Monday 6 September 2021

ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ বন্ধুত্ব’ ... আর কতদিন?

০৬ই সেপ্টেম্বর ২০২১

আফগানিস্তান থেকে অপমানজনক পলায়ন ব্রিটিশরা মেনে নিতে পারছে না সামরিক পরাজয়ের কারণে নয়; বরং পশ্চিমা আদর্শকে তুলে ধরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপারগতা প্রকাশের কারণে। তবে ব্রিটিশরাও স্বীকার করে নিচ্ছে যে, তারাও সুপারপাওয়ার নয়। কারণ ব্রিটেনের একার পক্ষে পশ্চিমা আদর্শের ঝান্ডা বহণ করা সম্ভব নয়। পশ্চিমাদের আদর্শিক দুর্যোগের এই সময়ে কেউবা দায়িত্ব নেবার ইচ্ছে পোষণ করছে না; আবার কেউবা ইচ্ছে থাকলেও সামর্থের খাঁচায় আটকে পড়ে যাচ্ছে। পশ্চিমা আদর্শের জন্যে এতবড় দুর্যোগ আর কখনোই আসেনি।


ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডমিনিক রাব কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা হামলার জন্যে ব্রিটিশদের কোনরূপ দায়িত্ব অস্বীকার করেন। এর আগে পেন্টাগন অভিযোগ করেছিল যে, ব্রিটিশরা তাদের নাগরিকদের বিমানবন্দরে ঢোকার সুবিধার জন্যে বিমানবন্দরের ‘এবি গেইট’ লম্বা সময়ের জন্যে খোলা রাখতে বলেছিল। রাব বলছেন যে, এটা পুরোপুরিভাবে মিথ্যা গল্প। ব্রিটেন এমন কিছুই করেনি, যাতে কিনা ‘এবি গেইট’ খোলা রাখার দরকার ছিল। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্যা মিরর’ বলছে যে, ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তারা এবং টোরি পার্টির পার্লামেন্ট সদস্যরা অভিযোগ করছেন যে, মার্কিনীরা ২৬শে অগাস্ট বিমানবন্দরে আত্মঘাতী হামলার দায়ভার অন্যের ঘাড়ে দিতে চাইছে। সেই হামলায় ১৩ জন মার্কিন সেনা এবং ১’শ ৬৯ জন আফগান নিহত হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ডিফেন্স সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান টোবিয়াস এলউড ‘দ্যা সান’ পত্রিকার সাথে সাক্ষাতে বলেন যে, মার্কিনীদের এই দোষারোপ করার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে, ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন কতটা নিম্ন স্তরে রয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের এক কর্মকর্তা বলছেন যে, মার্কিনীরা ‘এবি গেইট’ বন্ধ করে দিতে চাইলে ব্রিটিশরা স্বাভাবিকভাবেই তা মেনে নিতো। কারণ হুমকিজনক পরিস্থিতির ব্যাপারে সকলেই অবগত ছিল। পেন্টাগন মার্কিন মিডিয়া ‘দ্যা পিলিটিকো’কে বলে যে, পেন্টাগন গোপন তথ্যের বেআইনী ফাঁসের নিন্দা জানাচ্ছে। তারা ‘দ্যা পলিটিকো’র সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সাথে কথা বলেছেন যাতে এই তথ্য প্রকাশ করা না হয়।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তান থেকে অপরিকল্পিতভাবে সড়ে আসার কারণে ব্রিটেনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সিদ্ধান্ত ব্রিটেনের জন্যে ইইউ থেকে বের হয়ে আসার পর তার বিশ্বব্যাপী প্রভাব বৃদ্ধির ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ কৌশলের বাস্তবায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ব্রিটেন কাবুল ত্যাগের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সিদ্ধান্তের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বলেছেন যে, কাবুল এয়ারলিফট তখনই শেষ হবে, যখন মার্কিনীরা কাবুল ছেড়ে যাবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের মুখপাত্র ম্যাক্স ব্লেইন বলছেন যে, ব্রিটিশরা প্রথমে অন্যান্য ন্যাটো সদস্য দেশগুলির সাথে কথা বলেছিল কাবুলে থাকার জন্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, মার্কিনীরা কাবুল ছাড়ার সাথেসাথে তাদেরকেও চলে যেতে হবে। কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্যে ৬ হাজার মার্কিন সেনার সাথে ১ হাজার ব্রিটিশ সেনাও ছিল। দুই দশকে আফগানিস্তানে দেড় লক্ষ ব্রিটিশ সেনা যুদ্ধ করেছে এবং সাড়ে ৪’শ জন মৃত্যুবরণ করেছে। ব্রিটেনের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ সম্পর্ক’কে অন্তসারশূণ্য বলে আখ্যা দেন।

‘বিবিসি’র উত্তর আমেরিকা সম্পাদক জন সপেল এক লেখায় বলছেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন আফগানিস্তান থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কিই বা করার ছিল? একটা উদাহরণ টেনে তিনি বলেন যে, একটা ৮’শ পাউন্ডের গরিলা ঘর থেকে বের হয়ে গেলে সেখানকার ছোট বানরগুলি সেখানে থেকে কি করবে? মার্কিন সেনারা চলে আসলে ব্রিটিশ সেনারা সেই শূণ্যস্থান পূরণ করবে, এই চিন্তা করাটা অর্থহীন। যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নেবার পর ব্রিটেনের সেটা মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায়ই ছিল না। তিনি বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের মাঝে এরূপ সম্পর্ক চলছে বহুদিন আগ থেকেই। ১৯৮৩ সালে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সদস্য গ্রেনাডাতে সামরিক হস্তক্ষেপ করার সময় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগ্যান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে জিজ্ঞেস করারই প্রয়োজন মনে করেননি; যা ছিল ব্রিটিশদের জন্যে অত্যন্ত লজ্জাজনক। সপেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে দুই দেশের সম্পর্কের কিছু দিক তুলে ধরে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র অনেক সময়েই ব্রিটেনকে তার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করেছে। বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র লীজ করে আনার সময় সুযোগ বুঝে যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছেমতো শর্ত দিয়েছিল। এরপর ১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করতে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনকে দেউলিয়া করে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। এরকম আরও বহু উদাহরণ রয়েছে। সপেল বলছেন যে, গত সাত বছরে তার ওয়াশিংটনে থাকার সময়ে অনেক ইস্যুতেই মার্কিনীরা ব্রিটেনের উপর ছড়ি ঘুরিয়েছে; যেমন, ব্রিটেন তার জিডিপির কত শতাংশ প্রতিরক্ষায় খরচ করবে; ব্রিটেন চীনা টেলিকম কোম্পানির কাছ থেকে প্রযুক্তি ক্রয় করছে কিনা; অথবা ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেবে, ইত্যাদি। মোট কথা, হোয়াইট হাউজে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যেই থাকুক না কেন, ব্রিটেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, গত জুনে জি৭ বৈঠকের আগেই বাইডেন এবং জনসনের মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। বাইডেন ব্রিটেনের ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করেন। এমনকি তিনি জনসনকে ট্রাম্পের ‘ক্লোন’ বলে আখ্যা দেন। ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন’এর ‘সেন্টার অন ইইউএস পলিসিজ’এর ডিরেক্টর থমাস গিফট বলছেন যে, আফগানিস্তানের ঘটনাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলিকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির ব্যাপারে আরও সন্দেহপ্রবণ করে তুলবে। তারা মনে করবে যে, বাইডেন প্রশাসনের অধীনেও যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থকেই সুরক্ষা করে চলবে; যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্রগুলি তা অপছন্দ করে।

ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা সচিব বেন ওয়ালেস ব্রিটেনের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘স্পেকট্যাটর’এ ২রা সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক সাক্ষাতে বলেন যে, ব্রিটেন সুপারপাওয়ার নয়। ব্রিটেনের বৈশ্বিক সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রশ্ন করা হলেও তিনি উত্তরটা ঘুরিয়ে অন্য দিকে নিয়ে গিয়ে বলেন যে, তবে যে সুপারপাওয়ার কোন একটা লক্ষ্যের পিছনে লেগে থাকে না, তাকেও সুপারপাওয়ার বলা যায় না। এটা অবশ্যই একটা বৈশ্বিক শক্তি নয়; কেবলমাত্র একটা বড় শক্তি। ওয়ালেস তার মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ না করলেও ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, অনেকেই এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে মন্তব্য বলেই ধরে নেবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন যে, ওয়ালেস সামরিক শক্তির সাথেসাথে রাজনৈতিক সদিচ্ছার গুরুত্বের কথা বলছিলেন।

প্রাক্তন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব জেরেমি হান্ট ২রা সেপ্টেম্বর এক লেখায় আফগানিস্তান থেকে পলায়নের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, অপরিকল্পিত এই কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়েছে তাদের হাতেই দেশটাকে তুলে দেবার জন্যে, যারা ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলাকারীদের আশ্রয় দিয়েছিল। যারা লিবারাল আদর্শ এবং স্বাধীনচেতা সমাজের চিন্তা ধারণ করেন, তাদের জন্যে এটা খুবই কষ্টদায়ক মুহুর্ত ছিল। তিনি বলেন যে, ৪’শ ৫৭ জন ব্রিটিশ সেনা আফগানিস্তানে মৃত্যুবরণ করেছে ব্রিটেনের উপর সন্ত্রাসী হামলা কমাবার জন্যে নয়। ট্রাম্প এবং বাইডেনের একা থাকার নীতিকেও তারা সমর্থন করেনি। ব্রিটিশরা আফগানিস্তানে জীবন দিয়েছে গভীরভাবে ধারণ করা কিছু আদর্শকে রক্ষা করতে; যেমন মেয়েরা ছেলেদের মত একই শিক্ষা পাবে; আদালতে ধর্মের কোন প্রভাব থাকবে না; সাংবাদিকদের আটক করা হবে না। প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদি এই আদর্শগুলিকে বিশ্বাস করে থাকেন, তাহলে সেটা ইতোমধ্যেই শোনা গিয়েছে। হান্ট আরও বলেন যে, আফগানিস্তান থেকে সড়ে আসার সিদ্ধান্ত ব্রিটেনের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদি এরকম বিভেদ সামনের দিনে থাকে, তা হবে অত্যন্ত বিপজ্জনক।

গত ৮ই জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন যে, তিনি আফগানিস্তানে আরেকটা মার্কিন জেনারেশনকে পাঠাতে চান না; যেখানে আলাদা কোন ফলাফল পাবার কোন যুক্তিযুক্ত আশা নেই। ওবামা প্রশাসনের সময় আফগানিস্তানে মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি রিচার্ড হলব্রুক তার আত্মজীবনিতে লিখেছিলেন যে, বাইডেন ২০১১ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময় প্রেসিডেন্ট ওবামার মুখের উপর বলেছিলেন যে, আফগান মহিলাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যে তিনি তার সন্তানকে আবারও জীবন বাজি রেখে সেখানে ফেরত পাঠাতে চান না। তারা সেখানে এই কারণে যাননি। বাইডেনের কথাগুলির সাথে ব্রিটিশদের কথার বিশাল ফারাক চোখে পড়ার মতো। ব্রিটিশরা পশ্চিমা আদর্শগুলিকে যতটা শক্তভাবে ধরে রাখতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র ঠিক ততটাই সেখান থেকে নিজেকে বের করে আনতে চাইছে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রীয় চিন্তার মাঝে এই আদর্শগুলি এতটাই গভীরভাবে প্রোথিত যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বহু বছরের একতরফা সিদ্ধান্তকে ‘বিশেষ সম্পর্ক’এর খাতিরে মেনে নিয়েছে; যদিও সেগুলি ছিল ব্রিটিশ আত্মসন্মানের প্রতি আঘাতস্বরূপ। তারা শুধু এটাই চেয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাথে একই পশ্চিমা আদর্শকে ধারণ করুক এবং সেই আদর্শকে বিশ্বব্যাপী রক্ষা করতে নিজের জানমাল বিনিয়োগ করুক। এটা যতদিন যুক্তরাষ্ট্র করেছে, ততদিনই ব্রিটেন সুপারপাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তান থেকে অপমানজনক পলায়ন ব্রিটিশরা মেনে নিতে পারছে না সামরিক পরাজয়ের কারণে নয়; বরং পশ্চিমা আদর্শকে তুলে ধরায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপারগতা প্রকাশের কারণে। তবে ব্রিটিশরাও স্বীকার করে নিচ্ছে যে, তারাও সুপারপাওয়ার নয়। কারণ ব্রিটেনের একার পক্ষে পশ্চিমা আদর্শের ঝান্ডা বহণ করা সম্ভব নয়। পশ্চিমাদের আদর্শিক দুর্যোগের এই সময়ে কেউবা দায়িত্ব নেবার ইচ্ছে পোষণ করছে না; আবার কেউবা ইচ্ছে থাকলেও সামর্থের খাঁচায় আটকে পড়ে যাচ্ছে। পশ্চিমা আদর্শের জন্যে এতবড় দুর্যোগ আর কখনোই আসেনি।

