Sunday 8 May 2022

রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের স্বার্থের দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে আফ্রিকা

০৮ই মে ২০২২

আফ্রিকা-রাশিয়া বৈঠক; সচি, রাশিয়া। ২০১৯ সাল। আফ্রিকাতে রাশিয়াকে প্রতিস্থাপিত করে অন্য কোন শক্তি আসার ব্যাপারটা পশ্চিমাদের কাছে, তথা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভীতির কারণ। এমতাবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেও পশ্চিমারা আফ্রিকাতে রুশ অবস্থানকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। আফ্রিকাতে রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের মাঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও তা ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত; যা এখন পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।  

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, দুই মাসে ইউরোপে সূর্যমুখীসহ ভোজ্যতেলের মূল্য ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় অনেক দেশই নিজেদের মজুত নিশ্চিত করতে রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া সাম্প্রতিক সময়ে পাম তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের মূল্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্রাসেলস ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যদিও রাশিয়া থেকে খাদ্য আমদানিতে বাধা দেয়া হয়নি, তথাপি রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের কারণে রুশ বিক্রেতাদেরকে মূল্য পরিশোধ করা কঠিন হয়ে গেছে এবং জাহাজের ইন্সুর‍্যান্সও পাওয়া যাচ্ছে না। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউএনডিপির আফ্রিকা বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ রেইমন্ড গিলপিন ৬ই মে জেনেভায় এক সাংবাদিকদের বলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার উপর পশ্চিমাদের অবরোধের কারণে আফ্রিকা অভূতপূর্ব সংকটের মাঝে পড়েছে। করোনার লকডাউন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আফ্রিকা যখন মারাত্মক সমস্যায় পতিত ছিল, তখনই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য, সার ও জ্বালানির মূল্য মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বিশেষ করে আফ্রিকার তিনটা দেশের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে মূদ্রাস্ফীতির ফলাফল সবচাইতে বেশি পরিলক্ষিত হবে; যেগুলি হলো আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে এবং পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওন। আফ্রিকার অনেক দেশই খাদ্য এবং সারের জন্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের উপর নির্ভরশীল। এই দুই দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে গম, ভুট্টা, রাই সরিষা ও সূর্যমুখী তেলের প্রধান যোগানদাতা। আফ্রিকার কিছু দেশ তাদের দরকারের প্রায় ৮০ শতাংশ গম এই দুই দেশ থেকে আমদানি করে থাকে।

জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আহুন্না এজিয়াকোনওয়া বলছেন যে, এখন আফ্রিকার দেশগুলির জন্যে খাদ্য সরবরাহের রাতারাতি কোন বিকল্প নেই। গিলপিন বলছেন যে, পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল, মধ্য আফ্রিকা এবং পূর্ব আফ্রিকার ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলে সামাজিক সংঘাত চলছিল আরও আগে থেকেই; অর্থনৈতিক সমস্যা সেটাকে আরও ঘনীভূত করতে পারে। শহরাঞ্চলে স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে; সহিংস প্রতিবাদ এবং সংঘাতেও রূপ দিতে পারে। আর যে দেশগুলিতে ২০২২ এবং ২০২৩ সালে নির্বাচনের কথা রয়েছে, সেগুলি বিশেষভাবে বিপদের মাঝে রয়েছে। গত এপ্রিলে আইএমএফও বলেছে যে, মূল্যস্ফীতির কারণে আফ্রিকায় সামাজিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। এর আগে মার্চ মাসে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ‘ডব্লিউএফপি’র প্রধান ডেভিড বীসলি বলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাবের যে সমস্যা চলছিল, তা অভূতপূর্ব আকার ধারণ করতে পারে। তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বলেন যে, খাদ্য, জ্বালানি এবং পরিবহণ খরচের মারাত্মক বৃদ্ধির কারণে যারা না খেয়ে থাকছে, তাদের জন্যে আরও কম খাবার থাকবে।

 
আফ্রিকার অনেক দেশই খাদ্য এবং সারের জন্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের উপর নির্ভরশীল। এই দুই দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে গম, ভুট্টা, রাই সরিষা ও সূর্যমুখী তেলের প্রধান যোগানদাতা। আফ্রিকার কিছু দেশ তাদের দরকারের প্রায় ৮০ শতাংশ গম এই দুই দেশ থেকে আমদানি করে থাকে।

