Tuesday 21 January 2020

লিবিয়াতে কি চাইছে ইতালি?

২২শে জানুয়ারি ২০২০

  
গত ৭ই জানুয়ারি ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্টি লিবিয়ার জেনারেল হাফতারের সাথে সাক্ষাৎ করেন; যার ফলাফল যায় ইতালির বিপক্ষে। ‘জিএনএ’এর প্রতিপক্ষ জেনারেল খলিফা হাফতারের অধীন পূর্ব লিবিয়ার ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা ‘এলএনএ’কেও একইসাথে আলিঙ্গন করার ফলে ইতালি এখন দুই কূলই হারাতে বসেছে। ইতালির রাজনীতিবিদদের ব্যাপক সমালোচনা করে বলা হচ্ছে যে, তারা প্রকৃতপক্ষে কূটনীতি বোঝেন না।


গত ৭ই জানুয়ারি ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্টি লিবিয়ার যুদ্ধরত দুই পক্ষকে হঠাত করেই একত্রে আলোচনায় বসাবার চেষ্টা করেন; যার ফলাফল যায় ইতালির বিপক্ষে। ইতালি এতকাল ধরে ত্রিপোলির জাতিসংঘ সমর্থিত ‘গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল একর্ড’ বা ‘জিএনএ’কে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ‘জিএনএ’এর প্রতিপক্ষ জেনারেল খলিফা হাফতারের অধীন পূর্ব লিবিয়ার ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা ‘এলএনএ’কেও একইসাথে আলিঙ্গন করার ফলে ইতালি এখন দুই কূলই হারাতে বসেছে। ‘জিএনএ’ প্রেসিডেন্ট ফায়েজ আল-সারাজএর দেখা করার আগেই কন্টি হাফতারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই খবর পাবার পর আল-সারাজ কন্টির সাথে দেখা করতেই রাজি হননি। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর রোম অফিসের ডিরেক্টর আরটুরো ভারভেলি বলছেন যে, ইতালির রাজনীতিবিদেরা পররাষ্ট্রনীতির দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেননা; যার ফলাফল এখন দেখা যাচ্ছে। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে ইতালির রাজনীতিবিদদের ব্যাপক সমালোচনা করে বলা হয় যে, তারা প্রকৃতপক্ষে কূটনীতি বোঝেন না। ২০১৮ সালে সরকার গঠন করার সময় কন্টি এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইজি ডি মাইও উভয়েরই কূটনীতি বিষয়ে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। আর এর ফলে ইতালি লিবিয়াতে তার প্রভাব হারিয়েছে। ইতালির উগ্র ডানপন্থী নেতা মাত্তেও সালভিনি প্রধানমন্ত্রী কন্টির সমালোচনা করে বলেন যে, কন্টির আসলে কোন যোগ্যতাই নেই। তার সরকারের লোকজন অপেশাদার। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, লিবিয়ার উপর এক আলোচনায় বসার পর ইতালি বুঝতে পারে যে সে একঘরে হয়ে গেছে। আলোচনায় ফ্রান্স, মিশর, গ্রীস এবং গ্রীক সাইপ্রাস, সকলেই হাফতারের পক্ষ নেয়ায় ডি মাইও লিবিয়া বিষয়ে যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান।

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১১ সালে ইউরোপ মুয়াম্মার গাদ্দাফির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আগ্রহী হলেও পরবর্তীতে দেশটাকে যুদ্ধরত বিভিন্ন গ্রুপের হাতে সপে দেয়। লিবিয়ার অস্ত্র আফ্রিকার অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে সহিংসতার জন্ম দেয়, যা বিরাট শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি করে। ইউরোপের দেশগুলি লিবিয়াতে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পেছনেই ছুটেছে; একেকজন একেক পক্ষকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু তুরস্ক যুদ্ধে জড়াবার পরপরই পুরো ইউরোপ মনোযোগ দেয়া শুরু করেছে। এখানে যেন নতুন কোন ‘গ্রেট গেম’ শুরু হয়ে গেছে, যা ইউরোপের আশেপাশের অঞ্চলকে অস্থির করছে। তুরস্ক এবং রাশিয়া একত্রে আলোচনায় বসে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেবার পরপরই জার্মানি লিবিয়ায় স্বার্থ আছে এমন সকলকে নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করেছে। ‘জার্মান মার্শাল ফান্ড’এর ব্রাসেলস অফিসের ডিরেক্টর ইয়ান লেসার বলছেন যে, লিবিয়া নিয়ে ইউরোপের চিন্তা করার কারণগুলির মাঝে রয়েছে শরণার্থী, জ্বালানি তেল, নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ। কিন্তু তুরস্ক এবং রাশিয়া লিবিয়াতে অতটা সক্রিয় না হলে লিবিয়া নিয়ে সকলে এতটা ব্যস্ত হয়ে যেত না।

ডাচ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ক্লিগেনডেল ইন্সটিটিউট’এর রিসার্চ ফেলো জালেল হারচাউই বলছেন যে, লিবিয়াতে তুরস্ক এবং রাশিয়া যেভাবে আগ্রাসী কূটনীতি চালাচ্ছে, তাতে ইতালি একেবারেই কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। ইতালিয়ান ইন্টেলিজেন্সএর এক কর্মকর্তা ‘রয়টার্স’কে বলেন যে, ইতালির রাজনীতিবিদেরা তাদের নির্দেশ দিয়েছেন সকল পক্ষের সাথেই যোগাযোগ রাখতে। অর্থাৎ ইতালি সকলকেই একত্রে বন্ধু রাখতে চাইছে। কিন্তু এধরনের চলমান সংঘাতে নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার না করতে পারলে প্রভাব হারানোটাই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন তিনি। শুধু লিবিয়াই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেই ইতালি প্রভাব হারাচ্ছে। বাগদাদে ইরানি জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে হত্যার পর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও বিশ্বব্যাপী ফোন করে জনমত আদায়ের চেষ্টা করলেও ইতালিতে কারুর সাথেই তিনি কথা বলেননি; যদিও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের পর পশ্চিমা দেশগুলির মাঝে ইতালির সৈন্যসংখ্যাই সবচাইতে বেশি।


  
শরণার্থী সমস্যা ইতালির জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি প্রধান হুমকি। ইতালিয়দের চিন্তায় শরণার্থী সমস্যা এতটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে, লিবিয়ায় তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড এর তুলনায় হয়ে গেছে গৌণ। ২০১৭ সালে ইতালির দেয়া প্রায় ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বৈদেশিক সাহায্যের মাঝে ৫৬ শতাংশই গিয়েছে শরণার্থী সমস্যা নিরসনে। 


ইতালির প্রধান ভয় - শরণার্থী

‘আল জাজিরা’র এক লেখায় রোমানা রুবেও এবং রামজি বারুদ বলেন যে, লিবিয়ার ‘জিএনএ’ সরকারের কোস্ট গার্ডের নেতৃত্বে থাকা আব্দ আল-রাহমান বিজা মিলাদএর সাথে ইতালিয়রা কাজ করছে। মিলাদ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যার সম্পর্কে ২০১৭ সালের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিবেদনে বলা হয় যে, তিনি শুধু চোরাকারবারিতেই জড়িত নন, গুলি করে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌকা ডুবিয়ে দেয়ার রেকর্ডও রয়েছে তার। ২০১৭এর ফেব্রুয়ারিতে ত্রিপোলির ‘জিএনএ’ সরকারের সাথে অবৈধ অভিবাসী ঠেকার জন্যে ইতালি একটা চুক্তি করে। চুক্তির অধীনে লিবিয়াতে শরণার্থীদের আটক করার জন্যে লিবিয়ার মাটিতেই ক্যাম্প তৈরির জন্যে অর্থায়ন করে ইতালি। মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’এর ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে এই ক্যাম্পের কার্যকলাপকে ‘অমানবিক’ বলে উল্লেখ করা হয়। এই চুক্তি করার জন্যে মিলাদ ইতালির দক্ষিণে সিসিলির কাতানিয়া শরণার্থী শিবিরে গেলে সেখানে অভিবাসীরা তাকে ‘ইতালিয়ান মাফিয়া’ বলে সম্ভোধন করে। অভিবাসন ঠেকাবার ইতালিয় চেষ্টাগুলি নতুন নয়।

২০০৮ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির সময়ে তৎকালীন সিলভিও বারলুসকোনির ইতালি সরকার অভিবাসী ঠেকাতে লিবিয়াকে ৫ বিলিয়ন ডলার দেয়। চিন্তাটা ছিল এমন যে, ইতালির হয়ে লিবিয়াই অভিবাসীদের ঠেকাবে; আর এর সাথে মানবাধিকার লংঘনের ইস্যুগুলি থেকেও ইতালি নিজেকে দূরে রাখতে পারবে। ২০০৯ সালে গাদ্দাফিকে ইতালিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়; আর ২০১০ সালে বারলুসকোনিও লিবিয়া সফর করেন।

শরণার্থী সমস্যা ইতালির জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি প্রধান হুমকি। আফ্রিকার শরণার্থী সমস্যা থেকে বাঁচতে ইতালি আফ্রিকার দেশগুলিকে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং নারীর ক্ষমতায়নে সহায়তা দিচ্ছে। ‘ওইসিডি’র হিসেবে ২০১৭ সালে ইতালির দেয়া প্রায় ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বৈদেশিক সাহায্যের মাঝে ৫৬ শতাংশই গিয়েছে শরণার্থী সমস্যা নিরসনে।

কূটনৈতিক অনভিজ্ঞতা

গত ১৩ই জানুয়ারি আঙ্কারায় ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্টির সাথে লিবিয়া বিষয়ে এক বৈঠকের পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেন যে, ইতালির সাথে তুরস্ক একত্রে চেষ্টা করছে যাতে লিবিয়ার যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হয়। কন্টি বলেন যে, যুদ্ধবিরতি লিবিয়ায় একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুযোগ তৈরি করবে। এর একদিন আগেই তুরস্ক এবং রাশিয়া একত্রে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে খলিফা হাফতার যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে স্বাক্ষর না করেই মস্কো ত্যাগ করেন। লিবিয়া ইস্যুতে তুরস্ক এবং ইতালি উভয়েই ত্রিপোলি-কেন্দ্রিক ‘জিএনএ’এর পক্ষাবলম্বন করছে। তবে ইতালি লিবিয়ার ইস্যুকে ছেড়ে দিতে নারাজ। ১৬ই জানুয়ারি ইতালির প্রধানমন্ত্রী কন্টি লিবিয়ার প্রতিবেশী দেশ আলজেরিয়াতে ছুটে যান লিবিয়ার বিষয়ে কথা বলার জন্যে।

‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর প্যান ইউরোপিয়ান ফেলো মাত্তিয়া গিয়ামপাওলো এক লেখায় বলছেন যে, ইতালিয়দের চিন্তায় শরণার্থী সমস্যা এতটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে, লিবিয়ায় তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড এর তুলনায় হয়ে গেছে গৌণ। ২০১৮ সালে ওয়াশিংটন সফরের সময়ে কন্টি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে বড় ধরনের কূটনৈতিক সমর্থন পান। ট্রাম্প ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সমস্যাগুলি সমাধানে ইতালিকে প্রধান বন্ধু হিসেবে সম্ভোধন করেন। কিন্তু সেই সময় থেকে লিবিয়াকে নিয়ন্ত্রণে ইতালির পকেটে শুধু ব্যর্থতাই জমা হয়েছে।

ইতালি লিবিয়াতে কেন?

লিবিয়াতে ইতালির স্বার্থ বহুকাল থেকে। উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া উপকূলে কার্থেজ সাম্রাজ্যের সাথে রোমের বৈরিতা ছিল। পরবর্তীতে সপ্তম শতাব্দীতে উত্তর আফ্রিকার পুরো উপকূল মুসলিমদের অধীন হয়ে গেলে ইতালির সাথে আফ্রিকার বৈরিতা আরও বৃদ্ধি পায়। বর্তমান রাষ্ট্র ইতালির একত্রীকরণ সম্পন্ন হয় ১৮৭১ সালে। নতুন এই দেশ ইউরোপের বাকি দেশগুলির দেখাদেখি নিজেরাও উপনিবেশ খুঁজতে শুরু করে। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ আর ফরাসীদের সাথে সমঝোতা করেই তাদের চলতে হয়েছে। ১৮৮৯ সালে ইতালি পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া এবং এরিত্রিয়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ১৯১১ সালে লিবিয়া ছিল উসমানি খিলাফতের অধীনে। ইতালিয়রা ইস্তাম্বুলের খলিফার কাছে চরমপত্র দিয়ে লিবিয়া আক্রমণ করে। লিবিয়ার পূর্বে মিশরের দখলে ছিল ব্রিটিশরা; আর পশ্চিমে আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল ফরাসীরা। তাদের সমর্থনেই ইতালি লিবিয়া আক্রমণ করে। ইতালিয়রা লিবিয়ার উপকূলের এলাকাগুলি সহজে দখলে নিতে পারলেও দেশের ভেতরের এলাকাগুলির নিয়ন্ত্রণ নিতে তাদের কয়েক দশক সময় লেগেছিল। এসময়ের মাঝে ইতালিয়রা নৃশংসভাবে লিবিয়ার জনগণের বিদ্রোহ দমন করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালিয়দের হাত থেকে ব্রিটিশ আর ফরাসীরা লিবিয়া দখল করে নেয়। ১৯৫১ সালে বর্তমান লিবিয়ার জন্ম হয়। ১৯৫৯ সালে তেলখনি আবিষ্কারের পর থেকে লিবিয়ার নতুন ইতিহাস লেখা শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেন। ২০১১ সালে পশ্চিমা হস্তক্ষেপে গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর লিবিয়া অশান্ত রয়েছে।

২০১১ সালে গাদ্দাফিকে সরিয়ে দেবার পশ্চিমা চেষ্টায় ইতালিও সরাসরি অংশ নেয়। লিবিয়াতে নিজেদের স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে ইতালির এখন আর গাদ্দাফিকে দরকার নেই। গাদ্দাফি পরবর্তী গৃহযুদ্ধ কবলিত লিবিয়াতে ইতালি এবং বাকি ইউরোপ তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থকে ছেড়ে দেয়নি। ২০১৮ সালে ইতালির সর্ববৃহৎ তেল কোম্পানি ‘ইএনআই’ লিবিয়ার তেলখনিতে বিনিয়োগ করে; এবং তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষায় সেখানকার মিলিশিয়া গ্রুপগুলির সাথে নিরাপত্তা চুক্তি করে। লিবিয়ার তেল সবচাইতে বেশি রপ্তানি হয় ইতালিতে।

ইতালির অর্থনৈতিক দৈন্যদশা

ইতালির অর্থনীতি থেমে আছে। ২০০৭ সালে ইতালির জিডিপি যা ছিল, এখনও তার কাছাকাছিই আছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, ইতালির রাষ্ট্রীয় ঋণ এখন ২ হাজার ২’শ ৪০ বিলিয়ন ডলার; যা পুরো ইতালির জিডিপির চাইতে ৩০ শতাংশ বেশি। খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকিং সেক্টর; ঋণ দেয়া প্রায় বন্ধ। ইতালির প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সংগঠন ‘কনফিন্ডাসট্রিয়া’র বোর্ড সদস্য পাওলো স্কুডেরি বলছেন যে, ইইউএর নীতির সাথে ইতালির ডানপন্থী সরকারের বিরোধ শুরু হবার পর থেকে ইতালিতে কেউ বিনিয়োগ করতে দুইবার চিন্তা করছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইতালির অর্থনৈতিক দৈন্যদশাই ক্ষমতায় এনেছে ডানপন্থীদের। ইতালির উত্তরাঞ্চলের শিল্পাঞ্চলগুলির চাইতে দক্ষিণাঞ্চলে কম আয়ের এলাকাগুলিতে বেকারত্বের হার সবচাইতে বেশি; যেখানে ডানপন্থীরা শরণার্থী ঠেকানো এবং কর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট পাচ্ছে। দক্ষিণের মানুষ চাকুরি হারিয়ে উত্তরের শিল্পাঞ্চলগুলিতে পাড়ি জমাচ্ছে। যথেষ্ট আয়ের অভাবে অনেক মধ্যবয়সীদের পরিবার নেই। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলছে যে, ২০১৪ সালের পর থেকে ইতালির যুবকদের মাঝে বেকারত্বের হার কমছে। ৪০ শতাংশের অধিক বেকার থেকে তা এখন ৩৩ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। অর্থাৎ প্রতি তিনজন যুবকের মাঝে একজন বেকার। গ্রীসের পর ইইউএর মাঝে এটা সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার। এমতাবস্থায় দক্ষিণে লিবিয়া থেকে শরণার্থীর জোয়ার ইতালির জন্যে বিরাট দুঃসংবাদই বটে।

ইতালির দিকে হাত বাড়িয়েছে তুরস্কের কৌশলগত বন্ধু কাতার। লিবিয়াতে তুরস্কের পাশে কাতারেরও সমর্থন রয়েছে; আবার কাতারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে তুরস্কের সেনারা। ইতালি তার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে কাতারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে। ২০শে জানুয়ারি কাতার সফরে গিয়েছেন ইতালির প্রেসিডেন্ট সার্জিও মাত্তারেলা। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। এর আগে ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে ইতালি সফর করেন শেখ তামিম। আর ২০১৮ সালের এপ্রিলে কাতার সফর করেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী কন্টি। কাতারের নৌবাহিনীর জন্যে ৫ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের ৭টা যুদ্ধজাহাজ তৈরির ক্রয়াদেশ পেয়েছে ইতালি। কাতারে কাজ করছে প্রায় আড়াই’শ ইতালিয় কোম্পানি। অন্যদিকে ইতালির এড্রিয়াটিক সাগরের তীরে তৈরি করা টার্মিনালে কাতার থেকে আমদানি করা এলএনজি অবতরণ করছে। ইতালির ১০ শতাংশ গ্যাসের চাহিদা কাতার পূরণ করছে। ইতালিতে কাতারের বড় বিনিয়োগ রয়েছে আবাসন, হোটেল এবং এভিয়েশন খাতে; যেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। মোটকথা লিবিয়ার সংঘাতে ইতালি, কাতার এবং তুরস্কের এক পক্ষে থাকার একাধিক কারণ রয়েছে।

শান্তি প্রচেষ্টার ভবিষ্যৎ কি?

১৯শে জানুয়ারি বার্লিনে লিবিয়ায় শান্তির বিষয়ে একটা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শুধু শক্তিশালী দেশগুলিই কথা বলেছে; ‘জিএনএ’ এবং ‘এলএনএ’ চুপ থেকেছে। আলোচনার ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর জেষ্ঠ্য বিশ্লেষক ক্লাউডিয়া গাজিনি বলছেন যে, বার্লিন কনফারেন্স দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইউরোপিয়রা আঞ্চলিক শক্তিগুলির সাথে কথা বলে উত্তেজনা প্রশমণে ইচ্ছুক। কিন্তু এই ইচ্ছা কি উত্তেজনা প্রশমণে যথেষ্ট কিনা, তা অনিশ্চিত। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিন অন ফরেন রিলেনশন্স’এর পলিসি ফেলো তারেক মাগেরিসি ‘আল জাজিরার’কে বলেন যে, এই আলোচনায় বোঝা যাবে যে, হাফতারকে যারা সমর্থন দিচ্ছেন, তারা হাফতারের উপর চাপ সৃষ্টি করার ব্যাপারে কতটা সততা রাখেন।

হাফতার মস্কো থেকে ফেরত এসেছেন যুদ্ধবিরতির চুক্তি না করেই। হাফতার এই আলোচনায় অংশ নেবার আগেই লিবিয়ার তেলখনির উৎপাদন প্রায় বন্ধ করে এসেছেন। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, হাফতারের লোকেরা লিবিয়ার ব্রেগা, রাস লানুফ, হারিগা, জুয়াইতিনা এবং সিদ্রা বন্দরে তেল রপ্তানি করে দিয়েছে। লিবিয়ার তেল উৎপাদন এখন দৈনিক ১২ লাখ ব্যারেল থেকে নেমে মাত্র ৭২ হাজার ব্যারেলে এসে ঠেকেছে। এতে হাফতার তার শক্তিশালী অবস্থানকেই জানান দিয়েছেন। এই তেল বিক্রির অর্থ যাচ্ছে লিবিয়ার ‘ন্যাশনাল অয়েল কর্পোরেশন’ বা ‘এনওসি’এর কাছে, যা কিনা ত্রিপোলির অধীনে। অথচ তেলখনিগুলির নিয়ন্ত্রণ এখন হাফতারের কাছে! তেল বিক্রি বন্ধ করে হাফতার একইসাথে ত্রিপোলির ‘জিএনএ’ সরকারের উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং লিবিয়ার তেলের উপর নির্ভরশীল দেশগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করছে, যাতে তারা ‘জিএনএ’কে সমর্থন দেয়া বন্ধ করে দেয়। চাপে পরা দেশগুলির শুরুতেই নাম আসবে ইতালির।

২০১৫ সাল থেকে ইউরোপিয়রা ‘অপারেশন সোফিয়া’ নামের একটা মিশনে লিবিয়ার উপকূল পাহাড়া দিতো। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভূমধ্যসাগরে শরণার্থীদের পানিতে ডোবা থেকে বাঁচানো। কিন্তু ২০১৯ সালের মার্চে ইতালির প্রতিবাদে এই মিশন বন্ধ হয়ে যায়। ইতালি শরণার্থীদের দায়িত্ব নিতে নারাজ ছিল; তাদের কথা ছিল যে, শরণার্থীরা জাহাজ থেকে যেই দেশেই অবতরণ করুক না কেন, সেটা ইতালি হবে না। বার্লিন কনফারেন্সের পর ‘অপারেশন সোফিয়া’ আবারও শুরু করার কথা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, এই মিশন লিবিয়ার উপকূলে অস্ত্রের চালানও আটকাবে। তবে এবারেও ইতালির অবস্থান হবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মিশনের মূল লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট আসবে ইতালি থেকেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই অপারেশন চালিত হবে শুধুই সমুদ্রে; লিবিয়ার স্থলসীমানাগুলিতে নয়। অর্থাৎ স্থলসীমানা দিয়ে লিবিয়াতে অস্ত্র ঢোকার পথ খোলাই থাকছে। লিবিয়ার বেশিরভাগ স্থলসীমানা এখন হাফতারের নিয়ন্ত্রণে। 

২০শে জানুয়ারি কাতার সফরে গিয়েছেন ইতালির প্রেসিডেন্ট সার্জিও মাত্তারেলা। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। ইতালির দিকে হাত বাড়িয়েছে তুরস্কের কৌশলগত বন্ধু কাতার। লিবিয়াতে তুরস্কের পাশে কাতারেরও সমর্থন রয়েছে; আবার কাতারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে তুরস্কের সেনারা। ইতালি তার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে কাতারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে। মোটকথা লিবিয়ার সংঘাতে ইতালি, কাতার এবং তুরস্কের এক পক্ষে থাকার একাধিক কারণ রয়েছে।


ইতালি আর কি করতে পারে?

পৃথিবীর ৮ম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়েও ইতালি তার অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে রাজনৈতিক প্রভাবে রূপ দিতে পারেনি। ৮ম বৃহত্তম দাতা দেশ হয়েও ইতালি আফ্রিকার রাজনীতিতে ফ্রান্স বা ব্রিটেনের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবচাইতে শক্তিশালী ১০টা নৌবহরের একটা থাকার পরেও ভূমধ্যসাগরই ইতালির নিয়ন্ত্রণে নেই; অন্যান্য সাগর নিয়ে কথা বলা অমূলক। সেরা ১০টা অস্ত্র রপ্তানিকারক রাষ্ট্রের মাঝে থেকেও ইতালির ভূরাজনৈতিক প্রভাব নগন্য। ১৮৭১ সালে একত্রীকরণের পর থেকে ইতালি কখনোই ইউরোপের অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে পেরে ওঠেনি; ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও রাশিয়ার কাছে ইতালি ‘লিটল ব্রাদার’ থেকেছে সর্বদাই। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ফ্রান্সের পিছনেই থাকতে হয়েছে ইতালিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন এবং ফ্রান্স আফ্রিকাতে তাদের প্রাক্তন উপনিবেশগুলিতে প্রভাব ধরে রাখতে সচেষ্ট হলেও বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পক্ষাবলম্বন করায় ইতালি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। লিবিয়াও সেভাবেই ইতালির হাতছাড়া হয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।

লিবিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি বেশ জটিল। তবে বার্লিন কনফারেন্স আবারও দেখিয়ে দিল যে, এই সংঘাতে শক্তিশালী দেশগুলির লক্ষ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দ্বারা প্রশিক্ষিত জেনারেল হাফতার মস্কো থেকে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর না করে চলে আসায় সকলেই হাফতারের লক্ষ্য নিয়ে কথা বলছেন। তুরস্ক এবং রাশিয়ার লিবিয়াতে জড়ানো নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও তারা যে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে না, তা এখন নিশ্চিত। ইতালি বুঝতে পারছে যে, হাফতারকে সমর্থন দেয়া ফ্রান্সের সাথে সমঝোতা করে ইইউএর ছাতার নিচে কাজ করা কঠিন হবে।

লিবিয়া ইতালির ভৌগোলিক বাস্তবতা। ভূমধ্যসাগরে শরণার্থীবাহী নৌকাগুলিকে তারা ইতালির ভূখন্ডের চারিদিকে অবরোধের মতো দেখছে। আর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে উতপন্ন হওয়া শরণার্থী সমস্যা ইতালির নিয়ন্ত্রণে নয়। আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীরা ইতালির জন্যে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু। তাই নিজের নিরাপত্তার জন্যেই লিবিয়ার সরকারকে নিজের পক্ষে রাখতে চাইবে ইতালি। কিন্তু হাফতারের হাতে ত্রিপোলির পতন হলে হাফতার কি ইতালিকে বন্ধু হিসেবে নেবে? বিশেষ করে এতোদিন ধরে ‘জিএনএ’কে সমর্থন দেবার পর হাফতার ইতালিকে কতটা বিশ্বাস করতে পারবেন? একইসাথে লিবিয়ার তেলের সরবরাহ ইতালির জন্যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আর তেলখনিগুলি হাফতারের নিয়ন্ত্রণে থাকলে ইতালিই সবচাইতে বেশি বিচলিত হবে। এই মুহুর্তে ‘জিএনএ’ সরকারকে সমর্থন করে যাওয়া ছাড়া ইতালির হাতে কোন অপশন নেই। ১৯১১ সালে ইস্তাম্বুলের হাত থেকে লিবিয়া ছিনিয়ে নিলেও শতবর্ষ পরে ‘জিএনএ’এর সমর্থক হিসেবে ইতালি শুধুমাত্র তুরস্ককেই তার পাশে দেখতে পাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment