Monday 6 January 2020

যুক্তরাষ্ট্র কি ইরাক ছাড়ছে?

৬ই জানুয়ারি ২০২০
সুলাইমানির মৃত্যু যদি ইরাকে মার্কিন অবস্থানকে দুর্বল করে, এবং শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরাক ছাড়তে বাধ্য হয়, তাহলে ইরাক এবং সিরিয়াতে যে ভূরাজনৈতিক শূণ্যস্থান তৈরি হবে, সেটা কেউ না কেউ পূরণ করতে চাইবে। তবে ইরাকের জনগণ ইরানকে এই অবস্থানে দেখতে না-ও চাইতে পারে; কারণ তারা চাইছে না যে ইরাকের পুরো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে চলে যাক। এক্ষেত্রে ইরানের বিকল্প হিসেবে ইরাকের উত্তর এবং দক্ষিণের দুই আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক এবং সৌদি আরবের আবির্ভাবের সম্ভাবনা রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের একার বদলে কয়েকটা শক্তির মাঝে ইরাককে বিভক্ত দেখতে চাইবে।

৫ই জানুয়ারি ইরাকের পার্লামেন্টে একটা ভোট অনুষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা বের করে দেবার ইচ্ছা ব্যাক্ত করা হয়। তবে এই সমঝোতার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ইরাকের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আদেল আব্দুল মাহাদি বলেন যে, তার দেশ থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেবার জন্যে একটা টাইমলাইন ঠিক করে ফেলা দরকার। তবে ইরাক থেকে মার্কিন সেনাদের সরাতে এমন একটা আইন লাগবে, যা বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর একইসাথে মার্কিন সেনাদেরকে এক বছরের নোটিস দিতে হবে। বর্তমানে ইরাকে ৫ হাজার ২’শর মতো মার্কিন সৈন্য রয়েছে। এতকাল যাবত ট্রাম্প প্রশাসন ইরাকের রাজনীতিবিদদের বোঝাতে পেরেছে যে, ইরাকে মার্কিন সেনাদের প্রয়োজন রয়েছে। এমনকি ইরান-সমর্থিত গ্রুপগুলিও আইসিস দমনে ইরাকে মার্কিন সেনা রাখার পক্ষে ছিল। কিন্তু ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ড কোরের ‘কুদস ফোর্স’এর কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে বাগদাদ বিমানবন্দরে বিমান হামলার মাধ্যমে হত্যা করার পর ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের দাবি আরও জোরদার হয়েছে।

‘দ্যা ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো মাইকেল নাইটস বলছেন যে, ইরাকে বহু রাজনীতিবিদ রয়েছে যারা কিনা ইরাকে মার্কিন সেনাদের অবস্থানের উপর নিজেদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার টিকিয়ে রেখেছেন। এই গ্রুপগুলি ইরানের প্রভাবকে ব্যালান্স করার জন্যে ইরাকে মার্কিন সেনা চাইছে। আর ঠিক একারণেই ২০১৮ সালে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেবার পিছনে তিনদফা আন্দোলনের পরেও ব্যাপারটার কোন সুরাহা করা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে আলোচনা এবং আইনের ড্রাফট তৈরির মাঝে যেকোন ইস্যুই হারিয়ে যেতে পারে। ইরাকে একটা আইনকে পিছিয়ে দেবার এতো বেশি পদ্ধতি রয়েছে যে, এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে দেশটা থেকে মার্কিন সেনা সরাবার জন্যে প্রকৃতই কোন আইন পাস করা যাবে। আর ইরাকের বর্তমান অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর অধীন সরকার সাংবিধানিকভাবে কতটুকু ক্ষমতাবান, সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরাকের করা এক্সিকিউটিভ এগ্রিমেন্ট বাতিল করতে পারবে কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়। আর ৫ই জানুয়ারির ভোটাভুটির সময় পার্লামেন্টে সুন্নি এবং কুর্দী গ্রুপগুলির অনেক প্রতিনিধিই উপস্থিত ছিলেন না। ট্রাম্পের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রাক্তন কর্মকর্তা কার্সটেন ফনটেনরোজ বলছেন যে, যে শিয়া নেতারা ভোট দিয়েছেন, তাদের জন্যে বিপক্ষে ভোট দিয়ে নিরাপদে রাস্তায় হাঁটা কঠিন ছিল; কারণ ভোটাভুটি হয়েছে প্রকাশ্যে। গোপন ভোটাভুটিতে ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো।

তবে সুলাইমানির হত্যাকান্ড সকলকেই কাঁপিয়েছে। এমনকি সুলাইমানির হত্যাকান্ডে যেসব রাজনীতিবিদ সুবিধা পাবেন, তারাও মার্কিন বাহিনীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এদের মাঝে রয়েছেন ইরাকের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল-সদর। সদর পার্লামেন্টে দেয়া এক বক্তব্যে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলেন। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স ওয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিনীরা চাইছে ইরাকিদের সামনে একটা অপশন তুলে ধরতে – হয় তোমরা যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নাও, নতুবা ইরানকে। কিন্তু বেশিরভাগ ইরাকির জন্যে ব্যাপারটা অতটা পরিষ্কার নয়। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের সরকারকে উৎখাতের পর ইরাকের নতুন সরকার গঠনে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান একত্রে কাজ করেছে। পরবর্তীতে আইসিসের আবির্ভাবের পরও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান একত্রে কাজ করেছে। ইরাকি এক কর্মকর্তা বলছেন যে, সুলাইমানি না থাকলে হয়তো বাগদাদ আর আরবিল শহরের পতন হয়ে যেতো। তবে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইরাকের বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপগুলিকে সরকারি নিরাপত্তা কাঠামোর মাঝে নিয়ে আসতে।

ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে আনা হবে কিনা, সেব্যাপারে মার্কিনীদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন যে, সুলাইমানির হত্যার পর ইরাকে মার্কিন সেনাদের নিরাপত্তা কঠিন পরীক্ষার মাঝে পড়েছে। তারা বলছেন যে, ট্রাম্পের উচিৎ ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, সেটা তিনি বাস্তবায়ন করবেন। ‘ডিফেন্স প্রাইয়রিটিজ’এর পলিসি ডিরেক্টর বেঞ্জামিন ফ্রীডম্যান বলছেন যে, আজ হোক কাল হোক, ইরাকের সমস্যা ইরাকীদেরকেই সমাধান করতে হবে। এটা ইরাকীরা জানে; মার্কিনীরাও সেব্যাপারে একমত। যেব্যাপারে সকল বিশ্লেষকেরাই মোটামুটিভাবে একমত তা হলো, ইরাকে মার্কিন কর্মকান্ড আগের চাইতে কমিয়ে ফেলতে হতে পারে। ইতোমধ্যেই হামলার কারণে ইরাকে মার্কিন প্রশিক্ষণ কর্মকান্ডকে কমিয়ে আনা হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক কার্ক সোওয়েল বলছেন যে, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মাহাদি এবং প্রেসিডেন্ট বারহাম সালিহ মার্কিন সমর্থিত লোক হলেও এই মুহুর্তে অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে তাদের পক্ষে মার্কিন স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে পারাটা আরও কঠিন হয়ে যাবে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকের রাস্তায় আন্দোলনের সময় সরকারি দুর্নীতির সাথে সাথে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও কথা বলেছে জনগণ। এতে অনেকের সাথে ইরান-সমর্থিত গ্রুপগুলিও চিন্তিত হয়েছে। গত মে মাসের নির্বাচনে মুকতাদা আল-সদরএর গ্রুপ সবচাইতে বেশি ভোট পেয়েছিল। সদরই মার্কিন সেনাদের ইরাক থেকে সরানোর ব্যাপারে পার্লামেন্টে কথা বলেছেন। মাইকেল নাইটস বলছেন যে, সদরকে সুলাইমানির সমর্থক বলা না গেলেও সদরই মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারটাকে তুলে ধরে সুলাইমানির মৃত্যুকে বেশি ব্যবহার করতে পারবেন।

সুলাইমানির মৃত্যু যদি ইরাকে মার্কিন অবস্থানকে দুর্বল করে, এবং শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরাক ছাড়তে বাধ্য হয়, তাহলে ইরাক এবং সিরিয়াতে যে ভূরাজনৈতিক শূণ্যস্থান তৈরি হবে, সেটা কেউ না কেউ পূরণ করতে চাইবে। তবে ইরাকের জনগণ ইরানকে এই অবস্থানে দেখতে না-ও চাইতে পারে; কারণ তারা চাইছে না যে ইরাকের পুরো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে চলে যাক। এক্ষেত্রে ইরানের বিকল্প হিসেবে ইরাকের উত্তর এবং দক্ষিণের দুই আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক এবং সৌদি আরবের আবির্ভাবের সম্ভাবনা রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের একার বদলে কয়েকটা শক্তির মাঝে ইরাককে বিভক্ত দেখতে চাইবে।


4 comments:

  1. conflicts of interest er karone hoyto iran turkey ar saudi arabia big player hobe iraq e jodi amra usa ke iraq e ney dhore nei.r
    r se khetre iraq er aro unstable hower possibility ase bole mone kori .
    on the other hand usa sohoje iraq sharte parbe bole mone kori na .
    r akta major fact holo iraq er politician der moddhe bivajon

    apnar motamot asha korsi .........................

    any way nice write up

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ কমেন্টের জন্যে!

      শিয়াদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নেতা (গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ) ছিলেন মুকতাদা আল-সদরএর বাবা মুহাম্মাদ সাদিক আল-সদর। তাকে সাদ্দাম হোসেনের সরকার হত্যা করে। মুকতাদার শ্বশুর ছিলেন গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ মুহাম্মদ বাকির আল-সদর; যাকে সাদ্দাম সরকার ১৯৮০ সালে ফাঁসি দেয়। এই হত্যাকান্ডগুলি ইরানের রেভোলিউশনের পর খোমেনির হাতে শিয়াদের নেতৃত্ব চলে যেতে সহায়তা করে। শিয়াদের সকল ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি কিন্তু ইরাকেই।

      মুকতাদা আল-সদরের হাত ধরে শিয়াদের নেতৃত্ব আবারও ইরাকের হাতে চলে আসতে পারে। এটা ইরানের বর্তমান নেতৃত্ব কখনোই হতে দিতে চাইবে না। মুকতাদা আল-সদর ইরাকে যথেষ্ট সন্মানিত এক ব্যক্তি। শিয়া-সুন্নী সকলেই তাকে সন্মান করে। খামেনির অবস্থান কিন্তু ইরাকে মুকতাদার মতো নয়।

      ইরাকের রাজনীতি অনেকক্ষেত্রেই নির্ভর করবে ইরাকের জনগণকে একত্রিত করতে কে কাজ করবে আর কে কাজ করবে না, সেটা উপর।

      Delete
    2. complex situation wait kortese sobar jonno jara iraq er control nite chabe
      r akta point
      samne iran er move ki hote pare iraq abong shiea der control dhore rakher khetre bole apni mone koren ?

      Delete
    3. ইরান ইরাকে তার জনসমর্থন বাড়াবার জন্যে মার্কিনীদের বিরুদ্ধে আরও কিছু হামলার দিকে এগুতে পারে। কিন্তু ইট মারলে আবার পাটকেল খাবার জন্যেও তাকে রেডি থাকতে হবে; যেটা এখন ইরানের ক্যাপাসিটির বাইরে।

      রাজনৈতিকভাবে ইরানের পক্ষে ইরাকের নিয়ন্ত্রণ নেয়া খুব কঠিন; কারণটা উপরের কমেন্টে পাবেন। ইরাকের নিয়ন্ত্রণ নিতে গেলে ইরাকের জনগণকে একত্রিত করতে হবে; যা ইরানের পক্ষে সম্ভব নয়। সেকারেই ইরানের কাছে 'মার্কিনী হঠাও' আন্দোলনের নেতৃত্ব নেয়ার চেষ্টা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে এই পথে যেতে গেলে মুকতদা আল-সদরের গ্রহণযোগ্যতা সর্বাগ্রে। কারণ তিনিই শিয়াদের মাঝে প্রথম মার্কিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

      Delete