Wednesday 29 September 2021

মধ্য এশিয়াতে তুরস্ক ও পাকিস্তানের কৌশলগত সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে

৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২১

ইরানের কর্মকর্তারা কাস্পিয়ান সাগরীয় অঞ্চলে তুরস্ক এবং পাকিস্তানের সামরিক অবস্থানকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন। মধ্য এশিয়ার ‘লাপিস লাজুলি করিডোর’ বরাবর তুরস্কের এবং পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে।


সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক এবং পাকিস্তানের কৌশলগত সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমা সৈন্য চলে যাবার পর থেকে তালিবানদের অধীনে আফগানিস্তানকে বিভিন্নভাবে সমর্থন দেবার ক্ষেত্রে পাকিস্তান এবং তুরস্কের কৌশলগত সহযোগিতা চোখে পড়ছে। তবে এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটা দেশের নামও উল্লেখ করার মতো; যার নাম কাতার। প্রায় একইসাথে মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে পাকিস্তান থেকে তুরস্ক পর্যন্ত ‘লাপিস লাজুলি’ নামের একটা কৌশলগত পরিবহণ নেটওয়ার্ক ডেভেলপ করে ভূমধ্যসাগরকে মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে ভারত মহাসগরের সাথে যুক্ত করে তার নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষেত্রেও মধ্য এশিয়ার দেশ আজেরবাইজান এবং তুর্কমেনিস্তানের নাম সামনে আসছে।

গত জুন এবং জুলাই মাসে তুরস্কে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো যৌথ সামরিক মহড়া ‘আনাতোলিয়ান ঈগল ২০২১’। তুরস্কের বিমান বাহিনীর অফিশিয়াল বিবৃতি অনুযায়ী এই মহড়ার উদ্দেশ্য ছিল অংশগ্রহণকারী দেশগুলির জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাকে একে অপরের সাথে সমন্বয় করা। এবং একইসাথে সত্যিকারের যুদ্ধাবস্থায় যৌথ অপারেশনে অভ্যস্ত হওয়া। এটা ছিল মূলতঃ চারটা দেশের বিমান বাহিনীর একটা মহড়া। তুরস্ক এই মহড়া অনেকদিন ধরেই আয়োজন করে চলেছে। তবে সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই মহড়ার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। মহড়ায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ৫টা ‘জেএফ ১৭’ ফাইটার বিমান অংশ নেয়। এর সাথে মহড়ায় অংশ নেয় আজেরবাইজানের রুশ নির্মিত ২টা ‘মিগ ২৯’ বিমান এবং ২টা ‘সুখোই ২৫’ যুদ্ধবিমান। তুরস্কের পক্ষ থেকে ৩৮টা ‘এফ ১৬’ বিমান, একটা ‘আনকা এস’ ড্রোন এবং একটা ‘কেসি ১৩৫’ রিফুয়েলিং বিমান অংশ নেয়। তবে পুরো মহড়ার সবচাইতে আলাদা অংশগ্রহণকারী ছিল কাতারি বিমান বাহিনীর ৪টা ফরাসি নির্মিত ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান। এর ফলে তুর্কি এবং পাকিস্তানি ফাইটার পাইলটরা প্রথমবারের মতো ফরাসি ‘রাফাল’ ফাইটার জেটের বিরুদ্ধে একটা সত্যিকারের মহড়ায় অংশ নেয়। পাকিস্তানের মূল আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ফ্রান্স থেকে ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান কিনেছে। অপরদিকে তুরস্কের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিসও ফ্রান্স থেকে ‘রাফাল’ বিমান পাচ্ছে। এই যৌথ মহড়ার ব্যাপারে ভারত এবং গ্রিস উভয় দেশের বিশ্লেষকেরাই দুশ্চিন্তা দেখিয়েছেন। কারণ এর মাধ্যমে তুরস্ক এবং পাকিস্তান উভয়েই ‘রাফাল’ বিমানের সক্ষমতা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা অর্জন করতে পারবে।

শুধু মহড়াই নয়। জুন মাসে কাতারের সাথে তুরস্কের একটা আলাদা চুক্তি তুর্কি পার্লামেন্টে পেশ করা হয়, যার মাধ্যমে কাতারি বিমান বাহিনীর ৩৬টা বিমান এবং প্রায় আড়াই’শ সদস্য তুরস্কে ট্রেনিং নেবে। ‘মিডলইস্ট আই’ বলছে যে, গত মার্চেই তুর্কি সামরিক বাহিনীর জেনারেল ইয়াসার গুলার কাতারিদের সাথে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী কাতারি বিমান বাহিনী পাঁচ বছরের জন্যে তুরস্কে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। প্রতিবারের প্রশিক্ষণের আগে দুই মাসের একটা আগাম খবর দেবে কাতারিরা। ডকুমেন্টে বলা হয় যে, এর মাধ্যমে দুই দেশের মাঝে সামরিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি পাবে। তুরস্কের আকাশসীমা এবং বন্দরসমূহ ব্যবহার করে কাতারিরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবে। প্রতিবেদনে আরও মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, ২০১৭ সাল থেকে কাতারের উপর সৌদি গ্রুপের অবরোধ আরোপের পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে সেসসম্য় থেকেই কাতারে তুরস্কের একটা সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পেও কাতারিরা বিনিয়োগ করেছে এবং তুরস্কের পর্যটন ও রিয়েল এস্টেট খাত ছাড়াও বিভিন্ন খাতে কাতার ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। তবে তুরস্কের মাটিতে কাতারিদের বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ নতুন কিছু নয়। ১৯৯০এর দশক থেকে শুরু করে এক দশকের বেশি সময় ধরে ইস্রাইলি বিমান বাহিনী তুরস্কের পাহাড়ি অঞ্চলকে আকাশ প্রশিক্ষণের জন্যে ব্যবহার করে। উভয় পক্ষ একে অপরের বিমান এবং কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে। সেই হিসেবে গ্রিক বিশ্লেষকদের মতে, তুর্কিরা কাতারের ‘রাফাল’ ফাইটার বিমান সম্পর্কে গভীর ধারণা পেতেই কাতারি বিমান বাহিনীর বিমানকে নিজ দেশে প্রশিক্ষণে দেখতে চায়। এতে তুর্কিরা ফরাসি বিমান সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারবে।

 

অপরদিকে তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের কৌশলগত সহযোগিতা আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় সেপ্টেম্বর মাসে। ১২ই সেপ্টেম্বর থেকে আজেরবাইজানের রাজধানী বাকুতে শুরু হয় ত্রিদেশীয় আরেকটা যৌথ মহড়া। ‘থ্রি ব্রাদার্স ২০২১’ নামের এই মহড়া আরেকটা দিকনির্দেশনা দেয়। আজেরবাইজানের স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার লেঃ জেনারেল হিকমাত মিরজাইয়েভ তুর্কি এবং পাকিস্তানের স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের নিজ দেশে স্বাগত জানান। তিন দেশের কাছাকাছি সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করতে জেনারেল মিরজাইয়েভ আর্মেনিয়ার সাথে ৪৪ দিনের যুদ্ধের প্রথম থেকেই তুরস্ক এবং পাকিস্তানের পুরোপুরি সমর্থনের কথা উল্লেখ করেন। প্রায় তিন দশকের আর্মেনিয় দখলদারিত্বের পর আজেরিরারা নাগোর্নো কারাবাখের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ শহরসহ প্রায় ৩’শ বসতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়; যখন উভয় পক্ষ রুশ মধ্যস্ততায় যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়। জেনারেল মিরজাইয়েভ তিন দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক নিরাপত্তার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তুর্কি লেঃ কর্নেল কুরসাত কনুক এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লেঃ কর্নেল আমির শাহজাদ দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এই সামরিক সম্পর্কের গুরুত্বকে তুলে ধরেন।

তুরস্কের ‘কাদির হাস ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর মিতাত চেলিকপালা তুর্কি মিডিয়া ‘টিআরটি’র সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, এই মহড়ার মাধ্যমে তুরস্ক এবং আজেরবাইজানের কৌশলগত অবস্থানকে মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে আফগানিস্তান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তুরস্ক এবং পাকিস্তানের মাঝে সামরিক এবং কৌশলগত সম্পর্ককে আরও শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত করতেই আজেরবাইজানের মাধ্যমে দেশদু’টাকে আরও কাছাকাছি আনা হচ্ছে। অপরদিকে আজেরবাইজানের ‘এডিএ ইউনিভার্সিটি’র ফারিজ ইসমাঈলজাদে বলছেন যে, এই মহড়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে পরিবহণ করিডোর, যার মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। যদিও এই মহড়া কোন বিশেষ দেশকে টার্গেট করে হচ্ছে না, তথাপি আর্মেনিয়ার মতো কোন দেশ যদি আবারও অত্র অঞ্চলে শান্তি বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে, তবে তার জন্যে এই মহড়া হবে একটা হুমকি। তবে ইরানের কর্মকর্তারা কাস্পিয়ান সাগরীয় অঞ্চলে তুরস্ক এবং পাকিস্তানের সামরিক অবস্থানকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন। মধ্য এশিয়ার ‘লাপিস লাজুলি করিডোর’ বরাবর তুরস্কের এবং পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment