Saturday 25 January 2020

লোহিত সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় নতুন মোড়

২৫শে জানুয়ারি ২০২০

  
সোমালিয়ার জলদস্যুতা যেমন প্রায় নিশ্চিহ্ন হবার পথে, তেমনি ইয়েমেনের যুদ্ধও ২০২০ সালেই শেষ হবার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এমতাবস্থায় লোহিত সাগর এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাব-এল-মান্ডেব প্রণালীতে সামরিক উপস্থিতি ধরে রাখতে আঞ্চলিক শক্তিগুলি নতুন করে হিসেব কষছে। বিশেষ করে তুরস্কের সাথে সৌদি গ্রুপের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। যার অংশ হিসেবে ‘রেড সী কাউন্সিল’ গঠন করেছে সৌদিরা।


গত ২২শে জানুয়ারি মিশরের সামরিক বাহিনী ঘোষণা দেয় যে, সৌদি আরবের সাথে লোহিত সাগরে মিশর একটা সামরিক মহড়া শুরু করেছে। ‘মরগান ১৬’ নামের এই মহড়ায় উপকূলীয় একটা টার্গেটে হামলার ট্রেনিংসহ কর্মদক্ষতার উন্নয়নের পিছনে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে লোহিত সাগরে মিশর এবং সৌদি আরবের কৌশলগত কর্মকান্ড বেশ গতি পাচ্ছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে জেদ্দার কাছাকাছি লোহিত সাগরে অনুষ্ঠিত হয় ‘রেড ওয়েভ ২’ নামের যৌথ মহড়া। এতে অংশ নিয়েছিল সৌদি আরব, মিশর, জর্দান, সুদান, জিবুতি, ইয়েমেন এবং সোমালিয়া। ভারত মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সমুদ্রপথে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা দিনে দিনে গভীর হচ্ছে।

গত ১৫ই জানুয়ারি লোহিত সাগরের উপকূলে বারনিস নামক স্থানে মিশর একটা সামরিক ঘাঁটি উদ্ভোধন করে, যা তারা লোহিত সাগরের সবচাইতে বড় সামরিক ঘাঁটি বলে ঘোষণা দিয়েছে। মিশর বলছে যে, এই ঘাঁটি লোহিত সাগর এবং সুয়েজ খালের মাঝে জাহাজের প্রবাহের নিরাপত্তা দেবে। সরকারি বরাত দিয়ে ‘ইজিপ্ট ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ বলছে যে, ১৫ হাজার একর এলাকার এই ঘাঁটিতে বিমান ওঠানামার জন্যে ৩ হাজার মিটার লম্বা রানওয়ে রয়েছে এবং জাহাজের জন্যে ১ হাজার মিটার লম্বা এবং ১৪ মিটার গভীরতার জেটি রয়েছে। এই ঘাঁটিতে বিমানবাহী যুদ্ধহাজাহাজ ডকিং করা যাবে। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেন্স’ বলছে যে, এই ঘাটিতে বিমান রাখার জন্যে ১৮টা শক্তিশালী কংক্রিট হ্যাঙ্গার তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ৩৬টা বিমানকে একত্রে রাখা যাবে। এছাড়াও এখানে একটা বেসামরিক বিমানবন্দর এবং বেসামরিক সমুদ্রবন্দরও তৈরি করা হয়েছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি এই ঘাঁটির উদ্ভোধন করেন এবং উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ‘গালফ নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় মিশর এবং আমিরাত একে অপরকে কাছে টেনেছে। এই অনুষ্ঠানে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালেদ বিন সালমানও উপস্থিত ছিলেন।

তবে লোহিত সাগরের কৌশলগত দিক থেকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে ৬ই জানুয়ারি রিয়াদে। লোহিত সাগর এবং তৎসংলগ্ন আদেন উপসাগরের সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটা কাউন্সিল গঠন করা হয়। এর অংশ হিসেবে সৌদি বাদশাহ সালমান মিশর, জর্দান, এরিত্রিয়া, ইয়েমেন, সুদান, জিবুতি এবং সোমালিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। চুক্তির অংশ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, এর মাধ্যমে জলদস্যুতা, চোরাচালান এবং অন্যান্য হুমকি মোকাবিলায় লোহিত সাগরের দেশগুলির মাঝে সহযোগিতা বাড়বে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ‘কাউন্সিল অব এরাব এন্ড আফ্রিকান কোস্টাল স্টেটস অব দ্যা রেড সি এন্ড দ্যা গালফ অব আদেন’ নামে একটা চার্টারে স্বাক্ষর করেন। তবে সোমালিয়ার ‘রেডিও দালসান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সোমালিয়া থেকে আলাদা হয়ে চলা স্বঘোষিত রাষ্ট্র সোমালিল্যান্ড অঞ্চল চাইছে যে, এই কাউন্সিলে তাদের নামও থাকা উচিৎ ছিল। সোমালিল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল আহমেদ ওমার এলমি এক বার্তায় বলছেন যে, সোমালিল্যান্ড অত্র এলাকার নিরাপত্তার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল রয়েছে। তবে লোহিত সাগরের কোন ব্যাপারে সোমালিল্যান্ডকে বাদ দেয়াটা তারা মেনে নেবেন না। ফরাসী মিডিয়া ‘আরএফআই’এর সাথে এক স্বাক্ষাতে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর গবেষক ক্যামিল লন্স বলছেন যে, সোমালিল্যান্ডের বারবেরাতে আমিরাত সমুদ্রবন্দর তৈরি করা শুরু করার পর থেকেই সোমালিয়ার সাথে আমিরাতের সম্পর্ক শীতল যাচ্ছে। সৌদি আরবও সোমালিল্যান্ডের সাথে সম্পর্ক রাখে। তবে সোমালিল্যান্ডকে এই কাউন্সিলে রাখলে সোমালিয়াকে রাখা যেত না, এবং এতে কূটনৈতিক সমস্যা হতো। আবার যেহেতু মিশরের সাথে নীল নদে বাঁধ দেয়া নিয়ে ইথিওপিয়ার একটা বিরোধ চলমান, তাই ইথিওপিয়াকে নিলে মিশরকে রাখা যেতো না। সৌদিরা লোহিত সাগরে তুরস্ক, কাতার এবং ইরানের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। সেজন্যে তারা সকলের মাঝে কিছুটা ব্যালান্স করেই চলতে চাইছে।


   
ভারত মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সমুদ্রপথে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা দিনে দিনে গভীর হচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ঘোষণা দেন যে, সোমালিয়া তুরস্ককে সোমালিয়ার উপকূলে তেল অনুসন্ধানের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। মিশর এবং সৌদিদের কাছে এটা হুমকিস্বরূপই ঠেকবে। কারণ তুরস্কের পক্ষে নিজস্ব নৌবাহিনীর নিরাপত্তা ছাড়া সোমালিয়ার উপকূলে তেল অনুসন্ধান সম্ভব হবে না। অর্থাৎ এতে ভারত মহাসাগরে তুরস্কের নৌশক্তির আনাগোনা নিশ্চিত।


আবুধাবির ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’এর প্রাক্তন প্রফেসর আলবদর আলশাতারি আমিরাতের ‘দ্যা ন্যাশনাল’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, লোহিত সাগর দিয়ে যেহেতু পৃথিবীর প্রায় ১০ শতাংশ তেল রপ্তানি হয়, তাই এই অঞ্চল শুধুমাত্র লোহিত সাগরের তীরবর্তী দেশগুলি ছাড়াও বাকিদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। ইয়েমেনের যুদ্ধে লজিস্টিক্যাল সুবিধার জন্যে এরিত্রিয়ার আসাবএর কাছে একটা বড় সামরিক ঘাঁটি করেছে আমিরাত। অন্যদিকে সোমালিয়াতে সোমালিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীকে ট্রেনিং দিতে সেখানে একটা ঘাঁটি করেছে তুরস্ক। আবার সুদানের লোহিত সাগর উপকূলে সুয়াকিন দ্বীপে তুরস্ক নৌঘাঁটি করতে চাইছে বলে অভিযোগ মিশরের। কাতারে ইতোমধ্যেই সামরিক ঘাঁটি করেছে তুরস্ক। এখন লিবিয়ার যুদ্ধেও জড়িয়েছে তুরস্ক। জিবুতিতে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ অনেকগুলি দেশ সামরিক ঘাঁটি করেছে। ইয়েমেনে আল কায়েদার সদস্যদের টার্গেট করতে জিবুতিতে ঘাঁটি করে যুক্তরাষ্ট্র। আর সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যু নিধনের ছুতোয় জিবুতিতে ঘাঁটি করে বাকি দেশগুলি। এরপর ইয়েমেনের যুদ্ধের ছুতোয় সৌদি গ্রুপের দেশগুলি এই এলাকায় ঘাঁটি করে।

ইয়েমেনের যুদ্ধের সময় বেশ কয়েকবার সৌদি এবং আমিরাতের জাহাজ ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে সোমালিয়ার জলদস্যুতা যেমন প্রায় নিশ্চিহ্ন হবার পথে, তেমনি ইয়েমেনের যুদ্ধও ২০২০ সালেই শেষ হবার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এমতাবস্থায় লোহিত সাগর এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাব-এল-মান্ডেব প্রণালীতে সামরিক উপস্থিতি ধরে রাখতে আঞ্চলিক শক্তিগুলি নতুন করে হিসেব কষছে। বিশেষ করে তুরস্কের সাথে সৌদি গ্রুপের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। যার অংশ হিসেবে ‘রেড সী কাউন্সিল’ গঠন করেছে সৌদিরা। ২০শে জানুয়ারি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান ঘোষণা দেন যে, সোমালিয়া তুরস্ককে সোমালিয়ার উপকূলে তেল অনুসন্ধানের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এবং এরদোগান বলেন যে, তুরস্ক এখন সেইদিকেই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এরদোগানের কথাগুলি মিশর এবং সৌদিদের কাছে হুমকিস্বরূপই ঠেকবে। কারণ তুরস্কের পক্ষে নিজস্ব নৌবাহিনীর নিরাপত্তা ছাড়া সোমালিয়ার উপকূলে তেল অনুসন্ধান সম্ভব হবে না। অর্থাৎ এতে ভারত মহাসাগরে তুরস্কের নৌশক্তির আনাগোনা নিশ্চিত।

No comments:

Post a Comment