২৫শে মার্চ ২০২৩
গত জানুয়ারি মাসে ফরাসি সরকার পেনশন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেবার পর থেকে প্রতিবাদে দেশজুড়ে চলছে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ। শিক্ষক, ট্রেনচালক, তেলের রিফাইনারির কর্মীসহ বিভিন্ন সেক্টরের লক্ষ লক্ষ কর্মীরা কর্মবিরতি পালন করছে এবং নিয়মিতভাবে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। ২৪শে মার্চ নাগাদ ফ্রান্সের পরিচ্ছন্নকর্মীরা ১৯ দিন ধরে ধর্মঘটে রয়েছে। শহরের রাস্তাগুলিতে ময়লা আবর্জনার স্তূপের মাঝে ইঁদুরের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা; যার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন রোগজীবাণু ছড়াবার আশংকাও তৈরি হয়েছে। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’ বলছে যে, ৯ হাজার ৬’শ টনের বেশি আবর্জনা এখন প্যারিসের রাস্তাগুলিতে স্তূপীকৃত অবস্থায় রয়েছে। আর পরিচ্ছন্ন কর্মীদের শ্রমিক ইউনিয়ন বলছে যে, তারা ২৭শে মার্চের আগে ধর্মঘট প্রত্যাহার করবে না।
ফ্রান্সের জ্বালানি ডিপো এবং তেলের রিফাইনারিগুলিতে দুই সপ্তাহ ধরে চলছে ধর্মঘট। কর্মীরা উৎপাদন কমানো ছাড়াও সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটাতে চেষ্টা করছে। ২১শে মার্চ ফ্রান্সের দক্ষিণের জ্বালানি ডিপোতে ধর্মঘটকারী কর্মীদেরকে জোরপূর্বক কাজে ফেরত আনার চেষ্টা করলে কর্মীরা ডিপো অবরোধ করে। এতে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপরে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। ধর্মঘটে ফ্রান্সের দক্ষিণের প্রায় ৪০ শতাংশ পেট্রোল স্টেশনেই জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে বলে বলছে ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’। পুরো ফ্রান্সে ৮ শতাংশ পেট্রোল স্টেশনে জ্বালানি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সংকট মোকাবিলায় অনেক পেট্রোল স্টেশনেই গাড়িপ্রতি সর্বোচ্চ ৩০ লিটার পেট্রোল বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’ বলছে যে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর কথায়, এই পরিবর্তন ফ্রান্সের পেনশন ব্যবস্থাকে ধ্বসে পড়া থেকে বাঁচাবে এবং সরকারের খরচ কমাবে। অবসরের সময় দুই বছর বৃদ্ধি করে ৬৪ বছরে উন্নীত করার মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষ অতিরিক্ত দুই বছর কাজ করার পরেই পেনশন পাবার জন্যে যোগ্যতা অর্জন করবে। ম্যাক্রঁ সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করতে চাইছেন এবং সরকারের বাজেট ঘাটতিকে কমিয়ে ইইউএর টার্গেটের সাথে সমন্বয় করতে চাইছেন। পুরো ইউরোপের মাঝে ফ্রান্সে অবসরপ্রাপ্তরা অর্থনৈতিকভাবে সবচাইতে বেশি সচ্ছল। তবে এর জন্যে ‘ওইসিডি’র হিসেবে ফ্রান্সের জিডিপির সাড়ে ১৪ শতাংশ পেনশনের পিছনে খরচ করতে হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে তা মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ। পেনশনের খরচ মেটাতে গিয়ে ২০২৩ সালে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউরো ঘাটতির মাঝে পড়তে যাচ্ছে সরকার। ২০২৫ সালের মাঝে এটা আরও বেড়ে প্রায় ১১ বিলিয়ন ইউরো এবং ২০৩৫ সাল নাগাদ ২১ বিলিয়ন ইউরোতে ঠেকবে। ফ্রান্সের মানুষের গড় বয়স বাড়ার সাথেসাথে পেনশনের জন্যে অর্থায়ন করা কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। খরচ মেটাতে সরকার নতুন করে কর আরোপ বা সরকারি ঋণ বৃদ্ধি করতে চাইছে না। এর আগে ২০১৯ সালে ম্যাক্রঁর সরকার পরিবহণ খাতের পেনশন ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের চেষ্টা করলে পুরো ফ্রান্সজুড়ে পরিবহণ শ্রমিকরা রাস্তায় নেমেছিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণেই সেবার সরকার বেশিদূর এগুতে পারেনি।