উত্তর আফ্রিকার সাথে রাশিয়া ও ইউক্রেনের বাণিজ্য

‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ বা ‘আইসিজি’ বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার কিছু দেশ সরাসরিই রাশিয়া পক্ষ নিয়েছে; আর বাকিরা রাশিয়া এবং পশ্চিম উভয়ের সাথেই সম্পর্ক রেখে চলার নীতিতে এগুচ্ছে। আর এরই মাঝে বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, পশ্চিমা দেশগুলি এখন তাদের নিজেদের এলাকা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকার দুর্ভিক্ষের কথা নিয়ে চিন্তা করার সময় এখন তাদের নেই। উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়া যুদ্ধরত দুই দেশ থেকে মাত্র ৩ শতাংশ গম আমদানি করে থাকে; কাজেই তারা কিছুটা হলেও স্বস্তিতে রয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের গমের মজুদ রয়েছে। আর জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে খাদ্য আমদানির উচ্চমূল্য তাদেরকে খুব বেশি সমস্যায় ফেলবে না। মরক্কোর ক্ষেত্রেও প্রায় একইরকম; কারণ দেশটার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ গম রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আসে। তবে মরক্কো তাদের ৪০ শতাংশ গম আমদানি করে; এবং সাম্প্রতিক সময়ে খরার কারণে গমের ফলন খারাপ হয়েছে। এমতাবস্থায় সরকার আটার উপর ভর্তুকি তিনগুণ বাড়িয়েছে। এই খরচাগুলি সরকার কোথা থেকে জোগাড় করবে সেটা না বললেও মরক্কোকে খুব সম্ভবতঃ আইএমএফ এবং আন্তর্জাতিক বন্ডের বাজার থেকে ঋণ নিতে হবে। মরক্কো জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দেয়নি। তবে এই অবস্থান নেয়ার জন্যে মরক্কোর পশ্চিমা বন্ধুরা দেশটার তেমন সমালোচনা করেনি। বিতর্কিত পশ্চিম সাহারা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও মরক্কো চিন্তিত থাকতে পারে; কারণ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া ভেটো প্রদানের মাধ্যমে মরক্কোর চেষ্টাকে রুখে দিতে পারে। মস্কো এখন পর্যন্ত পশ্চিম সাহারা ইস্যুতে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছে।

অপরদিকে মিশরের ব্যাপারটা যথেষ্ট বিপজ্জনক; তারা তাদের ৮০ শতাংশ গমই রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে আমদানি করে। রুটির মূল্য ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও যুদ্ধের কারণে ভুট্টার মূল্য বৃদ্ধিতে দেশটাতে পশুখাদ্য উৎপাদনেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। যুদ্ধের আগে মিশরের পর্যটন ভিত্তিক অর্থনীতিতে রুশ এবং ইউক্রেনিয়ান পর্যটকের সংখ্যা ছিল প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এপ্রিল মাসে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতার দেশটাকে ২২ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা ও বিনিয়োগের আস্বাস দিলেও মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে দরিদ্র্য জনগণের জীবন আরও দুর্বিসহ হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের উপর জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে মিশর রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ করার পরপরই মার্কিনীরা মিশরের কাছে ‘এফ-১৫’ যুদ্ধবিমান বিক্রির ইচ্ছা পোষণ করা শুরু করে। অনেকেই মনে করছেন যে, এটা হলো মিশরের কাছে রুশ ‘সুখোই ৩৫’ যুদ্ধবিমান বিক্রি বন্ধের একটা প্রচেষ্টা। কিন্তু এই প্রচেষ্টার পর মিশরের সাথে রাশিয়ার ‘টু প্লাস টু’ কূটনৈতিক বৈঠকে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের আলোচনা বলে দিচ্ছে যে, মার্কিন কূটনৈতিক সাফল্য কতটা সফল হয়েছে।

‘আইসিজি’এর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, আমদানিকৃত জ্বালানির উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তিউনিসিয়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। দেশটা তাদের ৫০ শতাংশ গ্যাস এবং ৭০ শতাংশ জ্বালানি তেল বাজার মূল্যে যথাক্রমে আলজেরিয়া এবং খোলা বাজার থেকে ক্রয় করে। ২০২২ সালের বাজেটে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৭৫ ডলার ধরা হয়েছিল। এখন ১’শ ডলার মূল্যের কারণে জ্বালানি আমদানির খরচ ২০১৯ সালে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন থেকে বেড়ে গিয়ে এবছরে ৪ বিলিয়ন ডলার হতে চলেছে। বাজেটের উপর চাপ কমাতে সরকার ইতোমধ্যেই জ্বালানির মূল্য কয়েক দফা বৃদ্ধি করেছে; যা কিনা জনগণের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। অপরদিকে দেশটা তাদের গমের একটা বড় অংশ আমদানি করে, যার অর্ধেকই আসে ইউক্রেন থেকে। বর্তমান গমের মজুদ জুন মাস পর্যন্ত চলবে। সাম্প্রতিক সময়ে গত ছয় মাসের বাকি ৩’শ মিলিয়ন ডলার আমদানিমূল্যের অর্ধেক চেয়েছে ইউক্রেন; যা না দিলে তারা তিউনিসিয়াকে আর গম সরবরাহ করবে না। কাজেই জুন মাসে নতুন ফসল ঘরে তুলতে পারার আগেই গমের অপ্রতুলতা দেখা দিতে পারে।

 
ইউক্রেনের মাটিতে ব্যাপক ক্ষতির মাঝে পড়ার পরেও আফ্রিকাতে রাশিয়া তার সামরিক ও ব্যবসায়িক অবস্থানগুলিকে চালিয়ে নিচ্ছে। সামনের দিনগুলিতে আফ্রিকার আরও দেশের সাথে রাশিয়ার নিরাপত্তা চুক্তি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

আফ্রিকার মাটিতে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব

ফরাসি বার্তা সংস্থা ‘আরএফআই’এর এক খবরে বলা হচ্ছে যে, গত ১২ই এপ্রিল আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুন রাশিয়ার সাথে একটা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি মোতাবেক দুই দেশ সামরিক তথ্য আদান প্রদান, প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। ২০১৫ সাল থেকে রাশিয়া ক্যামেরুনের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। আর জাতিসংঘে সাম্প্রতিক ভোটাভুটিতে ক্যামেরুন রাশিয়ার বিপক্ষে যায়নি। বর্তমানে আফ্রিকার দেশ সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, লিবিয়া, মালি এবং আরও কিছু দেশে রুশ সরকারের সমর্থনপুষ্ট ভাড়াটে ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর সদস্যরা সরকারি বাহিনীকে ট্রেনিং দিচ্ছে এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দিচ্ছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ল’ফেয়ার ইন্সটিটিউট’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনের মাটিতে ব্যাপক ক্ষতির মাঝে পড়ার পরেও আফ্রিকাতে রাশিয়া তার সামরিক ও ব্যবসায়িক অবস্থানগুলিকে চালিয়ে নিচ্ছে। সামনের দিনগুলিতে আফ্রিকার আরও দেশের সাথে রাশিয়ার নিরাপত্তা চুক্তি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে রুশরা শূণ্যস্থান পূরণ করেছে এবং মালিতে ফ্রান্সকে প্রস্তিস্থাপিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক বা মালির মতো দেশগুলির উপর থেকে পশ্চিমা সহায়তা সড়িয়ে নেবার হুমকি তাদের অবস্থানকে পরিবর্তন করাবে না; বরং তাতে সেখানে রুশ প্রভাব আরও বৃদ্ধি পাবে এবং মার্কিন অবস্থান দুর্বল হবে। শুধু তাই নয়, এতে সেসব দেশের জনগণের উপর আরও বেশি দুর্ভোগ নেমে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র বরং চিন্তা করতে পারে যে, আফ্রিকার দেশগুলিতে রুশ প্রভাবের স্থানে অন্য কারুর অবস্থান নেয়াটা পশ্চিমাদের জন্যে কতটা ভয়াবহ হবে। সেই হিসেবে মধ্যম মেয়াদে আফ্রিকাতে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

‘ল’ফেয়ার ইন্সটিটিউট’ আরও বলছে যে, সুদানে সামরিক অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটার উপর থেকে ৭’শ মিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক সহায়তা এমন সময়ে সড়িয়ে নেয়, যখন সেখানে অর্থনৈতিক দৈন্যতা এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিলো। এতে বোঝা যায় যে, ওয়াশিংটনের সুদান নীতি যথেষ্ট সমৃদ্ধ নয় এবং সেখানকার গণতন্ত্রকামীদের জন্যে মার্কিন সমর্থনের কথাগুলি নিছক গালগপ্প ছাড়া আর কিছুই নয়। সুদানের উপর মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রভাব অধিক থাকায় এবং এই দেশগুলি ওয়াশিংটনের বন্ধু হওয়ায় মার্কিনীরা হয়তো তাদের মাধ্যমেই সুদানের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখতে পারে। সুদানের মতো দেশগুলির নেতারা পশ্চিমা সহায়তা নয়, বরং ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়েই বেশি চিন্তিত থাকে। সুদানের সামরিক সরকারকে মার্কিন বন্ধু দেশ মিশর, আমিরাত, সৌদি আরব, এমনকি ইস্রাইল সহায়তা প্রদান করছে।

