Saturday 18 January 2020

ইন্দোনেশিয়াকে ঘুম থেকে জাগালো চীন?


১৮ই জানুয়ারি ২০২০
চীন যেমন এখানে তার প্রভাব বৃদ্ধিতে পিছপা হবে না, তেমনি ইন্দোনেশিয়াও নতুনা সাগরে চীনের ফিশিং ফ্লীটের হুমকি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না। নতুনার এই বিরোধ হয়তো ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির জন্যে ঘুম থেকে জেগে ওঠার কাজটাই করবে। পূর্বের সাগরের প্রায় সবগুলি কৌশলগত সমুদ্রপথের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া তার পররাষ্ট্রনীতিকে পরিবর্তন করলে এর ভূকৌশলগত প্রভাব সারা বিশ্বে প্রতিফলিত হবে।

দক্ষিণ চীন সাগরে ইন্দোনেশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন নতুনা দ্বীপপুঞ্জের কাছে চীনের সাথে তিন সপ্তাহব্যাপী উত্তেজনার পর ৯ই জানুয়ারি ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনী ঘোষণা দেয় যে, চীনের সকল জাহাজ ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রসীমা ত্যাগ করেছে। ইন্দোনেশিয়ার ‘ম্যারিটাইম সিকিউরিটি এজেন্সি’ বলছে যে, গত ১৯ থেকে ২৪শে ডিসেম্বরের মাঝে কমপক্ষে ৬৩টা চীনা মাছ ধরার জাহাজ চীনা কোস্ট গার্ডের প্রহরায় নতুনার আশেপাশের সমুদ্রে এসে পৌঁছায়, যে সমুদ্রাঞ্চলকে ইন্দোনেশিয়া নিজেদের অর্থনৈতিক অঞ্চল বলে দাবি করে। অন্যদিকে চীনারাও তাদের স্বঘোষিত ‘নাইন-ড্যাশ লাইন’এর আওতায় এই এলাকায় নিজেদের ‘ঐতিহাসিক অধিকার’ রয়েছে বলে মনে করে। হতচকিত হয়ে ইন্দোনেশিয়ার নেতৃবৃন্দ জানুয়ারির শুরুতে নতুনার দিকে নৌবাহিনীর দু’টা কর্ভেট প্রেরণ করে। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেনস’ বলছে যে, জানুয়ারির ৬ তারিখ নাগাদ ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী সেখানে আরও ৪টা ফ্রিগেট, একটা সাবমেরিন এবং একটা উভচর পরিবহণ জাহাজ প্রেরণ করে। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়ার বিমান বাহিনীর ১৬ নম্বর স্কোয়াড্রন থেকে ৪টা ‘এফ-১৬’ ফাইটার বিমান এবং সেনাবাহিনীর ৬’শ সদস্য সেখানে মোতায়েন করা হয়।

৬ই জানুয়ারি দক্ষিণ চীন সাগরের স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের ‘ফায়ারি ক্রস’ দ্বীপ হতে চীনা কোস্ট গার্ডের দু’টা জাহাজ নতুনার পথে যাত্রা করে বলে জানায় ‘ম্যারিন ট্রাফিক’ নামের শিপিং ইন্টেলিজেন্স সংস্থা। জাহাজগুলি খুব সম্ভবতঃ সেখান থেকে জ্বালানি নিয়ে যাত্রা করে। ‘ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজ’এর ‘চায়না ম্যারিটাইম স্টাডিজ ইন্সটিটিউট’এর রায়ান মার্টিনসন বলছেন যে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের মূল ভূখন্ড থেকে দূরবর্তী এলাকাগুলিতে অপারেশন চালাবার জন্যে চীনের দখলে থাকা স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের এই ঘাঁটিগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ‘অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইন্সটিটিউট’এর গবেষক চার্লি লিয়ন্স জোন্সএর মতে, মনুষ্যনির্মিত এই দ্বীপগুলি চীনের নৌশক্তিকে মূল ভূখন্ড থেকে দূরের এলাকায় প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করছে। ‘ফায়ারি ক্রস’এ চীনারা বিশাল রানওয়ে তৈরি করেছে, যেখানে ফাইটার জেট এবং বড় পরিবহণ বিমান অবতরণ করতে পারবে। তবে তিনি আরও বলছেন যে, চীনারা মূল ভূখন্ড থেকে অতটা দূরে এই ঘাঁটি ধরে রাখার লজিস্টিক্যাল চ্যালেঞ্জগুলি কতটা মোকাবিলা করতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে।


  
চীনকে না চটানোর নীতিটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়ায় চীনাদের নিয়মিত হুমকিগুলি ইন্দোনেশিয়দের জন্যে প্রায় গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। আর অন্যদিকে চীন নিজের বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। নতুনা দ্বীপপুঞ্জ চীনের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ মালাক্কা প্রণালীর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে। কাজেই চীন যেমন এখানে তার প্রভাব বৃদ্ধিতে পিছপা হবে না, তেমনি ইন্দোনেশিয়াও নতুনা সাগরে চীনের ফিশিং ফ্লীটের হুমকি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না। 


প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলা এই উত্তেজনার মাঝে ইন্দোনেশিয়া ৩০শে ডিসেম্বর জাকার্তাতে চীনা রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদলিপি পেশ করে। ‘ভোয়া নিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, চীনের সাথে ইন্দোনেশিয়ার মৎস্য শিকার নিয়ে বিভেদ নতুন নয়। আর ইন্দোনেশিয়াও সাম্প্রতিক সময়ে নতুনা দ্বীপ এলাকায় সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়ার এহেন সামরিক পদক্ষেপ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী কর্মকান্ড ঠেকাতে যথেষ্ট ছিল না। মোটকথা ইন্দোনেশিয়া একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল। ৮ই জানুয়ারি নতুনা দ্বীপে ছুটে যান ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। তিনি নতুনার লাম্পা স্ট্রেইট ফিশিং পোর্টে ঘোষণা দেন যে, তিনি সেখানে গিয়েছেন উত্তর নতুনা সাগরের সম্পদের উপর ইন্দোনেশিয়ার সার্বভৌম ক্ষমতা বলবত করতে।

চীনের হুমকি মোকাবিলায় সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত করতে ইন্দোনেশিয়া জরুরি পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে। ‘আইএইচএস জেনস’ জানাচ্ছে যে, ইন্দোনেশিয়া তার নৌবাহিনীর ফ্রান্স থেকে কেনা ১১টা ‘প্যান্থার’ হেলিকপ্টারকে সাবমেরিন ধ্বংসী এবং জাহাজ ধ্বংসী অস্ত্রে সজ্জিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই হেলিকপ্টারগুলি ক্রয়ের সময়ে শত্রুর জাহাজের উপর সরাসরি হামলার জন্যে উপযোগী অবস্থায় ক্রয় করা হয়নি। একইসাথে নৌবাহিনী ৪টা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল ক্রয়ের জন্যে টেন্ডার ডেকেছে। চীনা কোস্ট গার্ডের বিরাট প্যাট্রোল ভেসেলগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দোনেশিয়ার কোস্ট গার্ডের বেশিরভাগ জাহাজই অপেক্ষাকৃত ছোট। তাই নৌবাহিনীর কর্ভেট এবং ফ্রিগেটগুলিকে ডেকে পাঠাতে হয়েছে চীনা কোস্ট গার্ডের জাহাজগুলিকে মোকাবিলার জন্যে। এছাড়াও পূর্ব জাভার পাইতন নৌঘাঁটিতে ৭৬ মিঃমিঃএর একটা কামান বসানো হয়েছে কামান চালনায় নৌবাহিনীর দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে। অর্থাৎ এতকাল কামান চালনাকে বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রের অংশই মনে করা হয়নি।

১৫ই জানুয়ারি দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত নতুনা দ্বীপে সরেজমিন পরিদর্শন করে ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক, আইনী এবং নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী মাহফুদ এমডি বলেন যে, নতুনা দ্বীপে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়াবার লক্ষ্যে ইন্দোনেশিয়ার সরকার সেখানে মৎস্য আহরণ বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে। ‘জাকার্তা পোস্ট’এর এক খবরে বলা হচ্ছে যে, ১ হাজার কিঃমিঃএর বেশি দূরত্বে অবস্থিত জাভা থেকে ৩৫টা মাছ ধরার জাহাজ নিয়ে আসা হচ্ছে এই অঞ্চলে। এই জাহাজগুলির প্রতিটার ধারণক্ষমতা ৭৫টনের বেশি। সরকার বলছে যে, নতুনার জেলেদের জাহাজগুলি একেবারেই ছোট, যেগুলি চীনাদের সাথে প্রতিযোগিতা করে এই অঞ্চলের সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে একেবারেই অপ্রতুল। একই দিনে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি ভিয়েতনামের হো চিন-মিন সিটিতে এক ঝটিকা সফরে ভিয়েতনামের ‘হাই নাম’ নামের একটা সীফুড কোম্পানির সাথে বৈঠক করে ইন্দোনেশিয়া থেকে বেশি করে মাছ আমদানি করার আহ্বান জানান। উদ্দেশ্য নতুনা সাগরে মাছ আহরণ বৃদ্ধি করে সেই মাছের জন্যে বাজার ধরা। ১৭ই জানুয়ারি জাকার্তায় ম্যারিটাইম এফেয়ার্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট মন্ত্রী লুহুত পাঞ্জাইতান সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া নতুনা দ্বীপে ফিশ প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি করতে ইচ্ছুক।

২০১৭ সালে নতুনা দ্বীপের আশেপাশের অঞ্চলকে নিজের অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করলেও প্রকৃতপক্ষে ইন্দোনেশিয়া তার স্বার্থকে সমুন্নত করতে নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা ছাড়াই এগুচ্ছিল। চীনকে না চটানোর নীতিটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়ায় চীনাদের নিয়মিত হুমকিগুলি ইন্দোনেশিয়দের জন্যে প্রায় গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। আর অন্যদিকে চীন নিজের বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। নতুনা দ্বীপপুঞ্জ চীনের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ মালাক্কা প্রণালীর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে। কাজেই চীন যেমন এখানে তার প্রভাব বৃদ্ধিতে পিছপা হবে না, তেমনি ইন্দোনেশিয়াও নতুনা সাগরে চীনের ফিশিং ফ্লীটের হুমকি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না। নতুনার এই বিরোধ হয়তো ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির জন্যে ঘুম থেকে জেগে ওঠার কাজটাই করবে। পূর্বের সাগরের প্রায় সবগুলি কৌশলগত সমুদ্রপথের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া তার পররাষ্ট্রনীতিকে পরিবর্তন করলে এর ভূকৌশলগত প্রভাব সারা বিশ্বে প্রতিফলিত হবে।

2 comments:

  1. ইন্দোনেশিয়া একটি মুসলিম দেশ। তাদের সাথেও আমাদের সামরিক সম্পর্ক জোরদার করা উচিৎ। উদ্দেশ্যও প্রায় একই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সমুদ্রে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি এবং ধরে রাখতে গেলে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সম্পর্কোন্নয়ন জরুরি। পূর্বের সাগরগুলিকে নিরাপদ দেখতে চাইলে এর বিকল্প কিছু নেই। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ১টা বা ২টা জাহাজ সবসময়ের জন্যে পূর্বের সাগরে থাকার ব্যবস্থা করাটা জরুরি।

      Delete