Friday 22 May 2020

মালদ্বীপে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ঘনীভূত হচ্ছে

২৩শে মে ২০২০
   
মে মাসের স্যাটেলাইট ছবি। ‘ফেইধু ফিনোলহু’ দ্বীপে রেজর্ট তৈরির কাজ করতে গিয়ে দ্বীপকে বড় করছে চীনা কোম্পানি। রেজর্ট তৈরির জন্যে আরও অনেকেই মালদ্বীপে দ্বীপ লীজ নিলেও চীনাদের এই লীজ নেয়া এবং দ্বীপ উন্নয়নের কাজের ব্যাপারে ভারতীয় চিন্তাবিদেরা বিশেষভাবে চিন্তিত।

মে মাসে স্যাটেলাইট ছবির মাধ্যমে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষকরা বলেন যে, মালদ্বীপে চীনারা একটা দ্বীপের উন্নয়ন কাজ বেশ এগিয়ে নিয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে যেখানে এই দ্বীপের আকৃতি ছিল মাত্র ৩৮ হাজার বর্গ মিটার, সেখানে ২০২০এর ফেব্রুয়ারিতে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লক্ষ বর্গ মিটার। ‘ফেইধু ফিনোলহু’ নামে রাজধানী মালের কাছাকাছি অবস্থিত এই দ্বীপটা একসময় ছিল একটা জনমানবশূণ্য দ্বীপ। মালদ্বীপের পুলিশ ওয়েলফেয়ার কোম্পানির অধীনে থাকা এই দ্বীপটাকে ২০১৭ সালে একটা চীনা কোম্পানির কাছে রেজর্ট তৈরির জন্যে ৪ মিলিয়ন ডলারে ৫০ বছরের জন্যে লীজ দেয়া হয়। এই সময়ের মাঝে পুলিশ ওয়েলফেয়ার সেই কোম্পানির কাছ থেকে ৮৫ মিলিয়ন ডলার পাবে। মালদ্বীপে দ্বীপ লীজ দেয়াটা নতুন নয়। এই লীজের আগে পাঁচ বছরের মাঝে কয়েক ডজন মানবশূণ্য দ্বীপ রেজর্ট তৈরির উদ্দেশ্যে দেশী এবং বিদেশী কোম্পানির কাছে লীজ দেয়া হয়। তবে ২০১৬ সালে লীজ দেয়ার নিয়মকানুনে কিছু পরিবর্তন এনে ‘ক্লোজড’ বিডিংএর অনুমোদন দেয়া হয়। রেজর্ট তৈরির জন্যে আরও অনেকেই মালদ্বীপে দ্বীপ লীজ নিলেও চীনাদের এই লীজ নেয়া এবং দ্বীপ উন্নয়নের কাজের ব্যাপারে ভারতীয় চিন্তাবিদেরা বিশেষভাবে চিন্তিত। মালদ্বীপে চীনা বিনিয়োগ ভারতীয়দের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। ‘ইন্ডিয়া টুডে’র এক প্রতিবেদনে চীনা এই প্রকল্পকে ভারত মহাসাগরে চীনাদের প্রভাব বৃদ্ধির প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করা হয়। তবে মালদ্বীপে ভারত এবং চীনের এই দ্বন্দ্বকে বুঝতে হলে আরও অনেকগুলি ক্ষেত্রের দিকে তাকাতে হবে।

মালদ্বীপে চীনাদের প্রভাব বৃদ্ধির শুরু ২০০৯ সালের পর থেকে; যখন প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুমের ৩০ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। গাইয়ুমের উত্তরসুরী মোহামেদ নাশীদ ভারত-ঘেঁষা বলেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালে মোহাম্মেদ ওয়াহিদ হাসান প্রেসিডেন্ট হবার পর পরিস্থিতি বেশ কিছুটাই পাল্টে যায়। মোহামেদ নাশীদের সমর্থকেরা ওয়াহিদের সরকারকে কাজ করতে না দিলেও কিছু ব্যাপারে ওয়াহিদ সরকারের সিদ্ধান্ত মালদ্বীপের রাজনীতিতে পরিবর্তনের আভাস দেয়। ‘দ্যা ইকনমিক টাইমস’ বলছে যে, ২০১০ সালের জুনে মালদ্বীপের মূল বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজ দেয়া হয় ভারতীয় কোম্পানি ‘জিএমআর গ্রুপ’কে। ৫’শ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প ভারতকে দেয়ার জন্যে সেসময় প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশীদের সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তবে মোহাম্মেদ ওয়াহিদ হাসানের সরকার ২০১২ সালের নভেম্বরে এই প্রকল্প বাতিল করলে ভারতীয় কোম্পানি সিঙ্গাপুরের আদালতে মামলা করে। তবে বিমানবন্দরের কাজ ভারতীয়দের না পাওয়াটা ভূরাজনীতিতে মালদ্বীপের অবস্থান পরিবর্তিত হবার লক্ষণ হিসেবে আবির্ভূত হয়। যা সবসময় ভারত তার নিজের প্রভাবের জায়গা মনে করতো, তার ব্যাপারে এখন অতটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
   
মালদ্বীপের মতো ছোট্ট দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ না হলে এখানে সাড়ে তিন কিঃমিঃ লম্বা বিশাল রানওয়ের আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর তৈরির প্রশ্নই উঠতো না। রয়াল নিয়জিল্যান্ড এয়ার ফোর্সের পরিবহণ বিমান এবং এয়ার সিলনের বাণিজ্যিক ফ্লাইটই বলে দিচ্ছে যে, এই বিমানবন্দরের বেসামরিক এবং সামরিক কোন বিভেদ নেই। এখন বেসরকারি বিমানবন্দর হওয়া সত্ত্বেও কৌশলগত দিক থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এই বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলছে টানাপোড়েন।

মালদ্বীপে বিমানবন্দরের ভূরাজনীতি

মালদ্বীপে বিমানবন্দর তৈরির ইতিহাসটা আলোচনায় আনা যেতে পারে। মালদ্বীপের এই বিমানবন্দর শুধু বেসামরিক বিমানবন্দরই নয়; একমাত্র বড় বিমানবন্দর। ভারত মহাসাগরে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন সামরিক ঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়া থেকে এই মালে বিমানবন্দরের দূরত্ব প্রায় ১৩’শ কিঃমিঃ। ভারতের দক্ষিণ উপকূল থেকে মালের দূরত্ব প্রায় ৫’শ কিঃমিঃ; আর শ্রীলংকার কলম্বো থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৭’শ কিঃমিঃ। শ্রীলংকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের মাঝ দিয়ে যাওয়া পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্য রুটগুলির একটা মালে থেকে মাত্র ৪’শ কিঃমিঃএর দূরত্বে মালদ্বীপের উত্তরের দীপগুলি এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জের মাঝ দিয়ে যায়। লাক্ষাদ্বীপের আগাত্তিতে ভারতের একটা বিমানবন্দর থাকলেও সেখানে লজিস্টিক্যাল কারণে নিয়মিত বিমান ওঠানামা করানো কঠিন। অন্যদিকে মালে বিমানবন্দর ২০১৯ সালে ৫৪ হাজার ফ্লাইটে ৪৮ লক্ষ যাত্রী এবং প্রায় ৬৫ হাজার টন মালামাল হ্যান্ডলিং করেছে। মালদ্বীপের সর্বউত্তরে হানিমাধুতে আরেকটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাকলেও সেটা লজিস্টিক্যাল দিক থেকে মালে বিমানবন্দরের ধারেকাছেও নয়। মালদ্বীপের দক্ষিণে কাধধুতে একটা এবং হুলুওয়ারোলুতে আরেকটা ছোট বিমানবন্দর রয়েছে।

মালদ্বীপের মূল দ্বীপ মালের সাথে লাগোয়া মালে এটলএর একটা অংশ হুলহুলে দ্বীপে ১৯৬০ সালের অক্টোবরে একটা বিমানবন্দর তৈরি করা হয়। প্রায় ৩ হাজার ফুট লম্বা এই রানওয়েতে ১৯শে অক্টোবর রয়াল নিউজিল্যান্ড এয়ার ফোর্সের একটা পরিবহণ বিমান অবতরণ করে। প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইট ছিল এয়ার সিলনের; ১৯৬২ সালের এপ্রিলে। মালদ্বীপের শেষ সুলতান মোহাম্মদ ফরীদ দিদিএর অধীনে প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিম নাসিরের তত্বাবধানে ১৯৬৬ সালে এই বিমানবন্দরের রানওয়ে উন্নয়নের কাজ করা হয়। ১৯৭২ সালের দিকে মালদ্বীপে পর্যটকদের ঢল আসতে থাকলে নতুন একটা আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর তৈরির গুরুত্ব বোঝা যেতে শুরু করে। ১৯৮১ সালে মালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু করা হয়। ২০১০ সালের জুলাই মাসে নাশীদ সরকার বিশ্বব্যাংকের অধীন ‘ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্স কর্পোরেশন’ বা ‘আইএফসি’র উপদেশে বিমানবন্দরটাকে বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই কাজ যৌথভাবে পায় মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টস এবং ভারতের জিএমআর গ্রুপ। ভারতীয়দের হাতে থাকে ৭৭ শতাংশ মালিকানা; মালয়েশিয়ার হাতে ২৩ শতাংশ। ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট নাশীদ এই বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ইব্রাহিম নাসির বিমানবন্দর। মালদ্বীপের মতো ছোট্ট দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ না হলে এখানে সাড়ে তিন কিঃমিঃ লম্বা বিশাল রানওয়ের আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর তৈরির প্রশ্নই উঠতো না। পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্যেই এই বিমানবন্দরের উন্নয়নের কথা বলা হয়েছিল। রয়াল নিয়জিল্যান্ড এয়ার ফোর্সের পরিবহণ বিমান এবং এয়ার সিলনের বাণিজ্যিক ফ্লাইটই বলে দিচ্ছে যে, এই বিমানবন্দরের বেসামরিক এবং সামরিক কোন বিভেদ নেই। এখন বেসরকারি বিমানবন্দর হওয়া সত্ত্বেও কৌশলগত দিক থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এই বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলছে টানাপোড়েন।

২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ুম সিঙ্গাপুরের সরকারি কোম্পানি ‘সুবর্ন জুরং’এর কাছে বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প ব্যবস্থাপনার কাজ দেয়। ২০১৮ সালের অক্টোবরে সৌদি আরব বিমানবন্দরের উন্নয়নে ১’শ মিলিয়ন ডলার দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। ওপেক ফান্ড দেয় ৫০ মিলিয়ন ডলার। একইসাথে আবুধাবি এবং কুয়েতও এই প্রকল্পে অর্থায়ন করে। নতুন টার্মিনালের ডিজাইন এবং কন্সট্রাকশনের কাজ পায় সৌদি বিল্লাদিন গ্রুপ। রানওয়ের উন্নয়ন এবং পানি থেকে ওঠানামা করতে পারা ৮৫টা বিমানের ধারণক্ষমতার সীপ্লেন টার্মিনালের কনসালট্যান্সির কাজ পায় মার্কিন কোম্পানি ‘ল্যানড্রাম এন্ড ব্রাউন’; ৩৪’শ মিটার লম্বা রানওয়ে তৈরির কাজ পায় চীনা কোম্পানি ‘বেইজিং আরবান কন্সট্রাকশন গ্রুপ’। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন বিমানবন্দরের নাম আবারও পরিবর্তন করে দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম নাসিরের পরিবারের নামানুসারে রাখেন ভেলানা বিমানবন্দর। ২০১৯ সালে বিমানবন্দরের নতুন রানওয়েতে বিমান ওঠানামা শুরু হয়। মালদ্বীপে বিমানবন্দরের মূল উন্নয়নের কাজ ভারতীয়রা না পেলেও তা কিন্তু চীনারাও পায়নি। বরং সেটা গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু দেশ সৌদি আরব, আমিরাত এবং সিঙ্গাপুরের কাছে। চীনারা রানওয়ে উন্নয়নের কাজে থাকলেও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল না তারা।
  
মালদ্বীপের রাজধানী মালে শহর। মালদ্বীপের পর্যটন শিল্পে চীনারা গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। বেশি সংখ্যক পর্যটকের উৎস হওয়ায় চীনারা মালদ্বীপের অর্থনীতিতে বড় অবদানের অংশীদার হয়ে গিয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে পর্যটন শিল্পে ধ্বস নামার কারণে মালদ্বীপের অর্থনীতি ২০২০ সালে সাড়ে ৮ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।

মালদ্বীপের পর্যটন শিল্পের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেবে মালদ্বীপের জনসংখ্যা মাত্র ৫ লক্ষ ১৫ হাজারের মতো। অথচ দেশটাতে একবছরে পর্যটকের সংখ্যা দেশটার মোট জনসংখ্যার তিন গুণেরও বেশি! মালদ্বীপের ৩০ শতাংশ লোকের বাসবাস রাজধানী মালেতে; বাকিরা প্রায় ২’শ দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পুরো দেশের ভূমি ৩’শ বর্গকিঃমিঃএরও কম! মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ১২ হাজার ডলার। মালদ্বীপের অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল পর্যটনের উপর। দেশটার জিডিপির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই সেক্টরের উপর নির্ভরশীল। প্রায় ৪৫ হাজার লোকের সরাসরি কর্মসংস্থান এই সেক্টরে। মালদ্বীপের ৪০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় এই সেক্টরের মাধ্যমে। গত প্রায় এক দশক ধরেই মালদ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা প্রতিবছরই গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে। মালদ্বীপের মিডিয়া ‘এডিশন’ বলছে যে, দেশটায় মোট হোটেল শয্যার সংখ্যা প্রায় ৪২ হাজারের মতো। ২০১৯ সাল জুড়ে প্রায় ৬০ শতাংশের মতো হোটেল রুম ভর্তি ছিল। কাজেই মালদ্বীপের অর্থনীতির চাবি এই পর্যটন শিল্পের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

মালদ্বীপের পর্যটন শিল্পে চীনারা গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। মালদ্বীপের সরকারের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, ২০১৯ সালে ২ লক্ষ ৮০ হাজারের বেশি চীনা পর্যটক মালদ্বীপে ভ্রমণ করেছে। একই বছরে মালদ্বীপে রেকর্ড ১৭ লক্ষেরও বেশি পর্যটক এসেছিল। এর মাঝে ৮ লক্ষ ৩৩ হাজার বা ৪৯ শতাংশ এসেছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। মালদ্বীপের মিডিয়া ‘আভাস’ বলছে যে, একটা দেশ থেকে সবচাইতে বেশি পর্যটক আসার কথা বলা হলে সেটা চীন; মোট পর্যটকের প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মাঝে মালদ্বীপে চীনা পর্যটকের সংখ্যা ৬৭ শতাংশ বেড়ে গিয়ে ২ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ ৩২ হাজার হয়ে যায়; যদিও এরপর থেকে চীনা পর্যটকের সংখ্যা মোটামুটিভাবে ৩ লক্ষ থেকে সাড়ে ৩ লক্ষের কাছাকাছিই ছিল। তবে ভারত মালদ্বীপে চীনা পর্যটকদের দৌরাত্মকে ব্যালান্স করতে সেখানে ভারতীয় পর্যটকদের যাতায়াত সহজ করেছে। এর ফলে ২০১৯ সালে মালদ্বীপে ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা আগের বছরের চাইতে ৮৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার হয়। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০ হাজারের মতো। আর ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১ হাজারের মতো। অর্থাৎ ২০১১ থেকে ২০১৯এর মাঝে মালদ্বীপে ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা পাঁচ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তার পরেও এখনও তা মোট পর্যটকের ১০ শতাংশ; অর্থাৎ চীনের চাইতে কম। বেশি সংখ্যক পর্যটকের উৎস হওয়ায় চীনারা মালদ্বীপের অর্থনীতিতে বড় অবদানের অংশীদার হয়ে গিয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে পর্যটন শিল্পে ধ্বস নামার কারণে মালদ্বীপের অর্থনীতি ২০২০ সালে সাড়ে ৮ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।
  
মালদ্বীপের উন্নয়ন কাজে বাংলাদেশী কর্মীদের অবদান অনস্বীকার্য। খুব কম পারিশ্রমিকে এবং অপ্রতুল আবাসস্থলে থাকার পরেও তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি করছে হুলহুমালে দ্বীপ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হবার পর এই শ্রমিকেরাই সবচাইতে বেশি বিপদে রয়েছে। ভারত যেখানে তার নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়েছে নিজেদের নাগরিকদের সেখান থেকে সরিয়ে আনার লক্ষ্যে, বাংলাদেশ সেখানে নিজেদের সামরিক বিমান এবং সামরিক জাহাজ পাঠিয়েছে নিজেদের মেডিক্যাল কর্মী এবং ত্রাণ সামগ্রী দিতে; যা কিনা ভারতকে আরও বিচলিত করেছে।


বিদেশী কর্মীর উৎসে উত্থান পতন

অন্যদিকে মালদ্বীপের পর্যটন শিল্প, তথা পুরো অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে বিপুল সংখ্যক বিদেশী কর্মীর উপর। মালদ্বীপের মিডিয়া ‘এডিশন’ বলছে যে, মালদ্বীপে বৈধভাবে কর্মরত রয়েছে ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৬’শ বিদেশী কর্মী। এর বাইরেও অবৈধভাবে কাজ করছে ৬৩ হাজারেরও বেশি মানুষ। এই বিদেশী কর্মীদের মাঝে বেশিরভাগই হলো বাংলাদেশী। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহর সরকার ২০১৯এর সেপ্টেম্বরে যে কোন একটা দেশ থেকে দেড় লক্ষের বেশি কর্মী না নেবার কথা ঘোষণা করে। তবে প্রকৃতপক্ষে এই ঘোষণাটা ছিল বাংলাদেশীদের টার্গেট করে। মালদ্বীপের অর্থমন্ত্রী আহমেদ ফাইয়াজ বলেন যে, দেড় লক্ষের এই কোটা পার হয়ে যাবার কারণে মালদ্বীপ বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মালদ্বীপে বাংলাদেশের দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এটিএম মোশফিকুর রহমান বলেন যে, মালদ্বীপ সরকার বাংলাদেশের দূতাবাসকে এব্যাপারে কিছুই বলেনি। আর যেহেতু মালদ্বীপে বাংলাদেশীদের সংখ্যা এক লক্ষের বেশি নয়, তাই দেড় লক্ষের এই কোটা বাস্তব নয়। আর প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশী কর্মী এই মুহুর্তে মালদ্বীপে ‘অবৈধ’ভাবে রয়েছে। তিনি বলেন যে, অনেক সময় চাকুরিদাতা কোম্পানি বেতন ঠিকমতো দেয়না। তখন কর্মীরা চাকুরি পরিবর্তন করে; এবং ‘অবৈধ’ আখ্যা পায়। বাংলাদেশ দূতাবাস মালদ্বীপকে অনেকদিন থেকেই এই ৪০ হাজার কর্মীকে ‘বৈধতা’ দেবার কথা বলে আসছে। মালদ্বীপের বর্তমান সরকার বাংলাদেশী কর্মীদের ব্যাপারে যেকথাই বলুক না কেন, মালদ্বীপের উন্নয়ন কাজে বাংলাদেশী কর্মীদের অবদান অনস্বীকার্য। খুব কম পারিশ্রমিকে এবং অপ্রতুল আবাসস্থলে থাকার পরেও তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি করছে হুলহুমালে দ্বীপ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হবার পর এই শ্রমিকেরাই সবচাইতে বেশি বিপদে রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপের জনগণ এবং এই শ্রমিকদের জন্যে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়। এটা সম্ভব হয়েছে দুই দেশের মানুষের মাঝে দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্বের কারণে। ভারত যেখানে তার নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়েছে নিজেদের নাগরিকদের সেখান থেকে সরিয়ে আনার লক্ষ্যে, বাংলাদেশ সেখানে নিজেদের সামরিক বিমান এবং সামরিক জাহাজ পাঠিয়েছে নিজেদের মেডিক্যাল কর্মী এবং ত্রাণ সামগ্রী দিতে; যা কিনা ভারতকে আরও বিচলিত করেছে। এর আগে ২০০৪ সালে এশিয়ান সুনামির সময় এবং ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মালদ্বীপের ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট অচল হয়ে গেলে বাংলাদেশ মালদ্বীপকে বিমান বাহিনীর পরিবহণ বিমান এবং নৌবাহিনীর জাহাজে করে ত্রাণ পাঠিয়েছিল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান মালদ্বীপ সফর করে মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা দপ্তরের জন্যে ৭টা সামরিক ট্রাক উপহার হিসেবে দিয়ে আসেন।

মালদ্বীপের স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইয়ারবুকের তথ্য অনুসারে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত মালদ্বীপে বৈধ বিদেশী কর্মীদের মাঝে সবচাইতে বেশি প্রায় ৬ থেকে ৯ হাজার ছিল শ্রীলঙ্কান। ১৯৯৮ সাল থেকে ভারতীয় কর্মী বাড়তে থাকে; ১৯৯৭ সালে ৫ হাজার থেকে ২০০৭ সালে তা প্রায় ২৩ হাজারে পৌঁছে যায়। অন্যদিকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশী কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ হাজার। ২০০৪ থেকে তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে এবং ২০০৮ সাল নাগাদ প্রায় ৪০ হাজার হয়ে যায়। সেসময় ভারতীয় কর্মী ছিল প্রায় ২২ হাজার এবং শ্রীলঙ্কান প্রায় ১০ হাজার। বাংলাদেশী কর্মীদের এই সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হলো মালদ্বীপের কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি। পর্যটন সেক্টরে ২০০৩ সালে ১০ হাজার বিদেশী কর্মী কাজ করছিল; যা ২০১১ সাল নাগাদ বেড়ে ১৪ হাজারের মতো হয়। অন্যান্য সার্ভিসে বিদেশী কর্মী ৪ বা ৫ হাজার থেকে বেড়ে ৬ থেকে ১০ হাজার হয়। কিন্তু কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিতে বিদেশী কর্মী ২০০২ সালে ৫ হাজার থেকে বেড়ে ২০০৮ সাল নাগাদ প্রায় ৩৫ হাজার হয়ে যায়। মালদ্বীপে কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি এতটা বড় হলো কি করে? এই উত্তর পেতে তাকাতে হবে মালদ্বীপে বিনিয়োগের উৎসের দিকে।
  
হুলহুলের সাথে রাজধানী মালের যোগাযোগ স্থাপন করে দিয়েছে চীনের নির্মিত ‘সিনামালে’ সেতু। ২’শ ১০ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত এই সেতুর খরচের ১’শ ২৬ মিলিয়ন চীনারা অনুদান হিসেবে দিয়েছে; আর ৭২ মিলিয়ন দিয়েছে ঋণ হিসেবে। এই সেতু তৈরির মাঝে তিনটা সরকার ক্ষমতায় ছিল; কিন্তু প্রকল্প বন্ধ হয়নি। চীনারা মালদ্বীপে নতুন করে কিছু করেনি; তারা শুধু মালদ্বীপের দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা রাষ্ট্রীয় দ্বীপ উন্নয়নের কাজে যোগ দিয়েছে মাত্র।

চীনা ঋণের ফাঁদে?

২০১৮ সালের নভেম্বরে মোহামেদ সলিহর নতুন সরকার ক্ষমতা নেবার পর পত্রপত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় যে, চীনা ঋণে জর্জরিত মালদ্বীপকে চীনারা ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের বিল ধরিয়ে দিয়েছে। এই কথাগুলি বলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশীদ, যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট সলিহর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। ‘রয়টার্স’ নাশীদের কথার উপর ভিত্তি করেই বলে যে, মালদ্বীপে চীনা রাষ্ট্রদূত ঝাং লীঝং লিখিতভাবে এই অর্থ ফেরত চান। মালদ্বীপের কর্মকর্তারা বলছেন যে, মালদ্বীপের মতো অর্থনীতির পক্ষে চীনা ঋণ ফেরত দেয়া কঠিন হবে। চীনা রাষ্ট্রদূত মালদ্বীপের মিডিয়া ’আভাস’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে নাশীদের এই দাবিকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, এধরনের কোনকিছুই মালদ্বীপের কাছে দাবি করা হয়নি; আর মালদ্বীপের কাছে চীনের পাওনা রয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো; নাশীদ যা বলছেন তা নয়। এর মাঝে সমুদ্রের মাঝ দিয়ে ‘সিনামালে’ সেতু তৈরি, বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজ, এবং সমুদ্র থেকে ভূমি মুক্ত করে সেখানে দু’টা রেসিডেনশিয়াল টাওয়ার ব্লক তৈরিতে চীন ঋণ দিয়েছে ৬’শ মিলিয়ন ডলার; আর বাকি ৯’শ মিলিয়ন ডলার বাণিজ্যিক ঋণ হিসেবে মালদ্বীপের সরকারি কোম্পানিগুলিকে দেয়া হয়েছে, যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ থেকে শুরু করে বাসস্থান তৈরিতে। মালদ্বীপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মালদ্বীপ মনেটারি অথরিটির গভর্নর আহমেদ নাসিরও চীনা ঋণের ব্যাপারে এই অংকই বলেছেন। কিন্তু চীনাদের ঋণেই কি মালদ্বীপ জর্জরিত? মালদ্বীপের সকল প্রকল্পই কি চীনাদের প্রকল্প?

২০০০ সালের দিকে মালদ্বীপের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ছিল সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ; এটা ২০০৮ সালে প্রায় ৭ শতাংশ হয়ে যায়। আর ২০১১ সাল নাগাদ তা জিডিপির ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। কন্সট্রাকশন সেক্টরে বিদেশী কর্মীদের সংখ্যাটাও এর সাথেই যায়; ২০০২ সালে ৫ হাজার কর্মী থেকে ২০০৮ সালে তা হয়ে যায় ৩৫ হাজার। চীনারা তখনও কিন্তু মালদ্বীপে বিনিয়োগ শুরু করেনি। ২০০৭ সালে বেইজিংএ মালদ্বীপের দূতাবাস খোলা হলেও মালদ্বীপে চীনের দূতাবাস খোলা হয় মাত্র ২০১১ সালে। অর্থাৎ মালদ্বীপে বিনিয়োগ এবং কন্সট্রাকশন সেক্টরের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি খুঁজতে বেইজিং নয়, অন্য কোথাও খুঁজতে হবে।
   


হুলহুমালে প্রকল্পই হচ্ছে সেই প্রকল্প, যা মালদ্বীপে নতুন করে বিদেশী কর্মীদের ঢল এনেছে। এই প্রকল্প মহাসাগরের জলরাশির মাঝে শুধু একটা নতুন দ্বীপ তৈরিই নয়; এটা মালদ্বীপের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প; সেদেশের মানুষের আশা। তাই দুই দশকের বেশি সময় ধরে হুলহুমালে শহরের কাজ চলছে। মাঝে পাঁচটা সরকার এবং বহু রাজনৈতিক টানাপোড়েন গিয়েছে; গিয়েছে বহু ভূরাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা। প্রকল্পে পরিবর্তন এসেছে; কনট্রাক্টর পরিবর্তন হয়েছে; অর্থায়নকারী পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়নি। বিমানবন্দর নিয়ে রাজনীতি হয়েছে; ভারতীয়রা বাদ পড়েছে; কিন্তু প্রকল্প বাতিল হয়নি।

হুলহুমালে - মালদ্বীপের আশা

১৯৯০এর দশকের মাঝামাঝি মালে বিমানবন্দরের উত্তরে সমুদ্র থেকে ভূমি মুক্ত করে নতুন একটা দ্বীপ তৈরির পরিকল্পনা শুরু করা হয়। উদ্দেশ্য, নতুন একটা শহর তৈরি করা এবং মালে দ্বীপের মাত্র ৫ দশমিক ৮ বর্গকিঃমিঃ জায়গায় গাদাগাদি করে থাকা ১ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষের জন্যে স্থান সঙ্কুলানের ব্যবস্থা করা। প্রায় দু’শ দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলিকেও এখানে নিয়ে এসে নাগরিক সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়। প্রথম ফেইজে মাটি ফেলে ১’শ ৮৮ হেক্টর ভূমি সমুদ্রের নিচ থেকে মুক্ত করে আনার কাজ শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। ২১ মিলিয়ন ডলার খরচে বেলজিয়ামের ‘ড্রেজিং ইন্টারন্যাশনাল’ ড্রেজিং করে বালু ভরাটের কাজ করে। এই কাজ শেষ হয় ২০০২ সালে। ২০০১ সালের মাঝে সিঙ্গাপুরের একটা কোম্পানির তত্বাবধানে প্রথম মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়। ২০০৪ সালের মাঝামাঝি কিছু নতুন বাসস্থানের উদ্বোধনের মাধ্যমে নতুন শহর ‘হুলহুমালে’র জন্ম দেয়া হয়। প্রথমদিকে এখানে শুধু থাকার ব্যবস্থার কথা বলা হলেও পরবর্তীতে এখানে পর্যটন, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিকমিউনিকেশন, ফিনান্স, ইন্ডাস্ট্রি, হাসপাতাল এবং শিক্ষার অবকাঠামো যোগ করার পরিকল্পনা করা হয়। এখানে বিজনেস পার্ক, আইটি পার্ক, ক্রুজ টার্মিনাল, মারিনা, পর্যটন জোন, থিম পার্ক, হোটেল, শপিং মল, অফিস বিল্ডিং, ইত্যাদি তৈরির জন্যে বিনিয়োগের পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এই শহরে প্রায় ৮৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়। পরিবেশগত দিক থেকেও হুলহুমালেকে এমন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তা দীর্ঘমেয়াদে মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে।

প্রথম ফেইজের কাজ শেষ হতে দশ বছর লেগে যায়। এই ফেইজে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এই প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেইজের জমি ভরাটের কাজ শুরু হয়। মাত্র ৭৭ দিনের মাঝে ২’শ ৪৪ হেক্টর জমি সমুদ্র থেকে মুক্ত করা হয়। সমুদ্রের প্রায় ৬০ মিটার নিচ থেকে সাকশন ড্রেজারের মাধ্যমে ৬০ লক্ষ কিউবিক মিটার বালু তুলে এখানে ফেলা হয়। বেলজিয়ামের কোম্পানি ‘ডিইএমই’এর অধীন ‘ড্রেজিং ইন্টারন্যাশনাল’ ৫০ মিলিয়ন ডলার খরচে এই কাজ করে। এই ফেইজে পরবর্তীতে মাস্টার প্ল্যানে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। বেশিরভাগ জনগণের জন্যে যাতে গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিসগুলি দেয়া সম্ভব হয়, সেজন্য এই পরিবর্তন আনা হচ্ছে বলে বলেন ‘হাউজিং ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’এর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহামেদ সায়মন। দ্বিতীয় ফেইজে প্রায় ২ লক্ষ মানুষের স্থান সঙ্কুলানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সরকারি অফিসগুলিও হুলহুমালেতে স্থানান্তর করার কথা রয়েছে। আগে পরিকল্পনা না থাকলেও এখন হুলহুমালেতে উঁচু দালান তৈরি করা হচ্ছে। ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’এর হেং চিয়ে কিয়াং এন্ড লো বুন ইয়াংএর উপদেশ, তত্ত্বাবধান এবং ডিজাইনে এই কাজগুলি সম্পাদন করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ফেইজে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তিন লেনের রাস্তা তৈরির কাজ করছে ভারতীয় কোম্পানি ‘মোহন মুথা এক্সপোর্টস’ এবং ‘অশোকা বিল্ডকন’।
  
৪’শ ৩৪ মিলিয়ন ডলার খরচে ১৬টা ২৫ তলা রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিংএর প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না’র ঋণে। নতুন প্রেসিডেন্ট মোহামেদ সলিহর সরকার ২০১৯এর শুরুর দিকে রেসিডেশিয়াল প্রকল্পগুলিতে পরিবর্তন এনে দুই রুমের এপার্টমেন্টের পরিবর্তে ৩ রুমের এপার্টমেন্ট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। শুধু তা-ই নয়, চীনা প্রকল্পে তৈরি হয়ে যাওয়া বিল্ডিংগুলিতে এপার্টমেন্টের ডিজাইনে পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়।

বর্তমানে হুলহুমালেতে মালদ্বীপের সর্বোচ্চ ২৫ তলা অফিস বিল্ডিং তৈরি করা হচ্ছে। আর ৬২টা ২৫ তলা রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিং তৈরি করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ফেইজের অধীনে ৩৫ হাজার হাউজিং ইউনিট তৈরির টার্গেট রয়েছে। ৪’শ ৩৪ মিলিয়ন ডলার খরচে ১৬টা ২৫ তলা রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিংএর প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না’র ঋণে। ২০১৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ‘চায়না স্টেট ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কন্সট্রাকশন কোম্পানি’। এখানে সাড়ে ৫’শ বর্গফুট আয়তনের এবং দুই বেড ও দুই বাথরুমের ছোট ফ্ল্যাটে ৭ হাজার পরিবারের থাকার ব্যবস্থা হবে। এছাড়াও মালদ্বীপ পোর্টস লিমিটেড তৈরি করছে ৩টা ১৪ তলা রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিং, যেখানে ৫’শ ৩৪টা এপার্টমেন্ট থাকবে। নতুন প্রেসিডেন্ট মোহামেদ সলিহর সরকার ২০১৯এর শুরুর দিকে রেসিডেশিয়াল প্রকল্পগুলিতে পরিবর্তন এনে দুই রুমের এপার্টমেন্টের পরিবর্তে ৩ রুমের এপার্টমেন্ট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। শুধু তা-ই নয়, চীনা প্রকল্পে তৈরি হয়ে যাওয়া বিল্ডিংগুলিতে এপার্টমেন্টের ডিজাইনে পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়। ‘এইচডিসি’র নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুহাইল আহমেদ বলেন যে, তৈরি করা এই এপার্টমেন্টগুলি মালদ্বীপের মানুষের লাইফস্টাইলের সাথে যায় না বিধায় এগুলিকে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মালদ্বীপের একটা সাধারণ পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর সাথে দু’টা শিশু থাকে। এর বাইরে রাজধানী থেকে তাদের বাবা-মা অনেক সময়েই ভিজিট করেন; কাজেই তিন রুমের এপার্টমেন্টই মালদ্বীপের জন্যে বেশি চলনসই। সাড়ে ৫’শ বর্গফুটের এপার্টমেন্টগুলি খুবই সংকীর্ণ এবং এখানে লিফটের সংখ্যাও কম। তবে সুহাইল এটাও বলেন যে, বর্তমান সরকার এই প্রকল্পকে থামিয়ে দিতে চায় না। আর এপার্টগুলিকে ২৫ তলা উঁচু না করেই হুলহুমালেতে ১ লক্ষ ৬০ হাজার মানূষের বসবাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব।

বাসস্থান তৈরি ছাড়াও আরও অনেক প্রকল্প রয়েছে হুলহুমালেতে। ২০০৯ সালে মার্কিন কোম্পানি ‘জেনারেল ইলেকট্রিক’এর সাথে ২’শ মিলিয়ন ডলারের ‘গাফারু’ বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু ২০১১ সালে আলোচনা ভেস্তে গেলে প্ল্যান্টের কাজ পায় চীনা কোম্পানি ‘এক্সইএমসি’। ২০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ ছাড়াও ৩০ মেগাওয়াট এলএনজি চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে তারা। তবে চীনারা একা নয়; অন্যরাও হুলহুমালেতে বেশকিছু কাজ পেয়েছে। ২০১৬ সালে ভারতীয় কোম্পানি ‘আরপিপি গ্রুপ’এর অধীন ‘রেনাটাস প্রজেক্ট’ ৭২টা লাক্সারি এপার্টমেন্ট তৈরির কাজ পায়। মালদ্বীপের নিজস্ব কোম্পানি ‘ব্যাচ কন্সট্রাকশন’কে দেয়া হয় ৬৯টা মিক্সড এপার্টমেন্ট তৈরির কাজ; ‘দামাস কোম্পানি’ পায় ৯৫টা মিক্সড এপার্টমেন্ট তৈরির কাজ; ‘এপোলো হোল্ডিংস’ পায় ৯৭টা এপার্টমেন্ট তৈরির কাজ। হুলহুমালে ছাড়াও অন্য দ্বীপগুলিতেও অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে। ২০১৯ সালে আমিরাতের ৬ মিলিয়ন ডলার সহায়তায় মালের দেড়’শ কিঃমিঃ উত্তরে রা এটলের ভান্ধু দ্বীপে আবর্জনা থেকে বিদ্যুৎ তৈরির একটা কেন্দ্র তৈরি করা হয়। পুরো মালদ্বীপ জুড়ে হাইব্রিড পাওয়ার জেনারেশনের জন্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং জাপান সরকার ৫৫ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিচ্ছে।

হুলহুমালে প্রকল্পই হচ্ছে সেই প্রকল্প, যা মালদ্বীপে নতুন করে বিদেশী কর্মীদের ঢল এনেছে। এই প্রকল্প মহাসাগরের জলরাশির মাঝে শুধু একটা নতুন দ্বীপ তৈরিই নয়; এটা মালদ্বীপের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প; সেদেশের মানুষের আশা। তাই দুই দশকের বেশি সময় ধরে হুলহুমালে শহরের কাজ চলছে। মাঝে পাঁচটা সরকার এবং বহু রাজনৈতিক টানাপোড়েন গিয়েছে; গিয়েছে বহু ভূরাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা। প্রকল্পে পরিবর্তন এসেছে; কনট্রাক্টর পরিবর্তন হয়েছে; অর্থায়নকারী পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়নি। বিমানবন্দর নিয়ে রাজনীতি হয়েছে; ভারতীয়রা বাদ পড়েছে; কিন্তু প্রকল্প বাতিল হয়নি। এই শহরের সাথে হুলহুলে দ্বীপে অবস্থিত মালে বিমানবন্দরের সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে। আর হুলহুলের সাথে রাজধানী মালের যোগাযোগ স্থাপন করে দিয়েছে চীনের নির্মিত ‘সিনামালে’ সেতু। ২’শ ১০ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত এই সেতুর খরচের ১’শ ২৬ মিলিয়ন চীনারা অনুদান হিসেবে দিয়েছে; আর ৭২ মিলিয়ন দিয়েছে ঋণ হিসেবে। এই সেতু তৈরির মাঝে তিনটা সরকার ক্ষমতায় ছিল; কিন্তু প্রকল্প বন্ধ হয়নি। চীনারা মালদ্বীপে নতুন করে কিছু করেনি; তারা শুধু মালদ্বীপের দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা রাষ্ট্রীয় দ্বীপ উন্নয়নের কাজে যোগ দিয়েছে মাত্র। এখানে চীনারা ছাড়াও সিঙ্গাপুর, ভারত, সৌদি আরব, আমিরাত, কুয়েত, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম এবং আরও অনেকেই রয়েছে। আর এই পুরো কর্মযজ্ঞ সফল করতে হাজারো কর্মী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতীয়দের কাছে চীন এবং সৌদি গ্রুপ কারুর বিনিয়োগই পছন্দনীয় হয়নি। ‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানি বলেন যে, চীন এবং সৌদি আরব মালদ্বীপে একটা বাজে ভূমিকা নিয়েছে, যার মাধ্যমে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে। চেলানির চিন্তাগুলি ভারতের রাষ্ট্রচিন্তারই প্রতিফলক। শুধু চীনা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগই নয়, মালদ্বীপে বাংলাদেশী কর্মীদের সংখ্যাবৃদ্ধি এবং সেখানে চীনা পর্যটকদের আনাগোণাকেও ভারত হুমকি হিসেবে দেখছে। মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় মালদ্বীপকে ভারত তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যে আরও বড় হুমকি হিসেবে দেখেছে। একইভাবে মালদ্বীপের ব্যাপারে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অবস্থানকেও ভারত সবসময় সন্দেহের চোখে দেখেছে।
  
মালদ্বীপের ব্যাপারে সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের হিসেব ভিন্ন। বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্যপথগুলির একটা মালদ্বীপের উত্তর সীমানা ঘেঁষে গিয়েছে; আর ভারত মহাসাগরের ব্রিটিশ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়াও মালদ্বীপ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। মালদ্বীপে চীনা বিনিয়োগের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে খেয়াল রাখছে, তা ছোট্ট দেশটার অপেক্ষাকৃত বৃহৎ বিমানবন্দরের কাজের ভাগবাটোয়ারা দেখলেই বোঝা যায়। চীনের প্রভাবকে কমাতে ভারতকে অখুশি করাতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ খুব কমই খুন্ন হয়েছে। ভারতের নিরাপত্তাহীনতা বরং ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি টেনেছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ব্যালান্স করতে মালদ্বীপে সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলির বিনিয়োগ টেনে এনেছে।



সমুদ্র বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রকের অবস্থানে মালদ্বীপ

মালদ্বীপের অর্থনীতিতে অন্য যেকোন দেশের বিনিয়োগকে ভারত নিজের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছে। ভারত মালদ্বীপের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়নি কখনোই; বরং দেশটাকে নিরাপত্তার দিক থেকে নিজের প্রভাবে রাখাতেই তার আগ্রহ ছিল সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মালদ্বীপ সফর করেন। দ্বিতীয়বার নির্বাচন জেতার পর এটা ছিল মোদির প্রথম বৈদেশিক সফর। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মালদ্বীপের এর আগের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লা ইয়ামিনের সময়ে ২০১৭এর ফেব্রুয়ারিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর ভারতের সাথে সম্পর্কের ব্যাপক অবণতি ঘটে। ইয়ামিন ভারতীয় নাগরিকদের চাকুরির ভিসা নিয়ন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং চীনের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দিকে এগিয়ে যান; যেগুলি ভারত ভালো চোখে দেখেনি। মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সলিহ নির্বাচনে চীন বিরোধী একটা অবস্থান নেয়ায় ভারত স্বস্তিতে আছে। সলিহ ক্ষমতায় গিয়েই প্রথম ভারত সফর করেছিলেন।

গত জুনের মালদ্বীপ সফরের সময় মোদি মালদ্বীপে ভারতের রাডার স্টেশন উদ্বোধন করেন। এ পর্যন্ত মালদ্বীপে ভারত ইলেকট্রনিক্সের তৈরি ১০টা রাডার বসানো হয়েছে। মালের কাছাকাছি ভিলিংগিলি দ্বীপে ‘মালদ্বীপ ম্যারিটাইম রেসকিউ কোঅরডিনেশন সেন্টার’এর কন্ট্রোল সেন্টারের সাথে এই রাডারগুলি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত। মোদির সফরের আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখালে সাংবাদিকদের বলেন যে, এই রাডারগুলি মালদ্বীপের সমুদ্রসীমা পাহাড়া দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হবে। ভারতীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘ডেকান হেরাল্ড’ বলছে যে, এই রাডারগুলি একইসাথে ভারতের কৌশলগত সম্পদ। কারণ এগুলি ভারতীয় নৌবাহিনীকে অত্র এলাকা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা দিয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তাকে সুসংহত করবে। আগের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লা ইয়ামিন এই রাডার প্রকল্পকে থামিয়ে দিয়েছিলেন। ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্যা ট্রিবিউন’ বলছে যে, ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইব্রাহিম সলিহ ক্ষমতা নেবার ছয় মাস পর ২০১৮এর এপ্রিল থেকে এই প্রকল্প আবারও এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় ফেইজের কাজের মাঝে ছিল ৭টা নতুন রাডার বসানো এবং প্রথম ফেইজের পুরাতন ৩টা রাডার আপগ্রেড করা। এই ১০টা রাডার ভারতের উপকূলের ৪৬টা রাডারের সাথে একত্রে সমুদ্র নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। একই প্রকল্পের অধীনে ভারত সেইশেলে ১টা, মরিশাসে ৮টা এবং শ্রীলঙ্কাতে ৬টা রাডার স্থাপন করছে। মোদি তার মালদ্বীপ সফরের সময় মালদ্বীপের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্যে একটা প্রশিক্ষণ ঘাঁটিরও উদ্বোধন করেন। একইসাথে দুই দেশ ‘হোয়াইট শিপিং’ নিয়ে একটা সমঝোতা স্বাক্ষর করে। এর মাধ্যমে মালদ্বীপের সীমায় যেকোন বেসামরিক জাহাজের তথ্য মালদ্বীপ ভারতীয় নৌবাহিনীকে সরবরাহ করবে। ভারতের ৪৬টা রাডার প্রথম ফেইজে বসানো হয়েছে; যার মাঝে ৩৬টা বসানো হয়েছে ভারতের মূল ভুখন্ডে; ৬টা লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জে এবং ৪টা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। এর সাথে ১৬টা কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টারও রয়েছে। দ্বিতীয় ফেইজে আরও ৩৮টা রাডার এবং ৫টা কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টার বসাবার কাজ চলমান রয়েছে। ভারতের এই ‘কোস্টাল সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম’ বা ‘সিএসএস’এর মাঝে রয়েছে উপকূলীয় রাডার সিস্টেম; ‘অটোম্যাটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম’ বা ‘এআইএস’; ‘ইলেক্ট্রো অপটিক সিস্টেম’; আবহাওয়ার তথ্য নেবার সিস্টেম; এবং কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টারের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে ভিএইচএফ রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেম। রাডার ছাড়াও মালদ্বীপের নৌসীমা পাহাড়া দেয়ার জন্যে ভারত মালদ্বীপকে প্যাট্রোল বোটও সরবরাহ করেছে। ২০০৮ সালে মুম্বাইএ সন্ত্রাসী হামলায় অংশ নেয়া সন্ত্রাসীদের সমুদ্রপথে ছোট নৌকার মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ করার খবর প্রকাশ পাবার পর থেকে ভারত তার পুরো উপকূলব্যাপী সারভেইল্যান্স রাডার বসানো শুরু করে, যাতে উপকূলের কাছাকাছি ছোটছোট নৌকাও যেন বাদ না যায়। সেই সময় থেকে পুরো ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে ভারত রাডার বসানো ছাড়াও হোয়াইট শিপিংএর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের চুক্তি করছে এবং ছোট দেশগুলিকে প্যাট্রোল বোট সরবরাহ করছে। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় চিন্তাবিদদের নিরাপত্তাহীনতার চিন্তার ব্যাপারটা মালদ্বীপের ভূরাজনীতিকে জটিল করেছে।
  
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় ত্রাণ নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজের মালদ্বীপ সফর। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে ভারত এবং চীনকে; এমনকি সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র এখান থেকে বের হয়ে যেতে পারেনি। আর এই বাস্তবতাই অঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানকে মালদ্বীপের ভূরাজনৈতিক হিসেবের মাঝে রাখবে। পাকিস্তানের সহায়তা ছাড়া চীনের পক্ষে আরব সাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ কোন মিশন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ভারত সর্বদাই পাকিস্তানকে ব্যালান্স করতে গিয়ে বাংলাদেশকে ছাড় দিতে বাধ্য হবে। আর একইসাথে চীনকে ব্যালান্স করতে গিয়ে সৌদি আরব এবং আমিরাতকে মেনে নিতে বাধ্য হবে।



এই রাডার নেটওয়ার্ক থেকে পাওয়া তথ্য ভারতীয় নৌবাহিনীর ‘ইনফরমেশন ফিউশন সেন্টার, ইন্ডিয়ান ওশান রিজিয়ন’ বা ‘আইএফসি, আইওআর’এ সরাসরি সরবরাহ করা হবে। এই অঞ্চলে ‘হোয়াইট শিপিং’এর সমঝোতা হয়েছে যে দেশগুলির সাথে, তারা ‘আইএফসি, আইওআর’কে তথ্য দেবে। ভারতীয় নৌবাহিনীর বরাত দিয়ে ‘দ্যা নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ বলছে যে, ‘আইএফসি, আইওআর’এ নিজেদের নৌবাহিনীর লোক পোস্টিং দেয়ার জন্যে ৫টা বড় নৌবাহিনী এগিয়ে এসেছে। এই দেশগুলি হলো যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের গুরগাঁওতে ‘আইএফসি, আইওআর’এর চালু করা এই সেন্টারে ২০১৯এর সেপ্টেম্বরে প্রথম বিদেশী লিয়াঁজো অফিসার হিসেবে একজন ফরাসী সামরিক অফিসারকে পোস্টিং দেয়া হয়। এই কর্মকান্ডকে বাস্তবায়ন করতে ভারত ২২টা দেশের সাথে তথ্য সরবরাহ করার সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে; একইসাথে ৩০টা দেশের সাথে একটা ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চাইছে তারা, যাতে পুরো ভারত মহাসাগরের সকল জাহাজের তথ্য সাথেসাথেই পাওয়া যায়। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে ভারত এই নেটওয়ার্কের কাজ করলেও শক্তিশালী দেশগুলি এর সাথে যুক্ত হতে যে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি তা মোটামুটিভাবে পরিষ্কার। সবাই এটা বুঝতে পারছে যে, এ নেটওয়ার্ক আঞ্চলিক নয়, বরং ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তার চিন্তার উপর ভিত্তি করেই তৈরি হচ্ছে। এটার বেশি প্রয়োজন ভারতের; অন্য দেশগুলির নয়।

তবে মালদ্বীপের ব্যাপারে সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের হিসেব ভিন্ন। বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্যপথগুলির একটা মালদ্বীপের উত্তর সীমানা ঘেঁষে গিয়েছে; আর ভারত মহাসাগরের ব্রিটিশ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়াও মালদ্বীপ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। মালদ্বীপে চীনা বিনিয়োগের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে খেয়াল রাখছে, তা ছোট্ট দেশটার অপেক্ষাকৃত বৃহৎ বিমানবন্দরের কাজের ভাগবাটোয়ারা দেখলেই বোঝা যায়। চীনের প্রভাবকে কমাতে ভারতকে অখুশি করাতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ খুব কমই খুন্ন হয়েছে। ভারতের নিরাপত্তাহীনতা বরং ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি টেনেছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ব্যালান্স করতে মালদ্বীপে সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলির বিনিয়োগ টেনে এনেছে। আর হুলহুমালে দ্বীপে মালদ্বীপের রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পগুলি ভূরাজনৈতিকভাবে এতটাই শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, তা বন্ধ করার কোন পদ্ধতি কেউ নিয়ে আসেনি; বরং এই প্রকল্পে অংশ নিতে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করেছে। আর এত গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রকল্পে বিদেশী কর্মী, বিশেষ করে বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণ ঠেকাবার পদ্ধতিও খুব একটা নেই। মালদ্বীপের অবস্থানই মালদ্বীপের গুরুত্ব পাবার কারণ। কিন্তু পর্যটন শিল্প বৃদ্ধি না পেলে মালদ্বীপের অবকাঠামো উন্নয়নের কোন প্রশ্নই আসতো না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় মালদ্বীপের পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়লেও দেশটাকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা কমেনি; বরং বেড়েছে। চীনের অর্থনৈতিক উত্থান এবং ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর আনাগোণা মালদ্বীপের গুরুত্বকে আরও বৃদ্ধি করেছে। এতদিন মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টাকে কেউ চ্যালেঞ্জ না করলেও এখন সেই সমীকরণ পাল্টে গেছে। ছোট্ট এই দ্বীপ দেশে নিজ প্রভাব ধরে রাখতে ভারতকে চীন ছাড়াও সৌদি আরব, আমিরাত, বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চীন এবং বাংলাদেশ মালদ্বীপকে মেডিক্যাল সহায়তা প্রদান করেছে; যা ভারতকে আরও বেশি বিচলিত করেছে। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে ভারত এবং চীনকে; এমনকি সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র এখান থেকে বের হয়ে যেতে পারেনি। আর এই বাস্তবতাই অঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানকে মালদ্বীপের ভূরাজনৈতিক হিসেবের মাঝে রাখবে। পাকিস্তানের সহায়তা ছাড়া চীনের পক্ষে আরব সাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ কোন মিশন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ভারত সর্বদাই পাকিস্তানকে ব্যালান্স করতে গিয়ে বাংলাদেশকে ছাড় দিতে বাধ্য হবে। আর একইসাথে চীনকে ব্যালান্স করতে গিয়ে সৌদি আরব এবং আমিরাতকে মেনে নিতে বাধ্য হবে।

2 comments:

  1. Bangladesh should immediately gift at least two Padma class OPVs and one Durjoy class LPC. If that's not possible then Bangladesh could sell these at a discounted price....

    ReplyDelete
  2. দুই'টি পদ্মা ক্লাস ওপিভি নামমাত্র মূল্যে সরবরাহের অফার দিয়ে দেখা যেতে পারে। যদিও প্রতিবেশী দেশগুলো ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখবে না বলাই বাহুল্য।

    ReplyDelete