Tuesday 17 May 2022

রাশিয়ার উপর অবরোধের ব্যাপারে জাপান বাস্তববাদীই থাকছে

১৭ই মে ২০২২

১২ই মে ২০২২। ইইউএর নেতৃবৃন্দের সাথে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা। ইউরোপই যখন নিজেদের গণতান্ত্রিক আদর্শকে সমুন্নত রাখাতে গিয়ে রাশিয়ার জ্বালানির উপর নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে হিমসিম খাচ্ছে, তখন জাপানকে নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনাটাই অবান্তর। কারণ পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলি যে নিজেদের অর্থনীতিকে অন্য সকল বিষয়ের উপরে রাখবে, সেটাই স্বাভাবিক।


গত ১২ই মে জাপানের রাজধানী টোকিওতে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেইয়েন এবং ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেলএর সাথে এক যৌথ সংবাদ সন্মেলনে জাপানি প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বলেন যে, ইউক্রেনে হামলার কারণে ইইউ এবং জাপান একত্রে রাশিয়ার উপর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেবে এবং একইসাথে তারা জ্বালানি সরবরাহ উন্নয়নে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। কিশিদা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার কথা বললেও জাপান বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে না। কিশিদার সংবাদ সন্মেলনের দু’দিন আগে ১০ই মে জাপানের অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী কোইচি হাগিউদা সাংবাদিকদের বলেন যে, জাপান তার অর্থনীতির উপর প্রভাব বিবেচনা করেই রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করা বন্ধ করবে। হাগিউদা বলছেন যে, তারা কিছু সময় নিয়ে রুশ জ্বালানি তেল আমদানি কমাতে বা পুরোপুরি বন্ধ করতে পদ্ধতি ডেভেলপ করতে চাইছেন, যাতে করে জাপানের ব্যবসা এবং জনগণের জীবনের উপর এর প্রভাবগুলি সর্বনিম্ন রাখা সম্ভব হয়; কারণ বিকল্প উৎস নিশ্চিত না করে জাপান হঠাৎ করেই রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বন্ধ করতে পারবে না।

‘আল জাজিরা’ জানাচ্ছে যে, ২০২১ সালে জাপান রাশিয়া থেকে তার মোট তেলের ৪ শতাংশ এবং মোট গ্যাসের ৯ শতাংশ আমদানি করেছিল। কিছুদিন আগেই ‘জি-৭’এর সহযোগী দেশগুলির সাথে আলোচনায় ইউক্রেন হামলার প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করতে রাজি হয়েছিল জাপান। শিল্পমন্ত্রীর সংবাদ সন্মেলনের একদিন আগেই জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, জাপান ধীরে ধীরে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বন্ধ করবে। শিল্পমন্ত্রী হাগিউদা দৃঢ়ভাবে বলেন যে, বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। কারণ তেল এবং গ্যাস উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ দেশ; তাদের উচিৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে একটা নতুন ব্যবস্থা তৈরি করা। যুক্তরাষ্ট্রে তরলীকৃত গ্যাস প্রকল্প রয়েছে, যেখানে বেশ স্বল্প সময়ের মাঝে উৎপাদন বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা রয়েছে। জাপান সরকার সেখানে বিনিয়োগ করতে রাজি আছে।

গত ৯ই মে প্রধানমন্ত্রী কিশিদা সাংবাদিকদের বলেন যে, রাশিয়ার পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের ‘সাখালিন-১’ এবং ‘সাখালিন-২’ জ্বালানি প্রকল্পে জাপানের যে বিনিয়োগ রয়েছে, সেগুলি জাপান তুলে নেবে না। এই প্রকল্পগুলি থেকে জাপান তেল এবং গ্যাস আমদানি করে থাকে। রাশিয়ার জ্বালানি প্রকল্পে জাপানের বিনিয়োগের ব্যাপারে এই কথাগুলি নতুন নয়। এর আগে গত ১৫ই এপ্রিল জাপানি শিল্পমন্ত্রী হাগিউদা সাংবাদিকদের বলেন যে, জাপান যদি রাশিয়ার জ্বালানি প্রকল্প থেকে সড়ে আসে এবং জাপানের অংশটা যদি রাশিয়া বা তৃতীয় কোন দেশ কিনে নেয়, তাহলে সেটা রাশিয়ার উপর অবরোধকে দুর্বল করে ফেলবে। কারণ এতে রুশ সম্পদের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং তা রাশিয়াকে সহায়তা দেবে। জাপানের বিনিয়োগের অংশটা যদি তৃতীয় কোন দেশ কিনে নেয়, তাহলে জাপানের বিনিয়োগ তুলে নেয়াটা রাশিয়ার জন্যে কোন ক্ষতি বয়ে আনবে না। 

সাখালিন দ্বীপে রাশিয়ার হাইড্রোকার্বন প্রকল্পে জাপানের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। জাপান বলছে যে, জাপানের বিনিয়োগের অংশটা যদি তৃতীয় কোন দেশ কিনে নেয়, তাহলে জাপানের বিনিয়োগ তুলে নেয়াটা রাশিয়ার জন্যে কোন ক্ষতি বয়ে আনবে না। তাই তারা সেখান থেকে তাদের বিনিয়োগ তুলে নেবে না বলে জানিয়েছে।


জাপান পশ্চিমা দেশগুলির নীতি সরাসরি অনুসরণ করছে না। ১৩ই মে ব্রিটিশ ডাচ কোম্পানি ‘শেল’ ঘোষণা দেয় যে, তারা রাশিয়াতে তাদের তেল বিপনন ব্যবসা রুশ কোম্পানি ‘লুকঅয়েল’এর কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ব্রিটিশ তেল কোম্পানি ‘বিপি’ ও ‘শেল’, মার্কিন কোম্পানি ‘এক্সন মোবিল’ এবং নরওয়ের কোম্পানি ‘ইকুইনর’ ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা রাশিয়া থেকে তাদের বিনিয়োগ সড়িয়ে নেবে। আর ফরাসি কোম্পানি ‘টোটাল’ ঘোষণা দেয় যে, তারা রাশিয়াতে নতুন কোন বিনিয়োগে যাবে না। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলি নিজেরাই এখনও রুশ জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা বন্ধ করতে পারছে না। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে ইইউএর দেশগুলি রাশিয়া থেকে প্রতি মাসে ২৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের জ্বালানি আমদানি করেছে। অথচ ২০২১ সালে জ্বালানির মূল্য অপেক্ষাকৃত কম থাকায় তখন তারা প্রতি মাসে রাশিয়া থেকে সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি আমদানি করেছিল।

‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, একটা প্রধান জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশের উপর অবরোধ দেয়া যে কতটা কঠিন, তা এখন সকলেই টের পাচ্ছে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে রুশ সরকারের কর থেকে আয় ১’শ ৮০ বিলিয়ন ডলার হতে চলেছে; যা কিনা আগের বছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি! অবরোধের কারণে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল রপ্তানি সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ কমেছে। চীন এবং ভারতের মতো দু’টা বড় অর্থনীতি রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করেনি। তবে এশিয়াতে রাশিয়ার জ্বালানি বিক্রির দুর্বলতা হলো পাইপলাইনের অপ্রতুলতা। শুধুমাত্র তেলের জাহাজ দিয়ে তেল রপ্তানি করাটা ব্যয়সাধ্য। একারণে স্বল্পমেয়াদে মূল্যস্ফীতির কারণে রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানি থেকে আয় বৃদ্ধি হলেও মধ্যমেয়াদে জ্বালানি রপ্তানির অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়া রাশিয়ার পক্ষে এশিয়াতে রপ্তানি বৃদ্ধি করাটা কঠিন। ‘ক্লিয়ারভিউ এনার্জি পার্টনার্স’এর প্রধান নির্বাহী কেভিন বুক ‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’কে বলছেন যে, ইইউ যেভাবে পরিকল্পনা করে রাশিয়ার জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে, সেটা মোটেই পরিকল্পিত হবে না। কারণ একদিকে ইউরোপ যেমন মূল্যস্ফীতির মারাত্মক প্রভাবকে এড়াতে পারছে না; অরপদিকে ইইউএর মাঝেই অবরোধের ব্যাপারে একাত্মতা এখনও গড়ে ওঠেনি। আর যদি ইইউএর অবরোধ কার্যকর করা হয়, তাহলে মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে।

জাপান সরকার আদর্শিক নয়, বরং বাস্তববাদী হবারই চেষ্টা করছে। তারা একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউএর মতো বাণিজ্য সহযোগীদের দূরে ঠেলে দিতে চাইছে না, তেমনি রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে নিজেদের অর্থনীতিকেও ক্ষতির মাঝে ফেলতে উচ্ছুক নয়। এটা পরিষ্কার যে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির ব্যাপক মূল্যস্ফীতির কারণে রাশিয়ার অর্থনীতির উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না। আর জাপানের মতো অনেক দেশই, বিশেষ করে চীন এবং ভারত, রাশিয়ার জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতাকে দোষের কিছু মনে করছে না। অন্ততঃ ইউরোপই যখন নিজেদের গণতান্ত্রিক আদর্শকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে রাশিয়ার জ্বালানির উপর নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে হিমসিম খাচ্ছে, তখন জাপানকে নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনাটাই অবান্তর। কারণ পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলি যে নিজেদের অর্থনীতিকে অন্য সকল বিষয়ের উপরে রাখবে, সেটাই স্বাভাবিক।

No comments:

Post a Comment