Saturday 14 May 2022

ইথিওপিয়ায় হঠাৎ যুদ্ধবিরতির কারণ কি?

১৫ই মে ২০২২
যুদ্ধবিরতির পর জাতিসংঘের ট্রাকগুলি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে তিগ্রে অঞ্চলে পৌঁছাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলি যখন ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত, তখন ইথিওপিয়ার সরকারের ‘মানবিক’ যুদ্ধবিরতি অনেকেই পছন্দ করছে।  ড্রোন ব্যবহারে ইথিওপিয়া সরকার যখন যুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তখনই ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক চাপই ইথিওপিয়ার সরকারকে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।

 
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ঠিক একমাস পর ২৪শে মার্চ ইথিওপিয়ার সরকার দেশটার উত্তরের তিগ্রে অঞ্চলের নেতৃত্বের সাথে চলা ১৭ মাসের গৃহযুদ্ধে সকলকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ করেই একতরফাভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। সরকার বলে যে, এই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে মানবিক সহায়তা যাবার একটা সুযোগ করে দেবে। এর চার দিন পর তিগ্রে অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ‘টিপিএলএফ’ এই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার পক্ষে বিবৃতি দেয়। একইসাথে তারা বলে যে, তারা শান্তিচুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী, তবে খুব বেশি একটা নয়। ২৫শে এপ্রিল তিগ্রে বিদ্রোহীরা আফার অঞ্চল থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়; যা কিনা ইথিওপিয়ার সরকার তিগ্রে অঞ্চলে মানবিক সহায়তা যেতে দেবার জন্যে শর্ত হিসেবে দেখছিল।

৫ই মে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফানে দুজাররিক সাংবাদিকদের বলেন যে, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে চার দফায় সড়কপথে ১’শ ৬৯টা ট্রাকে করে মোট ৪ হাজার ৩’শ টন দ্রব্য সেখানে পরিবহণ করা সম্ভব হয়েছে। তথাপি এই ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। আর বিশেষ করে ইথিওপিয় সরকার তিগ্রে অঞ্চলে বিদ্যুৎ, টেলিকম এবং ব্যাংকিং সেবা বন্ধ করে দেয়ায় সেখানে যেকোন কিছু করাই কঠিন হয়ে গেছে। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ‘ডব্লিউএফপি’র হিসেবে তিগ্রে অঞ্চলে দিনে ১’শ ট্রাক মালামাল নেয়া প্রয়োজন; আর পরিবহণ চালিয়ে নেয়ার জন্যে সপ্তাহে ২ লক্ষ লিটার জ্বালানি তেলের প্রয়োজন। জানুয়ারি মাস থেকে মার্চের শেষ পর্যন্ত আকাশপথে তিগ্রে অঞ্চলে মোট ৪’শ ২৮ মেট্রিক টন খাদ্য পাঠানো গেছে; যা কিনা মাত্র ১১ ট্রাকের সমপরিমাণ!

অনেকেই বলছেন যে, তিগ্রে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়েছে ড্রোন। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কেউ স্বীকার না করলেও ইথিওপিয়া সরকারকে তুরস্ক, ইরান, চীন এবং সম্ভবতঃ আরব আমিরাত মনুষ্যবিহীন ড্রোন সরবরাহ করেছে। ব্রাসেলস ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ বা ‘আইসিজি’র এক বিশ্লেষণে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হচ্ছে যে, ২০২১এর জুনে তিগ্রেরা সরকারি বাহিনীকে তাদের অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করে। এরপর তারা তিগ্রে অঞ্চল থেকে বের হয়ে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার মাত্র ১’শ কিঃমিঃএর মাঝে পৌঁছে যায়। তবে সরকারি বাহিনী বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা ড্রোন ব্যবহার শুরুর পর থেকে তিগ্রে বাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয়। অপরদিকে তিগ্রে অঞ্চলের পক্ষে শক্তিশালী কোন দেশ দেশ অবস্থান না নেয়ায় এবং তিগ্রেদের সাথে যোগ দেয়া অরোমো অঞ্চলের গেরিলারা খুব একটা শক্তিশালী ভূমিকা না রাখতে পারায় তিগ্রেদের জয়লাভের আশা স্তিমিত হয়ে যায়। ২০২১এর ২২শে ডিসেম্বর ইথিওপিয়ার সরকার ঘোষণা দেয় যে, সরকারি বাহিনী তিগ্রে অঞ্চলের ভেতরে আর ঢুকবে না।

 
তিগ্রের পশ্চিমাঞ্চল এখন এরিত্রিয়া সমর্থিত আমহারাদের দখলে; যার ফলে তিগ্রেরা সুদানের সাথে সরাসরি স্থলযোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন। সরকারের শর্তের বেড়াজালে পড়ে তিগ্রেরা যদি সামনের দিনগুলিতে সুদানের সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে পশ্চিমাঞ্চল দখল করতে চায়, তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।

