Saturday 4 June 2022

বৈশ্বিক অস্থিরতার মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে নিজস্ব নিরাপত্তা বৃদ্ধি করছে ইস্রাইল

০৪ঠা জুন ২০২২
 
ইরানের 'আইআরজিসি'র অন্তর্গত 'আল কুদস ফোর্স'এর কর্নেল হাসান সাইয়াদ খোদাইএর শেষকৃত্যানুষ্ঠান। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিকে মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যেতে বাধা দিচ্ছে; যা কিনা চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের পরিপন্থী। এমতাবস্থায় ইরানকে নিয়ন্ত্রণের কাজটা ইস্রাইলের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকেই রক্ষা করবে। ইরানের ‘আল কুদস ফোর্স’এর নেতা এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যাকান্ড সেই পরিকল্পনারই অংশ।


১লা জুন ইস্রাইলের সামরিক বাহিনী ঘোষণা দেয় যে, তারা একটা সামরিক মহড়া শুরু করেছে, যেখানে কয়েক ডজন ইস্রাইলি যুদ্ধবিমান দূরবর্তী টার্গেটে হামলা করার অনুশীলন করে। বিবৃতিতে বলা হয় যে, এই মহড়ায় আকাশে থাকা অবস্থায় বিমান থেকে বিমানে জ্বালানি সরবরাহ করার অনুশীলনও করা হয়। মহড়াটা হলো একমাসব্যাপী মহড়ার একটা অংশ, যেখানে সাইপ্রাসও যুক্ত রয়েছে। ‘দ্যা এরাব উইকলি’ বলছে যে, মহড়ার ধরণ এভাবে ঘোষণা দেয়ার অর্থ হলো ইস্রাইল নিঃসন্দেহে ইরানকে হুমকি দিচ্ছে। মহড়াটা এমন সময়ে এলো, যখন পশ্চিমা দেশগুলির সাথে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প কয়েক মাস ধরে আটকে রয়েছে। ইস্রাইল মনে করে যে ইরানের সাথে পশ্চিমাদের পারমাণবিক চুক্তির মাঝে ইস্রাইলের নিরাপত্তার জন্যে যথেষ্ট রক্ষাকবচ নেই। তাই তারা এই চুক্তির বিরোধী। ইস্রাইলের এই প্রচ্ছন্ন হুমকি ইরানের সাথে চলমান উত্তেজনা এবং সংঘাতকেই তুলে ধরে; যা মিডিয়াতে ‘ছায়াযুদ্ধ’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।

৩রা জুন ইরান ঘোষণা দেয় যে, ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ড কোর বা ‘আইআরজিসি’র অন্তর্গত ‘কুদস ফোর্স’এর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মৃত্যুবরণ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ইরানের সরকারি বার্তাসংস্থা ‘ইরনা’ জানায় যে, কর্নেল আলী এসমাইলজাদেহ কারাজ শহরে তার নিজ বাড়িতে কোন ‘একটা ঘটনায়’ মৃত্যুবরণ করেন। এর চাইতে বেশি কিছু বলা না হলেও সেখানে অস্বীকার করা হয় যে, কর্নেলকে হত্যা করা হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক ইরানের রাজনৈতিক বিরোধীদের ওয়েবসাইট ‘ইরান ইন্টারন্যাশনাল’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত দিয়ে বলছে যে, কর্নেলকে ‘আইআরজিসি’ই বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করেছে। কারণ এসমাইলজাদেহ মাত্র কিছুদিন আগেই হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া ‘আল কুদস ফোর্স’এর আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ব্যাপারে তথ্য পাচার করেছিলেন। ওয়েবসাইটটা সৌদি আরবের অর্থায়ন পায় বলে অনেকে ধারণা করেন। এই ঘটনার কিছুদিন আগেই কর্নেল হাসান সাইয়াদ খোদাইকে অজ্ঞাত দু’জন বন্দুকধারী মোটরসাইকেল থামিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তেহরানের মোজাহেদিন এ-ইসলাম স্ট্রীটের নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা এলাকায় তাকে হত্যা করা হয়; যেখানে ‘আইআরজিসি’র উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বসবাস করেন। ইরান এখনও হত্যাকান্ডের ব্যাপারে কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও ঘটনার জন্যে তারা ইস্রাইলকে দায়ী করেছে। এর আগে গত কয়েক বছরে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে কর্মরত বেশ ক’জন বিজ্ঞানী হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতেও কয়েকবার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে; যেগুলির জন্যেও ইরান ইস্রাইলকে দায়ী করেছে। ইস্রাইল বলছে যে, খোদাই ইরানের বাইরে বিভিন্ন অপহরণ এবং হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন; বিশেষ করে ইস্রাইলি টার্গেটের বিরুদ্ধে কাজ করছিলেন তিনি। ২০২০ সালের নভেম্বরে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ হত্যার পর থেকে এটাই ইরানের অভ্যন্তরে সবচাইতে বড় হত্যাকান্ড। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ জানাচ্ছে যে, ইস্রাইল মার্কিন কর্মকর্তাদের বলেছে যে, খোদাইএর হত্যাকান্ড ইস্রাইলই ঘটিয়েছে। এই ঘটনার জের ধরেই ইস্রাইল তুরস্কে ইস্রাইলি নাগরিকদের জন্যে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে; এবং বলেছে যে, ইরান তুরস্কে ইস্রাইলের স্বার্থে আঘাত করতে পারে।

 
লোহিত সাগরের উত্তর প্রান্তে আকাবা উপসাগরের মুখে কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ দু’টা দ্বীপ তিরান এবং সানাফিরের মালিকানা নিয়ে মিশর এবং সৌদি আরবের মাঝে যে সমঝোতা হতে চলেছে, তা ইস্রাইল মেনে নেবে। দ্বীপ নিয়ে এই আলোচনাগুলির মূলে রয়েছে ইস্রাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ইস্রাইলও যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল না থেকে বরং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে নিজের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে চাইছে।

এদিকে ২রা জুন ‘জেরুজালেম পোস্ট’ বলে যে, লোহিত সাগরের উত্তর প্রান্তে আকাবা উপসাগরের মুখে কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ দু’টা দ্বীপ তিরান এবং সানাফিরের মালিকানা নিয়ে মিশর এবং সৌদি আরবের মাঝে যে সমঝোতা হতে চলেছে, তা ইস্রাইল মেনে নেবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জুন মাসে তার আসন্ন মধ্যপ্রাচ্য সফরে এই দ্বীপগুলির মালিকানা মিশরের হাত থেকে সৌদি আরবের হাতে যাবার ঘোষণা দিতে পারেন। দ্বীপদু’টা ইস্রাইলের দক্ষিণের এইলাত সমুদ্রবন্দরের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে অবস্থিত। ১৯৬৭ সালে ইস্রাইল এই দ্বীপদু’টা দখল করে নেয় এবং ‘ক্যাম্প ডেভিড’ শান্তিচুক্তির পর ১৯৮২ সালে ইস্রাইল মিশরের কাছে দ্বীপদু’টা হস্তান্তর করে। ইস্রাইলের এই স্বীকৃতির বিনিময়ে সৌদি আরব তার আকাশসীমাকে ইস্রাইলের যেকোন বেসামরিক বিমানকে ব্যবহার করতে দেবে। বর্তমানে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সাথে ইস্রাইলের বিমান যোগাযোগের ক্ষেত্রে সৌদি আরব আকাশসীমা ব্যবহার করতে দিচ্ছে। এছাড়াও ভারতের ‘এয়ার ইন্ডিয়া’র ফ্লাইটগুলিও ইস্রাইলে যাতায়াত করতে পারে। ‘মিডলইস্ট আই’ বলছে যে, দ্বীপ নিয়ে এই আলোচনাগুলির মূলে রয়েছে ইস্রাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা। ২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারের প্রচেষ্টায় ‘আব্রাহাম একর্ডস’এর মাধ্যমে আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো এবং সুদান ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ করে।

১লা জুন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন ‘ফরেন এফেয়ার্স’ ম্যাগাজিন আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনায় বলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সৌদি আরব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সহযোগী। তিনি আরও বলেন যে, ‘আব্রাহাম একর্ডস’এর মাধ্যমে ইস্রাইলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্যে মার্কিন সরকার কাজ করে যাবে। কিছুদিন আগেই সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর এক আলোচনায় সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল-সউদ বলেন যে, তিনি মনে করেন যে, ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কের পুরোপুরি স্বাভাবিকীকরণ পুরো অঞ্চলের জন্যে বিশাল সুবিধা বয়ে আনবে। তবে ফিলিস্তিনের ইস্যুটা সমাধান না করা গেলে এই সুবিধাটা পাওয়া যাবে না।

বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ইস্রাইলও যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল না থেকে বরং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে নিজের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে চাইছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিকে মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যেতে বাধা দিচ্ছে; যা কিনা চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের পরিপন্থী। এমতাবস্থায় ইরানকে নিয়ন্ত্রণের কাজটা ইস্রাইলের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকেই রক্ষা করবে। ইরানের ‘আল কুদস ফোর্স’এর নেতা এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যাকান্ড সেই পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে দেখছেন অনেকেই। ইস্রাইল চাইছে না যে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ইরানের উপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিক। অন্ততঃ গত কয়েক মাস ধরে ইরানের সাথে আলোচনায় কোন অগ্রগতি না হওয়ায় বাইডেন প্রশাসন ইস্রাইলের দাবিগুলিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে এবং ইস্রাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার মাঝে ইস্রাইল এবং ইরানের মাঝে ‘ছায়াযুদ্ধ’ আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment