Sunday 31 May 2020

হংকং নিয়ে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব কোন দিকে যাচ্ছে?

করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা যখন চরমে উঠছে, তখন দুই দেশের দ্বন্দ্বের নতুন নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, এখন থেকে হংকং আর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল নয়। র ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হংকংএর কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ব্যাহত হতে পারে এবং সেখানে বিনিয়োগও ব্যাহত হতে পারে। এর অর্থনৈতিক ফলাফলের চাইতে ভূরাজনৈতিক ফলাফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন কিছু করলে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য, মহামারি এবং প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব এখন চরম পর্যায়ে রয়েছে। 


৩১শে মে ২০২০


গত ২৭শে মে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও এক বার্তায় ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে হংকং আর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল নয়। তিনি বলেন যে, তিনি মার্কিন কংগ্রেসকে এই কথাই বলে এসেছেন। পম্পেওর এই ঘোষণা ছিল চীনা সরকারের হংকংএর জন্যে নতুন নিরাপত্তা আইন তৈরির পদক্ষেপের ফলাফল। পম্পেও বলেন যে, এটা এখন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, হংকংকে চীন নিজের মতো করে গড়ে নিতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দিয়ে ‘বিবিসি’ বলছে যে, এতকাল বৈশ্বিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে হংকংকে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা দিয়ে আসছিল। তবে এই নতুন আইনের কারণে হংকংএর স্বায়ত্বশাসন ব্যাহত হবে বিধায় হংকংএর বিশেষ সুবিধা পাবার ব্যাপারটা রহিত করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। আইনগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র হংকংকে এই সুবিধা দিচ্ছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময় থেকেই। তবে ২০১৯ সাল থেকে এই আইনগত সুবিধা হংকং পাবে কিনা, তা নির্ভর করছিল হংকংএর স্বায়ত্বশাসনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। এই সময় থেকেই হংকংএর স্বায়ত্বশাসনকে যুক্তরাষ্ট্র স্বায়ত্বশাসন আখ্যা দেবে কিনা, তা হয়ে গিয়েছিল শর্তসাপেক্ষ। যদি মার্কিন সরকার কংগ্রেসকে বোঝাতে না পারে যে, হংকংএর স্বায়ত্বশাসন এখনও বলবত রয়েছে, তাহলে কংগ্রেস হংকংএর বিশেষ সুবিধা কেড়ে নিতে পারে। এর অর্থ হলো, এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র হংকং এবং চীনের মাঝে কোন পার্থক্য করবে না। এর ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হংকংএর কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ব্যাহত হতে পারে এবং সেখানে বিনিয়োগও ব্যাহত হতে পারে। হংকংকে চীনা এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ব্যাবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন সুবিধা পাবার জন্যে।

অপরদিকে চীনা সরকার বলছে যে, নতুন আইনের মাধ্যমে হংকংএ সহিংসতা বন্ধ করা যাবে। এতে শুধুমাত্র কিছু সমস্যা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিই বিপদে পড়বে। ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ থেকে চীনাদের অধীনে যাবার সময় চীনারা ‘এক দেশ দুই ব্যবস্থা’র অধীনে হংকংকে যথেষ্ট স্বায়ত্বশাসন দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে হংকংএর গণতন্ত্রকামীরা বলছে যে, নতুন আইনের মাধ্যমে চীন হংকংএর স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নিতে চাইছে। হংকংএর গণতন্ত্রী আন্দোলনকারীদের নেতা জশুয়া ওয়ং বলছেন যে, চীনের নিরাপত্তা আইন হংকংএর ব্যাবসার ব্যাপক ক্ষতি করবে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার নেতৃবৃন্দকে হংকংএর সাথে ব্যবসার জন্যে বিশেষ সুবিধা বাতিলের আহ্বান জানান। হংকংএর বিশেষ স্ট্যাটাস ধরে রাখার মাধ্যমেই ব্যাবসায়ীরা তাদের ব্যবসার স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন বলে বলছেন তিনি। নিজেদের কূটনৈতিক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র হংকংএ মার্কিন সরকারের মালিকানায় থাকা সাড়ে ৬’শ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পত্তি নিলামে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ব্যাতীত ব্রিটেন এবং কমনওয়েলথের অন্তর্গত কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া চীনের পদক্ষেপের ব্যাপারে ‘গভীর উদ্বেগ’ জানিয়েছে। তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মত কঠোর পদক্ষেপ নেবার কোন হুমকি এখনও দেয়নি। ব্রিটেন বলছে যে, তারা হয়তো হংকংএর বাসিন্দাদের জন্যে ভিসা সুবিধা বৃদ্ধি করতে পারে।

হংকংএর বিশেষ স্ট্যাটাস চলে যাবার সম্ভাবনার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে ‘বিবিসি’ বলছে যে, এর অর্থনৈতিক ফলাফলের চাইতে ভূরাজনৈতিক ফলাফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন কিছু করলে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য, মহামারি এবং প্রযুক্তিগত দ্বন্দ্ব এখন চরম পর্যায়ে রয়েছে। এখন প্রশ্ন আসবে যে, হংকংএর বিশেষ স্ট্যাটাস কেড়ে নেবার ফলে হংকংবাসীদের স্বায়ত্বশাসন এবং স্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন সুবিধা হবে কিনা; অথবা এতে শুধু হংকংএর জনগণের কষ্টই শুধু বাড়বে কিনা। ২৯শে মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন যে, হংকংএর বিশেষ স্ট্যাটাস কেড়ে নেয়া ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র কিছু গুরুত্বপূর্ণ চীনা ব্যক্তিত্বের উপর অবরোধ আরোপ করতে পারে। ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, ৩১শে মে চীনা মিডিয়াতে মার্কিন ঘোষণার ব্যাপক সমালোচনা করা হয়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘পিপলস ডেইলি’তে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত চীনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’ বলছে যে, চীন ইতোমধ্যেই সবচাইতে খারাপ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এব্যাপারে যতদূরই এগিয়ে যাক না কেন, চীন প্রতিযোগিতায় থাকবে।

করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা যখন চরমে উঠছে, তখন দুই দেশের দ্বন্দ্বের নতুন নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত কয়েক হাজার চীনা গ্র্যাজুয়েট ছাত্রকে সেদেশ থেকে বের করে দেয়া হতে পারে বলে বলছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসা ছাত্রদের মাঝে কেউ যদি এমন কোন চীনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসে থাকে, যার কিনা চীনা সামরিক বাহিনী বা চীনা ইন্টেলিজেন্সের সাথে যোগাযোগ রয়েছে, তাহলে সেই ছাত্রের ভিসা বাতিল হয়ে যেতে পারে। মার্কিন কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলি যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের বিরোধী; কারণ চীনা ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্যে বড়সড় আয়ের উৎস। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ২০১৮ সালে সাড়ে ৩ লক্ষের বেশি চীনা ছাত্রের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। চীনা ছাত্ররা যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসা মোট বিদেশী ছাত্রের এক-তৃতীয়াংশ। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, যেসব ছাত্রদের গোয়েন্দা কর্মকান্ডে জড়াবার সম্ভাবনা বেশি, শুধুমাত্র তাদেরকেই বের করে দেবার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। হংকংএর আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত না হলেও ছাত্রদের বহিষ্কার করার এই পদক্ষেপ চীনা সরকারকে প্রতিশোধমূলক কোন পদক্ষেপে প্ররোচিত করতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দুই দেশের মাঝে দূরত্ব বাড়াটা এমন এক পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে, যেখানে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা দ্রুত কমছে এবং একইসাথে পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। উত্তেজনা প্রশমণের পিছনে প্রচেষ্টা চললেও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দুই দেশ সাংঘর্ষিক অবস্থানেই থেকে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চীনের প্রভাব বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্ষুন্ন হওয়া ছাড়াও আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন শক্তির আবির্ভাবের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। আর চীনের সাথে বিরোধের জের ধরে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাবার কারণে এই সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, যা কিনা বৈশ্বিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। 

No comments:

Post a Comment