Thursday 5 March 2020

ইদলিবের যুদ্ধ সিরিয়ায় ইরানের অবস্থানকে দুর্বল করছে

০৫ই মার্চ ২০২০
 
 
সুলাইমানির হত্যার পর একটা দুর্বল অবস্থানে থেকে ইরানের পক্ষে আলোচনায় মধ্যস্ততা করাটা কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাশিয়া এবং তুরস্কের ভূরাজনৈতিক খেলায় ইরানের কোন ভূমিকাই নেই। এমতাবস্থায় শুধুমাত্র সিরিয়ার যুদ্ধকে ব্যবহার করে ইরানের পক্ষে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব নয়। কাসেম সুলাইমানি-পরবর্তী সময়ের আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক হিসেবনিকেশে ইরানের দুর্বলতর অবস্থানের সুযোগ অনেকটাই তুরস্ক নেবে।
 

ইরানের ‘ক্বোম নিউজ’এর বরাত দিয়ে ‘রেডিও ফারদা’ জানাচ্ছে যে, সিরিয়ার ইদলিবে ৩৪ জন তুর্কি সেনা নিহত হবার পর তুর্কিদের প্রতিশোধমূলক আক্রমণে সিরিয় সেনাদের সাথেসাথে ২১ জন ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া নিহত হয়। এই সেনাদের রিক্রুট করা হয়েছিল আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে। এর মাঝে ১৮ জন ছিল পাকিস্তানের ‘জেইনাবিউন ব্রিগেড’এর, আর ৩ জন ছিল আফগানিস্তানের ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’এর। পহেলা মার্চ ইরানের শিয়াদের পবিত্র শহর ক্বোমএ এই ২১ জনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। হিযবুল্লাহর ১৪ জন সদস্যও ইদলিবে নিহত হয়েছে, যাদের শেষকৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় লেবাননের রাজধানী বৈরুতে। ২৯শে ফেব্রুয়ারি ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের সাথে ফোনালাপ করেন। ফোনালাপে তিনি ২০১৮ সালের আস্তানা আলোচনার ছায়ায় তুরস্ক এবং রাশিয়াকে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানান। পরদিন পহেলা মার্চ সিরিয়াতে ইরানের ‘মিলিটারি এডভাইজরি সেন্টার’ বা ‘এমএসি’র এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ইরানিরা তুর্কিদের টার্গেট না করলেও তুর্কিরা ইরানিদেরকে টার্গেট করছে। একইসাথে বিবৃতিতে হুমকি দিয়ে বলা হয় যে, তুর্কিদের জেনে রাখা উচিৎ যে, তারা ‘এমএসি’র অস্ত্রের পাল্লার মাঝেই রয়েছে। এতে আরও বলা হয় যে, ইচ্ছে করলেই ইরানিরা তুর্কিদের উপর প্রতিশোধ নিতে পারতো; কিন্তু নেয়নি। বিবৃতির শেষে বলা হয় যে, যতদিন সিরিয়াতে সন্ত্রাসীরা থাকবে, ততদিন ইরান সিরিয়াতে থাকবে। ‘এমএসি’র এই ঘোষণা অনেককেই অবাক করেছে; কারণ প্রায় কেউই এতকালে ‘এমএসি’র নাম শোনেনি। তুর্কি মিডিয়া ‘ইয়েনি সাফাক’এর ৪ঠা মার্চের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে লন্ডনভিত্তিক প্রেস মনিটরিং সংস্থা ‘মিডলইস্ট মনিটর’ বলছে যে, ইরান ইদলিবের কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর সারাকিবে ‘আল কুদস ফোর্স’এর ২ হাজার সেনা প্রেরণ করেছে; আর সারাকিবের দক্ষিণে মা’রাত আল নুমানে ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’এর সদস্যরা পৌঁছেছে ২’শ গাড়িতে করে। হিযবুল্লাহও সারাকিবে তাদের যোদ্ধাদের পাঠিয়েছে।

ইদলিবের যুদ্ধ পরিস্থিতি - ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০২০

  

‘জার্মান ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল এন্ড সিকিউরিটি এফেয়ার্স’এর ফেলো হামিদরেজা আজিজি ওয়াশিংটনভিত্তিক আরবের পত্রিকা ‘আল মনিটর’এর এক লেখায় বলছেন যে, ইদলিবের যুদ্ধে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের মৃত্যু যুদ্ধকে আরও বেশি জটিল করে তুলেছে। ইরান এতকাল সিরিয়ার যুদ্ধে তার জড়িত থাকার ব্যাপারটাকে প্রচার না করলেও এখন সে আর তা গোপন রাখতে চাইছে না। সিরিয়ার দামাস্কাস আর আলেপ্পোর মাঝে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর চলে যাওয়া ‘এম ৫’ হাইওয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়াটা ইরানের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা লক্ষ্য বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এই হাইওয়ের সাথে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী লাতাকিয়া থেকে আসা ‘এম ৪’ হাইওয়ে মিশেছে সারাকিব শহরে, যা কিনা ইতোমধ্যেই চলমান ইদলিবের যুদ্ধের মাঝে দু’বার হাতবদল হয়েছে। ২০১৮ সালে সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার সময় রাশিয়ার ভূমিকাকে মেনে নিয়েছিল ইরান। কিন্তু এবারে সিরিয়ার বাশার সরকারকে রক্ষা করতে যথেষ্ট চেষ্টা না করায় ইরান কিছুটা অসন্তুষ্ট। ইরানিরা ধারণা করছে যে, রাশিয়া এবং তুরস্কের মাঝে সম্ভবতঃ একটা সমঝোতা হয়েছে, যা কিনা সন্মুখে আসেনি। ‘রাশান ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স কাউন্সিল’এর নন-রেসিডেন্ট বিশেষজ্ঞ ম্যাক্সিম সুচকভের মতে, রাশিয়া এবং তুরস্কের সম্পর্কের মাঝে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, তুরস্কের মাঝ দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে রুশ তেল ও গ্যাস সরবরাহের সহযোগিতা, রুশ সহায়তায় আক্কুইউতে তুরস্কের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, এবং রুশ ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ। এই প্রকল্পগুলি দুই দেশের জন্যে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, সেই তুলনায় সিরিয়ার যুদ্ধ দুই দেশকে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবার জন্যে যথেষ্ট নয়।



জেনারেল কাসেম সুলাইমানির (ডানে) সাথে সিরিয়াতে আফগান শিয়াদের ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’এর নেতা আলিরেজা তাভাসোলি (মাঝে)। তাভাসোলি সিরিয়ার দেরাতে যুদ্ধে নিহত হন; আর সুলাইমানি বাগদাদ বিমানবন্দরে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন
ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত আরবের পত্রিকা ‘দ্যা এরাব উইকলি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সিরিয়ার বিষয়ে এর আগে আস্তানা এবং সোচিতে যে সমঝোতা হয়েছিল, তাতে শান্তি ধরে রাখার মূল নিশ্চয়তা দানকারী ছিল রাশিয়া, তুরস্ক এবং ইরান। কিছুদিন আগ পর্যন্তও ব্যাপারটা এমন থাকলেও এখন তা পরিবর্তন হচ্ছে। কারণ ইদলিবের সংঘর্ষ থামাবার ব্যাপারে আলোচনাতে শুধুমাত্র আঙ্কারা এবং মস্কোর নামই শোনা যাচ্ছে; তেহরান এক্ষেত্রে অনুপস্থিত। ইউফ্রেতিসের পূর্বাঞ্চলের ব্যাপারে আলোচনাতে উপস্থিত ছিল তুরস্ক, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র; সেখানেও ইরান ছিল অনুপস্থিত। সিরিয়াতে কাজ করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে যে ম্যান্ডেট দিয়েছিল, ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তা ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের সাথে সাথে সরিয়ে নেন। সেসময় থেকেই সিরিয়াতে ইরানি সশস্ত্র গ্রুপগুলি ইস্রাইলসহ অন্য যেকোন বিরোধী শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হবার ভয়ে রয়েছে। ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও এই গ্রুপগুলিকে দুর্বল করছে। এই পুরো ব্যাপারটা তেহেরানের জন্যে আরও কঠিন হয়ে যায় নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে ইরানি জেনারেল কাসেম সুলাইমানির হত্যাকান্ডের পর। ইরানের ‘আইআরজিসি’র ‘আল কুদস ফোর্স’এর এই কমান্ডার সিরিয়াতে ইরান সমর্থিত বাহিনীরগুলিকে একত্রে ধরে রাখার জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা তার হত্যার পরই বোঝা যাচ্ছে। সিরিয়াতে সেনাবাহিনী এবং হিযবুল্লাহর কাজগুলি এখন কিছু কমান্ডারের ব্যক্তিগত চেষ্টার ফলাফল; তেহেরানের সমর্থিত কোন সমন্বিত পরিকল্পনার অংশ নয়, যা কিনা সুলাইমানি নিশ্চিত করতেন। সুলাইমানি তেহেরানে সরাসরি যোগাযোগ না করেও অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। সিরিয়ার আকাশের নিয়ন্ত্রণ মস্কোর হাতে; তাই মস্কোর সাথে লিয়াঁজো রক্ষাও তিনিই করতেন। ইদলিবই হলো সুলাইমানিকে হারাবার পর সিরিয়াতে ইরানের জন্যে প্রথম চ্যালেঞ্জ।

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ, ধ্বংসাত্মক মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও এর ফলশ্রুতিতে দেশব্যাপী জনবিক্ষোভ, নিজভূমে লিবারাল এবং কনজার্ভেটিভদের মাঝে দ্বন্দ্ব, লেবানন ও ইরাকে ব্যাপক জনরোষের মুখে ইরানের প্রভাবের ক্ষয়ে যাবার সম্ভাবনা ছাড়াও আঞ্চলিকভাবে ইস্রাইল, তুরস্ক এবং সৌদি গ্রুপের আগ্রাসী কর্মকান্ডে ইরান যথেষ্টই ক্ষতির মুখে পড়েছে। এমনই এক সময়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ইদলিবের ব্যাপারে আলোচনার জন্যে রাশিয়া এবং তুরস্কের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন। রাশিয়া এবং তুরস্ক উভয়েই ইরানের বর্তমান দুর্বল অবস্থানের ব্যাপারে অবগত। তুর্কিরা সিরিয়াতে রুশ টার্গেটে হামলা করা থেকে বিরত থাকলেও ইরানি টার্গেট সেখান থেকে বাদ পড়ে যায়নি। অপরদিকে রুশরা তুর্কিদেরকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্যে ডাকলেও সেখানে ইরানকে যোগ দেবার জন্যে বলেনি। সুলাইমানির হত্যার পর একটা দুর্বল অবস্থানে থেকে ইরানের পক্ষে আলোচনায় মধ্যস্ততা করাটা কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাশিয়া এবং তুরস্কের ভূরাজনৈতিক খেলায় ইরানের কোন ভূমিকাই নেই। এমতাবস্থায় শুধুমাত্র সিরিয়ার যুদ্ধকে ব্যবহার করে ইরানের পক্ষে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব নয়। কাসেম সুলাইমানি-পরবর্তী সময়ের আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক হিসেবনিকেশে ইরানের দুর্বলতর অবস্থানের সুযোগ অনেকটাই তুরস্ক নেবে।

No comments:

Post a Comment