‘আইসিজি’ বলছে যে, ইথিওপিয়ার অর্থনীতি হয়তো যুদ্ধবিরতির পিছনে ভূমিকা রেখেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই দেশটার মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৩ শতাংশ। দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে খরা, ঋণ পরিশোধ করতে না পারা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে আইএমএফএর চাপ প্রয়োগ শুরু হয়েছে। অপরদিকে তিগ্রেরা চাইছে তাদের অঞ্চলের পশ্চিমাংশ ফেরত পেতে, যা কিনা যুদ্ধের শুরুতেই পার্শ্ববর্তী দেশ এরিত্রিয়ার সহায়তায় আমহারা অঞ্চলের মিলিশিয়ারা দখল করে নেয় এবং ৭ লক্ষ তিগ্রেকে জোরপূর্বক ঘরছাড়া করে। এর ফলে তিগ্রেরা তাদের প্রতি সদাচরণ করা সুদানের সীমানার সাথে যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে সীমান্ত শহর হুমেরা দখল করে রাখার মাধ্যমে এরিত্রিয়া এবং আমহারা তিগ্রে অঞ্চলকে বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং যেকোন ত্রাণের জন্যে তিগ্রেকে ইথিওপিয়া সরকারের মর্জির উপর নির্ভরশীল করে। এখন ইথিওপিয়া সরকার সেই ত্রাণের বিনিময়ে তিগ্রেদের কাছ থেকে অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চাইছে। তিগ্রের পশ্চিমাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব খুব সহজেই চলে যাচ্ছে না। সরকারের শর্তের বেড়াজালে পড়ে তিগ্রেরা যদি সামনের দিনগুলিতে সুদানের সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে পশ্চিমাঞ্চল দখল করতে চায়, তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।

ইথিওপিয়া সরকারের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার একমাস পর এবং তিগ্রে বাহিনীর আফার অঞ্চল ত্যাগ করার চার দিন পর ২৯শে এপ্রিল মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন এক বার্তায় ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট আবি আহমেদের সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন যে, ইথিওপিয়া সরকারের অনেকগুলি পদক্ষেপের কারণে যুদ্ধ শেষ হবার একটা আশা তৈরি হয়েছে; যেগুলির মাঝে রয়েছে জরুরি অবস্থা তুলে নেয়া, কিছু রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেয়া, এবং একটা যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করা। একইসাথে তিনি তিগ্রেদের প্রশংসা করেন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার জন্যে এবং আফার অঞ্চল থেকে সেনা সরিয়ে নেয়ার জন্যে। সবশেষে তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র একটা একত্রিত সার্বভৌম ইথিওপিয়া চায়, যেখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাঝে সকলকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যাতে করে দেশটার বিভাজনগুলি কাটিয়ে ওঠা যায়।

যুদ্ধবিরতি পুরোপুরিভাবে কার্যকর করাটা যে খুব একটা সহজ নয়, তার প্রমাণ মিলে খুব দ্রুতই। ব্লিনকেনের বিবৃতির দিনই ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, আমহারা অঞ্চলে অরোমিয়ার সাথে সীমান্তে কিছু সশস্ত্র গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, শেওয়া রাবিত শহরে দুই গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষ হয়েছে। তবে এতে কোন গ্রুপগুলি জড়িত ছিল, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে; কারণ একপক্ষ অপর পক্ষকে দোষারোপ করছে।

পশ্চিমা দেশগুলি যখন ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত, তখন ইথিওপিয়ার সরকারের ‘মানবিক’ যুদ্ধবিরতি অনেকেই পছন্দ করছে। অন্ততঃ মার্কিন সরকারের কাছে ইথিওপিয়া সরকারের পক্ষ নেয়াটা অনেক সহজ হয়েছে; যেখানে ওয়াশিংটনের পছন্দের নোবেল বিজয়ী আবি আহমেদের সরকারের ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবরগুলি যুক্তরাষ্ট্রকে পীড়াদায়ক অবস্থান নিতে বাধ্য করেছে। ড্রোন ব্যবহারে ইথিওপিয়া সরকার যখন যুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তখনই ইউক্রেন যুদ্ধের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক চাপই ইথিওপিয়ার সরকারকে একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। তবে বলাই বাহুল্য যে, যুদ্ধবিরতি কোন শান্তি চুক্তি নয়; অস্থির আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির একটা প্রতিফলন মাত্র। দেশটার জাতিগত বিরোধগুলি যুদ্ধের মাঝে দগদগে ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে; যা মুছে ফেলা কঠিন। এই বিভেদগুলিই পূর্ব আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ ‘হর্ন’ অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার জ্বালানি হয়েছে।

2 comments:

  1. ধন্যবাদ আপনাকে। ইথিওপীয়ার যুদ্ধের শুরুটা ছোট করে জানিয়ে দিলে নতুনদের জন্য সুবিধা হতো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. You can read the earlier writings on Ethiopian civil war -

      https://koushol.blogspot.com/2020/11/ethiopia-succumbing-to-geopolitical-competition.html?m=1

      https://koushol.blogspot.com/2021/06/ethiopia-perfect-example-of-collapsed-world-order.html?m=1

      https://koushol.blogspot.com/2021/09/posterchild-democracy-abiy-ahmed-break-ethiopia.html?m=1

      https://koushol.blogspot.com/2022/01/what-change-of-us-policy-regarding-ethiopia-civil-war-means.html?m=1

      Delete