Friday 21 February 2020

আফগানিস্তানের ‘ব্ল্যাক হোল’ থেকে বের হতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র?

২২শে ফেব্রুয়ারি ২০২০

  
গত ১৮ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে আফগানিস্তানে। অথচ বিপুল অংখ্যক আফগান জনগণের মৌলিক চাহিদাই পূরণ করা হয়নি। আফগানিস্তানের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা ‘ব্ল্যাক হোল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা থেকে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া ট্রাম্প সরকার তালিবানদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি এবং সবচাইতে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের মতো পাথুরে অঞ্চলকে ১৮ বছর চেষ্টার পরেও নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। 


আফগানিস্তানের যুদ্ধ শেষ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবান মিলিশিয়াদের সাথে আংশিক যুদ্ধবিরতির একটা সমঝোতায় পৌঁছেছে। সমঝোতা অনুযায়ী ২২শে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে এক সপ্তাহ যুদ্ধবিরতির উপর লক্ষ্য রাখা হবে। যদি তা সফল হয়, তাহলে ২৯শে ফেব্রুয়ারি থেকে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হবে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, সহিংসতা কমতে থাকলে এটাই হবে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ। আফগান সরকারের সাথে তালিবানদের সংঘাতও এতে কমার আশা করছেন কেউ কেউ। তবে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই পরিস্থিতিতে গত সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের নির্বাচন পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি এবং বিরোধী নেতা আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহ - উভয়েই জয় পাবার দাবি করেছেন। পাঁচ মাস ধরে ব্যাপারটা ঝুলে থাকার ফলে কে বা কারা আফগান সরকারের পক্ষে তালিবানদের সাথে আলোচনায় বসবে সেটাই নিশ্চিত নয়। ২০১৯এর সেপ্টেম্বরে আরেক দফা যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার কারণে এবারের যুদ্ধবিরতির সফলতা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন করছেন। একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইছেন যেকোন মূল্যে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক অবস্থান কমাতে; অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে তালিবানরা ক্ষমতা ভাগাভাগিতে কতটা রাজি থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে এও বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের বেশিরভাগ সরিয়ে ফেলা হলেও স্পেশাল ফোর্সের ছোট একটা অংশ সেখানে রয়ে যাবে।

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, আফগানিস্তানের প্রতিটা নির্বাচন এতটাই সমস্যাসঙ্কুল ছিল যে, প্রতিবারই মার্কিন সরকার চেষ্টা করেছে যে, নির্বাচনের ফলে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হবার আগেই যেন তালিবানদের সাথে একটা শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিবারই নির্বাচনের কারচুপি এবং সহিংসতা তালিবানদের সাথে আলোচনায় বাধা দিয়েছে। আফগানিস্তানের মার্কিন সমর্থিত সরকার এখন কে চালাবে সেব্যাপারে দুই গ্রুপের মাঝে ব্যাপক বিরোধ দেখা দিয়েছে। ‘আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তান’এর সহকারি অধ্যাপক ওমর সাদর বলছেন যে, মার্কিনীদের সাথে তাদের আফগান মিত্ররাও শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাইছে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষের মাঝে এতটাই দূরত্ব তৈরি হয়েছে যে, তা দ্রুত কমানো না গেলে শান্তি প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে।

সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে তালিবানরা রাজি হয়েছে যে তারা শহর, হাইওয়ে এবং প্রধান নিরাপত্তা চৌকিগুলির উপর হামলা করা থেকে বিরত থাকবে; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সমর্থিত আফগান সরকারি বাহিনী তালিবানদের বিরুদ্ধে তাদের অপারেশন বন্ধ রাখবে। আফগান প্রেসিডেন্ট গনি বলছেন যে, তালিবানরা যদি বর্তমানে দিনে ৮০টা হামলা থেকে ১০টা হামলায় নামিয়ে আনে, তাহলে যুদ্ধবিরতি সফল হয়েছে বলে বলা যেতে পারে। তবে তালিবানরা যদি পূর্ণ যুদ্ধবিরতি পালন করতে যায়, তাহলে তাদের যোদ্ধাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হতে পারে।

