Saturday 29 February 2020

করোনাভাইরাস – ইরানের নেতৃত্বের জন্যে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ

২৯শে ফেব্রুয়ারি ২০২০

  
সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নির্বিঘ্নে ফ্লাইট চালানো এবং চীনে ভ্রমণ করাটা ইরানের সাধারণ জনগণের কাজ নয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও রোগের প্রাদুর্ভাবকে ছোট করে উপস্থাপন এবং রোগ ছড়াবার খবরকে ইরানের নির্বাচন আটকাতে বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ বলে আখ্যা দেয়াটা ইরানের নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা কমার পিছনে কাজ করবে। একইসাথে ‘কোয়ার‍্যানটিন’কে প্রস্তরযুগের পদ্ধতি আখ্যা দেবার মাঝ দিয়ে ইরানের নেতৃত্ব নিজের জনগণ তথা বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে এটাই ইরানের নেতৃত্বের জন্যে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ।



ইরানের কর্মকর্তারা ২৮শে ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দেন যে, সেদেশে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩’শ ৮৮তে পৌঁছেছে। আর এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪এ। তবে ‘বিবিসি’র পার্সি সার্ভিস হাসপাতাল থেকে নিজস্ব প্রচেষ্টায় উপাত্ত সংগ্রহ করে খবর দেয় যে, কমপক্ষে ২’শ ১০ জন এই রোগে মৃত্যুবরণ করেছে। ইরানি কর্মকর্তারা এই সংখ্যাকে অস্বীকার করেন। কিন্তু ইরানি কর্মকর্তাদের বিবৃতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইরানের উপ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইরাজ হারিরচি সাংবাদিক সন্মেলনে বলেন যে, ইরান এই ভাইরাসের সংক্রমণকে প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। তিনি ইরানের ক্বোম শহরের আইনপ্রণেতা আহমেদ আমিরিয়াবাদি ফারাহানির দাবিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে, আসল সংখ্যা যদি ফারাহানির সংখ্যার অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশও হয়, তবে তিনি তার পদ থেকে ইস্তফা দেবেন। তিনি তখন বলেন যে, ইরানে মাত্র ৬১ জনের মাঝে ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে; মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। তিনি আরও বলেন যে, ইরান ‘কুয়ার‍্যানটিন’ বা পৃথকীকরণের বিরোধী; কারণ এধরণের চিন্তা প্রস্তরযুগের। ‘নিউ ইয়র্কার’ ম্যাগাজিন বলছে যে, তিনি এই কথাগুলি যখন বলছিলেন, তখন প্রচন্ড ঘামছিলেন এবং ঘনঘন টিস্যু দিয়ে তার কপাল মুছছিলেন। পরদিন টুইটারে এক ভিডিওবার্তায় তিনি বলেন যে, তিনিও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং নিজেকে ‘কুয়ার‍্যানটিন’ বা পৃথক করেছেন।

ইরানি কর্মকর্তাদের কথা থেকে আক্রান্তদের মাঝ থেকে কতজন মৃত্যুবরণ করছে, তা নিয়েও শুরু হয়েছে আলোচনা। চীন থেকে আসা সংখ্যাগুলিকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সেখানে আক্রান্তদের মাঝ থেকে ৩ শতাংশ বা তারও কম মৃত্যুবরণ করেছে। ইরানের সরকারি হিসাবগুলিকে বিশ্বাস করলে দেখা যায় যে, সেই একই সংখ্যা ৮ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশের মাঝে ওঠানামা করছে। শুধু তা-ই নয়, ইরানের আক্রান্তদের একটা বড় অংশ হলো জেষ্ঠ্য সরকারি কর্মকর্তা। ২৭শে ফেব্রুয়ারি ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুমেহ এবতেকার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর আসে। আক্রান্ত হবার খবর আসার আগের দিনই তিনি প্রেসিডেন্ট রুহানি এবং তার ক্যাবিনেটের সাথে এক বৈঠকে যোগ দেন। আক্রান্তদের মাঝে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান। এছাড়াও তেহরানের একজন ডিস্ট্রিক্ট মেয়র মোস্তফা রাহমানজাদেহ ২২শে ফেব্রুয়ারি ভাইরাসে আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ‘রেডিও ফারদা’ বলছে যে, সনাক্ত হবার ক’দিন আগেই রাহমানজাদেহ তেহরানের সিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মোহসেন হাসেমির সাথে সভায় যোগ দিয়েছিলেন। ভ্যাটিকানে ইরানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত হাদি খসরুশাহি ৮১ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণ করেছেন। আইনপ্রণেতা মাহমুদ সাদেগি ২৫শে ফেব্রুয়ারি টুইটারে বলেন যে, তাঁ বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ; তার বয়স ৫৭। তবে আক্রান্তদের সকলেই বৃদ্ধ নন। ২৬শে ফেব্রুয়ারি ইরানের মহিলা ফুটবল খেলোয়াড় এলহাম শেইখি মাত্র ২৩ বছর বয়সে করোনাভাইরাসে মারা যান।

২৪শে ফেব্রুয়ারি কানাডার ‘টরন্টো ইউনিভার্সিটি’র গবেষকদের এক গবেষণার ফলাফলে বলা হয় যে, ইরানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৮ হাজারেরও বেশি হতে পারে। তারা ইরান থেকে বিভিন্ন দেশে যাওয়া মানুষের মাঝে করোনাভাইরাস ছড়াবার ঘটনাগুলিকে পরিসংখ্যান মডেলের মাঝে এনে হিসেব করেছেন। যেহেতু ইরানের সাথে আশেপাশের অনেক দেশেরই বিমানে যাতায়াত খুবই কম, তাই সেই কম সংখ্যক যাত্রীর মাঝেও ভাইরাসের উপস্থিতি পেতে হলে ইরানে বহু সংখ্যক মানুষের মাঝে এই রোগের সংক্রমণ হতে হবে। ইরানের সরকারি হিসেবে ১৯শে ফেব্রুয়ারি প্রথম মৃতের খবর আসে শিয়াদের পবিত্র শহর ক্বোম থেকে। ধারণা করা হচ্ছে যে, ভাইরাসের প্রদুর্ভাব শুরু হয় তিন থেকে ছয় সপ্তাহ আগে; জানুয়ারি মাসে। এর অর্থ হচ্ছে মৃত ব্যক্তিরা কয়েক সপ্তাহ ধরে অন্যদেরকে আক্রান্ত করেছে। সরকারি হিসেবে প্রথম মৃত্যুর আট দিনের মাথায় এই রোগ ইরানের ৩১টার প্রদেশের মাঝে ২৪টায় ছড়িয়েছে বলে বলা হচ্ছে। প্রদুর্ভাব রোধে যাতায়াত কমাতে বলা দূরে থাকুক, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির ক্বোমের প্রতিনিধি মোহাম্মাদ সাঈদি এক ভিডিও বার্তায় বলেন যে, ক্বোমের পবিত্র মাজারগুলি হলো আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্তি পথ; তাই মানুষের উচিৎ এখানে আসা। ইরান থেকে ইতোমধ্যেই আজেরবাইজান, জর্জিয়া, আফগানিস্তান, কুয়েত, বাহরাইন, আমিরাত, ওমান, ইরাক, লেবানন, পাকিস্তান এবং কানাডায় এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। এর মাঝে অনেক ক্ষেত্রেই রোগ বহণকারীরা ক্বোম শহর ঘুরে এসেছেন। ২৭শে ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মাইক রায়ান জেনেভাতে এক সংবাদ সন্মেলনে বলেন যে, ইরানে করোনাভাইরাস ঢোকার সময় কেউ খেয়াল করেনি। তাই রোগের প্রাদুর্ভাব যা দেখা যাচ্ছে, তার চাইতে হয়তো আরও অনেক বেশি হতে পারে।

মার্কিন অবরোধে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং এর ফলশ্রুতিতে রাস্তায় বিক্ষোভ ও সহিংসতা; ৩রা জানুয়ারি কাসেম সুলাইমানি হত্যার পর যুদ্ধের শংকা; ৮ই জানুয়ারি ভুলবশতঃ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে প্রথমে তা অস্বীকার করা; ইত্যাদি সঙ্কটের মাঝে ইরান বন্ধু খুঁজেছে। ২রা ফেব্রুয়ারি ইরান সরকার অফিশিয়ালি চীনে ফ্লাইট বন্ধ করে দিলেও দু’দিন পর চীনা রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাতের সময় ইরানের প্রভাবশালী ‘মাহান এয়ার’এর প্রধান হামিদ আরাবনেযাদ চীনে ফ্লাইট চালু রাখার ঘোষণা দেন। ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত ‘মাহান এয়ার’ চীনের সাথে ৫৫টা ফ্লাইট অপারেট করে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নির্বিঘ্নে ফ্লাইট চালানো এবং চীনে ভ্রমণ করাটা ইরানের সাধারণ জনগণের কাজ নয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও রোগের প্রাদুর্ভাবকে ছোট করে উপস্থাপন এবং রোগ ছড়াবার খবরকে ইরানের নির্বাচন আটকাতে বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ বলে আখ্যা দেয়াটা ইরানের নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা কমার পিছনে কাজ করবে। একইসাথে ‘কোয়ার‍্যানটিন’কে প্রস্তরযুগের পদ্ধতি আখ্যা দেবার মাঝ দিয়ে ইরানের নেতৃত্ব নিজের জনগণ তথা বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে এটাই ইরানের নেতৃত্বের জন্যে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ।


No comments:

Post a Comment