Monday 18 May 2020

হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র - নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার শুরু?

১৮ই মে ২০২০
       
২০১৩ সালের মে মাসে ‘এক্স-৫১’ নামের হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলের টেস্ট করা হয় মার্কিন ‘বি-৫২’ বোমারু বিমান থেকে। এক দশকের বেশি সময় ধরে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে সাম্প্রতিককালে এই অস্ত্র ডেভেলপ করার পিছনে গুরুত্ব বাড়িয়েছে রাশিয়া এবং চীনের হাইপারসনিক প্রকল্পের সাফল্য, যদিও মার্কিনীরা এখনও এই অস্ত্র কোথায় কিভাবে ব্যবহৃত হবে, তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
১৫ই মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র একটা ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করছে, যেটাকে তিনি ‘সুপার ডুপার মিসাইল’ বলে আখ্যা দিতে চান। হোয়াইট হাউজে নতুন গঠন করা ‘স্পেস ফোর্স’এর পতাকা উন্মোচন অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের এক্ষেত্রে কিছু করবার ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রকে এহেন ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করতে হচ্ছে। ট্রাম্প মূলতঃ মার্কিন সামরিক বাহিনীর গবেষণাধীন ‘হাইপারসনিক’ অস্ত্রের কথাই বলছিলেন। ‘পপুলার মেকানিকস’ এই অস্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলছে যে, এটা এমন একটা অস্ত্র, যা কিনা শব্দের ৫ গুণ বা ‘মাক ৫’ থেকে শুরু করে ২০ গুণ বা ‘মাক ২০’ গতিতে চলতে পারে। ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যে অস্ত্র ডেভেলপ করছে, তা প্রতিপক্ষের অস্ত্রের প্রায় তিনগুণ বেশি গতিতে চলতে পারবে। যেখানে রাশিয়ার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের গতি ‘মাক ৫’ এবং চীনের ক্ষেপণাস্ত্রের গতি ‘মাক ৫’ থেকে ‘মাক ৬’, সেখানে মার্কিন অস্ত্রের গতি হবে ‘মাক ১৭’। ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিরক্ষা সচিব মার্ক এসপার ট্রাম্পের কথার সাথে সুর মিলিয়ে ট্রাম্পের দাবিকে সমর্থন দেন। তবে ট্রাম্পের এই দাবিগুলি হঠাত করেই আসেনি। যুক্তরাষ্ট্র এধরনের অস্ত্র ডেভেলপ করছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। তবে প্রতিরক্ষানীতিতে প্রাধান্য না থাকার কারণে এর ডেভেলপমেন্ট রাশিয়া এবং চীনের থেকে পিছিয়ে পড়ছিল। এখন রাশিয়া এবং চীনের ছুঁড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর নড়েচড়ে বসেছে।

হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কেন দরকার?

এবছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে হাইপারসনিক অস্ত্রের উপর মার্কিন ‘কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস’এর এক প্রতিবেদনে এই অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টের পিছনে চিন্তাগুলিকে লিপিবদ্ধ করা হয়। ২০০০এর দশকের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র প্রচলিত অস্ত্রের অধীনে দ্রুত আঘাত হানার একটা কৌশল বের করতে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ডেভেলপমেন্ট শুরু করেছিল। এই অস্ত্র দুই ধরনের। একটা হলো হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল। এটা একটা রকেটের সাথে সংযুক্ত থাকে। রকেট এটাকে অনেক উপরে উড়িয়ে নিয়ে একটা গতি ধরিয়ে দেয়; এরপর এটা রকেট থেকে আলাদা হয়ে গ্লাইড করে অতি দ্রুতগতিতে লক্ষ্যে আঘাত হানে। আর দ্বিতীয় ধরনের অস্ত্র হলো হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইল। এটা বর্তমানে ব্যবহৃত ক্রুজ মিসাইলের মতোই একটা জেট ইঞ্জিনের সহায়তায় চলে; তবে এটা সাধারণ জেট ইঞ্জিনের থেকে বেশ আলাদা; যেটাকে ‘স্ক্র্যামজেট’ ইঞ্জিন বলে। হাইপারসনিক অস্ত্রের উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডের জেনারেল জন হাইটেন বলেন যে, যেসব ক্ষেত্রে অন্যান্য অস্ত্র ঠিকমতো কাজ করবে না বা ব্যর্থ হবে বা হাতের কাছে থাকবে না, তখন অনেক দূরের অবস্থানে শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থার শত্রছায়ায় থাকা লক্ষ্যবস্তুকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের সুযোগের ‘উইন্ডো’র মাঝে হাইপারসনিক অস্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সমালোচকেরা বলছেন যে, হাইপারসনিক অস্ত্রের নির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য এখনও সংজ্ঞায়িত হয়নি; এটা মার্কিন সামরিক সক্ষমতায় নতুন কিছু যোগ করবে না; আর ডিটারেন্স তৈরি করার ক্ষেত্রেও এর কোন ভূমিকা থাকবে না।

এতকাল হাইপারসনিক অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টের জন্যে তেমন একটা বাজেট না পাওয়া গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া এবং চীনের এহেন অস্ত্রের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবার পর পেন্টাগন এবং কংগ্রেস উভয়েই বেশ নড়েচড়ে বসেছে। রাশিয়া এবং চীন ২০২০ সালের মাঝেই অপারেশনাল হাইপাসনিক অস্ত্র মোতায়েন করে ফেলতে পারে; যার মাঝে পারমাণবিক অস্ত্র বহণে সক্ষম ক্ষেপ্ণাস্ত্রও থাকতে পারে। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর সিনিয়ন ইঞ্জিনিয়ার জর্জ নাকুজি বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু পারমাণবিক অস্ত্রের ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করছে না, তাই মার্কিন অস্ত্রগুলির টার্গেটিং আরও নিখুঁত হতে হবে। অন্যদিকে রুশ এবং চীনাদের অস্ত্রগুলি পারমাণবিক সক্ষমতার হবার কারণে সেগুলির টার্গেটিং অতটা নিখুঁত না হলেও চলবে। ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইন্সটিটিউট অব সিকিউরিটি স্টাডিজ’এর প্রাক্তন সদস্য জো স্ট্যানলি লকম্যান বলছেন যে, মার্কিন অস্ত্রগুলি প্রচলিত ওয়ারহেড বহণ করবে বিধায় এর টার্গেটিংএর পিছনে মার্কিন গবেষকদের আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে। কারণ প্রচলিত অস্ত্রের টার্গেট হয় অনেক ছোট। তবে কেউ কেউ মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এধরনের অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টে পিছিয়ে নেই; বরং যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য এক্ষেত্রে আলাদা। থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’এর জেমস একটন বলছেন যে, রাশিয়া এবং চীনের লক্ষ্য হাইপারসনিক মিসাইলকে পারমাণবিক অস্ত্র বহণে নিযুক্ত করা; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এধরনের মিসাইলকে প্রচলিত অস্ত্র বহণের জন্যে প্রস্তুত করা। রাশিয়া ও চীনের লক্ষ্যের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য সরাসরি তুলনা করা যায় না। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন থেকেই প্রচলিত অস্ত্রের উপর পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে; যা যুক্তরাষ্ট্রকে এক্ষেত্রে এগিয়ে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলকে ৪ হাজার কিঃমিঃ পাল্লায় পরীক্ষা করেছে; যেটা চীন মাত্র ২ হাজার কিঃমিঃএর কম পাল্লায় পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে।
  
মার্কিন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘এজিএম-১৮৩এ’ ‘এআরআরডব্লিউ’। এই প্রকল্পটাকেই বিমান বাহিনী এগিয়ে নিতে চাইছে, কারণ এটাতে খরচ কম হবে এবং এধরণের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ‘বি-৫২’ বোমারু বিমান এবং ‘এফ-১৫’ ফাইটার বিমানে বেশি সংখ্যায় বহণ করা সম্ভব হবে।
 প্রযুক্তিগত দিক থেকে হাইপারসনিকের সম্ভাবনা কতটুকু?

তবে ক্ষেপণাস্ত্রের উদ্দেশ্য যা-ই হোক, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের জন্যে পেন্টাগনের বাজেট বৃদ্ধি পাবার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ২০২০ সালের সামরিক বাজেটে সকল ধরনের হাইপারসনিক অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টের জন্যে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ চাওয়া হলেও ২০২১ সালের বাজেটে এই অর্থ বাড়িয়ে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত পেন্টাগন হাইপারসনিক অস্ত্রের জন্যে নির্দিষ্ট কোন প্রকল্প নেয়নি; এর অর্থ হলো, হয় তারা এই অস্ত্রের ব্যবহার কোথায় হবে সেটার ব্যাপারে নিশ্চিত নয়; অথবা এর দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের ব্যাপারে এখনও দোটানায় রয়েছে। কংগ্রেস যে ব্যাপারগুলি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে, তার প্রথমটা হলো, এই ক্ষেপণাস্ত্র কি ধরনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবে? হাইপারসনিক অস্ত্র কি এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচাইতে সহজ পদ্ধতি? মার্কিন কৌশলগত চিন্তার মাঝেই বা এই অস্ত্রকে কিভাবে দেখা হবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, নির্দিষ্ট সংজ্ঞায়িত মিশন না থাকলে এই অস্ত্রের বাজেটকে অন্যান্য বাজেটের সাথে কিভাবে তুলনা করা হবে? কোন প্রকল্পকে কোন প্রকল্পের উপর বা নিচে স্থান দেয়া হবে? এর ডেভেলপমেন্টের পিছনে প্রযুক্তিই বা কতটুকু বাস্তবসম্মত? আর তৃতীয়ত, এরূপ অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টের ফলে কৌশলগত স্থিতিশীলতা কিভাবে প্রভাবিত হবে? আর চতুর্থত, অন্যান্য দেশের সাথে উত্তেজনা যাতে না বাড়ে, সেই উদ্দেশ্যে নতুন কোন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির দিকে যাবার প্রয়োজন রয়েছে কিনা, যা একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে করা হয়েছিল?

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রকল্পগুলির ব্যাখ্যা দিয়েছে প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘পপুলার মেকানিকস’। মার্কিন সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী একত্রে ডেভেলপ করছে একটা হাইপারসনিক অস্ত্র, যা গত ১৯শে মার্চ হাওয়াইএর কাউয়াই দ্বীপের ‘প্যাসিফিক মিসাইল রেঞ্জ ফ্যাসিলিটি বারকিং স্যান্ডস’এ পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা করা ‘কমন হাইপারসনিক গ্লাইড বডি’ নামে পরিচিত এই অস্ত্রটা মূল ক্ষেপণাস্ত্রের একটা অংশ। রকেটের সাথে জুড়ে দিয়ে এটাকে উৎক্ষেপণ করা হয়। তবে এই পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে মার্কিনীরা কোন কথাই বলছে না। এই হাইপারসনিক অস্ত্র বর্তমানে ব্যবহৃত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থেকে আলাদা। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেড প্রায় মহাকাশের কক্ষপথে চলে যায়; এরপর সেখান থেকে ‘মাক ২৪’ পর্যন্ত গতিতে লক্ষ্যের দিকে ধেয়ে আসে। অন্যদিকে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মূলতঃ বায়ুমন্ডলে অবস্থান করেই ওড়ে। সেনা এবং নৌবাহিনী একত্রে এই ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করলেও সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভবতঃ বহণ করা হবে বড় আকৃতির ট্রাকের উপর; আর নৌবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ‘আরলেই বুর্ক-ক্লাস’ ডেস্ট্রয়ার, ‘টিকনডেরোগা-ক্লাস’ ক্রুজার, ‘জুমওয়াল্ট-ক্লাস’ ডেস্ট্রয়ার এবং ‘ভার্জিনিয়া-ক্লাস’ সাবমেরিনে বহণ করা হতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্র টেস্টিংএর পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলকে বুস্টার রকেটের সাথে জুড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ অস্ত্র হিসেবে টেস্ট করা হতে পারে। তবে সেটার খবর পেতে হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

অন্যদিকে মার্কিন বিমান বাহিনীও বেশ হাঁকডাক দিচ্ছে। ২৭শে এপ্রিল বিমান বাহিনী এক বার্তায় হাইপারসনিক স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনের ব্যাপারে তথ্য চেয়েছে মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলির কাছ থেকে। এই তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বিমান বাহিনীর ক্রয় বিভাগের দায়িত্বে থাকা সহকারি সচিব উইল রোপার বলেন যে, এর মাধ্যমে তারা বুঝতে পারবেন যে, কতটা দ্রুত তারা এধরনের একটা ক্রুজ মিসাইল ডেভেলপ করতে পারবেন। তবে তিনি এ-ও বলেন যে, স্ক্র্যামজেট প্রযুক্তি এখন এতটাই এগিয়েছে যে, এধনের ক্ষেপণাস্ত্র এখন বেশ দ্রুতই ডেভেলপ করা সম্ভব। রোপারের কথায় এটা পরিষ্কার যে, বিমান বাহিনী এখন এমন একটা প্রযুক্তির দিকে যাচ্ছে, যা কিনা এখন পর্যন্ত ডেভেলপ করা রকেট বুস্টারের মাধ্যমে চলা হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলএর একটা বিকল্প। রোপার এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, রকেট বুস্টার ব্যাবহার করা গ্লাইড মিসাইলগুলি বায়ুমন্ডলের একেবারে সর্বশেষ প্রান্ত দিয়ে ওড়ে, যেখানে বাতাসের ঘনত্ব থাকে খুব কম। অন্যদিকে স্ক্র্যামজেটে চলা ক্রুজ মিসাইল ওড়ে বায়ুমন্ডলের এমন স্থান দিয়ে, যেখানে বাতাসের ঘনত্ব থাকে অনেক বেশি। একারণে দুই ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র দুই প্রকারের টার্গেট এবং মিশন নিতে সক্ষম। রোপার বলেন যে, বিমান বাহিনী চাইছে না প্রযুক্তিগত এই প্রতিযোগিতার মাঝে কোন একটা স্থানে পিছিয়ে পড়তে। একইসাথে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর চাইছে যে, আরও কিছু কোম্পানি এই প্রযুক্তি ডেভেলপমেন্টে এগিয়ে আসুক। হাতে গোণা কিছু কোম্পানি গ্লাইড ভেহিকলের প্রযুক্তি ডেভেলপ করেছে বিধায় তারাই সেগুলি তৈরি করছে; অন্য কেউ এখানে ঢুকতেই পারছে না। উইল রোপার বলেন যে, ক্রুজ মিসাইল ডেভেলপ করতে গিয়ে আরও কিছু কোম্পানি এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারবে। রোপার বলেন যে, তিনি মনে করেছিলেন যে, গ্লাইড ভেহিকলের প্রযুক্তি থেকে স্ক্র্যামজেটের প্রযুক্তি পিছিয়ে রয়েছে; কিন্তু সেটা আসলে সত্যি নয়। এই প্রযুক্তিটা এখন বেশ অগ্রসর হয়েছে এবং এটা এখন ব্যাবহারের জন্যে প্রস্তুত।
  
রুশ ‘মিগ-৩১’ ফাইটার বিমান বহণ করছে ‘কিনঝাল’ নামের স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনের ক্রুজ মিসাইল। ‘কিনঝাল’ ইতোমধ্যেই কমপক্ষে ১২ বার ‘মিগ-৩১’ ফাইটার বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, চীনাদের এই প্রকল্প রুশদের প্রকল্পগুলির চাইতে চিন্তাগত দিক থেকে এগিয়ে; কারণ চীনাদের দূরপাল্লার হাইপারসনিক অস্ত্রগুলি চীনের আশেপাশে মার্কিন সামরিক অবস্থানগুলির জন্যে হুমকি তৈরি করছে; যার ফলে মার্কিনীরা এর প্রত্যুত্তর দিতে বাধ্য হচ্ছে।

মার্কিন, চীনা এবং রুশ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পগুলি কতদুর এগুলো?

মার্কিন ‘ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি’ বা ‘ডারপা’ এবং ‘এয়ার ফোর্স রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ এই প্রকল্পে সহায়তা দেবে বলছে। ‘ডারপা’র ‘হাইপারসনিক এয়ার ব্রিদিং ওয়েপন কনসেপ্ট’এর উপর ভিত্তি করে প্রাইভেট কোম্পানির দু’টা দল স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনের ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করছে। একদলে রয়েছে রেইথেয়ন এবং নর্থরোপ-গ্রুমান; আর অন্য দলে রয়েছে লকহীড মার্টিন ও এরোজেট রকেটডাইন। বর্তমানে মার্কিন বাহিনী ‘এয়ার লঞ্চড র‍্যাপিড রেসপঞ্জ ওয়েপন’ বা ‘এআরআরডব্লিউ’ নামে একটা প্রকল্পকে এগিয়ে নিচ্ছে। কিছুদিন আগেই তারা ‘হাইপারসনিক কনভেনশনাল স্ট্রাইক ওয়েপন’ বা ‘এইচসিএসডব্লিউ’ নামের আরেকটা প্রকল্প বাতিল করে বাজেটের সমন্বয় আনার লক্ষ্যে। ‘এআরআরডব্লিউ’ প্রকল্পটাকেই বিমান বাহিনী এগিয়ে নিতে চাইছে, কারণ এটাতে খরচ কম হবে এবং এধরণের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ‘বি-৫২’ বোমারু বিমান এবং ‘এফ-১৫’ ফাইটার বিমানে বেশি সংখ্যায় বহণ করা সম্ভব হবে। ‘এআরআরডব্লিউ’ এবং বাতিল করা ‘এইচসিএসডব্লিউ’, দু’টাই একই কোম্পানি লকহীড মার্টিন ডেভেলপ করেছে।

২০১৯এর জুন মাসে বিমান বাহিনী ‘বি-৫২’ বোমারু বিমান থেকে ‘এআরআরডব্লিউ’এর সফল পরীক্ষা চালাবার কথা ঘোষণা করে। ২০১৮ সালের অগাস্টে লকহীড মার্টিন ৪’শ ৮০ মিলিয়ন ডলারের এই কাজ পায় প্রতিরক্ষা দপ্তরের কাছ থেকে। এর আগে একই বছরের এপ্রিল মাসে ‘এইচসিএসডব্লিউ’ প্রকল্পের অধীনে ৯’শ ২৮ মিলিয়ন ডলারের কাজ পেয়েছিল লকহীড মার্টিন; যা পরবর্তীতে বাতিল হয়ে যায়। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের বরাত দিয়ে ‘সিএনবিসি’ বলছে যে, ‘এআরআরডব্লিউ’এর পরীক্ষা এখনও চলমান রয়েছে; এবং আরও কয়েক বছর এই পরীক্ষা চলবে। এই মুহুর্তে রুশ এবং চীনাদের ডেভেলপ করা হাইপারসনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রতিরক্ষা নেই। অথচ রাশিয়ার দু’টা ক্ষেপণাস্ত্র ২০২০ সালের মাঝেই সার্ভিসে আসতে পারে বলে মনে করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। এর মাঝে একটা হলো ‘এভানগার্ড’ নামের হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল; আরেকটা আকাশ থেকে নিক্ষেপণযোগ্য ‘কিনঝাল’ নামের স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনের ক্রুজ মিসাইল। ‘কিনঝাল’ ইতোমধ্যেই কমপক্ষে ১২ বার ‘মিগ-৩১’ ফাইটার বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। অপরদিকে ২০১৮ সালের অগাস্টে চীন তাদের প্রথম হাইপারসনিক পরীক্ষা চালিয়েছে। পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘সিএনবিসি’ বলছে যে, চীনাদের এই প্রকল্প রুশদের প্রকল্পগুলির চাইতে চিন্তাগত দিক থেকে এগিয়ে। ‘নাসা’র প্রাক্তন কর্মকর্তা মাইকেল গ্রিফিন মনে করছেন যে, চীনাদের দূরপাল্লার হাইপারসনিক অস্ত্রগুলি চীনের আশেপাশে মার্কিন সামরিক অবস্থানগুলির জন্যে হুমকি তৈরি করছে; যার ফলে মার্কিনীরা এর প্রত্যুত্তর দিতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়ার আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলিই বরং যুকরাষ্ট্রের জন্যে বড় হুমকি; হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নয়।

যুক্তরাষ্ট্র হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করছে বহুদিন ধরেই। তবে সেটা তারা কি কাজে লাগাবে, সেব্যাপারে প্রতিরক্ষা দপ্তর একটা নিশ্চিত সংজ্ঞা দাঁড় করাতে পারেনি। কিন্তু উদ্দেশ্য থাকুক আর না থাকুক, ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতাতে টিকে থাকতেই যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে চীন এবং রাশিয়ার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রত্যুত্তর দিতে। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপমেন্টের উদ্দেশ্য রাশিয়া, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পুরোপুরি আলাদা। তদুপরি, এই অস্ত্র না থাকলে একটা রাষ্ট্র যেন শক্তিশালীই হতে পারবে না। এই অস্ত্রের সামরিক উদ্দেশ্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, এর রাজনৈতিক গুরুত্ব সেটার চাইতে কম নয়। অন্ততঃ ট্রাম্পের কাছে তার ‘সুপার ডুপার মিসাইল’এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। তদুপরি এই ক্ষেপণাস্ত্র ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় নতুন অস্ত্র হিসেবে দেখা দিতে পারে। আর এই প্রতিযোগায় এগিয়ে থাকার অদম্য বাসনা কৌশলগত উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে যেতে পারে। এতে উদ্দেশ্যবিহীন একটা অস্ত্র প্রতিযগিতায় পতিত হতে পারে বৈশ্বিক ব্যবস্থা; যা কিনা করোনা দুর্যোগের মাঝে আরও দুর্বল হয়েছে।

No comments:

Post a Comment