তবে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ শুধু যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা নয়। দীর্ঘমেয়াদে আফগানিস্তানে শান্তি আনাতে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে হাজারো প্রশ্ন। ‘ভোক্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তানের বড় শহরগুলিকে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড চললেও দেশটার বেশিরভাগ অঞ্চলই আসলে ঠিকমতো চলছে না। কাবুলের উচ্চবিত্তদের মাঝে পশ্চিমা লাইফস্টাইলে ১ ডলারের কফি জনপ্রিয় হলেও দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের একদিনের আয় ১ ডলারের নিচে। উঁচু দালান এবং বিয়েশাদীর জন্যে তৈরি করা হলগুলি শহুরে উচ্চবিত্তদের নিজেদের জাহির করার পদ্ধতি হলেও তা দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না। দেশটার প্রায় অর্ধেকটাই হয় তালিবানদের দখলে অথবা নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতার মাঝে রয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রহরায় নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছে প্রার্থীরা; যেখানে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হয়নি, সেখানে তারা যাননি। নির্বাচনের দিন সহিংসতার ভয়ে বেশিরভাগ পোলিং স্টেশন বন্ধ ছিল। অর্থাৎ নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুধুমাত্র কিছু শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। আফগানদের কেউ কেউ মনে করছেন যে, আফগান সরকার যেকোন কিছুই করতে অক্ষম; অন্যদিকে তালিবানরা আর যা-ই হোক, কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং কাজ করতে পারে। কাবুল থেকে মাত্র ৩০ কিঃমিঃ দূরেও যেকোন ধরনের নাগরিক সুযোগসুবিধা অবর্তমান। জনগণ মনে করছে যে, এতে সরকারের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। কাবুল সরকারের অনেক কর্মকর্তাই পশ্চিমা ধারায় চিন্তা করেন; তাদের অনেকরই দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে; অনেকেই আফগানিস্তানের ভাষাও বলতে পারেন না। আফগান সরকার মার্কিন অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহায়তার জন্যে ওয়াশিংটনের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল।

২০১৯এর অগাস্টে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বেশ ঘটা করে আফগানিস্তানের স্বাধীনতার ১’শ তম বার্ষিকী উদযাপন করেন। কিন্তু এই উতসব চলাকালীন রাতের বেলায় মার্কিন বিমান হামলায় আফগানদের মাঝে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলছিল। জাতিসংঘের গত ডিসেম্বর মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী যুদ্ধে ১ লক্ষের বেশি বেসামরিক জনগণ এবং ২ হাজার ৩’শ মার্কিন সেনাসহ দেড় লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অনেক আফগানের কাছেই এই ‘তথাকথিত স্বাধীনতা’র বার্ষিকী মূল্যহীন। আফগানিস্তানের কিছু গোপন দলিল ফাঁস হবার পর ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, আফগানিস্তানের বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার একটা প্রবণতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সমর্থিত আফগান সরকারের মাঝে। তারা মিথ্যা এবং বানোয়াট তথ্য দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের ধারণাগুলিকে ভিত্তি দিতে চাইছেন। গত ১৮ বছরে যুক্তরাষ্ট্র ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে আফগানিস্তানে। অথচ বিপুল অংখ্যক আফগান জনগণের মৌলিক চাহিদাই পূরণ করা হয়নি। গোপন দলিলে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক কমান্ডারদের স্বীকারোক্তি রয়েছে যে, যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কেই তারা নিশ্চিত নন; এবং তারা আফগানিস্তানের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে মার্কিন জনগণকে অন্ধকারে রেখেছেন। আফগানিস্তানের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা ‘ব্ল্যাক হোল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা থেকে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া ট্রাম্প সরকার তালিবানদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। কিন্তু আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ যেমন মার্কিনীরা ছেড়ে দিতে নারাজ, আবার দীর্ঘমেয়াদে আফগানিস্তানে শান্তি আনার মত কোন কাজই এত বছরে মার্কিনীরা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতি এবং সবচাইতে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের মতো পাথুরে অঞ্চলকে ১৮ বছর চেষ্টার পরেও নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে।


No comments:

Post a Comment