২২শে মার্চ ম্যাক্রঁ ফরাসি টেলিভিশনে এক সাক্ষাতে বলেন যে, তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে আসবেন না; কারণ ফ্রান্সের জাতীয় স্বার্থের জন্যে সেটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। একইসাথে তিনি ফ্রান্সের বিক্ষোভকে ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারির যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের ‘ক্যাপিটল হিল’এর অরাজকতার সাথে তুলনা করেন। ‘হ্যারিস ইন্টারএকটিভ’এর ২২শে মার্চের জরিপে বলা হচ্ছে যে, ফ্রান্সের ৭০ শতাংশ জনগণ ম্যাক্রঁর এই বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এর আগে ৬ই মার্চ ‘এলাবি’র জরিপে বলা হয় যে, ৬৭ শতাংশ জনগণ সরকারের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। ম্যাক্রঁর বক্তব্যের পর ২৩শে মার্চ পুরো ফ্রান্স জুড়ে বিক্ষোভ হয়। ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, ফরাসি পুলিশের হিসেবে ১১ লক্ষ মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে; আর ফরাসি শ্রমিক ইউনিয়নগুলির হিসেবে প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। প্যারিসে ময়লার স্তূপে অগ্নিসংযোগ ছাড়াও সংঘর্ষে কমপক্ষে ৪’শ ৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৪’শ ৪১ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়। এর আগের ১১ই ও ১৫ই মার্চের বিক্ষোভ অপেক্ষাকৃত ছোট ছিল বলে অনেকেই সেটাকে ফরাসি সরকারের বিজয় বলে ধরে নিচ্ছিলো। কিন্তু নতুন করে সহিংস বিক্ষোভের পরে তার পুনরায় সরকারকে অস্থিরতার মাঝে ফেলেছে। ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে গত ১৯শে জানুয়ারি থেকে ২৩শে মার্চ পর্যন্ত মোট ৯টা বড় আকারের বিক্ষোভ হয়েছে, যেগুলিতে সাড়ে ৩ লক্ষ থেকে শুরু করে ১৩ লক্ষ মানুষ অংশ নিয়েছে।
ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন ফরাসি টেলিভিশনের এক সাক্ষাৎকারে বলছেন যে, সহিংসতার মাত্রা যথেষ্ট বেড়ে যাওয়ায় পুলিশকে একটা সীমা পর্যন্ত বলপ্রয়োগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল ফেবিয়েন রুসেল সাংবাদিকদের বলেন যে, ফরাসি সরকার সহিংসতা নিয়ে জুয়া খেলছে। মাত্র কয়েকদিনের মাঝেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ পরিণত হয়েছে পুলিশের লাঠিচার্জে। বিক্ষোভকারীরা বলছে যে, তারা শুধুমাত্র পেনশন ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়েই বিক্ষোভ করছে না; ফরাসি সরকার পার্লামেন্টকে বাইপাস করে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অগ্রসর হওয়াতে জনগণের আক্রোশ আরও বেড়ে গেছে। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পার্লামেন্টে পাস করাতে না পেরে গত ১৬ই মার্চ ম্যাক্রঁর সরকার ফরাসি সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৪৯’এর উপর ভিত্তি করে পার্লামেন্টকে বাইপাস করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে পেনশন ব্যবস্থার পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ফ্রান্সে বিক্ষোভকারীদের অনেকেই মনে করছেন যে, সরকারের পেনশন ব্যবস্থা পরিবর্তনেও সমস্যার সমাধান হবে না। বরং ফ্রান্সের সামাজিক সুরক্ষা মডেলের দিনই এখন প্রায় শেষের পথে। এর মাধ্যমে ফ্রান্সে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার দ্রুত নিম্নগামী হচ্ছে। একইসাথে আইনপ্রনয়ণের প্রক্রিয়াও অল্প কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, ২১শে মার্চ ফ্রান্সের পার্লামেন্টে ম্যাক্রঁর বিরুদ্ধে পরপর দু’টা অনাস্থা প্রস্তাব ভেস্তে গেলে বিরোধী রাজনীতিবিদদের কাছে প্লাকার্ড তুলে প্রতিবাদ করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। কারণ ৭০ শতাংশ জনগণ বিপক্ষে থাকলেও এখন সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৪৯’ বলে সরকার পেনশন ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে আইন তৈরি করতে পারবে। প্যারিসের আবর্জনার স্তূপের মাঝেই ফ্রান্সের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের অনাস্থা এবং ফ্রেঞ্চ রিপাবলিকের ভিত্তিতে পচনের প্রমাণ পাওয়া গেলেও এর সমাধান কারুর কাছেই নেই।
No comments:
Post a Comment