর ২০০১ সালে জর্জ বুশ জুনিয়রের সময় সর্বোচ্চ ৫৪ শতাংশ মানুষের আস্থা থাকলেও ২০০৮ সালের পর থেকে বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেনের সময়ে তা কখনোই ২৫ শতাংশের উপরে ওঠেনি।

শুধু সরকারই নয়, পুরো সরকারব্যবস্থার উপরেই জনগণের আস্থা পড়ে গেছে। গত ৭ই এপ্রিল ‘পিউ রিসার্চ’এর প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয় যে, জনগণের ৫৬ শতাংশ মনে করছে না যে, তাদের রাষ্ট্র তাদের বড় সমস্যাগুলির সমাধান দিতে সক্ষম। শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের অধীনে প্রশাসনই নয়, উভয় দলের কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ এবং খোদ পার্লামেন্টের উপরেই জনগণের আস্থা পড়ে গেছে। মাত্র ২৬ শতাংশ জনগণের পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত নেবার উপরে আস্থা রয়েছে। শুধু তাই নয়; জনগণের ৭৬ শতাংশ মনে করছে না যে, মার্কিনীদের সক্ষমতা রয়েছে সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার। এছাড়াও জনগণ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকেও ভালো চোখে দেখছে না। ৪৬ শতাংশ জনগণ আশংকা করছে যে, আসন্ন বছরে অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হবে।

মার্কিন জনগণের রাষ্ট্রীয় ভিতগুলির উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটা যথেষ্টই গভীর। মার্কিন জনগণ এখন কোনকিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। মার্কিন থিঙ্কট্যাক ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর এক প্রতিবেদনে এটাকে ‘ট্রুথ ডেকে’ বা সত্যের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে সত্য এবং বিশ্লেষণের গুরুত্ব কমে গেছে। মানুষ বিভিন্ন বিশ্লেষণকে বিশ্বাস করতে পারছে না; যার ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে এবং সাধারণভাবে কোনটা সত্য, আর কোনটা সত্য নয়, সেটার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সেখানে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সরকারগুলি করোনা মহামারির সময়ে ভ্যাকসিনের নিরাপদ হবার ব্যাপারে যথেষ্টভাবে বললেও যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিনের ব্যাপারে অনাস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলির পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, মানুষ এখন প্রচলিত তথ্যের উৎসের উপরে নির্ভর না করে সোশাল মিডিয়ার উপরে নির্ভর করছে। এছাড়াও রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে মার্কিনীরা এখন প্রচন্ডভাবে বিভক্ত; যা কিনা তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কিছু সত্যের উপরে স্থির না থাকার কারণে রাষ্ট্রীয় যেকোন সমস্যা, তা কোভিড-১৯ হোক, দারিদ্র্য, অভিবাসন, জলবায়ুই হোক, সেগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হবে।

No comments:

Post a Comment