Tuesday 7 September 2021

গিনি অভ্যুত্থান ... ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন

০৭ই সেপ্টেম্বর ২০২১

ছবিঃ গিনির অভ্যুত্থানের নেতা লেঃ কর্নেল মামাদি দুমবুইয়া। প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ হবার কারণে গিনিতে ফ্রান্সের প্রভাব যথেষ্ট। বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ এবং সামরিক নেতৃবৃন্দ ফ্রান্সের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছে অথবা ফ্রান্সের অধীনে কাজ করেছেন। ফরাসি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ এবং সামরিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে ফ্রান্স হয়তো তার প্রভাব কিছুটা হলেও ধরে রাখার চেষ্টা করবে। কিন্তু ব্যাপক গনঅসন্তোষের মাঝে জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকাটা যেমন কঠিন, তেমনি তা খুব সহজেই ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্যে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছে; যা পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে।


পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনিতে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে বলে খবর আসছে। ৫ই সেপ্টেম্বর গিনির রাজধানী কোনাক্রিতে কয়েক ঘন্টার বন্দুকযুদ্ধের পর সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা ক্ষমতা নিয়েছে বলে সরকারি টেলিভিশনে বলা হয়। টিভিতে প্রচারিত বিবৃতিতে নয়জন সেনাকে দেখা যায়, যাদের কেউ কেউ জাতীয় পতাকায় মোড়ানো ছিল। তারা বলছে যে, প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডেকে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং দারিদ্র্যের জন্যে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। নিজেদেরকে ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর রেকনসিলিয়েশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট’ আখ্যা দিয়ে তারা সংবিধান বাতিল ঘোষণা করে। ৮৩ বছর বয়সী প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার পিছনে গ্রুপটার নেতৃত্ব দিয়েছেন লেঃ কর্নেল মামাদি দুমবুইয়া। একটা ভিডিওতে প্রেসিডেন্ট কন্ডেকে একটা সোফার উপর জিন্স এবং টিশার্ট পড়ে খালি পায়ে বসে থাকতে দেখা যায়। অভ্যুত্থানকারীরা দেশটার স্থলসীমা এবং বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করেছে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত কালুম উপদ্বীপে সরকারি অফিস এবং প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস ঘিরে ফেলেছে সেনারা। ‘বিবিসি’ বলছে যে, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাচ্যুত হবার খবরে বিরোধী দলীয় সমর্থকেরা রাস্তায় উল্লাস করে। তারা বলছে যে, প্রেসিডেন্ট কন্ডের সময়ে তারা অনেক কষ্ট করেছেন। কেউ কেউ জামা খুলে ‘দুমবুইয়া’ নামে শ্লোগান দিচ্ছে। বিরোধী দলীয় নেতা মামুদু নাগনালেন বারি ‘বিবিসি’কে বলেন যে, তিনি ভারাক্রান্তভাবে খুশি। তিনি আশা করছেন যে, সেনারা বেসামরিক নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

‘বিবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, অভ্যুত্থানকারীরা জনপ্রিয় কথাগুলিই এখন বলছে। বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান লেখার কথায় অনেকেই খুশি হবে। তবে সামরিক অভ্যুত্থানকারীরা পরবর্তীতে তাদের প্রতিশ্রুতি কতটা রাখবে, তা নিশ্চিত নয়। গত এক বছরের মাঝে পশ্চিম আফ্রিকায় এটা চতুর্থ অভ্যত্থান প্রচেষ্টা। এর আগে মালিতে দু’বার এবং নিজেরএ একবার অভ্যুত্থান চেষ্টা হয়। আবার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে গিনি এবং আইভোরি কোস্টে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট সংবিধান পরিবর্তন করিয়েছেন নির্বাচনে অংশ নিতে। এতে পশ্চিম আফ্রিকায় গণতন্ত্রের অবস্থা আরও করুন হলো বলে বলা হচ্ছে সেখানে।

গিনির ইতিহাস ... সামরিক অভ্যুত্থানই যেখানে স্বাভাবিক

গিনিতে বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ১৯৫৮ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার পর প্রথম প্রেসিডেন্ট হন আমহেদ সেকু তুরে। টানা ২৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৮৪ সালে প্রেসিডেন্ট তুরেএর মৃত্যু হলে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নেন লানসানা কন্টে। ফরাসি সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষিত কন্টে টানা ২৪ বছর ক্ষমতা ধরে রাখেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে কন্টে দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর মৃত্যবরণ করেন। একই দিনে আরেকটা সামরিক অভ্যুত্থানে ক্যাপ্টেন মুসা দাদিস কামারা ক্ষমতা দখল করেন। দাদিস এর আগে জার্মানিতে লম্বা সময়ের জন্যে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তবে এক বছরের মাথায় ২০০৯এর ডিসেম্বরে দাদিস তার সেনাদের গুলিতে আহত হয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। দাদিসের স্থান নেন মরক্কোতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অফিসার সেকুবা কোনাতে। তিনি ২০১০ সালে নির্বাচনের আয়োজন করে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তৎকালীন মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম ফিতজগেরাল্ড কোনাতের পক্ষে মার্কিন সরকারের সমর্থনও জ্ঞাপন করেন। নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন প্রবীন রাজনীতিবিদ আলফা কন্ডে। কন্ডের পুরো বেড়ে ওঠা ছিল ফ্রান্সে এবং কয়েক দশক তিনি গিনির বাইরে ছিলেন। ১৯৯১ সালে দেশে ফেরত এসে তিনি একনায়ক লানসান কন্টেএর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়েন। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি বিরোধী দলের রাজনীতি করে যান। ১৯৯৯ সালে কন্ডে গ্রেপ্তার হন এবং দুই বছর পর রাজনীতি ত্যাগ করার মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। চার বছর ফ্রান্সে থাকার পর তিনি আবারও দেশে ফেরত আসেন। তৎকালীন সামরিক নেতৃত্বের সাথে কন্ডে সম্পর্ক খারাপ করেননি। ২০১০ সালের নির্বাচনে প্রথম রাউন্ডে মাত্র ১৮ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকার পরেও দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সেলু দালেইন দিয়ালো প্রথম রাউন্ডে ৪০ শতাংশ ভোট পেলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে হেরে যান।
 

আলফা কন্ডে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে দেশটার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন। ২০১৫ সালে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগের মধ্যে দিয়ে তিনি আবারও নির্বাচনে জেতেন। ২০১৬ সালে ব্রিটিশ অস্ট্রেলিয়ান মাইনিং কোম্পানি ‘রিও টিন্টো’র সাথে কন্ডেএর সরকারের অর্থ আদানপ্রদানের খবর ছড়িয়ে পড়লেও কন্ডে সেযাত্রায় সমস্যা এড়াতে পারেন। তবে ২০১৯ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে দাঁড়াবার চেষ্টা করার পর রাস্তায় ব্যাপক আন্দোলন দেখা দেয়। প্রায় শ’খানেক মানুষের মৃত্যু হয় সেই আন্দোলনে। এই আন্দোলন দমনে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা অংশ নেন। ২০২০ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে আলফা কন্ডে আবারও জয়ী হন। হেরে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী সেলু দালেইন দিয়ালো কারচুপির অভিযোগ করে আন্দোলনের ডাক দেন। আন্দোলনে কমপক্ষে ১২ জন নিহত হবার খবর পাওয়া যায়।

প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডে সেনাবাহিনীর ‘স্পেশাল ফোর্সেস গ্রুপ’এর নেতৃত্ব দেবার জন্যে ২০১৮ সালে মামাদি দুমবুইয়াকে ডেকে নিয়ে আসেন। দুমবুইয়া ছিলেন ফরাসি সামরিক বাহিনীর ‘ফরেন লিজিয়ন’এর একজন সদস্য। ফরাসি মিডিয়া ‘আরএফআই’ বলছে যে, সেখানে তার লম্বা ক্যারিয়ারে তিনি ফ্রান্সের সামরিক একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করা ছাড়াও আফগানিস্তান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, জিবুতি এবং আইভোরি কোস্টে বিভিন্ন সামরিক মিশনে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি ইস্রাইলের সামরিক একাডেমিতে এবং সেনেগাল ও গ্যাবনেও প্রশিক্ষণ পান। ৪১ বছর বয়স্ক দুমবুইয়ার সামরিক ক্যারিয়ার ১৫ বছরের উপর। ফরাসি মিডিয়া তাকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব এবং সামরিক কৌশলের বিশেষজ্ঞ বলে আখ্যা দিচ্ছে। একইসাথে তার ইউনিটের লাল টুপি জনগণের মাঝে একটা শক্তিশালী প্রভাব রাখে বলে বলছে ফরাসিরা।

সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলকে গিনির জনগণ কিভাবে দেখবে? তারা ইতোমধ্যেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডের স্বরূপ দেখে ফেলেছে। পার্শ্ববর্তী সেনেগালে বসবসরত গিনির নাগরিক মালিক দিয়াল্লো তুর্কি মিডিয়া ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলছেন যে, প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডে জোর করে তৃতীয়বারের মত নির্বাচন করেছিলেন। তার আসলে ক্ষমতায় থাকার অধিকারই ছিল না। আরেকজন মামাদু সালিউ দিয়াল্লো বলছেন যে, সামরিক অভ্যুত্থান ভালো জিনিস নয়। কিন্তু গিনির জনগণের আর কি করার ছিলো? প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি বয়স্ক; যিনি গিনিয়ানদেরকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন না এবং তিনি ক্ষমতাও ছাড়তে চান না। তবে ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, অভ্যুত্থানকারীরা জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে; কারণ সামরিক বাহিনী এখনোও বিভক্ত। প্রেসিডেন্টের সমর্থকেরা পাল্টা কিছু করতে পারে।

গিনি কেন গুরুত্বপূর্ণ

আটলান্টিক মহাসরের পাড়ের দেশ গিনির জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৪ লক্ষ; যার প্রায় ৮৫ শতাংশই মুসলিম। তবে দেশটা সবসময় সেকুলার নেতৃত্বই দেখেছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডে ৪৯ বছর পর ২০১৬ সালে ইস্রাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পূনস্থাপন করেন। ১৯৬৭ সালে গিনি ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। তবে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য রয়েছে। পার্শ্ববর্তী সেনেগালের রাজধানী দাকার থেকে গিনিতে ইস্রাইলের কূটনৈতিক তৎপরতা চলে। খনিজ সম্পদে ভরপুর গিনি তার বক্সাইট খনির জন্যে বিখ্যাত। বক্সাইট থেকে এলুমিনিয়াম তৈরি হয়। ‘কেপিএমজি গ্লোবাল মাইনিং ইন্সটিটিউট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, গিনির খনিতে রয়েছে ৭’শ ৪০ কোটি টন বক্সাইট; যা কিনা পুরো দুনিয়ার বক্সাইট রিজার্ভের ২৬ শতাংশ। এছাড়াও সেখানে রয়েছে ৪’শ কোটি টন লৌহ খনি; স্বর্ণ এবং হীরকও কম নয়। এছাড়াও সেখানে ইউরেনিয়ামের খনি রয়েছে বলেও বলা হচ্ছে। ‘ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে’র ২০২১ সালের জানুয়ারির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গিনি ২০২০ সালে ৮ কোটি ২০ লক্ষ টন বক্সাইট উৎপাদন করেছে; যা কিনা সারা দুনিয়ার বক্সাইট উৎপাদনের ২২ শতাংশ। গিনির স্বাধীনতার পর গিনির বক্সাইট খনির মূল নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মার্কিন কোম্পানিগুলির হাতে। তবে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ‘রিও টিন্টো’র শেয়ার রয়েছে খনিতে। তথাপি ‘রিও টিন্টো’ গিনিতে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হিমসিম খেয়েছে।

গিনির অর্থনীতি খনিগুলির উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ‘ওইসি ওয়ার্ল্ড’এর হিসেবে ২০১৯ সালে দেশটা প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে এবং প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। রপ্তানি পণ্যের মাঝে ৯৩ শতাংশই হলো বক্সাইট এবং স্বর্ণ। সবচাইতে বড় আমদানিকারক হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং চীন। আমিরাত কিনছে স্বর্ণ; চীন কিনছে বক্সাইট। ভারতও সেখান থেকে স্বর্ণ আমদানি করে। গিনির আমদানির ৩৯ শতাংশই আসে চীন থেকে। পুরো ইউরোপের সাথে যত বাণিজ্য হয়, চীনের সাথে বাণিজ্য হয় তার চাইতে বেশি।
 
ছবিঃ গিনির বক্সাইট খনি। গিনির অতি গুরুত্বপূর্ণ বক্সাইট খনির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় একটা কৌশলগত প্রতিযোগিতা সবসময়েই বিদ্যমান। প্রচুর খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও গিনির জনগণ খুবই দরিদ্র। তাদের অভিযোগ অনেক। গিনির নেতৃত্ব কখনোই জনগণের কথা চিন্তা করেনি।


ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নাইজেরিয়ার নেতৃত্বে পশ্চিমা আফ্রিকার আঞ্চলিক সংস্থা ‘ইকনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস’ বা ‘একোওয়াস’এর পক্ষ থেকে গিনির উপর অবরোধ আরোপের হুমকি দেয়া হয়। আফ্রিকান ইউনিয়নও বলছে যে, তারা সঠিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে আলোচনা করবে। যুক্তরাষ্ট্র এই অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানায় যে, এই ঘটনার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বন্ধু দেশগুলির জন্যে গিনির জনগণকে সহায়তা দেয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে। এতে দেশটার শান্তি, উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে বলে বলা হয়। ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক টুইট বার্তায় বলা হয় যে, ফ্রান্স এই ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছে এবং প্রেসিডেন্ট কন্ডেএর শর্তহীন মুক্তি চাইছে। জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুতেরেজও প্রেসিডেন্টের মুক্তি দারি করেন।

প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ হবার কারণে গিনিতে ফ্রান্সের প্রভাব যথেষ্ট। বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ এবং সামরিক নেতৃবৃন্দ ফ্রান্সের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছে অথবা ফ্রান্সের অধীনে কাজ করেছেন। বর্তমান অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া মামাদি দুমবুইয়া ফরাসি সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষিত এবং ফ্রান্সের অধীনেই বহু বছর ধরে বিভিন্ন দেশে সামরিক মিশনে গিয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডেও বহু বছর ফ্রান্সেই থেকেছেন। যদিও বর্তমানে গিনির অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ এবং চীন ও আমিরাতের বাজারের উপর নির্ভরশীল, তথাপি ফরাসি ভাষাভাষী পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলকে ফ্রান্স এখনও নিজের অঞ্চলই মনে করে। গিনির অতি গুরুত্বপূর্ণ বক্সাইট খনির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় একটা কৌশলগত প্রতিযোগিতা সবসময়েই বিদ্যমান। একারণেই অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি ‘রিও টিন্টো’ সেখানে শক্ত ভিত গাড়তে কঠিন সময় পার করছে। যেহেতু গিনির ইতিহাসে সামরিক অভ্যুত্থান একটা স্বাভাবিক বিষয়, তাই শক্তিশালী দেশগুলি গিনির সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের দিক থেকে নিয়ন্ত্রণ চায়। সাহেলের মালি, নিজের এবং বুরকিনা ফাসোতে সংঘাত বন্ধে হিমসিম খাচ্ছে ফ্রান্স। আইভোরি কোস্টের নিয়ন্ত্রণও নড়বড়ে। এর উপর সেখানে তুরস্ক, নাইজেরিয়া, মরক্কো সহ অনেক দেশের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে ব্যালান্স করা ফরাসিদের জন্যে কঠিন কাজ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ফরাসি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ এবং সামরিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে ফ্রান্স হয়তো তার প্রভাব কিছুটা হলেও ধরে রাখার চেষ্টা করবে। কিন্তু প্রচুর খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও গিনির জনগণ খুবই দরিদ্র। তাদের অভিযোগ অনেক। গিনির নেতৃত্ব কখনোই জনগণের কথা চিন্তা করেনি। এহেন পরিস্থিতিতে ব্যাপক গনঅসন্তোষের মাঝে জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকাটা যেমন কঠিন, তেমনি তা খুব সহজেই ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্যে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছে; যা পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে।

4 comments:

  1. প্রায়ই দেখা যায় ছোট ছোট দেশের সিভিল এবং ইউনিফর্ম সার্ভিসের কর্মকর্তারা আঞ্চলিক বড় বড় শক্তির দেশে যান প্রশিক্ষণ নিতে।

    হাতে কলমে একাডেমিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তারা সেই দেশ থেকে আর কিকি বিষয় মগজে ধারণ করে আনেন?

    ReplyDelete
    Replies
    1. কিছু কনসেপ্ট এবং কালচার ছাড়া পশ্চিমা কোন ট্রেনিংই হয় না। তারা কোন কারণ ছাড়া এই ট্রেনিংগুলি দেয় না। এরকম অনেক ট্রেনিংই হয় পশ্চিমা দেশগুলির নিজস্ব খরচে। তারা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যতীত কোন ট্রেনিং কাউকে প্রদান করে না। আর অনেক ক্ষেত্রেই এই ট্রেনিং প্রদানের সময় শিক্ষার্থীকে কালচারাল দিক থেকে তাদের কারচারকে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই কাকে কাকে ট্রেনিং দেয়া হবে, তা-ও তারা ঠিক করে দেয়। অর্থাৎ তারা কোন ব্যক্তিকে ট্রেনিং দিতে চায়, সেটাও অনেক ক্ষেত্রেই বলে দেয়। এভাবে তারা তাদের নিজেদের পক্ষের লোক তৈরি করে। ট্রেনিংএর পরে ট্রেনিংপ্রাপ্তদের সাথে তারা দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক রেখে চলে এবং বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে কালচারিং করার জন্যে তাদেরকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ায়। এই লোকগুলির মাধ্যমে তারা আরও লোককে ট্রেনিংএর জন্যে সিলেক্ট করে এবং এরকম আরও বিশ্বস্ত লোক তৈরি করতে থাকে।

      এই পদ্ধতিতে কয়েক দশক চলার পর পশ্চিমা দেশগুলি নিজের একটা সমর্থকের ভিত তৈরি করে ফেলে সেই দেশের কর্মকর্তাদের মাঝে। এরা পশ্চিমা দেশগুলির স্বার্থকে তুলে ধরে তাদের নিজেদের চিন্তাগত একাত্মতার কারণেই। কারণ পশ্চিমা দেশগুলিকে তারা খুব কাছের বন্ধু হিসেবে মনে করতে থাকে। ফলাফল হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলি ঐ দেশে নিজেদের রাজনৈতিক ভিত্তিকে শক্ত করে ফেলতে সক্ষম হয়।

      Delete
  2. তাহলে আগের দিনের মত এখন আর ফুট সোলজার দিয়ে দেশ দখলের মত ব্যাপার অপ্রচলিত হয়ে যাচ্ছে? এখন প্রশাসন আর সমরবিদদের মস্তিস্ক দখল করতে পারলেই শিল্পোন্নত দেশগুলোর নিজেদের স্বার্থ দুর্বল দেশের উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে?

    আর মুক্ত বাণিজ্য কিভাবে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় লাভবান করতে পারছে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা তো নতুন কিছু নয়। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি তো কখনোই তাদের উপনিবেশ ছেড়ে যায়নি। কিছু ক্ষেত্রে প্রাক্তন ঔপনিবেশিকের স্থান নিয়ে নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের ধরনটা ছিল ইউরোপিয়দের থেকে কিছুটা আলাদা। যেহেতু ইউরোপিয়রা তাদের ঔপনিবেশিক অঞ্চলে নিজেদের লোক তৈরি করার কারখানা রেখে গিয়েছে, তাই মার্কিনীরা সেখানে ঢুকতে হিমসিম খেয়েছে। এক্ষেত্রে মার্কিন ধরণটা ছিল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেয়া। এভাবে আগের শক্তির অনুগত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে পাশ কাটিয়ে বা কিছু ক্ষেত্রে মেরে ফেলে ক্ষমতা নিয়ে নেয়া। এভাবে যুক্তরাষ্ট্র ল্যাটিন আমেরিকায় বহুবার অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে; এশিয়াতেও ঘটিয়েছে। এগুলি ঔপনিবেশিক শক্তিদের নিজেদের মাঝে ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব ছাড়া আর কিছুই নয়।

      মুক্ত বাণিজ্যের সম্প্রসারণের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলির কোম্পানিগুলি বড় বড় প্রকল্প, বিশেষ করে খনিজ এবং প্রযুক্তিগতভাবে সংবেদনশীল ইন্ডাস্ট্রি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। যেমন বিশ্বব্যাপী বেশিরভাগ খনিক কোম্পানিই পশ্চিমা। তারা যেই দেশে অপারেট করে, সেই দেশটা পশ্চিমাদের বিরোধিতা করলেও তারা পশ্চিমা কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে যায়। যুদ্ধের মাঝেও এদের কর্মকান্ড চলে। সকল কিছুর উপর অবরোধ দেয়া হলেও পশ্চিমা কোম্পানিগুলির উপর আবরোধ আসে না কখনোই। মুক্ত বাণিজ্যের প্রসারের মাধ্যমেই পশ্চিমারা এই নিয়ন্ত্রণগুলি রাখতে পারে।

      Delete