Sunday 24 May 2020

‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তিকে বিদায় দিল যুক্তরাষ্ট্র - বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তনের আরেকটা ধাপ সম্পন্ন হলো

২৪শে মে ২০২০
   
মার্কিন বিমান বাহিনীর ৬০ বছরের পুরোনো 'ওসি-১৩৫বি' গোয়েন্দা বিমান, যা 'ওপেন স্কাইজ' চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। মার্কিন চিন্তাবিদদের হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীই এখন চীন। ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তিতে ইউরোপ, রাশিয়া থাকলেও চীন নেই। যুক্তরাষ্ট্র এখন তার নিজের তৈরি করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকেই বের হয়ে যাচ্ছে; যা বর্তমান পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার স্থায়িত্বকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে। ইউরোপের ছোট দেশগুলির যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতার দিন যেমন ঘনিয়ে আসছে, তেমনি কৌশলগত দিক থেকে ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
 
গত ২১শে মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তি থেকে বের করে আনার ঘোষণা দেন। এই চুক্তির অধীনে পশ্চিমা দেশগুলির সাথে রাশিয়ার সমঝোতা হয় যে, তারা একে অপরের আকাশসীমায় গোয়েন্দা বিমান ওড়ার অনুমতি দেবে। হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন যে, রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তবে রাশিয়া এই চুক্তি মানছে না। কাজেই যতদিন রাশিয়া এই চুক্তি অনুযায়ী না চলবে, ততদিন যুক্তরাষ্ট্র এর থেকে বাইরে থাকবে। ট্রাম্পের বক্তব্যের পরদিন ফরাসী পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয় যে, ফ্রান্সের সাথে জার্মানি, বেলজিয়াম, স্পেন, ফিনল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, চেক রিপাবলিক এবং সুইডেন এই চুক্তিকে সন্মান করে যাবে। ফরাসীরা বলছে যে, রাশিয়া যে চুক্তি পুরোপুরি মানছে না, এই ব্যাপারটাতে তার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একমত; তদুপরি তারা এই চুক্তিতে থাকবে। অপরদিকে রাশিয়ার উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ বলেন যে, ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাওয়াটা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্যে হুমকিস্বরূপ। আর রাশিয়া এই চুক্তি মানছে না বলে যুক্তরাষ্ট্র যে অভিযোগ করছে, সেব্যাপারে তিনি বলেন যে, ওয়াশিংটন এই অভিযোগের সমর্থনে কোন প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের ফলে ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মাঝে স্বাক্ষরিত এবং ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া ‘নিউ স্ট্র্যাটেজিক আর্মস রিডাকশন টকস’ বা ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাপারেও সন্দেহ তৈরি হলো। এটা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নবায়ন হবার কথা রয়েছে। ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া নিজেদের কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা সাড়ে ১৫’শএর মাঝে সীমাবদ্ধ্ব করতে সম্মত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো অংশীদাররা রাশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগগুলির ক্ষেত্রে একমত হলেও তারা চুক্তি থেকে মার্কিনীদের বের হয়ে যেতে মানা করেছিল। ন্যাটোর এক কর্মকর্তা ‘আল জাজিরা’কে বলেন যে, ২০১৮ সালে শীর্ষ বৈঠকে যখন কথা উঠেছিল যে রাশিয়া কিছু বিশেষ স্থানেই শুধু এই চুক্তির বাস্তবায়ন করছে, তখনই নিরাপত্তার অবমূল্যায়নের ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

১৯৫৫ সালে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের মার্কিন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রস্তাব দেয় যে একে অপরের আকাশসীমায় গোয়েন্দা বিমান প্রেরণের মাধ্যমে উভয় পক্ষের সন্দেহ দূরীকরণ করা যেতে পারে। একে অপরের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হওয়া যাবে যে একজন অপরের উপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে না। সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ বলেন যে, সোভিয়েতরা মার্কিন কনসেপ্ট বা চিন্তার সাথে একমত নয়। তবে আইজেনহাওয়ারের এই প্রস্তাবের ৩৪ বছর পর আরেকজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ এধরনেরই আরেকটা প্রস্তাব নিয়ে আসেন, যার মাধ্যমে ন্যাটো এবং সোভিয়েত নেতৃত্বে থাকা ওয়ারস প্যাক্টের মাঝে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের খাতিরে নিজেদের আকাশসীমায় অপরের গোয়েন্দা বিমান ওড়ানোর কথা বলা হয়। এই আলোচনা চলার মাঝেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়; তবে আলোচনা চলে। অবশেষে ১৯৯২ সালের মার্চে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়াসহ ২৪টা দেশ ‘ওপেন স্কাইজ ট্রিটি’ স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে সকল দেশের জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন আদায় এবং সকল শর্ত চুড়ান্ত হবার পর ২০০২ সালের ২রা জানুয়ারি এই চুক্তি বাস্তবায়ন শুরু হয়। এই কর্মকান্ড বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র ‘ডিফেন্স থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি’ বা ‘ডিটিআরএ’ নামের একটা সংস্থা গঠন করে। এই সংস্থার অধীনে দু’টা ‘ওসি-১৩৫বি’ গোয়েন্দা বিমান রয়েছে। রাশিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এবং ইউক্রেনের কিছু গোয়েন্দা বিমানকে এই চুক্তির অধীনে প্রতিপক্ষের দেশের আকাশসীমায় ছবি তোলার সার্টিফিকেট দেয়া হয়। পশ্চিমা দেশগুলিও এই কাজে নিজেদের বিমান নিয়োজিত করে। ক্যামেরাগুলি বাজারে পাওয়া বাণিজ্যিক ক্যামেরা হবার শর্ত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা দেবার আগ পর্যন্ত এই চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ছিল ৩৫।

