Sunday 19 January 2020

চীন-মিয়ানমার ইকনমিক করিডোর – কতটুকু বাস্তব?

১৯শে জানুয়ারি ২০২০

 
চীন মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী কার্যকলাপকে বৈধতা দানে যতটুকু এগুলো, বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মানুষের আস্থা অর্জনে ততটাই পেছালো; যা কিনা রাখাইনে চীনের কৌশলগত কিউক পিউ বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সাথে সাংঘর্ষিক। অর্থনৈতিক দিক থেকে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ উভয়েই চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হলেও অত্র অঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক প্রভাব গুটিকয়েক ব্যক্তির মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে।

   

১৮ই জানুয়ারি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর প্রথম মিয়ানমার সফরের সময় মোট ৩৩টা সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হলো; আর এটা হলো এমন সময়ে, যখন অং সান সু কির সরকার রাখাইন প্রদেশের মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালানোর জন্যে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রয়েছে। এরকম পরিস্থিতির মাঝেই স্বাক্ষরিত এই সমঝোতাগুলির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ‘চায়না-মিয়ানমার ইকনমিক করিডোর’ বা ‘সিএমইসি’; যার মাঝে রয়েছে রাখাইনের কিউক পিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং সেই বন্দরের সাথে চীনের পশ্চিমাঞ্চলের কুনমিংএর রেল যোগাযোগ স্থাপন। এছাড়াও চীনের সীমানার কাছাকাছি একটা স্পেশাল ইকনমিক জোন এবং বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াংগনে একটা শিল্পাঞ্চল করার ঘোষণাও এসেছে। তবে ‘সিএমইসি’র বাস্তবতাগুলি আলোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কিউক পিউ থেকে ইতোমধ্যেই গ্যাস এবং তেলের পাইপলাইন চীন পর্যন্ত গিয়েছে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মালাক্কা প্রণালী বাইপাস করে চীনের জ্বালানি চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ করছে। এই পাইপলাইন যেভাবে চীনের স্বার্থ পূরণ করছে, তেমনি মিয়ানমারে অনেকেই মনে করছেন যে, কিউক পিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে সেটার সুবিধাও চীনই ভোগ করবে; মিয়ানমার নয়।

মিয়ানমারকে চীন সবসময়ই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জাতিসংঘে, সুরক্ষা দিয়ে গেছে। এমনকি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মুসলিমদের উপর ব্যাপক নির্যাতনের পরেও মিয়ানমারের পাশে থাকে চীন। ‘এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’এর আঞ্চলিক পরিচালক নিকোলাস বেকুয়েলিন বলছেন যে, চীনের সমর্থন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে মুসলিমদের উপর নির্যাতন বৃদ্ধি করতে শক্তি যুগিয়েছে। মিয়ানমারের বেসামরিক নেতা নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী অং সান সু কি রাখাইনের মুসলিমদের উপর নির্যাতনকে বৈধতা দিয়ে সারা বিশ্বে ধিক্কার কুড়িয়েছেন।

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, মিয়ানমারের উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রদেশগুলি দেশটাতে চীনা বিনিয়োগের জন্যে সবচাইতে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। একইসাথে উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশে চীনা ঋণের ফাঁদের উদাহরণ তৈরি হয়ে যাওয়ায় মিয়ানমারের কর্মকর্তারা পানিবিদ্যুৎ এবং সমুদ্রবন্দরের চুক্তিগুলিকে মুলতুবি রেখেছিলেন অথবা সেগুলির ব্যাপারে নতুন করে আলোচনার কথা বলেছেন। মিয়ানমারের সর্বউত্তরের কাচিন প্রদেশের প্রভাবশালী ব্যাপটিস্ট কনভেনশনের প্রেসিডেন্ট হাকালাম স্যামসন বলছেন যে, চীন সর্বদাই বলে যে মিয়ানমারে তাদের বিনিয়োগ হলো মিয়ানমারের জনগণের উন্নয়নের জন্য; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা পুরোপুরি অন্যরকম। চীনারা তাদের প্রকল্পগুলিতে শুধু চীনা নাগরিকদেরই চাকুরি দেয়। এমনকি তারা তাদের খাদ্যদ্রব্যও চীন থেকে নিয়ে আসে; মিয়ানমার থেকে কিছুই কেনে না। কাচিন প্রদেশ হলো সেই তিন প্রদেশের একটা, যেগুলি শি জিনপিংএর সফর থেকে বিনিয়োগের প্রস্তাব পাচ্ছে। কাচিন প্রদেশেই ২০১১ সালে মাইতসোন পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প আটকে যায়। কাচিনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান এতে পানির নিচে চলে যেতো; আর উৎপাদিত বিদ্যুৎ রপ্তানি হবার কথা ছিল চীনে। প্রকল্পটা আবারও নেয়া হতে পারে - এই গুজব ছড়িয়ে পড়লে ২০১৯ সালে সেখানে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ।
 
