Sunday 16 February 2020

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ফিলিপাইন?

১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২০

   
ফিলিপাইন এখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা কমলেও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্রদের উপরে ফিলিপাইনের নির্ভরশীলতা যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ফিলিপাইনের চুক্তি বাতিল হোক আর না হোক, ফিলিপাইন যে আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিরাপত্তার চাদরের মাঝে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না, তা নিশ্চিত। 


গত ১১ই ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইন ঘোষণা দেয় যে, দুই দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ফিলিপাইনের স্বাক্ষরিত একটা নিরাপত্তা চুক্তি তারা বাতিল করতে যাচ্ছে। ‘ভিজিটিং ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট’ বা ‘ভিএফএ’ নামের এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে তাদের সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে পারতো। ফিলিপাইন যে এই চুক্তি বাতিল করবে, তার আভাস আগেই পাওয়া যাচ্ছিলো, যখন ২৩শে জানুয়ারি ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদরিগো দুতার্তে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের সিনেটর রোনাল্ড ডেলা রসার ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে, তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘ভিএফএ’ চুক্তি বাতিল করবেন। ফিলিপাইনের অনলাইন মিডিয়া ‘র‍্যাপলার’ বলছে যে, সাংবাদিকদের সাথে এক টেলিকনফারেন্সে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব ক্লার্ক কুপার বলেন যে, এই চুক্তি বাতিল করা হলে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মাঝে প্রতি বছর যে ৩’শ যৌথ কর্মকান্ড চালিত হয়, তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে তিনি আশা করেন যে, ফিলিপাইনের নীতিনির্ধারকদের মাঝে অনেকেই এসব যৌথ কর্মকান্ড বন্ধ করার বিপক্ষে থাকবেন। এই চুক্তি বাতিল করা হলে ২০১৪ সালে স্বাক্ষরিত ‘এনহান্সড ডিফেন্স কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট’ বা ‘ইডিসিএ’ চুক্তিও হুমকির মুখে পড়বে। ‘ইডিসিএ’এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে সৈন্য রাখা ছাড়াও কিছু সামরিক ঘাঁটিতে আগে থেকেই স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পদ মজুত করে রাখে। তবে কুপার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, ‘ভিএফএ’ চুক্তি বাতিল করা মানেই ‘ইডিসিএ’ বাতিল করা নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিলিপাইন এখনও যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্র ক্রয় করছে। এমতাবস্থায় ১৯৫১ সালে দুই দেশের মাঝে স্বাক্ষরিত ‘মিউচুয়াল ডিফেন্স ট্রিটি’ হুমকির মাঝে পড়বে কিনা, এই প্রশ্নের জবাব কুপার এড়িয়ে যান।

দুতার্তে সিনেটর ডেলা রসার ভিসা নিয়ে যে হুমকি দিয়েছিলেন, তা ছিল ফিলিপাইনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েনের একটা অংশ। মার্কিন সিনেটে অনুমোদিত ‘গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি এক্ট’এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দুতার্তের মাদকবিরোধী যুদ্ধের উপরে লাগাম টানতে চাইছিল। তবে মার্কিনীরা একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে সামরিক চুক্তিগুলিকে সমস্যায় ফেলতে চাইছিল না। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, দুতার্তের সরকার চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে তাদের প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব তৈরি করছিল। ‘ভিএফএ’ চুক্তি বাতিল করে এই পথে আরও দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হচ্ছে ফিলিপাইন। এই ঘোষণা এমন সময়ে এলো, যখন দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা আরও গভীর হচ্ছে। ফিলিপাইন এক্ষেত্রে চীনের সাথে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলতে চাইছে।

    
ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর দূরের সাগরে পাড়ি জমাবার আকাংক্ষা দেখিয়ে দেয় যে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাথে সংঘাত তাদের উদ্দেশ্য নয়। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ফিলিপাইন তার নিজস্ব নিরাপত্তার জন্যে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিকভাবে বন্ধু খুঁজছে; যেকারণে অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে তারা সাহস করছে। চীনকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ফিলিপাইনকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতে ফিলিপিনোদের আরও সুযোগসুবিধা এবং ছাড় দিতে চাপের মাঝে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।


সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন ছাড়াও ফিলিপাইন তার পররাষ্ট্রনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। নীতির পরিবর্তনের অংশ হিসেবে গত এক দশকে ফিলিপাইন তার নৌশক্তিকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। ২০১১ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ড থেকে ‘হ্যামিল্টন-ক্লাস’এর একটা পুরোনো জাহাজ পায় ফিলিপাইনের নৌবাহিনী। ৩ হাজার ২’শ টনের এই জাহাজখানা চার দশকের বেশি পুরোনো হলেও এটা ছিল ফিলিপাইনের প্রথম বড় আকারের যুদ্ধজাহাজ, যা ফিলিপাইনের নিজস্ব সমুদ্রসীমা পার হয়ে দূরের সমুদ্রে যেতে সক্ষম। এরকম মোট ৩টা জাহাজ তারা পায় যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ড থেকে। ২০১৪ সালে এমন একটা জাহাজ অস্ট্রেলিয়া যায় একটা নৌমহড়ায় অংশ নিতে। ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে ‘ম্যাকাসার-ক্লাস’এর ২টা বড় আকারের উভচর যুদ্ধজাহাজের ক্রয়াদেশ দেয় ফিলিপাইন। ২০১৭ সালের মাঝে ডেলিভারি পাওয়া সাড়ে ১১ হাজার টনের এই জাহাজগুলির একেকটা ৫’শ সৈন্য, তাদের অনেক যানবাহন এবং ২টি হেলিকপ্টার ১৩ হাজার কিঃমিঃ দূরের সমুদ্র উপকূলে নামিয়ে দিতে সক্ষম। ২০১৮ সালের অক্টোবরে এরকম একটা জাহাজ ’টারল্যাক’ রাশিয়ার ভ্লাডিভস্টক বন্দর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু আইল্যান্ড সফর করে; যা ছিল ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর জন্যে দূরের সাগরে পাড়ি জমাবার নতুন এক অধ্যায়। ২০১৯এর জুলাই মাসে এরকম আরেকটা জাহাজ ‘দাভাও দেল সুর’ ৩’শ সেনা ও ক্রু এবং একটা হেলিকপ্টার নিয়ে রাশিয়ার ভ্লাডিভস্টক বন্দরে যায়। ২০১৮ সালের অগাস্টে ফিলিপাইন দু’টা জাহাজ হাওয়াই দ্বীপে পাঠায় একটা মহড়ায় অংশ নিতে। ২০১৩ সালে ডাকা টেন্ডার জেতার পর দক্ষিণ কোরিয়া ২ জাহাজ ৬’শ টনের ‘হোজে রিজাল-ক্লাস’এর ২টা অত্যাধুনিক ফ্রিগেট বানিয়ে দিচ্ছে; যার প্রথমটা এবছরের মার্চে ফিলিপাইনে পৌঁছাবার কথা রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর ‘পোহাং-ক্লাস’এর একটা এন্টিসাবমেরিন কর্ভেটও ফিলিপাইনের কাছে হস্তান্তর করেছে কোরিয় সরকার। ফিলিপাইনের কোস্ট গার্ডও ৪টা বড় অফশোর প্যাট্রোল জাহাজ কিনছে ফ্রান্স এবং জাপান থেকে। আরও ৬টা জাহাজ কেনার জন্যে অস্ট্রেলিয়া এবং থাইল্যান্ডের সাথে কথা চলছে।

এই জাহাজগুলির দূরের সাগরে যাবার অভিজ্ঞতা নতুন মোড় নেয় যখন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মাঝে উত্তেজনার ফলশ্রুতিতে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত ফিলিপিনোদের সরিয়ে নেবার লক্ষ্যে উভচর যুদ্ধজাহাজ ‘দাভাও দেল সুর’ এবং ‘হ্যামিল্টন-ক্লাস’ জাহাজ ‘রেমন এলকারাজ’ জানুয়ারির ১৪ তারিখে ফিলিপাইন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে ১৫ দিন পর শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে পৌঁছে। এটা ছিল ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর ইতিহাসে কোন জাহাজের প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ। ৬ই ফেব্রুয়ারি জাহাজগুলি ওমান পৌঁছে।

তবে ফিলিপাইন এখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে না; যা কিনা ক্লার্ক কুপারের কথায় বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা কমলেও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্রদের উপরে ফিলিপাইনের নির্ভরশীলতা যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ফিলিপাইনের চুক্তি বাতিল হোক আর না হোক, ফিলিপাইন যে আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিরাপত্তার চাদরের মাঝে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না, তা নিশ্চিত। চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নও সেকারণেই। ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর দূরের সাগরে পাড়ি জমাবার আকাংক্ষা দেখিয়ে দেয় যে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাথে সংঘাত তাদের উদ্দেশ্য নয়। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ফিলিপাইন তার নিজস্ব নিরাপত্তার জন্যে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিকভাবে বন্ধু খুঁজছে; যেকারণে অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে তারা সাহস করছে। চীনকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ফিলিপাইনকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতে ফিলিপিনোদের আরও সুযোগসুবিধা এবং ছাড় দিতে চাপের মাঝে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।

No comments:

Post a Comment