Sunday 5 January 2020

নতুন বছর কি যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ দিয়ে শুরু হচ্ছে?

৪ঠা জানুয়ারি ২০২০

সুলাইমানির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের ব্যাপক অভিযোগ থাকলেও মার্কিন পদক্ষেপ এসেছে বহু দেরিতে। যুক্তরাষ্ট্রে সুলাইমানির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচকেরা সকলেই সুলাইমানিকে শত্রু আখ্যা দিয়েছে। এরপরও ট্রাম্পের বা তার আগের সরকারগুলি এতকাল সুলাইমানির অপরাধগুলিকে মেনে নিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করেনি।


নতুন বছরের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্য কেঁপে উঠলো এক সংবাদে। ইরানি রেভোলিউশনারি গার্ড কোর বা ‘আইআরজিসি’র বিশেষ বাহিনী ‘কুদস ফোর্স’এর কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সুলাইমানি বাগদাদে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হন। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ‘আইআরজিসি’র বিদেশে অপারেশনগুলি দেখাশোনা করে ‘কুদস ফোর্স’। যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, সুলাইমানিকে তারা টার্গেট করেছে কারণ সুলাইমানির নির্দেশেই ২৭শে ডিসেম্বর ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে এক হামলায় এক মার্কিন নাগরিক নিহত হয়। পহেলা জানুয়ারির এক টুইট বার্তায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা এবং কিরকুকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার জন্যে ইরানকে সরাসরি দায়ি করেন। এবং একইসাথে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে হামলা এবং মার্কিন নাগরিক হত্যার জন্যে ইরানকে বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে; আর এটা কোন সতর্কবার্তা নয়, বরং এটা একটা হুমকি! ৩১শে ডিসেম্বর মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার জের হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের ‘কাতাইব হিযবুল্লাহ’ নামের ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ার উপর হামলা করে; যার ফলশ্রুতিতে ২৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। আর নিহত ব্যক্তিদের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের শেষে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা করে বিক্ষুব্ধ জনতা।

‘সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’র ফেলো এবং প্রাক্তন মার্কিন উপ-সহকারি প্রতিরক্ষা সচিব এন্ড্রু এক্সাম বলছেন যে, কাসেম সুলাইমানি এমন এক ব্যক্তি, যিনি ছিলেন ইরানের আঞ্চলিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নের মূল ব্যক্তি। সুলাইমানি ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়াসহ আরবি ভাষাভাষি এলাকাগুলিতে ইরানের প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সিরিয়া এবং ইরাকের গৃহযুদ্ধের সময় সুলাইমানি একবার ছুটে যেতেন সিরিয়াতে; আবার ছুটে যেতেন ইরাকে – যখন তাকে যেখানে বেশি দরকার হতো, তিনি সেখানেই হাজির হতেন। এক্সামের ধারণা, ইরানে আর এমন দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি নেই যার মাধ্যমে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সুলাইমানিকে সরিয়ে দেবার সাথেসাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের প্রতিযোগিতাটা প্রক্সি যুদ্ধের গন্ডি পেরিয়ে সরাসরি যুদ্ধে রূপ নিলো। তিনি বলছেন যে, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।

প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল দূত ব্রেট ম্যাকগার্ক মার্কিন টিভি চ্যানেল ‘এমএসএনবিসি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, মার্কিন জনগণ পছন্দ করুক আর না করুক, এখন বুঝে নিতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এখন ইরানের যুদ্ধাবস্থা চলছে। তিনি আরও বলেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব এশিয়াতে তার শক্তিকে একত্রিত করার কাজ করলেও সুলাইমানির হত্যাকান্ডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আবারও মধ্যপ্রাচ্যে ফেরত আসতে বাধ্য হবে। যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল; কারণ সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ‘ব্ল্যাক হোল’এর মতো তার সম্পদ হারাচ্ছিল। এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন শক্তি উঠিয়ে নেয়াটা খুব কঠিন হয়ে যাবে। একইসাথে ইরাকীরাই এখন যুক্তরাষ্ট্রকে দেশ ছাড়তে বলবে, যেটার কারণে ইরাকে একটা শূণ্যস্থান তৈরি হতে পারে।

ইরান কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যুত্তর দেবে, সেই প্রশ্নের উত্তরে ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রেসিডেন্ট ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, ইরান অবশ্যই এখন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব, অথবা পররাষ্ট্র সচিব বা ভাইস প্রেসিডেন্টের উপর হামলা করবে না; কারণ সেটা করলে ইরানের বর্তমান নেতৃত্ব ক্ষমতা হারাতে বসবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে ইরান প্রথমেই ইরাকের ভেতরে মার্কিন টার্গেটগুলিকেই বেছে নেবে। কিন্তু সুলাইমানি এতদিন ধরে ইরাকসহ বাকি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের যে প্রক্সিগুলিকে তৈরি করেছিলেন, সুলাইমানির মৃত্যুর সাথে সাথে তারাও নেতৃত্বহীন হয়ে হারিয়ে যাবে। তদুপরি এই সংঘাত আরও গভীর হবার সম্ভাবনা অবশ্যই বৃদ্ধি পেলো। ব্রেমার বলছেন যে, ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার জন্যে যথেষ্ট কারণ ইতোমধ্যেই পেয়েছিলেন, যেগুলিকে তিনি কাজে লাগাননি। যেমন, ইরান মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করেছে, পারস্য উপসাগরে তেলের ট্যাঙ্কারে হামলা এবং সৌদি তেলের খনিতে হামলার জন্যেও যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে দায়ি করেছিল। কিন্তু ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি এবং দূতাবাসে হামলা হয়তো ট্রাম্পকে নীতি পরিবর্তন করতে প্রণোদনা যুগিয়েছে।

‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সুলাইমানির হত্যাকান্ডে সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়লেও বড় কোন যুদ্ধ হবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই; কারণ বড় যুদ্ধে ইরানের তেলের স্থাপনাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যাবে, যা অবরোধের শিকার ইরানের অর্থনীতির জন্যে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। তাই ইরান খুব সম্ভবতঃ কুদস ফোর্সের তৈরি করা প্রক্সিগুলি ব্যবহার করেই প্রত্যুত্তর দেবে। ২০০৩ সাল থেকে সুলাইমানি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইস্রাইলের টার্গেট লিস্টে থাকলেও এবারই প্রথম তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, কারণ ট্রাম্পের হয়তো মনে হয়েছে যে, ঝুঁকির চাইতে এর পুরষ্কার বেশি। অর্থনৈতিক অবরোধ এবং জনগণের আন্দোলনে ইরান হয়তো এতটাই দুর্বল হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ইরান এখন কৌশলগত হুমকি নয়। ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসি’র ডিরেক্টর কামরান বোখারি ‘সিবিসি’র সাথে সাক্ষাতে বলেন যে, ওসামা বিন-লাদেন বা বাগদাদির হত্যাকান্ড থেকে সুলাইমানির হত্যাকান্ড আলাদা; কারণ সুলাইমানি একটা রাষ্ট্রের কর্মকর্তা। আর সুলাইমানি যে পদ্ধতিতে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন বা ইয়েমেনে যুদ্ধ করছিলেন, ইরান সেগুলিতেই পারদর্শী; সম্মুখ সমরে নয়। আর একজন ব্যক্তির জন্যে ইরান অতবড় ঝুঁকি নেবে না। আইসিসের পতনের পর সুলাইমানির মাধ্যমে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল। অন্যদিকে ঘটনার সুবিধা নিলেও নিজেদের স্বার্থকে ছাপিয়ে রাশিয়া এবং চীন ইরানকে সমর্থন দেবে না। আর ইরানও এমন কিছু করবে না, যাতে রাশিয়া, চীন এবং ইউরোপের সমর্থন মিলিয়ে যায়।

সুলাইমানির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের ব্যাপক অভিযোগ থাকলেও মার্কিন পদক্ষেপ এসেছে বহু দেরিতে। যুক্তরাষ্ট্রে সুলাইমানির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচকেরা সকলেই সুলাইমানিকে শত্রু আখ্যা দিয়েছে। আর ট্রাম্প বলেছেন যে, নিরপরাধ মানুষ হত্যা করা ছিল সুলাইমানির বিকৃত আসক্তি! অথচ এরপরও ট্রাম্পের বা তার আগের সরকারগুলি এতকাল সুলাইমানির অপরাধগুলিকে মেনে নিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করেনি। এই হত্যার ঘটনায় তেলের বাজার ইতোমধ্যেই গরম হয়েছে, যা কিনা তেল রপ্তানিকারক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করবে। আর একইসাথে নির্বাচনের আগেভাগে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে কাজ করবে।

2 comments:

  1. এই হত্যার ঘটনায় তেলের বাজার ইতোমধ্যেই গরম হয়েছে, যা কিনা তেল রপ্তানিকারক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করবে। আর একইসাথে নির্বাচনের আগেভাগে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে কাজ করবে।///////

    core point hisebe ki etakey dhorbo?
    naki batashe r je sokol kotha vashtese segulo keo count korbo?

    ReplyDelete
    Replies
    1. কোর পয়েন্ট হলো যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব হারাচ্ছে সারা দুনিয়াতে। তার দুর্বল অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করতেই ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে তেল রপ্তানিকারী দেশ হিসেবে প্রস্তুত করছে। বন্ধুদের সহায়তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কোন অঞ্চলকেই ধরে রাখতে পারছে না। কারুরই দায়িত্ব নিতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র; সকলকেই প্রতিযোগী হিসেবে দেখছে তারা। এটা একটা জাতীয়তাবাদী চিন্তা; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শিক অবস্থানের স্খলন।

      Delete