 
আফ্রিকা হলো ইউক্রেন যুদ্ধের ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’। আফ্রিকার দিকে তাকাবার মতো সময় এখন পশ্চিমাদের কাছে নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং এর ফলশ্রুতিতে সামাজিক অসন্তোষ যখন আফ্রিকাকে ঘিরে ফেলছে, তখন সমস্যার সমাধান দিতে না পারার কারণে সেখানে পশ্চিমারা শুধু প্রভাব হারাবেই। একইসাথে যে ভয়ে পশ্চিমারা রাশিয়াকে আফ্রিকা থেকে বিতাড়িত করতে চাইছে না, সেই ভীতিই বাস্তবে রূপ নেবে।


আফ্রিকা – ইউক্রেন যুদ্ধের ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’

‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২রা মার্চ জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে আফ্রিকার ৫৪টা দেশের মাঝে ২৬টা দেশই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যায়নি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর ৭ই এপ্রিল জাতিসংঘের আরেক ভোটে আফ্রিকার ৩৩টা দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যায়নি। আফ্রিকার দেশগুলি রাশিয়া থেকে সাহায্য না পেলেও তারা খাদ্য এবং অস্ত্র আমদানির জন্যে রাশিয়ার উপরে যথেষ্টই নির্ভরশীল। জাতিসংঘের হিসেবে আফ্রিকার ১৪টা দেশ তাদের অর্ধেক গমের জন্যে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের উপর নির্ভরশীল; অপরদিকে সোমালিয়া ৯০ শতাংশ এবং ইথিওপিয়া শতভাগ নির্ভরশীল। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসেবে রাশিয়ার সাথে আফ্রিকার বাণিজ্য ৪ বিলিয়ন ডলার; যার ৯০ শতাংশই হলো গমের বাণিজ্য। আর ইউক্রেনের সাথে আফ্রিকার বাণিজ্য সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার; যার ৫০ শতাংশ গম।

আফ্রিকার অনেক দেশই গৃহযুদ্ধ দ্বারা জর্জরিত অথবা প্রায় যুদ্ধাবস্থার মাঝে রয়েছে। এই যুদ্ধের অস্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই রুশ নির্মিত। তবে এই যুদ্ধগুলিতে পশ্চিমাদের স্বার্থ রয়েছে। যুদ্ধরত এই দেশগুলি একদিকে যেমন পশ্চিমাদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে, অন্যদিকে তারা রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে যুদ্ধ চালিয়ে নেবার জন্যে। ‘ল’ফেয়ার ইন্সটিটিউট’ বলছে যে, আফ্রিকাতে রাশিয়াকে প্রতিস্থাপিত করে অন্য কোন শক্তি আসার ব্যাপারটা পশ্চিমাদের কাছে, তথা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভীতির কারণ। এমতাবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেও পশ্চিমারা আফ্রিকাতে রুশ অবস্থানকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। আফ্রিকাতে রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের মাঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও তা ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত; যা এখন পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আফ্রিকার অনেকগুলি দেশই যেমন তাদের বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে জাতিসংঘে রাশিয়ার বিপক্ষে যায়নি, তেমনি পশ্চিমা দেশগুলিও বাস্তবতা মেনে নিয়ে আফ্রিকাতে রাশিয়াকে প্রতিস্থাপন করার চাইতে মহাদেশটার নিরাপত্তাকেই তাদের স্বার্থের জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে। ‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে যে, আফ্রিকা হলো ইউক্রেন যুদ্ধের ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’। আর ‘আইসিজি’ বলছে যে, আফ্রিকার দিকে তাকাবার মতো সময় এখন পশ্চিমাদের কাছে নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং এর ফলশ্রুতিতে সামাজিক অসন্তোষ যখন আফ্রিকাকে ঘিরে ফেলছে, তখন সমস্যার সমাধান দিতে না পারার কারণে সেখানে পশ্চিমারা শুধু প্রভাব হারাবেই। একইসাথে যে ভয়ে পশ্চিমারা রাশিয়াকে আফ্রিকা থেকে বিতাড়িত করতে চাইছে না, সেই ভীতিই বাস্তবে রূপ নেবে।

No comments:

Post a Comment