Wednesday 4 May 2022

মিশর … নিয়ন্ত্রিত স্থিতিশীলতা কতদিন?

০৪ঠা মে ২০২২

২রা মে ২০২২। কায়রোতে ঈদের জামাত। সবশেষে ঈদের দিন খোলা জায়গায় ঈদের নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়। এর ফলে ঈদের জামাতে লাখো মুসল্লির জমায়েত হয়। মার্কিন সরকার এবং কংগ্রেস এল সিসির সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে ইচ্ছুক বলেই মার্কিন ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিবেদনে মিশরের অবস্থান খুব খারাপ অবস্থানে নয়; যদিওবা মানবাধিকার সংস্থাগুলি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করছে। ভূকৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে জনবহূল দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মিশরের সরকার জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতার বিনিময়ে আপাততঃ ধরে রেখেছে; যা কিনা মার্কিন সরকারের কাছে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

 
এবারের ঈদুল ফিতর উদযাপন মিশরে অন্যান্য অনেক দেশের মতোই ছিল না। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণকে উল্লেখ করে মিশরের সরকার ধর্মীয় উপাসনার ক্ষেত্রে বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই এই বিধিনিষেধগুলি আসতে থাকে। রমজান মাসে মসজিদে রাত্রিকালীন তারাবির নামাজ আদায় করাটা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার নামাজ ৩০ মিনিটের মাঝে সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছিল। এরপর রমজানের শেষ ১০ দিনে রাতের বেলায় মসজিদে তাহাজ্জুদ নামাজ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর ঈদের নামাজের ব্যাপারে আসে সর্বোচ্চ কড়াকড়ি। খোলা ময়দানে ঈদের জামাত নিষিদ্ধ করা ছাড়াও শুধুমাত্র সরকারের অনুমোদিত কিছু মসজিদে ঈদের জামাত আদায় করার নির্দেশনা দেয়া হয়। তদুপরি নামাজের খুতবাতে কি থাকবে, সেটাও সরকার ঠিক করে দেবে বলে বলা হয়। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘মিডলইস্ট আই’ বলছে যে, মিশরে এই মুহুর্তে করোভাইরাসের সংক্রমণ তেমন কিছু নয়। আর উপাসনা বাদে কনসার্ট ও ফুটবল খেলা এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানসহ সকল ক্ষেত্রেই সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ সরকার অনুমোদিত মসজিদের ইমামরা তাদের যার যার মসজিদের দরজায় তালা দিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি ছবি তুলে সোশাল মিডিয়াতে পোস্ট করছে। এই ব্যাপারগুলি মিশরে ব্যাপক জনরোষের সৃষ্টি করে। বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা সরকার এই বিধিনিষেধগুলি দিচ্ছে বড় কোন জনসমাবেশ এড়াবার উদ্দেশ্যে; কারণ সরকার হয়তো ভাবছে যে, ধর্মীয় উপাসনাকে কেন্দ্র করে গণজমায়েত অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে পুঁজি করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ দিতে পারে।

ব্যাপক জনরোষের ফলস্বরূপ সরকার রমজানের শেষ তিন রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়েছিল; সেটাও আবার স্বল্প সংখ্যক সরকারি অনুমোদিত মসজিদে। ২৭শে এপ্রিল ‘এরাব নিউজ’ বলছে যে, প্রথমে সরকার বলেছিল যে, মাত্র ১০ মিনিটের মাঝেই নামাজ শেষ করতে হবে। এরপর সেই বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করে সরকারি বার্তায় বলা হয় যে, নামাজের ৩০ মিনিট আগে মসজিদ খোলার সময় দেয়া হয়েছে। আর সবশেষে ঈদের দিন খোলা জায়গায় ঈদের নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়। এর ফলে ঈদের জামাতে লাখো মুসল্লির জমায়েত হয়।

২০১৩ সালে আব্দেল ফাত্তাহ এল সিসিএর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিশরে সরকার বিরোধী জনসমাবেশ একপ্রকার নিষিদ্ধ রয়েছে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে মিশরের ইতিহাসের সবচাইতে বড় সরকার বিরোধী জনসমাবেশ আয়োজিত হয়েছিল মসজিদগুলিতে জুমআর নামাজের পর। একজন প্রাক্তন সরকার নিযুক্ত ইমাম এসাম তেলাইমা ‘মিডলইস্ট আই’কে বলছেন যে, মিশরের সরকার যেকোন জনসমাবেশের ব্যাপারে মারাত্মক শঙ্কিত থাকে। এটা অদ্ভূত যে সরকার সমজিদের ভিতরে ঈদের নামাজ পড়তে বিধিনিষেধ দেয়নি; কিন্তু খোলা যায়গায় নামাজ পড়তে নিষেধ করেছে। অথচ করোনাভাইরাসের কথাই যদি বলা হয়, তাহলে তো খোলা স্থানে নামাজ পড়াটাই বেশি উপযুক্ত হবার কথা ছিল।

