Saturday 1 February 2020

ব্রেক্সিট-পরবর্তী ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর ভবিষ্যৎ কি?

১লা ফেব্রুয়ারি ২০২০
ইইউএর মাঝে থেকেও ব্রিটেন সর্বদাই আলাদা থাকতে চেয়েছে। ইইউএর সাধারণ মুদ্রা ইউরোকেও ব্রিটেন নিজের মুদ্রা হিসেবে মেনে নেয়নি। ইইউ থেকে ব্রিটেন সুবিধা চেয়েছে; কিন্তু বিনিময়ে কিছু দিতে কার্পণ্য করেছে। ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ায় ইউরোপের সাথে ব্রিটেনের এই প্রতিযোগিতা শেষ হচ্ছে না; বরং নতুন রূপ নিচ্ছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্কও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে; বিশেষ করে ব্রিটেন যখন পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক নেতৃত্ব নিতে চাইছে। এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিও ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ সম্পর্কে আলোচনা করছে। কিন্তু এর বাস্তবতা নিয়ে কৌতুহলের চাইতে প্রশ্নই বেশি আসছে। ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেনের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিশ্বের সকলকে বিশ্বাস করানো যে ব্রিটেন বিশ্বকে আবারও নেতৃত্ব দেবার সক্ষমতা রাখে।


ইইউ পার্লামেন্ট এবং রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সম্মতির পর ৩১শে জানুয়ারি ব্রিটেন অফিশিয়ালি ইউরোপিয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গেল। তবে এতে সামনের দিনগুলিতে নতুন কিছু বিষয় আলোচনায় আসছে। এর একটা হলো ইইউএর সাথে নতুন করে বাণিজ্য চুক্তি করা। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ব্রেক্সিটের পর আরও কঠিন সময় শুরু হচ্ছে। ইইউএর সাথে বাণিজ্য আলোচনা খুব একটা সহজ হবে না। ইউরোপের দেশগুলি এখন ব্রিটেনের সাথে তেমন সহজ শর্তে ব্যবসা করবে না। ব্রিটেনের অর্থনীতি ইউরোপের সাথে ব্যবসার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তাহলে ব্রিটেন কেন এই ঝামেলার মাঝে জড়াতে গেলো? ব্রিটেন চাইছে তার ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাটাকে এগিয়ে নিতে; যার মাধ্যমে ব্রিটেন ইইউএর নিয়মকানুনের মাঝে আটকে না থেকে বিশ্বব্যাপী আদর্শিক নেতৃত্ব দিতে চাইছে।

প্রাক্তন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম হেগ ‘দ্যা ডিইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার এক লেখায় বলেন যে, ব্রিটেনের ইইউ থেকে বের হবার সাথেসাথে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর যুগ শুরু হলো। তিনি মনে করছেন যে, পশ্চিমা গণতন্ত্রই হচ্ছে বিশ্বের জন্য একমাত্র গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং বিশ্বব্যাপী আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন যেহেতু তেমন কিছুই করছে না, তাই ব্রিটেনের উচিৎ এক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়া। তবে ইইউ ছেড়ে গেলেও ইউরোপকে সাথে নিয়েই কাজ করার কথা বলছেন উইলিয়াম হেগ।

ব্রিটিশ থিংকট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর ইউরোপ প্রোগ্রামের ডিরেক্টর থমাস রেইনস ‘কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্স’এর এক লেখায় বলছেন যে, ব্রিটেনের সামনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে ব্যালান্স করে চলার এবং এর মাঝেই বিশ্বব্যাপী প্রভাব বৃদ্ধি করার এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেনের নিরাপত্তা সম্পর্ক গভীরই থাকবে; আর ইউরোপ যথারীতি ব্রিটেনের সবচাইতে বড় বাণিজ্য সহযোগী থাকবে। এর মাঝেই ব্রিটেন চাইবে কানাডা এবং জাপানের মতো কিছু মধ্যম সারির শক্তির সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে। জলবায়ু পরিবর্তন, মুক্ত বাণিজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং অর্থনৈতিক অবরোধের মতো ইস্যুগুলিতেও ব্রিটেন ইউরোপকে পাশে চাইবে। অর্থনৈতিক এবং সামরিক সক্ষমতার দৈন্যের মাঝেই ব্রিটেন মানবাধিকারের মতো লিবারাল আদর্শগুলির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক নেতৃত্ব নিতে চাইবে।

অপরদিকে ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক বিশ্লেষণে হচ্ছে যে, ইইউ থেকে বের হয়ে গেলেই যে ব্রিটেন স্বাধীনভাবে চলতে পারবে, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। চীনা কোম্পানি হুয়াইকে ব্রিটেনের ‘ফাইভ-জি’ মোবাইল নেটওয়ার্ক তৈরির অনুমতি দেবার পর যুক্তরাষ্ট্রের নাখোশ হবার ব্যাপারটাকে তুলে ধরে তারা বলছে যে, ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ব্রিটেনকে কোন একটা পক্ষে থাকতেই হবে।উইন্সটন চার্চিলের সময় থেকে ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটা ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রক্ষা করে চলছে; আর এই সম্পর্ককে ব্রিটেন ইউরোপের উপরেই স্থান দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে সর্বদাই এই ‘বিশেষ সম্পর্ক’কে বিশেষভাবে নয়, বরং নিজস্ব জাতীয় নিরাপত্তার আলোকে দেখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্রিটিশ স্বার্থকে পদদলিত করে যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থকেই সমুন্নত রেখেছে। তদুপরি, ইন্টেলিজেন্স, সামরিক এবং পারমাণবিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক সংঘাতে শত ঝড়ঝাপ্টার মাঝেও যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই ব্রিটেনকে পাশে পেয়েছে। দুই দেশের এই ‘বিশেষ সম্পর্ক’কে ব্রিটেনের জনগণ অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ব্রিটেনের আনুগত্যের সম্পর্ক হিসেবে দেখেছে। বিশেষ করে ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বে ইরাক আক্রমণের পর এই কথাগুলিই প্রচলিত হয়েছে। তবে ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ব্রিটেনের গুরুত্ব কমে যেতে পারে বলে মনে করছে ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটা যুতসই বাণিজ্য চুক্তি করতে না পারলে এই সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে।

চীনারাও ব্রেক্সিটের পর ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর দিকে খেয়াল রাখছে। লন্ডনে চীনা রাষ্ট্রদূত লিউ শিয়াওমিংএর একটা লেখা ছাপা হয় ব্রিটেনের ‘ডেইলি মেইল’ পত্রিকাতে। তিনি বলছেন যে, ব্রেক্সিটের পর ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’কে চীনের দিকেই তাকাতে হবে। গত পাঁচ বছরে চীনারা ব্রিটেনে যা বিনিয়োগ করেছে, তা এর আগের তিন দশকেও করেনি; এর মূল্যমান ১৯ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে ব্রিটিশরা চীনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদেশী বিনিয়োগের যোগানদাতা। চীনা কোম্পানি হুয়াই গত পাঁচ বছরে ব্রিটেনে ২ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে, সাড়ে ৭ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এবং প্রতি বছর ৬০ মিলিয়ন পাউন্ড কর দিয়েছে। এর পরের পাঁচ বছরে হুয়াই ‘ফাইভ-জি’ প্রকল্পে আরও ৩ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করবে। শিয়াওমিং ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর কাছ থেকে মুক্ত বাণিজ্যের নিশ্চয়তা চাইছেন, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের চলছে ব্যাপক বাণিজ্য যুদ্ধ। ব্রিটেন মনে করছে যে, ‘অকারণে’ চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধে জড়ালে ব্রিটেনের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুক্ত বাণিজ্যের প্রসার চাইলেও ব্রিটিশরা পূর্ব এশিয়ায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যেমে চীনের আগ্রাসী আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষপাতি; যা কিনা ব্রিটেনের আদর্শিক চিন্তারই ফসল।

সিঙ্গাপুরের ‘এস রাজারাতনাম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর ফেলো ফ্রেডারিক ক্লিয়েম ‘নিকেই এশিয়ান রিভিউ’এর এক লেখায় ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেনের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধির কথা বলছেন। ২০১৮ সালে ‘আসিয়ান’এর সাথে ব্রিটেনের বাণিজ্য ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের; অত্র এলাকায় ব্রিটেনের বিনিয়োগ রয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলার। তিনি বলছেন যে, ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্রিটেনকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে হবে। ইতোমধ্যেই ১৯৭১ সালে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের সাথে স্বাক্ষরিত ‘ফাইভ পাওয়ার ডিফেন্স এরেঞ্জমেন্টস’এর অধীনে ব্রিটেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিরক্ষা খাতে স্থায়ী খেলোয়াড় হতে চাইছে। ব্রিটিশ নৌবাহিনী দক্ষিণ চীন সাগরে নিয়মিত আসাযাওয়া করছে এবং এখানে একটা স্থায়ী নৌঘাঁটি করার পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে।

‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস’এর ‘আইডিয়াস ইন্সটিটিউট’এর এসোসিয়েট স্টিফেন পাদুয়ানো ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ তার অবাস্তব আকাংক্ষাকে আজ হোক কাল হোক মেনে নিতে বাধ্য। আফ্রিকাতে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং চীনকে টক্কর দিয়ে আফ্রিকায় সবচাইতে বড় বিনিয়োগকারী হবার আশা ব্রিটেন করতে পারে না। আফ্রিকাতে ব্রিটেন যদি তার পশ্চিমা সহযোগীদেরকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে থাকে, তাহলে ব্রিটেনের আকাংক্ষা বাস্তবায়ন কঠিন। একইসাথে ব্রিটেন আফ্রিকার দেশগুলিকে বলতে পারে না যে তারা যেন ব্রিটেনকেই তাদের প্রধান বাণিজ্য সহযোগী হিসেবে মেনে নেয়।

ইইউএর মাঝে থেকেও ব্রিটেন সর্বদাই আলাদা থাকতে চেয়েছে। ইইউএর সাধারণ মুদ্রা ইউরোকেও ব্রিটেন নিজের মুদ্রা হিসেবে মেনে নেয়নি। ইইউ থেকে ব্রিটেন সুবিধা চেয়েছে; কিন্তু বিনিময়ে কিছু দিতে কার্পণ্য করেছে। ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ায় ইউরোপের সাথে ব্রিটেনের এই প্রতিযোগিতা শেষ হচ্ছে না; বরং নতুন রূপ নিচ্ছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্কও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে; বিশেষ করে ব্রিটেন যখন পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক নেতৃত্ব নিতে চাইছে। এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিও ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ সম্পর্কে আলোচনা করছে। কিন্তু এর বাস্তবতা নিয়ে কৌতুহলের চাইতে প্রশ্নই বেশি আসছে। ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেনের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিশ্বের সকলকে বিশ্বাস করানো যে ব্রিটেন বিশ্বকে আবারও নেতৃত্ব দেবার সক্ষমতা রাখে।


2 comments:

  1. বৃটেনের এই আকাংখ্যা (আদর্শিকভাবে গ্লোবাল নেতৃত্ব দেয়ার) সহসা পূরন হবার নয়। যদিও উপনিবেশবাদী দেশগুলির মধ্যে বৃটেনের আচারনই সবচেয়ে বেশী সভ্য ও মানবিক ছিল, যদিও তা তর্কাতীত নয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির প্রাক্তন উপনিবেশগুলির ইতিহাস দেখলে এটা বুঝা যায়।

    বাংলাদেশ মনে হয় ইঊরোপের সাথে বিশেষ করে বৃটেনের সাথে অধিকতর প্রতিরক্ষার বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাচ্ছে। কয়েকটি ওপিভি, পরিবহন বিমান সি-১৩০জে এবং সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত ইএফটি জংগী বিমান (যদিও এখনো নিশ্চিত নয়) ক্রয়ের কথা উল্লেখ করা যায়। মোট কথা আমরা বৃটেনের এই উদ্যোগ ব্যবহার করে মিয়ানমারের উপর অধিকতরও চাপ সৃস্টি করতে পারি, যদিও তা কতটা কার্যকরী হবে তাতে আমি সন্দিহান।

    আচ্ছা, সম্প্রতিক সময়ের মিয়ানমারের ঘটনাপূন্জ নিয়ে আপনার মূল্যবান পোষ্ট আশা করছি। চীন যেভাবে নির্লজ্জ্বভাবে মিয়ানমারের পিছনে দাড়াচ্ছে, আর অবাক করার বিষয় হচ্ছে ভিয়েতনামের মত দেশও এদের পিছনে দাড়াচ্ছে। আসলে মোংগোলয়েড দেশগুলির দৃষ্টভংগীগুলিই আলাদা, এরা শক্তের ভক্ত ও নরমের যম। এদের সংগে কিরুপ আচারন করা উচিৎ এ ব্যাপারে আপনার মূল্যবান পোষ্ট আশা করছি, ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. অনেক ধন্যবাদ কমেন্টের জন্যে!

    প্রথমতঃ ব্রিটেনের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা থাকবে আমার তৃতীয় বইতে, যা এই ফেব্রুয়ারির মাঝেই প্রকাশ হবে ইনশাআল্লাহ!

    দ্বিতীয়তঃ মিয়ানমারের ব্যাপারে এই মুহুর্তে খুব বেশি বলার নেই। আপনি এর মাঝে আগের একটা লেখা আবারও পড়ে নিতে পারেন। এই কথাগুলি সামনের দিনগুলিতেও একই থাকবে।
    https://koushol.blogspot.com/2018/11/why-myanmar-should-be-under-bangladesh-influence.html

    ReplyDelete