4 comments:

  1. গ্লোবাল ব্রিটেন স্বপ্নে বিভোর ব্রিটেন।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর ব্রিটেনের সেই stature আর নেই। পশ্চিমা সভত্যার তল্পিবাহক যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা ও প্রভাব দিন দিন কমছে।
    এই সময়ে ব্রিটেন তার 'গ্লোবাল আউটরিচ প্রকল্প "গ্লোবাল ব্রিটেন ", এ কতটা সফল হবে সেটা " তিনি "ই জানেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্রিটেন হলো পশ্চিমা চিন্তার মাতা। যুক্তরাষ্ট্র হলো ব্রিটেনের সন্তান। যুক্তরাষ্ট্রের গায়ের জোর বেশি থাকতে পারে। তবে তার আদর্শের পুরোটাই সে পেয়েছে ব্রিটেনের কাছ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তাবিদদের মাঝে বেশকিছু লোক ছিল আইরিশ এবং পূর্ব ইউরোপের; যারা ব্রিটেনকে পছন্দ করতো না বলেই মার্কিন নীতি ব্রিটেনের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। কিন্তু তারা কখনোই তাদের আদর্শিক মাতাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। কারণ ব্রিটেন হলো সকল পশ্চিমা কনসেপ্টের আঁতুড় ঘর। ব্রিটিশরা সেই কনসেপ্টগুলিকে নিজেদের মতো তৈরি করে ধারণ করেছে। কিন্তু বাকি সকলের জন্যেই ব্যাপারটা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বুঝে বা না বুঝে সেই কনসেপ্টগুলিকে মেনে নেয়া এবং সমর্থন করে যাওয়া। ব্রিটেন ছাড়া আর কারুর জন্যেই সেই কনসেপ্টগুলি বাস্তবতা ছিল না। এই কারণেই ইউরোপের সকল দেশেই পশ্চিমা কনসেপ্টের বিরোধী অনেক কার্যকলাপ দেখা যায়। কিন্তু ব্রিটেনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পুরোপুরি আলাদা। উদাহরণস্বরূপ,

      ফরাসিরা সেকুলারিজম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মারাত্মক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে পদদলিত করেছে। অপরদিকে ব্রিটেন মুসলমদেরকে নিজের মতো করে তৈরি করিয়ে নিয়েছে, যাতে করে মুসলিমরা ব্রিটেনের স্বার্থকেই দুনিয়াকে প্রোমোট করে।

      আবার, জার্মানরা মুক্ত বাণিজ্যকে পছন্দ করে না। তারা শুধু রপ্তানি করতে চায়; আমদানি করতে চায় না। অপরদিকে ব্রিটেন এব্যাপারে সবচাইতে লিবারাল। প্রকৃতপক্ষে মুক্ত বাণিজ্যের কনসেপ্টটাই এসেছে ঊনিশ শতকে ব্রিটেনের কাছ থেকে।

      ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ইতালি সবগুলি দেশেই বিভিন্ন সময়ে একনায়ক শাসন করেছে এবং জনগণকে লৌহ হস্তে শাসন করেছে। কিন্তু ব্রিটেন তার লিবারাল চিন্তাকে সকল ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের মতো করে লালন করে গেছে।

      শেষকথা হলো, ব্রিটেন হলো পশ্চিমা বিশ্বের চিন্তার ধারক এবং বাহক। যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশকের জন্যে এই চিন্তার রক্ষাকর্তা ছিল কেবল। সেটা তারা ছিল তাদের ম্যাটেরিয়াল শক্তির কারণে; যেটা না হলে পশ্চিমারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারতো না। যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে যে লিবারাল আদর্শকে কমিউনিজমের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করেছিল, তা মূলতঃ ব্রিটিশদেরই চিন্তা।

      মনে রাখবেন যে, মার্কিনীরা ইংল্যান্ডের মাতৃভাষাতেই কথা বলে। এবং এতে তারা লজ্জাবোধ করে না।

      Delete
  2. ধন্যবাদ। বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার জন্য ।

    তবে যে প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে সেটি হল, গ্লোবাল ব্রিটেন কতটা সফল হবে?
    এই প্রজেক্টটি সফল হলে পশ্চিমা আদর্শিক বিশ্বব্যবস্থা নতুন রুপে পৃথিবী রাজ করবে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. কেউই বিশ্বাস করে না যে, 'গ্লোবাল ব্রিটেন' আবারও দুনিয়া শাসন করবে। কারণ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের দুনিয়া আর পরের দুনিয়া পুরোপুরিভাবে আলাদা। ব্রিটেন যখন সুপারপাওয়ার ছিল, তখন সে দুনিয়াটাকে একভাবে সাজিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়াটাকে নিজের মতো করে সাজিয়েছিল। এখন ব্রিটেনকে সেই দুনিয়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সমস্যা হলো, এখন গোটা দু'শ আলাদা দেশ তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়। এই দেশগুলির সবগুলি নিয়ন্ত্রণ করা ব্রিটেনের পক্ষে সম্ভব হবে না। ব্রিটেন দুনিয়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অন্য দেশগুলির উপরে এতটাই নির্ভর করতে হবে যে, তা ব্রিটেনের কর্মকান্ডকে প্রতিনিয়ত সমস্যায় ফেলবে। কেউ যদি ব্রিটেনের সাথে একমত না হয়, তাহলে তাদেরকে বাধ্য করার জন্যে ব্রিটেনের কাছে খুব কম অস্ত্রই রয়েছে।

      তবে ব্রিটেনের জন্যে সবচাইতে বড় সমস্যা হলো পশ্চিমা চিন্তার অধঃগতি। চিন্তাটা এখন দুনিয়ার মানুষের সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম হচ্ছে না। করোনাভাইরাসের সমস্যাটা এক্ষেত্রে সবচাইতে বড় উদাহরণ যে, পশ্চিমা চিন্তা মানুষের সমস্যার সমাধান দিতে অক্ষম।

      এখন এই অক্ষম চিন্তার উপর ভিত্তি করে দুর্বল ব্রিটেন অন্যান্য দেশের শক্তিকে ব্যবহার করে দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করবে - এটা কেউই বিশ্বাস করে না; ব্রিটিশরাও না। ব্রিটিশ নতুন জেনারেশন এই কাজটা করতে চায় না। তারা তাদের আদর্শের জন্যে জীবন দেবে না। কারণ তাদের আদর্শই তাদেরকে শিখিয়েছে যে, সম্পদ হলো সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। মোবাইল এবং গার্লফ্রেন্ডকে ছেড়ে কোন ব্রিটিশ যুবক যুদ্ধ করতে যেতে চায় না। তাও আবার অন্য দেশের মাটিতে আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে; যখন সেই দেশের মানুষ তাদেরকে সেখানে দেখতে চায় না।

      Delete