Saturday 8 April 2023

ভারত কেন ভূটানকে নিয়ে চিন্তিত?

০৮ই এপ্রিল ২০২৩

দিল্লী, মে ২০১৯। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ভূটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে যখন বলা হচ্ছে যে, ভূটানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ভারতে পড়াশোনা না করার ফলে ভূটানের উপরে ভারতের প্রভাব কমছে, তখন হয়তো প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এবং তার কাছের লোকদের কথাই বলা হয়েছে, যারা অনেকেই বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেছেন এবং বাংলায় কথা বলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ যে এখন ভারতের একার হাতে নেই, সেটা এখন পরিষ্কার।

এপ্রিলের শুরুতেই ভূটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ভারত সফরে গিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে সাক্ষাতের পর দুই দেশের পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিতে বেশকিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতার ঘোষণা দেয়া হয়; যার মাঝে রয়েছে লাইন অব ক্রেডিটের মাধ্যমে ঋণের ব্যবস্থা। ভূটানের সানকোস এবং পুনাতসাংছু পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পে ভারতের অংশগ্রহণের ব্যাপারে আশ্বাস দেয়া হয়। ১৯৮০এর দশকে ভারতের ঋণে তৈরি ভূটানের ৩’শ ৩৬ মেগাওয়াটের ছুখা পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ভারতের বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটাও ভারত সরকার চিন্তা করবে বলে বলা হয়। এছাড়াও ৬৪ মেগাওয়াটের বাসোছু পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ভারত বিদ্যুৎ আমদানিতে রাজি হয়েছে। ভারতের কোকরাঝর থেকে ভূটানের গেলেফু পর্যন্ত সাড়ে ৫৭ কিঃমিঃ দৈর্ঘ্যের রেললাইন নির্মাণ, দুই দেশের মাঝে সড়কপথের বাণিজ্যের জন্যে জয়গাঁওএ নতুন চেকপয়েন্ট নির্মাণ এবং তৃতীয় দেশের অতিথিদের জন্যে চেকপয়েন্ট নির্মাণ প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ভবিষ্যতে ভূটানকে মহাকাশ গবেষণা, শিক্ষা, ইন্টারনেট, ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাসও ভারতের পক্ষ থেকে দেয়া হয়। এই প্রকল্পগুলিকে ভূটানের রাজার ‘ট্রান্সফর্ম ইনিশিয়েটিভ’এর অংশ হিসেবে বলা হচ্ছে।

ভারতের ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে, ভূটানে যখন যুবসমাজের মাঝে বেকারত্বের হার ২১ শতাংশে পৌঁছেছে, তখন ভারতের নিঃসন্দেহে সেখানে কিছু করার রয়েছে। একসময় ভূটানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ভারতে শিক্ষা নিতো। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসার কারণে ভূটানের নীতি নির্ধারণ এবং সরকারি সিদ্ধান্তের উপর ভারতের প্রভাব কমতে বসেছে। এক্ষেত্রে ভূটানে ভারত সরকারের নতুন প্রকল্পগুলি ভারতের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে।

কিন্তু ভূটান এবং ভারতের এতো কাছের সম্পর্কের মাঝেও সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সাথে ভূটানের সীমান্ত নিয়ে ভূটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংএর মন্তব্য ভারতীয়দের বিচলিত করেছে। গত ২৫শে মার্চ বেলজিয়ামের মিডিয়া ‘লা লিব্রে বেলজিক’এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, তার সরকার শীঘ্রই চীনের সাথে সীমান্ত সমস্যার সমাধান করবে। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, ভূটানের ভেতর চীনা গ্রাম তৈরির ভারতীয় দাবির কোন ভিত্তি নেই। ভারতীয়রা চিন্তিত যে, চীনারা ভূটানের সাথে যখন সীমান্ত সমস্যা সমাধানের কথা বলছে, তার মাঝে তারা দোকলাম নিয়েও কথা বলছে। ২০১৭ সালে দোকলাম সীমান্তে ভারতের সাথে চীনের সামরিক দ্বন্দ্ব হয়েছিল। এই এলাকাটা তিন দেশের সীমান্তের সংযোগ এবং ভারতের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর বা ‘চিকেন নেক’এর খুবই কাছে। এই করিডোরের মাধ্যমেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটা রাজ্যের সাথে ভারতের মূল ভূখন্ডের স্থলযোগাযোগ রক্ষা করা হয়। সরু এই ‘চিকেন নেক’এর উত্তরে ভূটান ও চীন এবং দক্ষিণে বাংলাদেশ।

ভারত সরকার বলছে যে, চীনারা দোকলামে তিন দেশের সীমান্তকে ‘বাটাং লা’ এলাকার ৭ কিঃমিঃ দক্ষিণে ‘মাউন্ট গিপমোচি’ নামক এলাকায় নিয়ে আসতে চায়। এতে পুরো দোকলাম মালভূমি আইনগতভাবে চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। দোকলামের নিয়ন্ত্রণ চীনের কাছে চলে যাবার অর্থ হলো চীনারা ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ বা ‘চিকেন নেক’এর আরও কাছে চলে আসবে।

যদিও ভূটানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, দোকলামের ব্যাপারে যেকোন সমঝোতাতে তিন দেশের স্বার্থকেই দেখা হবে, তথাপি ভারতীয়রা এব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। ভূটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বলেছেন যে, দোকলাম ইস্যু সমাধানে তিন দেশেরই ‘সমান অধিকার’ রয়েছে। ভারতীয় পত্রিকা ‘হিন্দুস্থান টাইমস’ বলছে যে, ভূটানের প্রধানমন্ত্রীর এই কথাগুলি ভূটানের নীতির পরিবর্তন। কারণ এর আগে ভূটানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, তিন দেশের সীমান্তে সবারই যেকোন পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকা উচিৎ। ভারত সরকার বলছে যে, চীনারা দোকলামে তিন দেশের সীমান্তকে ‘বাটাং লা’ এলাকার ৭ কিঃমিঃ দক্ষিণে ‘মাউন্ট গিপমোচি’ নামক এলাকায় নিয়ে আসতে চায়। এতে পুরো দোকলাম মালভূমি আইনগতভাবে চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। দিল্লী চীনের এই পরিকল্পনার ঘোর বিরোধী। ভারত বলছে যে, চীনারা বেআইনীভাবে দোকলাম দখল করে রেখেছে। দোকলামের নিয়ন্ত্রণ চীনের কাছে চলে যাবার অর্থ হলো চীনারা ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ বা ‘চিকেন নেক’এর আরও কাছে চলে আসবে। তবে ভূটানের প্রধানমন্ত্রী ‘দ্যা ভূটানিজ’ পত্রিকাকে বলেছেন যে, বেলজিয়ান পত্রিকায় তার মন্তব্য নতুন কিছু নয়। কারণ সীমান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে ভূটানের নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা ৪ঠা এপ্রিল সাংবাদিকদের বলেন যে, ভারতের স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত যেকোন ব্যাপারেই ভারত খবর রাখে এবং প্রয়োজনমতো ভারত তার নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে যেকোন পদক্ষেপ নেবে। তিনি আরও বলেন যে, ভূটানের সাথে ভারতের ঐতিহাসিক নিরাপত্তা সহযোগিতা রয়েছে। একারণেই উভয় দেশ তাদের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সর্বদাই আলোচনা করে থাকে। তবে ভারতীয়দের মাঝে কেউ কেউ ভূটানের সাথে এগুনোর ক্ষেত্রে ধীরে চলার নীতিতে বিশ্বাসী। ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হচ্ছে যে, ভারতে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা যদি ভূটানের উপর বেশি চাপ প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে ভূটান দিল্লীর হাত থেকে ছুটে যেতে পারে।

ভারতীয় কলামিস্ট এবং ‘বিবিসি’র সাবেক সাংবাদিক আদিল ব্রার ভারতের ‘দ্যা প্রিন্ট’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, সীমান্ত আলোচনা নিয়ে চীনারা ভূটানের উপর চাপ সৃষ্টি করছে; এবং সেটা বিভিন্ন চীনা মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি চীনা বিশ্লেষকদের বক্তব্যগুলি তুলে ধরেন, যেখানে বলা হচ্ছে যে, ভূটানের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির উপর ভারতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে ভূটানের অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতির উপর ভারতের আধিপত্য রয়েছে। সেক্ষেত্রে ভূটানের প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলি চীনের জন্যে বিজয় এবং ভারতের জন্যে পরাজয়। একইসাথে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন যে, চীনের সাথে ভূটানের সীমান্ত আলোচনায় ভারত চাইছে ভূটানের হয়ে চীনের সাথে কথা বলতে।

অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তার দিক থেকে ভূটানের উপরে পুরোপুরি আধিপত্য থাকার পরেও ভূটানের ব্যাপারে ভারত চিন্তিত। আকারের দিক থেকে শক্তিশালী না হলেও ভূটান তার ভৌগোলিক অবস্থানকে ভূরাজনৈতিক দরকষাকষির মাঝে নিয়ে এসেছে। দোকলাম ইস্যুতে ভূটানের প্রধানমন্ত্রীর তিন দেশের ‘সমান অধিকার’এর পক্ষে বিবৃতি দিল্লীর চোখে ভারতের ‘চিকেন নেক’এর জন্যে প্রচ্ছন্ন হুমকির সৃষ্টি করেছে। ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে যখন বলা হচ্ছে যে, ভূটানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ভারতে পড়াশোনা না করার ফলে ভূটানের উপরে ভারতের প্রভাব কমছে, তখন হয়তো প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এবং তার কাছের লোকদের কথাই বলা হয়েছে, যারা অনেকেই বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেছেন এবং বাংলায় কথা বলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ যে এখন ভারতের একার হাতে নেই, সেটা এখন পরিষ্কার।

No comments:

Post a Comment