Saturday 28 May 2022

উত্তর আয়ারল্যান্ডের নির্বাচন – ব্রিটেনের ভৌগোলিক অখন্ডতার প্রতি চ্যালেঞ্জ?

২৯শে মে ২০২২

 
উত্তর আয়ারল্যান্ডের দেয়ালে জাতীয়তাবাদী গ্রাফিতির পাশে নির্বাচনী পোস্টার। পশ্চিমা দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের জোয়ারে উত্তর আয়ারল্যান্ডের ভোট যদি স্কটল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে অনুপ্রাণিত করে, তবে সেটাই ব্রিটেনের জন্যে বেশি দুশ্চিন্তার হবে। বিশেষ করে করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝে নিজেদের অর্থনৈতিক দৈন্যদশাই যখন বেশিরভাগ মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে মূল স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন ব্রিটেনের অখন্ডতা প্রশ্নাতীত থাকছে না।


ছোট্ট দেশ উত্তর আয়ারল্যান্ডের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়াতে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। ১৯২১ সালের মে মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সরকারের আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ব্রিটেনের অংশ হিসেবে উত্তর আয়ারল্যান্ডের জন্ম দেয়া হয়েছিল। সেই সময় থেকে ১’শ ১ বছর পর প্রথমবারের মতো দেশটার পার্লামেন্টে আইরিশ জাতীয়তাবাদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এতদিন পর্যন্ত সকল নির্বাচনেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে ‘ইউনিয়নিস্ট’ দলগুলি; যাদের মূল চিন্তা হলো ব্রিটেনের সাথে যুক্ত থাকা। বহু বছর ধরে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রামে লিপ্ত থাকা ‘আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি’র রাজনৈতিক মুখপাত্র ‘সিন ফেইন’ ২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ ২৭টা আসন পেয়েছে। মাত্র ১৯ লক্ষ জনসংখ্যার এই দেশের নির্বাচন ভূরাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ একদিকে উত্তর আয়ারল্যান্ড যেমন ব্রিটেনের একটা অংশ, অপরদিকে আইরিশ জাতীয়তাবাদীরা বহুদিন থেকে উত্তর আয়ারল্যান্ডকে ব্রিটেন থেকে আলাদা করে রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডের সাথে একত্রীকরণের পক্ষপাতি। অর্থাৎ উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজনীতি ব্রিটেনের ভৌগোলিক অখন্ডতার সাথে সম্পর্কিত।

নির্বাচনে ২১ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ‘ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টি’ বা ‘ডিইউপি’; যারা পেয়েছে ২৫টা আসন। ‘আলস্টার ইউনিয়নিস্ট পার্টি’ বা ‘ইউইউপি’ পেয়েছে ৯টা আসন। বাকিরা পেয়েছে ২৯টা আসন। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, উত্তর আয়ারল্যান্ডের ক্ষমতা ভাগাভাগির ফর্মূলা অনুযায়ী দেশটার সরকারের শীর্ষ নেতা ‘ফার্স্ট মিনিস্টার’ এবং ‘ডেপুটি ফার্স্ট মিনিস্টার’ আসবে জাতীয়তাবাদী এবং সবচাইতে বড় ‘ইউনিয়নিস্ট’ দল থেকে। বাকি মন্ত্রীরা আসবে নির্বাচনে বেশি আসন পাওয়া দলগুলি থেকে। শীর্ষ দু’টা পদের নাম আলাদা হলেও এদের কাজ একই; এবং এদের একজন পদত্যাগ করলে আরেকজন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী ‘সিন ফেইন’ দলের কাউকে যদি সরকার প্রধান হতে হয়, তাহলে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইউনিয়নিস্ট দলের কাউকে ‘ডেপুটি’র পদটা মেনে নিতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ‘ডিইউপি’ দলের প্রধান জেফরি ডোনাল্ডসন বলে দিয়েছেন যে, ব্রেক্সিটের পর থেকে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বাণিজ্য যেভাবে চলছে, সেটা তার দলের মনপূতঃ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ‘ডেপুটি’র পদ সমর্থন করবেন না। ‘নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড প্রোটোকল’ নামের পরিচিত এই বাণিজ্য ব্যবস্থা ‘ডিইউপি’ সমর্থন করে না।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রোটকলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই ‘ডিইউপি’র সদস্য পল গিভান ‘ফার্স্ট মিনিস্টার’এর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ইউনিয়নিস্টরা মনে করে যে, এই প্রটোকলের মাধ্যমে উত্তর আয়াল্যান্ডকে আলাদা করে দেখা হচ্ছে এবং এতে ব্রিটেনের অংশ হিসেবে উত্তর আয়ারল্যান্ডের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে। ‘ডিইউপি’ যদি ‘ডেপুটি’ পদে লোক না দেয়, তাহলে এই সমস্যা ৬ মাস পর্যন্ত চলতে পারে। বিরোধ তখনও চলতে থাকলে নির্বাচন দিতে হতে পারে; অথবা ব্রিটিশ সরকারের উত্তর আয়ারল্যান্ড সচিবকে নতুন কোন পদ্ধতি বের করতে হবে। উত্তর আয়ারল্যান্ডের সাথে ব্রিটেনের বাকি অংশের বাণিজ্য যে নীতিতে চলছে, তার মাঝে কিছু আইন ব্রিটেন একতরফাভাবে বাতিল করতে পারে বলে জানিয়েছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার অনেক বড় ঝুঁকি নিতে চলেছে; কারণ এর মাধ্যমে ব্রিটেন আবারও ইইউএর সাথে দ্বন্দ্বে জড়াতে পারে।

