০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪
জাতীয়
নিরাপত্তা বলতে আমরা মোটামুটি সবসময়ই মনে করি এটা বোধহয় সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত
কোনকিছু। হয়তো বহির্শত্রু থেকে দেশকে সামলে রাখাটাই এর মূলকাহিনী। কিন্তু এটা আমরা
চিন্তা করে দেখি না যে বহির্শত্রুর আক্রমণ ঠেকানো কেনো গুরুত্বপূর্ণ। বহির্শত্রু
আসলে আমাদের কি করতে পারে? আর সেটাতে আমাদের কি কি ক্ষতি হতে পারে? এই রকম ক্ষতি
কি বহির্শত্রুর আক্রমণ ছাড়াও হতে পারে? সেটা একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ ব্যাপারটা আসলে কি। তাহলে
একটু গভীরে যাবার চেষ্টা করি ব্যাপারটা নিয়ে।
ঢাল-তলোয়ারের সংজ্ঞা পরিবর্তন?
কোন
বহির্শত্রু যখন আমার দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থানে হস্তক্ষেপ করবে, আমরা তখন
স্বভাবতই আমাদের স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সচেষ্ট হবো। স্বাধীনভাবে নিজেদের দেশকে
চালাতে না পারলেই তো স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্ন উঠবে; ঠিক কিনা? তার মানে
বহির্শত্রুর আক্রমণে স্বাধীনভাবে দেশ চালানো হুমকির মুখে পড়বে। তাহলে শুধু
বহির্শত্রুর আক্রমণেই কি দেশের স্বাধীন পরিচালনা বিঘ্নিত হতে পারে, নাকি অন্য
কারণেও হতে পারে? কোন একটা পরিস্থিতিতে আমাদের দেশ যদি অন্য কোন দেশ বা কোন গোষ্ঠি
বা সংস্থার সাথে এমন কোন চুক্তি করতে বাধ্য হয়, যার শর্ত মোতাবেক আমরা ভবিষ্যতে
ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছুই করতে পারবো না – তাহলে কি দেশের স্বার্বভৌমত্ব
হুমকির মুখে পড়বে না? যদি পড়ে, তাহলে এই ধরণের হুমকি থেকে দেশকে রক্ষা করার উপায়
কি? এখানেই ঢাল তলোয়ারের সংজ্ঞা নিয়ে চিন্তার ব্যাপার রয়েছে। সবক্ষেত্রেই যে
অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে দেশের স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে তা নয়। বরং অস্ত্র
ব্যবহার করার আগেই যেন যুদ্ধ হেরে বসে না থাকি, সেটাও চিন্তা করতে হবে। একটা
সাম্প্রতিক উদাহরণ দেওয়া যাক। রাশিয়া এখন ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ
করছে নির্বিঘ্নে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মুখে মুখে বললেও রাশিয়াকে ইউক্রেন থেকে দূরে
রাখতে পারছে না। রাশিয়ার সামরিক শক্তি এখন সেই সোভিয়েত যুগের সাথে তুলনীয় নয়।
কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আন্তর্জাতিক অঙ্গনে
তাদের গুরুত্বকে অনেকটা উপরে উঠিয়েছে। বর্তমানে প্রায় সারা ইউরোপ রাশিয়া থেকে
লম্বা পাইপলাইনের মাধ্যমে পাওয়া জ্বালানীর উপরে নির্ভর করছে। এই জ্বালানীর যোগান
হঠাত বন্ধ হয়ে গেলে রাশিয়ার চাইতে ইউরোপই বেশি বিপদে পড়বে। কাজেই এখানে সামরিক
হস্তক্ষেপের বিষয়টি অর্থনৈতিক ভারসাম্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। রাশিয়া সামরিক
দিক থেকে যেটা পারেনি, সেটা অর্থনীতির মারপ্যাঁচে পুষিয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার উদ্ধৃত্ত
জ্বালানী সম্পদ এক্ষেত্রে শুধু অর্থনৈতিকভাবেই তাদের উপকৃত করেনি, কৌশলগত দিক থেকে
রাশিয়ার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে।
অর্থনীতিই সর্বোচ্চ স্বার্থ
অর্থনীতি
সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থ। একটি দেশ তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত
করতে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ চীনের কথা বলা যেতে পারে। চীনা
কম্পিউটার হ্যাকারদের অত্যাচারে যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাহি অবস্থা। আমেরিকানদের মতে এই
হ্যাকার গোষ্ঠী চীনের সামরিক বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একারণে মার্কিন সরকারের
এজেন্সিগুলি চীনা সামরিক বাহিনীর প্রযুক্তি বিভাগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে
চিনহিত করেছে; তাদের ছবিসহ পোস্টার ছাপিয়েছে। এই হ্যাকারগোষ্ঠী কিন্তু ক্রেডিট
কার্ড বা টেলিকম কোম্পানি থেকে টাকা চুরির লক্ষ্যে হ্যাকিং করে না। এই গোষ্ঠীর কাজ
হচ্ছে চীনারা যেসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে, সেসব ক্ষেত্রে চীনকে এগিয়ে নেয়া। কিছুদিন
আগে খবরে এলো যে চীনা হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক হাসপাতালের সিস্টেমে হ্যাকিং
করে সেখান থেকে অনেক তথ্য চুরি করেছে। হ্যাকাররা এমনই সব তথ্য চুরি করেছে, যা
ব্যবহার করে চীনা মেডিকেল কোম্পানিগুলি আমেরিকার মার্কেটে আমেরিকান কোম্পানির সাথে
পাল্লা দিয়ে আরও ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারে। কাজেই এই ‘তথ্য
যুদ্ধ’ আসলেই হেলা-ফেলার ব্যাপার নয়। এখানে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা জড়িত। চীনা
হ্যাকাররা এখানে জাতীয় স্বার্থ দেখেছে। হয়তো চীনা সামরিক বাহিনীও সেখানে জড়িত।
কিন্তু এরা সকলেই চেষ্টায় রয়েছে দেশের স্বার্থকে উপরে তুলে ধরতে; সেটা ন্যায়সম্মত
হোক আর না হোক। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এখন জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে
হাসপাতালের কম্পিউটারও ঢুকে গেল। হয়তো আগে থেকেই ছিল; তবে এখন গুরুত্বের দিক দিয়ে
সেটা কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল আরকি।
বেসামরিক
নাকি অগুরুত্বপূর্ণ?
শুধু
হাসপাতাল কেন? আরও অনেক কিছুই মার্কিন সিকিউরিটি লিস্টে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে।
৯/১১-এর আল কায়েদার হামলার পরে যুক্তরাষ্ট্র শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে দেশের
বহু বেসামরিক স্থাপনাকে প্রতিরক্ষা বলয়ের মাঝে নিয়ে আসার জন্য। বিমান পরিবহণের কথা
তো নতুন করে বলার কিছু নেই। বিমানবন্দরে
প্রতিটি বিমানে দেওয়া হয়েছে সাদা পোষাকের এয়ার মার্শাল। এনথ্রাক্স জীবানু
হামলার পরে ডাক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছিল তারা।
রাসায়নিক সার, গ্যাস সিলিন্ডার, শিল্পে ব্যবহার্য বিস্ফোরক, ইত্যাদি বিপজ্জনক
দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে বহু ধরণের নতুন নিয়ম-নীতির প্রচলন করা হয়েছিল। কয়েক বিলিয়ন
ডলার খরচ করে মানুষকে গুটি বসন্তের টীকা দেওয়া হয়েছিল। বিমান বন্দর, ব্যবসা
কেন্দ্র, গুরুত্বপূর্ণ সেতু, সমুদ্র বন্দর, রেল স্টেশন, পানি শোধনাগার, বিদ্যুত
কেন্দ্র, বাঁধ, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নেওয়া হয়েছিল কঠিন নিরাপত্তা
ব্যাবস্থা। এগুলি সব-ই বেসামরিক স্থাপনা, কিন্তু এগুলির কারণেই সেই দেশের অর্থনীতি
সচল ছিল। সামরিক স্থাপনাগুলির চাইতে এগুলির গুরুত্ব বেশি বৈ কম নয়। তাই সর্বশক্তি
দিয়ে তারা তাদের অর্থনৈতিক সম্পদকে নিরাপত্তা দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একটু বেশিই
করে ফেলেছে। আর বেশি বলেই সমালোচনা করবো কেন? আমাদের দেশে রপ্তানিমূখী গার্মেন্টস
শিল্পে বিশৃংখলা তৈরির অনেক চেষ্টা চলেছে। শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন না দেওয়া থেকে
শুরু করে মনুষ্য-সৃষ্ট দুর্ঘটনা, এমনকি কারখানায় অগ্নি সংযোগের ঘটনাও ঘটেছে।
কিন্তু আমরা এসব ক্ষেত্রে ২৪ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করা এই শিল্পের বিন্দুমাত্র
নিরাপত্তা দিতে পারিনি, অতিরিক্ত করা তো দূরে থাক। ষড়যন্ত্রকারীদের ধরতে পারিনি;
শ্রমিক অসন্তোষ নিভাতে পারিনি; দিতে পারিনি শ্রমিকের জীবনের মূল্য। অর্থনীতির এতবড়
সেক্টরকে আমরা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি; জাতীয় নিরাপত্তাকে ছেড়ে দিয়েছে
সৃষ্টিকর্তার হাতে!
ব্যবসায়িক
তথ্যের নিরাপত্তা
তবে
জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে আসলে বেশি বলে কোন কিছু নেই। কিছু না
ঘটলে সবাই বলে যে অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর কিছু ঘটে গেলে সবাই বলতে থাকে কিছুই করা
হয়নি। এই কিছু করার ক্ষেত্রটা অনেক বিশাল। সবসময় এটার গুরুত্ব বোঝাও কঠিন। যেমন
পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের পরে পাটের উপরে নতুন করে গবেষণার দুয়ার খুলে গেছে।
যদিও অনেকেই জানে যে বেশ কিছু গবেষণা অনেকটা এগিয়েছে, কিন্তু কি ধরণের গবেষণা
হচ্ছে সেটা নিয়ে কেউই কথা বলতে নারাজ। কেন? কারণ পাটের বাজারে বাংলাদেশের
প্রতিদ্বন্দীর অভাব নেই। বর্তমানে পাটের কয়েকটি পেটেন্ট-এর জন্যে বাংলদেশ আবেদন
করেছে। যেগুলি পেয়ে গেলে বাংলাদেশকে রয়ালটি না দিয়ে কেউ পাটের উপরে বিশেষ কিছু কাজ
করতে পারবে না। আমাদের গবেষণার বিষয় আমাদের প্রতিদ্বন্দীরা আগেভাগে থেকে জেনে
ফেললে এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক ক্ষতির একটা কারণ হতে পারে। বর্তমানে পাটের সাথে
বাংলাদেশের ৭০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাণিজ্য জড়িত, যা এখন খুব ছোট মনে না হলেও
পাটের ভবিষ্যত সম্ভাবনার কাছে নিতান্তই নস্যি। ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে পাটজাত
পণ্য আমাদের গার্মেন্টস-নির্ভর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে ব্যালান্স করতে পারবে। আর এই
গবেষণার নিরাপত্তার উপরে নির্ভর করছে আমাদের অর্থনীতির বিরাট এক সম্ভাবনা আর বহু
মানুষের কর্মসংস্থান। আমাদের প্রতিদ্বন্দীরা কেউ এখানে গোয়েন্দাগিরি করছে না, সেটা
কখনোই বলা যায় না। বড় বড় দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি তাদের দেশের বড় বড় প্রাইভেট
কোম্পানিগুলিকে বিভিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। এইসব তথ্য
আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় কোম্পানিগুলির টিকে থাকার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
বাণিজ্য
নির্ভরশীলতাও কি নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে?
