Thursday 6 February 2020

তুরস্কের এশিয়া গমন?

০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ 

  
প্রস্তাবিত ‘ইস্তাম্বুল ফিনানশিয়াল সেন্টার’এর পরিকল্পনা, যেটাকে বিশ্বের সবচাইতে বড় পুঁজিবাজার হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা করছে তুরস্ক। তুরস্ক এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সেতুস্বরূপ, যা দেশটাকে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বাকিদের থেকে আলাদা করেছে। ন্যাটো সদস্য এবং ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ একটা অর্থনীতি হিসেবে তুরস্ক চাইছে এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সেতু হিসেবে কাজ করতে। 

৪ঠা ফেব্রুয়ারি তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এশিয়া বিষয়ক এক কনফারেন্স। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু কনফারেন্সে বলেন যে, গত বছরের অগাস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা তুরস্কের ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশলের অংশ হিসেবে তুরস্ক চাইছে এশিয়ার দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কূটনীতিবিদ এবং প্রতিনিধিরা এতে যোগ দেন। কাভুসোগলু বলেন যে, আগামী ১০ বছরে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুই তৃতীয়াংশ আসবে এশিয়া থেকে। আর সম্ভবতঃ ১৫ বছরের মাঝে বিশ্বের সবচাইতে বড় পাঁচটা অর্থনীতির চারটাই থাকবে এশিয়াতে। এমতাবস্থায় ন্যাটো সদস্য এবং ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ একটা অর্থনীতি হিসেবে তুরস্ক এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে। এশিয়ার সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ছাড়াও প্রতিরক্ষা শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মিডিয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে চাইছে তুরস্ক। কাভুসোগলুর কথাগুলিকে শক্তিশালী ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠিত করতে ‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, আসিয়ানের ১০টা দেশ সহ এশিয়ার মোট ৩২টা দেশে তুরস্কের কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। গত ২৬শে ডিসেম্বর ‘এশিয়া এনিউ’ বিষয়ক এক কর্মশালায় ২০২০ সালে এশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। সেই কর্মশালায় তুরস্কের প্রভাবশালী শিক্ষাবিদ এবং থিঙ্কট্যাঙ্করা অংশ নেয়। চীন, ভারত, জাপান, ইন্দোনেশিয়ার সাথে অস্ট্রেলিয়াকেও ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশলের অংশ হিসেবে ধরা হয়। কাভুসোগলু বলেন যে, এশিয়ার বহুবিধ সমস্যা মোকাবিলায় তুরস্ক মানবিক এবং মধ্যস্ততার কাজে তার অভিজ্ঞতাকে সামনে তুলে ধরতে চায়। তিনি আরও বলেন যে, অষ্টাদশ শতক ছিল এশিয়ার হাতে; ঊনিশ শতক চলে যায় ইউরোপের হাতে; এরপর বিংশ শতকে আমেরিকা হয়ে যায় বিশ্বসেরা; একুশ শতকের পথ দেখাবে ‘এশিয়া এনিউ’।

‘এশিয়া এনিউ’ কৌশলের অংশ হিসেবে তুরস্ক তার বিনিয়োগের উৎসকে আরও কিছুটা ছড়িয়ে দিতে চাইছে। তারা চাইছে যে, তুরস্কের বিনিয়োগ শুধু ইউরোপ থেকে না এসে এশিয়া থেকেও আসুক। ১৪ই জানুয়ারি ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ফিনান্স অফিস’ বলে যে, ২০২০ সালে তুরস্ক এশিয়া থেকে অর্থায়নের চেষ্টাকে অধিক গুরুত্ব দেবে। এই অফিসের প্রধান গোকসেল আশান তুরস্কের ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে বলেন যে, তারা মনে করছেন যে, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এবং কাতার তুরস্কে সম্ভাবনাময় বিনিয়োগকারী হতে পারে। ২০১৫ সালে ‘আইসিবিসি’ তুরস্কে প্রথম চীনা ঋণদাতা হিসেবে ঢোকে। এরপর ২০১৭ সালে ‘ব্যাঙ্ক অব চায়না’ও তুরস্কে অপারেশন শুরু করে। আশান বলেন যে, তুরস্ক তার দৃষ্টি পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরিয়ে ফেলেনি; বরং বিশ্বের অর্থনীতিই পশ্চিম থেকে এশিয়ার দিকে সরে যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাভুসোগলু বলেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি এশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করলে তো কেউ বলেন না যে, তারা নিজেদেরকে পূর্বমুখী করছেন; তাহলে তুরস্ক এশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইলে তুরস্ক তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে ফেলেছে, এমন আলোচনা আসবে কেন? তুরস্কের শিল্প ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে যে, ২০০২ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তুরস্ক এশিয়া থেকে ২৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। ২০১৮ সালে তুরস্কে আসা মোট বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগের ২৮ শতাংশ ছিল এশিয়; যা ২০১৯ সালে বেড়ে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এর বিপরীতে ইউরোপিয় বিনিয়োগ ছিল ৫৫ শতাংশ এবং মার্কিন বিনিয়োগ ছিল ৯ শতাংশের কিছু কম। ২০১৯এর প্রথম দশ মাসে তুরস্কে সবচাইতে বেশি বিনিয়োগ এসেছে ব্রিটেন থেকে; যার পরে রয়েছে কাতার এবং আজেরবাইজান।

গোকসেল আশান আরও বলছেন যে, তুরস্ক চাইছে ২০২২ সালের মাঝে ‘ইস্তাম্বুল ফিনানশিয়াল সেন্টার’ নামের একটা পুঁজিবাজার তৈরি করতে, যা হবে পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ১০টা বাজারের একটা। লন্ডন বা সিঙ্গাপুরের পুঁজিবাজারকে সরাসরি অনুকরণ না করে এই বাজারকে কিছুটা ভিন্নভাবে তৈরি করা হবে; কারণ তুরস্ক জানে যে, প্রচলিত পদ্ধতিতে লন্ডন বা সিঙ্গাপুরকে টেক্কা দেয়া সম্ভব নয়। তাই ইসলামি মোড়কে পুঁজিবাজারটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে তারা। ‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, ২০০৯ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো নিউ ইয়র্ক, লন্ডন এবং দুবাইএর পুঁজিবাজারের চাইতে বড় একটা বাজার তৈরি করা, যা ইস্তাম্বুলকে আন্তর্জাতিক পুঁজির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করবে। ২৫ লক্ষ বর্গমিটার এলাকার মাঝে ৩০ হাজার মানুষের চাকুরির সুযোগ হবে বলে বলা হচ্ছে। সাড়ে ৫ লক্ষ বর্গমিটার আফিসস্পেস ছাড়াও এখানে থাকবে শপিং সেন্টার, হোটেল, বাসস্থান, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং ২ হাজার মানুষ ধারণক্ষমতার কনফারেন্স সেন্টার।


  
আগামী ১০ বছরে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুই তৃতীয়াংশ আসবে এশিয়া থেকে। আর সম্ভবতঃ ১৫ বছরের মাঝে বিশ্বের সবচাইতে বড় পাঁচটা অর্থনীতির চারটাই থাকবে এশিয়াতে। এমতাবস্থায় ন্যাটো সদস্য এবং ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ একটা অর্থনীতি হিসেবে এশিয়ার সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ছাড়াও প্রতিরক্ষা শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মিডিয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে চাইছে তুরস্ক। 


২০১৯এর অগাস্টে এশিয়ায় অবস্থিত তুরস্কের কূটনৈতিক মিশনগুলির সাথে ১১তম সভায় নেয়া ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশল সম্পর্কে চীনা মিডিয়া ‘শিনহুয়া’ বলছে যে, তুরস্কের এই প্রচেষ্টা এশিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ককে সবদিক থেকেই এগিয়ে নেবার একটা চেষ্টা। জুলাই মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের চীন সফরের সময় চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’এর মাধ্যমে দুই দেশের সহযোগিতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়। একজন জেষ্ট্য তুর্কি কূটনীতিক ‘শিনহুয়া’কে বলেন যে, ‘এশিয়া এনিউ’এর ফোকাস থাকবে বাণিজ্য বৃদ্ধি, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির মাঝে সম্পর্কোন্নয়ন এবং সামাজিক যোগাযোগের উন্নয়ন। তিনি বলেন যে, তুরস্ক এশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে সেতুস্বরূপ, যা দেশটাকে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বাকিদের থেকে আলাদা করেছে। এই চেষ্টাটাকেই এখন তুরস্ক একটা কৌশলগত দিকনির্দেশনায় পরিণত করতে চাইছে। ইস্তাম্বুলের কচ ইউনিভার্সির প্রফেসর আলতায় আতলি বলছেন যে, এতদিন এশিয়ার বেশকিছু দেশের সাথে তুরস্কের বেশ ভালো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছিল; কিন্তু তা তুরস্কের এশিয়া নিয়ে বৃহৎ কোন কৌশলের অংশ ছিল না। পৃথিবীর ৬০ শতাংশ মানুষ এশিয়াতে থাকে, এবং এখানেই দুনিয়ার সবচাইতে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলি রয়েছে। তাই শুধুমাত্র পশ্চিমা দেশগুলির সাথে সম্পর্ক রাখাটা তুরস্কের জন্যে যথেষ্ট নয়।

তুরস্ক তার ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশলকে নিয়মিত আলোচনার মাঝে দেখতে চাইছে। ২১শে জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর সাইডলাইনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাভুসোগলু আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ, জর্জিয়ার প্রধানমন্ত্রী গিওর্গি গাহারিয়া, চীনের রিটেইল ব্যবসা ‘আলীবাবা’র প্রতিনিধি, ভারতের গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘মাহিন্দ্রা’র প্রতিনিধি এবং আজেরবাইজানের তেল কোম্পানি ‘সোকার’এর প্রতিনিধির সাথে ‘নিউ ভিশন ফর এশিয়া’ আলোচনায় ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশলের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন যে, ২১ শতকে এশিয়া পৃথিবীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হতে চলেছে। তুরস্কের ‘ইহলাস নিউজ এজেন্সি’র সাথে এক স্বাক্ষাতে কাজাখস্তানের রাষ্ট্রদূত আবজাল সাপারবেকুলি বলেন যে, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন এশিয়ার দিকে ধাবিত হওয়ায় তুরস্কের ‘এশিয়া এনিউ’ কৌশল এশিয়ার দেশগুলির সাথে সম্পর্কে গতি আনবে। তিনি আরও বলেন যে, যেভাবে কাজাখস্তান তুরস্কের জন্যে রাশিয়া, চীন ও মধ্য এশিয়ার জন্যে দরজা, তেমনি তুরস্কও এশিয়া থেকে ইউরোপে যাবার দরজা।

সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া থেকে ‘এস-৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। একইসাথে সিরিয়ায় সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে ইউরোপের সাথেও তুরস্কের সম্পর্ক শীতল যাচ্ছে। লিবিয়ার যুদ্ধে জড়াবার পর থেকে এই শীতল সম্পর্ক শীতলতর হবার আশংকা দেখা যাচ্ছে। একুশ শতকে নিজের প্রভাবকে নতুনতর উচ্চতায় নিয়ে যেতে তুরস্ক ইউরোপ এবং এশিয়া উভয় অঞ্চলেই অবস্থান নিতে চাইছে। বিশেষ করে ঐতিহাসিকভাবে এশিয়ার অর্থনৈতিক গুরুত্বকে তুলে ধরে তুরস্ক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন একটা অধ্যায়কে প্রাধান্য দিতে চাইছে, যা মাত্র কয়েক দশক আগেও দৃশ্যমান ছিল না। এশিয়ার অর্থনীতিতে তুরস্কের উপস্থিতি এমন সময়ে আসছে, যখন ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ ও প্রযুক্তিযুদ্ধ প্রতিনিয়ত নতুন রূপ নিচ্ছে। তুরস্ক চাইছে চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটভ’কে যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রতিরোধ না করে বরং নিজের কাজে ব্যবহার করতে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে তুরস্ককে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর হলেই চলবে না, রাজনৈতিকভাবে এশিয়ায় তার অবস্থানকে দৃঢ় করতে হবে। রাজনৈতিক অবস্থান করতে এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলির সাথে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলায় মনোযোগী হবে তুরস্ক। ‘মুসলিম আইডেন্টিটি’কে ব্যবহার করে এগুতে চাইলেও আদর্শিক দিক থেকে তুরস্ককে নির্দিষ্ট একটা অবস্থানে আসতে হবে, যা কাশ্মির এবং উইঘুর ইস্যুতে তুরস্কের শক্ত অবস্থান নেবার অক্ষমতা থেকে আপাততঃ দৃশ্যমান নয়।

No comments:

Post a Comment