 
অস্থির প্রদেশগুলির মাঝ দিয়ে তৈরি ‘চায়না-মিয়ানমার ইকনমিক করিডোর’ বা ‘সিএমইসি’ প্রথম দিন থেকেই নিরাপত্তাহীন থাকবে। মিয়ানমারের জনগণকে চীন যথেষ্ট নির্ভরশীল করে তৈরি করতে পারেনি, যা কিনা এই করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতো। অন্যদিকে চীনের আগ্রাসী ঋণের বেড়াজালে আটকে যাবার ভয় থেকেও মিয়ানমার বের হতে পারছে না। কিউক পিউ বন্দরের জন্যে দীর্ঘমেয়াদি দরকষাকষি এটাই দেখিয়ে দেয়। 

২০১৮ সালে রাখাইন প্রদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির প্রকল্পকে আলোচনার মাধ্যমে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ থেকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়। রাখাইনের মানুষের অধিকার খর্ব হওয়া ছাড়াও বিশাল ঋণের ফাঁদে ফেলে বন্দরের নিয়ন্ত্রণ দখলের ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি হয়। ‘রাখাইন ইকনমিক ইনিশিয়েটিভ’এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ইউ খিন মাউং কি বলছেন যে, চীনা বিনিয়োগ জনগণের জন্যে কল্যাণকর না হলে জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করবে। আর সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিনিয়োগ সর্বদাই ঝুঁকিপূর্ণ। বিচ্ছিন্নতাবাদী শান প্রদেশের পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রী ইউ সোয়ে নিউন্ট লোউইন বলছেন যে, সীমান্ত প্রদেশে সহিংসতার কারণে চীনা বিনিয়োগ কমে গেছে। তিনি শি জিনপিংএর কাছ থেকে শান্তির আশা করছেন। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলির কয়েকটার উপর চীনাদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। গ্রুপগুলির নেতারা চীনে আশ্রয় পায়। এমনকি একবার একটা শান্তি আলোচনায় মিয়ানমারের রাজধানী নে পি দোতে পৌঁছাবার জন্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার জন্যে বিমান চার্টার করে দেয় বেইজিং। মিয়ানমারের জাতিগত সহিংসতায় সামরিক সরকার, চীন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলির নেতৃবৃন্দ - এরা সকলেই লাভবান হয়েছে; শুধু সাধারণ জনগণ ছাড়া। মিয়ানমারে চীনের প্রস্তাবিত বিনিয়োগেরও একই চেহারা হতে পারে।

‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতাতে টিকে থাকতে চীন চাইছে কৌশলগত মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করতে। তবে মালাক্কা প্রণালী যেমন চীনের নিয়ন্ত্রণে নেই, তেমনি বঙ্গোপসাগর চীনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কাজেই কিউক পিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করা এবং সেই বন্দরের সাথে চীনের সরাসরি রেল সংযোগ তৈরি করার প্রকল্প সর্বদাই অবরোধের হুমকিতে থাকবে। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে চীনারা মিয়ানমারের মুসলিমদের উপর অত্যাচার মেনে নেবার যে নীতিতে এগুচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদে চীনের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করছে। কারণ চীনের বেশিরভাগ জ্বালানিই আসে মুসলিম বিশ্ব থেকে। তদুপরি রাখাইন, কাচিন এবং শান প্রদেশে সহিংসতা বন্ধে চীন কতটুকু অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। অস্থির প্রদেশগুলির মাঝ দিয়ে তৈরি এই করিডোর প্রথম দিন থেকেই নিরাপত্তাহীন থাকবে। মিয়ানমারের জনগণকে চীন যথেষ্ট নির্ভরশীল করে তৈরি করতে পারেনি, যা কিনা এই করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতো। অন্যদিকে চীনের আগ্রাসী ঋণের বেড়াজালে আটকে যাবার ভয় থেকেও মিয়ানমার বের হতে পারছে না। কিউক পিউ বন্দরের জন্যে দীর্ঘমেয়াদি দরকষাকষি এটাই দেখিয়ে দেয়। পরিশেষে, চীন মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী কার্যকলাপকে বৈধতা দানে যতটুকু এগুলো, বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মানুষের আস্থা অর্জনে ততটাই পেছালো; যা কিনা রাখাইনে চীনের কৌশলগত কিউক পিউ বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সাথে সাংঘর্ষিক। অর্থনৈতিক দিক থেকে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ উভয়েই চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হলেও অত্র অঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক প্রভাব গুটিকয়েক ব্যক্তির মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে।

4 comments:

  1. চীন অতিরিক্ত বেশী আত্নপ্রত্যয়ি বা আত্নবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে যেটা তার জন্য শুভ পরিনাম বয়ে আনবে না। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই এইগুলি বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী ছকগুলি প্রনয়ন করবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. চীন দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করছে না। এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপানকে মাথায় রেখে সে অনেক কিছু করে ফেলতে চাইছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনগুলিকে সে বুঝতে পারছে না। যেমন - চীন যে কখনোই সুপারপাওয়ার হতে পারবে না, তা সে এখনও বুঝতে চাইছে না। যেকারণে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়ের পর দুনিয়াটা কেমন হবে, সেটা নিয়ে তার ভাবনা আকাশ-কুসুম চিন্তার মতোই।

      Delete
  2. economic corridor er bepar e bolte hoy tara risk share korlo
    kivhabe
    cpec te baluchistan e je risk ase + india er je risk ase
    seai tuku risk tara minimize korte chacche prostabito cmec dara
    besides in future jodi cpec kuno karon e kuno prodotto somoy er jonno function na kore sei somoy tuku cover korar jonn cmec kaj korbe

    2.abar bikolpo hisebe
    cpec & cmec dui tai tara function rakhbe risk er kotha ta mathay rekhey ager bola risk share korar maddhome

    3.cmec er risk tara hoyto puro puri coup up korte parbe.
    -karon bidrohi group gulo k kaje laganur maddhome (jader upor tader provhab ase) & notun group gulo keo kase tanbe taka chitteye jate cmec er jonno kuno humki toiri na kore
    - cpec te je india kortik beluch abong tar nijjossho operative dara (afghan theke) risk toiri kortese seai risk tuku cmec er maddhome release korlo/korbe
    4.hoyto tara bikolpo fuel er onek kase chole gase or chesta kortese jar fole tar middle east er fuel naholeo cholbe akta somoy por theke (hoyto seta cmec in ground e full function e asa er somoy porjonto )
    5. bastobotay hoyto bangla desh er people er motamot hoyto tader kase matter kore na .kevhabe seta tara india theke dekhe sikhse. r tai bd people theke j risk seta tara afford korte parbe
    6.onno dike theke dekhle bd people tader onek dorkari jinish china theke amdani kore .jar karone tara bd jonogon aktu birup holeo tader khoti ney.
    any way khub sundor lekha er jonno
    jajak allah khair
    apnar motamot er asay..................

    ReplyDelete
    Replies
    1. বারাকআল্লাহ ফিক!

      CPEC যদি কাজ না করে, তাহলে সেটার পিছনে সবচাইতে বড় কারণ হবে পাকিস্তানের জনগণকে চীনের পক্ষে আনতে না পারার ব্যর্থতা। এই ব্যাপারটা চীন এখনও বুঝতে ব্যর্থ। তারা পাকিস্তানের সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারলেই তাদের চলবে বলে মনে করছে। CMEC নিয়েও তাদের চিন্তাটা একই ধরনের।

      চীন যেটা বুঝতে পারছে না তা হলো, ভূরাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের স্থান একেবারেই সর্বনিম্ন স্তরে। জাতীয়তাবাদী চিন্তার মাঝে থাকলে বেশিরভাগ ভূরাজনৈতিক সমস্যা কেউ বুঝতেই পারবে না। চীন যদি শুধু 'পাকিস্তানী', 'বাংলাদেশী', 'সৌদী', 'তুর্কি', 'মালয়ান', 'আফ্রিকান' এভাবে মুসলিমদের দেখতে থাকে, তাহলে তাদের বিপদ অবশ্যম্ভাবী। জনগণের মতামত যেকোন সময়ে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। চীন এটা বোঝে না বলেই তার সুপারপাওয়ার হবার সম্ভাবনা শূণ্য। আর চীন এইগুলি বোঝে না, কারণ চীন কোন আদর্শিক শক্তি নয়; বরং হান জাতীয়তাবাদী শক্তি।

      না বুঝতে পারলে চীন হোঁচট খেতে খেতেই শিখবে।

      Delete