Saturday 8 February 2020

তুরস্ক কোনটা বেছে নেবে - ইদলিব, নাকি রাশিয়া?

০৯ই ফেব্রুয়ারি ২০২০

 
তুরস্কের সামনে এখন কঠিন সিদ্ধান্ত তারা ইদলিবকে রক্ষা করবে, নাকি রাশিয়াকে বন্ধু হিসেবে রাখবে? ইদলিব ধরে রাখতে হলে তুরস্ককে সিরিয় সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে হতে পারে। আর রুশ সামরিক সহায়তা ছাড়া সিরিয় বাহিনীর পক্ষে তুর্কিদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তোলা কঠিন। একদিকে তুর্কিরা যেমন চাইবে না রুশদের সাথে কৌশলগত চুক্তিগুলি সমস্যায় পড়ুক, তেমনি রাশিয়াও চাইবে না তুরস্কের মাধ্যমে রুশ অর্থনীতি লাভবান হবার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাক।


‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, ৭ই ফেব্রুয়ারি সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমের শহর ইদলিবে বাশার আল আসাদের সরকারি বাহিনী এবং রুশ বিমান বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে তুরস্ক আরও সেনা এবং ট্যাঙ্ক পাঠাচ্ছে। ইদলিব হলো সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সর্বশেষ প্রতিরোধের এলাকা। সিরিয়ার বিদ্রোহীদেরকে সমর্থন দেয়া তুরস্ক ইদলিবে বাশার বাহিনীর সাথে সংঘাতে জড়াবার কাছাকাছি রয়েছে। ‘ইসলাস নিউজ এজেন্সি’ বলছে যে, তুর্কি সেনাবাহিনীর কমপক্ষে ৩’শ ৩০টা গাড়ি কাফর লুসিন গিরিপথের মাঝ দিয়ে ইদলিব পৌঁছেছে। এর আগে ইদলিবের কাছাকাছি সারাকিবে তুরস্কের ৮ জন সেনা সিরিয় হামলায় নিহত হয়। এর জবাবে তুর্কিরাও সিরিয় বাহিনীর উপর গোলাবর্ষণ করেছে। ইদলিবের হাসপাতাল এবং স্কুলগুলির উপর রুশ এবং সিরিয় বিমান বাহিনীর নির্বিচার হামলা থেকে বাঁচতে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা আবহাওয়ার মাঝেই ইদলিব ছাড়ছে হাজারো মানুষ। গত কয়েক মাসে এখান থেকে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ পালিয়েছে। এর মাঝে অনেকে ইতোমধ্যেই সিরিয়ার অন্যান্য এলাকা থেকে কয়েকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তুরস্ক বলছে যে, সিরিয়ার সরকার ২০১৮ সালে তুরস্ক এবং রাশিয়ার সম্মতিতে করা যুদ্ধবিরতি লংঘন করেছে। ইদলিবে তুরস্কের ১২টা অবজার্ভেশন পোস্ট রয়েছে, যার মাধ্যমে তুরস্ক যুদ্ধবিরতি দেখাশুনা করে। তুর্কিরা বলছে যে, তারা এই পোস্টগুলি থেকে তাদের সৈন্য সড়াবে না; এবং তুর্কি অবস্থানে সিরিয়রা হামলা করলে তুরস্কও এর বদলা নেবে।

তুর্কি মিডিয়া ‘আহভাল নিউজ’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে লেবাননে কাজ করা জাতিসংঘের এক প্রাক্তন কর্মকর্তা তিমুর গোকসেল বলেন যে, ৬ই ফেব্রুয়ারি সারাকিব নামক স্থান সিরিয় বাহিনীর হাতে চলে যাবার পর তুর্কিরা এবং তাদের সমর্থিত মিলিশিয়ারা পুরো ইদলিব হারাতে বসেছে। আলেপ্পো থেকে আসা ‘এম৫’ এবং লাটাকিয়া থেকে আসা ‘এম৪’ হাইওয়ের সংযোগস্থলে সারাকিব হলো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা শহর, যার নিয়ন্ত্রণের উপরে আলেপ্পো থেকে ইদলিব পর্যন্ত সাপ্লাই লাইনের নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করছে। এই হাইওয়ে ধরে রাখতে তুরস্ক সারাকিব এবং ইদলিবের মাঝে তিনটা শক্তিশালী অবজার্ভেশন পোস্ট তৈরি করছিল। সারাকিবের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া তুর্কিদের ইদলিব পৌঁছানো কঠিন হবে। আর তখন ইদলিবের ৩০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে তুর্কি সীমানার দিকে রওয়ানা হবে। বর্তমানে তুরস্কের অভ্যন্তরে ৩৭ লাখেরও বেশি সিরিয় শরণার্থী রয়েছে। একারণেই হয়তো তুরস্ক সারাকিবের দিকে সেনা পাঠাবার ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গোকসেল বলছেন যে, এখন তুরস্ককে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা রুশদের বিরুদ্ধে সংঘাতে যাবে কিনা; কারণ সিরিয় সরকার রুশ সহায়তা ছাড়া ইদলিবের অপারেশন শুরুই করতে পারতো না। উত্তর সিরিয়াতে বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে তুরস্ক তার প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী এই প্রক্সিগুলিকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করেছে। ‘মিডলইস্ট মনিটর’ বলছে যে, ৬ই ফেব্রুয়ারি তুর্কি সেনারা ইদলিবের পূর্বে তাফতানাজ বিমান ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে নেবার পরপরই সিরিয়রা সেখানে গোলাবর্ষণ করেছে। তবে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলছেন যে, রুশ প্রতিনিধিদল তুরস্কে আসছে সিরিয়া বিষয়ে আলোচনা করতে। ইদলিবে উত্তেজনা প্রশমণে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন। ইদলিবের সংঘর্ষ এমন সময়ে এলো, যখন রাশিয়া এবং তুরস্কের সম্পর্কের মধুরতা চলছে বেশ কিছু সময় ধরে।
 
৬ই ফেব্রুয়ারি সারাকিব নামক স্থান সিরিয় বাহিনীর হাতে চলে যাবার পর তুর্কিরা এবং তাদের সমর্থিত মিলিশিয়ারা পুরো ইদলিব হারাতে বসেছে। আলেপ্পো থেকে আসা ‘এম৫’ এবং লাটাকিয়া থেকে আসা ‘এম৪’ হাইওয়ের সংযোগস্থলে সারাকিব হলো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা শহর, যার নিয়ন্ত্রণের উপরে আলেপ্পো থেকে ইদলিব পর্যন্ত সাপ্লাই লাইনের নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করছে।
 

গত ৮ই জানুয়ারি তুরস্ক এবং রাশিয়ার নেতারা কৃষ্ণ সাগরের একটা গ্যাস পাইপলাইন উদ্ভোধন করেন। কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে যাওয়া ৯’শ ৩০ কিঃমিঃ লম্বা এই পাইপলাইন রাশিয়ার উপকূলের আনাপা থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের পশ্চিমের কিয়িকয় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এই পাইপলাইনের একাংশের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস তুরস্ক যাবে। আর বাকি আরেক অংশের মাধ্যমে গ্যাস তুরস্কের মাঝ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বুলগেরিয়া, সার্বিয়া এবং হাঙ্গেরিতে যাবে। ‘আল-জাজিরা’ ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে, ‘তুর্কস্ট্রিম’ নামে পরিচিত এই পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাস ইউক্রেনকে বাইপাস করে ইউরোপ পৌঁছাবে। আর একইসাথে তা তুরস্ককে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা জ্বালানি ট্রানজিট করিডোরে পরিণত করবে। আবার ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রির পর ‘তুর্কস্ট্রিম’ রাশিয়া এবং তুরস্কের মাঝে সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে। প্রকল্প অনুযায়ী তুরস্ক বছরে ১৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস আমদানি করবে রাশিয়া থেকে। আর এর দ্বিতীয় অংশের কাজ শেষ হলে একই পরিমাণ গ্যাস যাবে ইউরোপে। মস্কোর সাথে ইউক্রেনের সংঘাত শুরু পর থেকেই রাশিয়া ইউক্রেনকে বাইপাস করে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করতে চাইছে। ‘তুর্ক্সট্রিম’ ছাড়াও রাশিয়া বল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ নামের আরেকটা পাইপলাইনের মাধ্যেম জার্মানিতে গ্যাস রপ্তানি করতে চাইছে। ২০১৯এর ডিসেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটা নতুন আইনে সই করেন, যার মাধ্যমে এই দুই পাইপলাইন তৈরির উপর অবরোধ আরোপ করা হয়। তবে ‘তুর্ক্সট্রিম’ তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় অবরোধ মূলতঃ পড়েছে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’এর উপর।
   
‘তুর্কস্ট্রিম’ নামে পরিচিত এই পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাস ইউক্রেনকে বাইপাস করে ইউরোপ পৌঁছাবে। আর একইসাথে তা তুরস্ককে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা জ্বালানি ট্রানজিট করিডোরে পরিণত করবে। একদিকে তুর্কিরা যেমন চাইবে না রুশদের সাথে কৌশলগত চুক্তিগুলি সমস্যায় পড়ুক, তেমনি রাশিয়াও চাইবে না তুরস্কের মাধ্যমে রুশ অর্থনীতি লাভবান হবার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাক।

 
তবে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের ঘনিষ্টতা তুরস্কের জন্যে কূটনৈতিক দুর্বলতা তৈরি করবে বলে মনে করেন কেউ কেউ। ‘টারকিশ চ্যাম্বার অব পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার্স’এর জ্বালানি নীতির প্রধান নেচদেত পামির বলছেন যে, এই পাইপলাইনের মাধ্যমে তুরস্ক গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা পেলেও তা তুরস্ককে রাশিয়ার সাথে বেঁধে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে রাশিয়ার উপরেও তুরস্কের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কিনা গ্যাস সরবরাহের ব্যাপারে তুরস্কের দরকষাকষির সুযোগকে কমিয়ে দিচ্ছে। এতে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাশিয়া বেশি সুবিধা ভোগ করবে। তবে পামির যে ব্যাপারটাকে উল্লেখ করেননি তা হলো ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক। রুশ গ্যাস যতদিন পর্যন্ত ইউক্রেনের মাঝ দিয়ে নির্বিঘ্নে না যেতে পারবে, ততদিন ‘তুর্ক্সট্রিম’ থাকবে রাশিয়ার কাছে মহামূল্যবান। মার্কিন অবরোধের মাঝে তুরস্ক এবং ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির এই সুযোগ দেশটার অর্থনৈতিক দৈন্যতা থেকে উত্তোরণের একটা পথ।

তুরস্কের সামনে এখন কঠিন সিদ্ধান্ত তারা ইদলিবকে রক্ষা করবে, নাকি রাশিয়াকে বন্ধু হিসেবে রাখবে? ইদলিব ধরে রাখতে হলে তুরস্ককে সিরিয় সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে হতে পারে। আর রুশ সামরিক সহায়তা ছাড়া সিরিয় বাহিনীর পক্ষে তুর্কিদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তোলা কঠিন। একদিকে তুর্কিরা যেমন চাইবে না রুশদের সাথে কৌশলগত চুক্তিগুলি সমস্যায় পড়ুক, তেমনি রাশিয়াও চাইবে না তুরস্কের মাধ্যমে রুশ অর্থনীতি লাভবান হবার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাক। সিরিয়ার মতো লিবিয়াতেও তুরস্ক এবং রাশিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে। আবার ক’দিন আগেই তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইউক্রেন ঘুরে এসেছেন, যা রাশিয়াকে উত্তক্ত করেছে বলেই বলছেন বিশ্লেষকেরা। ইদলিব, লিবিয়া এবং ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি দেখিয়ে দেয় যে, তুরস্কের সাথে রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্ক খুব শক্ত ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে নয়। কিন্তু আপাততঃ যেহেতু উভয়েই সেই কৌশলগত সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল, তাই ইদলিব বা লিবিয়ার মত স্থানে দুই দেশ সংঘাতের পরিস্থিতিতে গেলেও দ্রুত পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে চাইবে।

No comments:

Post a Comment