চুক্তি থেকে বের হয়ে যাবার কথা অনেক আগ থেকেই চলছিল। চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহৃত বিমানগুলি প্রায় ৬০ বছরের পুরোনো, এবং এগুলির রক্ষণাবেক্ষণের পিছনে অনেক খরচ করতে হয়। গত অক্টোবরে মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর টম কটন এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, প্রেসিডেন্টের উচিৎ ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেয়া এবং এই কাজ থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েক’শ মিলিয়ন ডলারকে অন্য গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ব্যবহার করে মার্কিন সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তবে যারা চুক্তির পক্ষে রয়েছেন, তাদের পক্ষেও রয়েছে যুক্তি। কানাডিয়ান সামরিক বিশ্লেষক স্টেফান ওয়াটকিন্স চুক্তির সুফলগুলি নিয়ে বলেন যে, এই চুক্তির কারণে পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিরা রুশ প্রতিনিধিদের সাথে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আলোচনা করতে পারছেন। এর মাধ্যমে তারা ওপাড়ের অবস্থার একটা ধারণা পান। ওপাড়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা, অথবা সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে কিনা, সেব্যাপারে তারা তথ্য পেয়ে থাকেন। নিজেদের মাঝে যোগাযোগের ফলে পারস্পরিক বিশ্বাসের দিক থেকে উন্নয়ন হয়। অপরদিকে ‘সেন্টার ফর স্ট্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর এরোস্পেস বিশেষজ্ঞ টড হ্যারিসন বলছেন যে, এই চুক্তির অধীনে ৩০ সেন্টিমিটার রেজোলিউশনের ছবি তোলা যায়, যা বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবির চাইতে আলাদা কিছু নয়। স্যাটেলাইট ব্যবহারের যুক্তির সমালোচনা করে মার্কিন ‘কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস’এর পারমাণবিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ এমি উলফ বলছেন যে, স্যাটেলাইটের ছবিগুলি বহুদূর থেকে তোলা হয় বিধায় বায়ুমন্ডলের ধূলাবালির কারণে ছবির মান ভালো হয়না; অন্যদিকে বিমানগুলি ভূমির অনেক কাছ দিয়ে ওড়ে বিধায় সেগুলি অনেক ভালো মানের ছবি দেয়। তাছাড়া বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের ছবি কেউ পরিবর্তন বা বিকৃত করেও সরবরাহ করতে পারে। যেসব দেশের স্যাটেলাইট থেকে ছবি তোলার সক্ষমতা নেই, সেসব দেশ বিমান থেকে তোলা ছবির উপর নির্ভর করতে পারে। এভাবে পুরো ইউরোপের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়। টড হ্যারিসন বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তার পুরোনো ‘ওসি-১৩৫বি’ বিমানগুলি অবসরে পাঠিয়ে দিলেও নিজেরা চুক্তির মাঝে থাকতে পারে। এতে অন্য দেশগুলি এই চুক্তির সুবিধাগুলি পাবে। আর যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের বিমান ব্যবহার করেও এই কাজ সম্পাদন করতে পারে।

করোনাভাইরাসের মহামারির মাঝে অর্থনৈতিক ধ্বসের পরেও প্রতিরক্ষা বাজেটের কতটা আগের মতোই রাখা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। আর তন্মধ্যে রুশ সহযোগিতার ব্যাপারে সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তির পিছনে কয়েক’শ মিলিয়ন ডলার খরচ করাটা ট্রাম্প সরকারের কাছে সমর্থনযোগ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব অর্থ খরচে ইউরোপের দেশগুলির নিরাপত্তা দেবার ব্যাপারটাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ; কারণ এই দেশগুলির অনেকগুলিই এখন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পক্ষে থাকছে না। ন্যাটোর সদস্য হিসেবে ইউরোপের দেশগুলি নিজেদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করছে না; যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ন্যাটো দেশগুলির টানাপোড়েন চলছে বেশকিছুদিন ধরেই। আর করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ইউরোপের অনেক দেশই চীনের কাছ থেকে সহায়তা নিয়েছে; যা ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। অথচ মার্কিন চিন্তাবিদদের হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীই এখন চীন। ‘ওপেন স্কাইজ’ চুক্তিতে ইউরোপ, রাশিয়া থাকলেও চীন নেই। যুক্তরাষ্ট্র এখন তার নিজের তৈরি করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকেই বের হয়ে যাচ্ছে; যা বর্তমান পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার স্থায়িত্বকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে। ইউরোপের ছোট দেশগুলির যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতার দিন যেমন ঘনিয়ে আসছে, তেমনি কৌশলগত দিক থেকে ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে।


No comments:

Post a Comment