১৯৯৮ সালের ‘গুড ফ্রাইডে এগ্রিমেন্ট’এর মাধ্যমে উত্তর আয়ারল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ শেষ হয় এবং ‘আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি’র সদস্যরা অস্ত্র ফেলে পার্লামেন্টে এসে বসে। তবে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় জাতীয়তাবাদীরা কখনোই দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক পদটা পায়নি। দেশটার রাজনৈতিক বিভেদের মাঝে জাতিগত এবং ধর্মীয় ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর আয়ারল্যান্ডের ক্যাথোলিক খ্রিস্টানদের বেশিরভাগই নিজেদেরকে আইরিশ বলে আখ্যা দেয়; অপরদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের বেশিরভাগই নিজেদেরকে ব্রিটিশ বলে আখ্যা দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে, স্বাধীন দেশ রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের অংশ নয়; এবং সেখানে বেশিরভাগ জনগণই হলো ক্যাথোলিক খ্রিস্টান। ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটেনের প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানরা উত্তর আয়ারল্যান্ডে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে সেখানে ব্রিটেনের শাসনকে মজবুত করেছে। বর্তমানে দেশটার প্রোটেস্ট্যান্ট জনগণ সেই বসতি স্থাপনকারীদেরই বংশধর।

 
ব্রেক্সিটের ভোটে ব্রিটেনের একেক অংশের ফলাফল ছিল একেক রকম। ইইউ থেকে বের হয়ে যাবার ব্যাপারে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসএর জনগণ যতটা উৎসুক ছিল, স্কটিশ এবং আইরিশরা ততটা ছিল না। এখন ব্রেক্সিটের পর তারা মনে করছে যে, ব্রিটেনের সাথে একত্রে থাকাটা তাদের জন্যে কোন অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনছে না।

‘সিন ফেইন’ বলছে যে, তারা আয়ারল্যান্ডের একত্রীকরণের ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর। দলটার নেতা লু ম্যাকডোনাল্ড বলছেন যে, পাঁচ বছরের মাঝে তারা আয়ারল্যান্ডের একত্রীকরণের জন্যে গণভোটের ডাক দেবেন। অপরদিকে ইউনিয়নিস্টরা বলছে যে, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে জাতীয়তাবাদীরা কম ভোট পেয়েছে; তাই গণভোটের প্রশ্নই আসে না। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২৮শে মে প্রায় ১০ হাজার ইউনিয়নিস্ট উত্তর আয়ারল্যান্ডের শতবর্ষ উদযাপন করে। অনুষ্ঠানে ‘অরেঞ্জ অর্ডার’এর গ্র্যান্ড মাস্টার এডওয়ার্ড স্টিভেনসন ঘোষণা দেন যে, উত্তর আয়ারল্যান্ড সবসময় ব্রিটেনের অংশই থাকবে।

ব্রেক্সিটের মাধ্যমে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাকে এগিয়ে নেবার যে স্বপ্ন ব্রিটেন দেখেছে, সেখানে একটা শক্ত কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে জাতীয়তাবাদ। কারণ উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিচ্ছন্নতাবাদীরা এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও স্কটল্যান্ড কিন্তু ২০১৪ সালে ব্রিটেন থেকে আলাদা হবার জন্যে গণভোটের আয়োজন করেছে; যেখানে ৪৫ শতাংশ জনগণ স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ব্রেক্সিটের পক্ষে বিপক্ষে ভোটই বলে দিয়েছে যে, স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড বাকি ব্রিটেনের থেকে ভিন্নভাবে চিন্তা করছে। অর্থাৎ ইইউ থেকে বের হয়ে যাবার ব্যাপারে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসএর জনগণ যতটা উৎসুক ছিল, স্কটিশ এবং আইরিশরা ততটা ছিল না। এখন ব্রেক্সিটের পর তারা মনে করছে যে, ব্রিটেনের সাথে একত্রে থাকাটা তাদের জন্যে কোন অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনছে না।

ব্রিটেনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে ইউরোপের মূল ভূখন্ডের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলি গত কয়েক’শ বছরে বিভিন্ন সময়ে আইরিশ ক্যাথোলিকদেরকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। সেই হিসেবে আয়ারল্যান্ড সর্বদাই ব্রিটেনের অস্তিত্বের প্রতি একটা হমকি হয়ে কাজ করেছে। আইরিশ দ্বীপে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার জন্যেই ব্রিটেন উত্তর আয়ারল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। একুশ শতকেও সেই ইতিহাসই বয়ে বেড়াচ্ছে উত্তর আয়ারল্যান্ড। তবে পশ্চিমা দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদের জোয়ারে উত্তর আয়ারল্যান্ডের ভোট যদি স্কটল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরকে অনুপ্রাণিত করে, তবে সেটাই ব্রিটেনের জন্যে বেশি দুশ্চিন্তার হবে। বিশেষ করে করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝে নিজেদের অর্থনৈতিক দৈন্যদশাই যখন বেশিরভাগ মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে মূল স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন ব্রিটেনের অখন্ডতা প্রশ্নাতীত থাকছে না।

No comments:

Post a Comment