মসজিদ ব্যাতীত করোনার বিধিনিষেধ কি অবস্থায় রয়েছে, সেটার বর্ণনা দিয়েছে ‘গালফ নিউজ’। তারা বলছে যে, মিশরে এখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ একেবারেই নেই। এজন্যেই দুই বছরের মাঝে এবারের ঈদের আমেজ অনেক বেশি। বিশেষ করে মিশরের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘খাক’ তৈরি করা বেকারি দোকানগুলি খুব ব্যস্ত রয়েছে। করোনার বিধিনিষেধগুলি তুলে নেয়ার পর থেকে দোকানগুলিতে উপচে পড়া ভীড় হচ্ছে। দোকান এবং রেস্টুরেন্টগুলিকে রাত ২টা পর্যন্ত খোলা রাখা অনুমতি দেয়া হয়েছে। রমজানের মাঝে রাস্তায় দান করার কর্মসূচীগুলিকেও সরকার অনুমোদন দিয়েছে। গত মার্চ মাস থেকেই করোনার বিধিনিষেধগুলি সরকার উঠিয়ে নিতে থাকে। এপ্রিল মাস পর্যন্ত মিশরে ৩ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষকে করোনার সম্পূর্ণ টিকা দেয়া হয়েছে; এর মাঝে ২০ লক্ষাধিক মানুষকে বুস্টার টিকা দেয়া হয়েছে।

মার্কিন ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’এর এক লেখায় মিশরের সরকারের রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়তে দেয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়। কারণ এর আগের দুই বছর করোনার কারণে মসজিদে তারাবির নামাজ পড়তেই দেয়া হয়নি। ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’এর ২০২২ সালের প্রতিবেদনে মিশরের বর্তমান ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সবচাইতে খারাপ ১৫টা দেশের মাঝে রাখা হয়নি; যেখানে চীন এবং পাকিস্তানের নাম রয়েছে। তবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খারাপ অবস্থানে থাকা ১২টা দেশের মাঝে মিশরের নাম রাখা হয়। এই প্রতিবেদনে মূলতঃ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কথাই উল্লিখিত হয়েছে। অর্থাৎ মিশরের মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশে সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের চাইতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারের ব্যাপারটা একেবারেই অবহেলিত রয়েছে। তবে পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মিশরে কোথায় এবং কখন নামাজ পড়তে হবে, তা নির্দিষ্ট করে দিয়ে দেশটার সরকার মানুষের ধর্মীয় অধিকারের উপর অগ্রহণযোগ্য বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। প্রতিবেদনে মিশরের সরকারের এহেন বিধিনিষেধকে বাকস্বাধীনতা হননের আরেকটা পদ্ধতি বলে উল্লেখ করা হয়। ২১শে এপ্রিল নামাজের সময়ের ব্যাপারে সোশাল মিডিয়ায় এক ভিডিওতে সমালোচনা করার অপরাধে সাফা আল কোরবিজি নামের এক মহিলা সাংবাদিককে আইন শৃংখলা বাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে তার বিরুদ্ধে ভুয়া খবর রটানোর অভিযোগ দায়ের করে।

কনসার্ট, ফুটবল খেলা এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ উঠে গেলেও তারাবি, তাহাজ্জুদ এবং ঈদের নামাজ পড়ার ব্যাপারে মিশর সরকারের বিধিনিষেধ আরোপ এল সিসির সামরিক সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে দুশ্চিন্তাকেই তুলে ধরে। অন্ততঃ ২০১১ সালের আরব বসন্তের মতো আরেকটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সরকার এড়াতে চাইছে। কিন্তু দেশটার অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গমের সরবরাহে ঘাটতি ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এল সিসির অবস্থানকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে। মার্কিন সরকার এবং কংগ্রেস এল সিসির সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে ইচ্ছুক বলেই মার্কিন ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিবেদনে মিশরের অবস্থান খুব খারাপ অবস্থানে নয়; যদিওবা মানবাধিকার সংস্থাগুলি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করছে। ভূকৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে জনবহূল দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মিশরের সরকার জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতার বিনিময়ে আপাততঃ ধরে রেখেছে; যা কিনা মার্কিন সরকারের কাছে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

No comments:

Post a Comment