অর্থনৈতিক
নির্ভরশীলতা যে সময়মত কতটা গুরুত্ববহ হয়ে যায়, সেটার জন্য আগে বর্ণিত রাশিয়ার
গ্যাস পাইপলাইনের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতীয় গরুর কথা বলা যায়। এই
গরু আমাদের দেশে শুধুমাত্র প্রোটিনের চাহিদাই পূরণ করে না। গরুর চামড়ার উপরে
নির্ভর করছে আমাদের ১.৩ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাণিজ্য। আমদের দেশ এখনো যেহেতু গরু
মোটাতাজাকরণ ব্যবসায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়নি, তাই এই ভারতীয় গরুর উপরেই আমাদের নির্ভর
করতে হচ্ছে। সীমান্তে এই ব্যবসাকে ঘিরে কত মানুষ যে ভারতের ‘ট্রিগার-হ্যাপি’ বিএসএফ সদস্যদের হাতে মারা
পড়েছে, তার হিসেব নেই। তারপরেও আমরা এখানে জিম্মি হয়ে থাকছি। আমরা প্রতিবাদ করলেও
বলতে পারছি না যে ভারত থেকে আর গরু আনবো না। অন্যদিকে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য
প্রায় পুরোটাই ইউরোপ-নির্ভর। কোন কারণে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা বা ইউরোপের সাথে
এদেশের রাজনৈতিক কোন্দলে আমাদের রপ্তানি বাজারে বিরাট প্রভাব পড়তে পারে। যার
ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়তে পারে। ইউরোপে মন্দার কারণে এদেশের
অনেক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এর প্রভাব ছিল সবচাইতে বেশি। উঠতি
এই শিল্পে প্রচুর বিনিয়োগের ঠিক পরপরেই একনাগারে কয়েক বছর একটিও বিদেশী জাহাজের
অর্ডার পায়নি। এমতাবস্থায় হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা হয়ে
দাঁড়িয়েছিল জাতীয় নিরাপত্তার অংশ। এই সময়ে দেশী জাহাজের অর্ডার অনেক গুণ বেড়ে
যাওয়ায় এই শিল্প সমূহ ধংসের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল। ভিয়েতনামের জাহাজ নির্মাণ
শিল্পে আমাদের চাইতে আরও অনেক বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল। তাই তাদের ক্ষতির পরিমাণ
আমাদের চাইতে বহুগুণ বেশি ছিল।
কর্মসংস্থানের
নিরাপত্তা
যেকোন
বাণিজ্যে ক্ষতি বেশি হবে যদি সেখানে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ হয়। এক্ষেত্রে অর্থের
ব্যাপারটা আসলে সবচেয়ে ছোট। চিন্তা করে দেখুন এমন কোন শিল্পের কথা যেখানে হাজার
হাজার মানুষ বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। তাদের উপরে নির্ভরশীল
হয়েছে তাদের পরিবার। এমন শিল্প যেখানে অনেক প্রতিভাবান তরুন তাদের জীবনের
সর্বশ্রেষ্ঠ সময় ব্যয় করেছে বিশেষ কোন বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্যে, যাতে সে সেই
গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের একজন অংশীদার হতে পারে। একটা বিরাট শিল্পের ধ্বসে জনশক্তির
ক্ষতি পুষিয়ে নেয়াটা সবচাইতে কঠিন। আর বাংলাদেশ যেহেতু ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, তাই
এদেশের জনশক্তির নিরাপত্তা দেখাটা দেশের সরকারের সবচাইতে জনগুরুত্বপূর্ণ কাজের
মধ্যে একটি। আর জনশক্তির কথা বলতে গেলে বিদেশে এদেশের মানুষের কর্মসংস্থানের
ব্যবস্থা নিশ্চিত করাটা দেশের অভ্যন্তরের চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ দেশে যে
হারে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, তা আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্যে এখনো অপ্রতুল। দেশের
অর্থনীতিতে বিদেশ থেকে পাঠানো প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের এই রেমিট্যান্স বাজার বিশাল
এক ভূমিকা রাখে। এখানেও খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশ কোন একটি বা দু’টি দেশের উপরে খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে কিনা। মধ্যপ্রাচ্যের উপরে
বরাবরই আমাদের জনশক্তি রপ্তানি নির্ভরশীল। কিন্তু এখানে প্রায় সবসময়ই কোন না কোন
আন্তর্জাতিক বিবাদ লেগেই আছে। অগণতান্ত্রিক এই দেশগুলিতে বড় ধরণের পরিবর্তন হলেই আমাদের
কর্মসংস্থান বাজারের উপরে ব্যপক চাপ পড়ে যায়। আবার এইসব দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নও
অনেক গুরুত্ব বহন করা শুরু করে। বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং-এর বিরূদ্ধে দেশে বা
বিদেশে যেকোন কর্মকান্ড এক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে। এখানে
ভুলে গেলে চলবে না যে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে আমাদের প্রতিদ্বন্দী দেশগুলি বসে
নেই। তারা কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের কয়েকগুণ দ্রুতগতিতে জনশক্তি রপ্তানি করছে; বন্ধ
করে দিচ্ছে আমাদের রপ্তানির পথ। দক্ষ জনশক্তির দিক থেকে তারা আমাদের চেয়ে অনেক
এগিয়ে আছে। দক্ষ জনশক্তির চাহিদা যেমন বেশি, তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সও তেমনি বেশি
হয়। কাজেই দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারাটা হয়ে যাচ্ছে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটা
ইস্যু। গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং ইন্সটিটিউট এবং শিক্ষা কেন্দ্রগুলিকে ঠিকমতো চালানোটা
কারো চোখে পড়বে না। কিন্তু কোন ধরণের অনাকাংক্ষিত বিশৃংখলায় যদি এসব গুরুত্ববহ
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হঠাত অকার্যকর হয়ে পড়ে, তখন কিন্তু সেখানে সবার চোখ যাবে।
কিন্তু গার্মেন্টস সেক্টরে বিশৃংখলা দেখা দেয়ার পরও আমরা ভুলে গেছি যে সেখানে ৪০
লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব সেক্টরে নজরদারি রাখাটা জাতীয়
নিরাপত্তার একটা অংশ।
আমাদের
জাতীয় নিরাপত্তার কিছু ইস্যু
নজরদারিতে
রাখার মতো অনেক বিষয়ের মাত্র কয়েকটি বিষয় উপরে উল্লেখ করেছি; আরও অনেক রয়েছে। চিন্তা
করে দেখুন তো চট্টগ্রাম বন্দর, যেখান দিয়ে দেশের ৯০% বাণিজ্য হয়, সেখানে কোন কারণে
এক সপ্তাহ সকল কাজ বন্ধ হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে কতটা ক্ষতি হতে পারে? বন্দরের
মুখে ডুবে যাওয়া জাহাজ, নদীর নাব্যতা, শ্রমিক অসন্তোষ, ইত্যাদি যেকোন সমস্যাই বন্ধের
কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। অথবা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোন একটি ব্রিজ এক
সপ্তাহের জন্যে অকার্যকর হয়ে পড়লে ঢাকা এবং এর আশেপাশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব
কতটুকু পড়বে? বেশিরভাগ বড় বড় ব্রিজ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট দ্বারা সুরক্ষিত।
কিন্তু ব্রিজগুলির টেকনিক্যাল সিকিউরিটি কিন্তু এর রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত
ইঞ্জিনিয়ারদের উপরে। একইভাবে যদি প্রাকৃতিক বা মনুষ্য-সৃষ্ট কোন কারণে
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি এবং মাওয়া কেওড়াকান্দি ফেরি একসাথে অকার্যকর হয়ে পড়ে,
তাহলে ঢাকার সাথে দেশের পুরো দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে; শত শত
কোটি টাকার মাছ ও সবজি নষ্ট হবে পথিমধ্যে, আর ঢাকায় এগুলির মূল্য হবে সাধারণের
ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুষ্ক মৌসুমে এই ফেরি রুটের
নিরাপত্তা চলে যায় নদী খননের জন্য ড্রেজার চালনা করা ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে। একইভাবে,
সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি নৌবন্দর হলো উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের চাষাবাদে ব্যবহৃত ডিজেল তেল
(সেচ ও জমি চাষ) ও রাসায়নিক সারের চাবিকাঠি। প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে মানিকগঞ্জ
থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত নৌপথে নাব্যতা ভয়াবহ কমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম ও মংলা
সমুদ্রবন্দর থেকে তেল ও সার নিয়ে আসা জাহাজগুলি বাঘাবাড়ি পৌঁছার আগেই আটকে যায়।
ড্রেজিং চলে দিনরাত; তারপরেও নৌরুটের বিপদ কাটে না; রাতের বেলায় চলে ডাকাতের
উপদ্রব; নজরদারী বাড়াতে হয় পুলিশের। এখানে তেল ও সার পৌঁছাতে দেরী হওয়া মানে বছর
শেষে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্য উতপাদনে বিরাট ঘাটতি। তিস্তা নদীতে সেচের
জন্যে পানি না থাকাও একই রেজাল্ট দেবে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভারতের
সাথে তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তির বাস্তবায়ন। আরও একটি উদাহরণ হলো দেশে ইলিশ
ধরা নিষিদ্ধ যে সময় (এপ্রিল ও অক্টোবরের কিছু সময়), সে সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের শত শত
কিলোমিটার নদী পাহাড়া দেওয়া। কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী ও পুলিশ এসময়ে তাদের সর্বশক্তি
নিয়োগ করেও হিমসিম খায় ইলিশ ধরা বন্ধ করতে গিয়ে। এই একটি মাছ ইলিশ এদেশের
জিডিপি-তে ১% অবদান রাখে; বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে; কর্মসংস্থান দেয় ৪.৫ লক্ষ জেলের। সময়মত ইলিশ ধরা বন্ধ না রাখতে পারলে এই সম্পদ বেশিদিন টেকানো সম্ভব
হতো না। গভীর সমুদ্রে বিদেশী ট্রলারের মাছ চুরি রোধ করাটাও একই ধরনের গুরুত্ব বহণ
করে। আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হবার পরে নৌবাহিনীকে শক্তিশালী
করাটা এখন তাই একটি জাতীয় ইস্যু। আরেকটি ইস্যু রয়েছে জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্পের
পরিবেশগত দিক ও শ্রমিক নিরাপত্তা। এই শিল্পের উপরে
নির্ভর করে গোটা
দেশের নির্মাণ শিল্প (রড, বার, এঙ্গেল); বেশিরভাগ যাত্রীবাহী লঞ্চ ও ছোট জাহাজ
(বালুবাহী বার্জ, কার্গো জাহাজ, মালামালবাহী লোহার নৌকা) তৈরি শিল্প; ফাউন্ড্রি শিল্প (টিউব ওয়েল, পানির পাম্প, ধান
মাড়ানি মেশিনের যন্ত্রাংশ, ইত্যাদি); বাস-ট্রাকের বডি তৈরির শিল্প; এমনকি পুরোনো
জাহাজ ভেঙ্গে পাওয়া নানা যন্ত্রপাতি ও আসবাব এগুলিরও নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। এসব
মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির একটা বিশাল অংশ জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্পের উপরে নির্ভর করে। অথচ
বিশ্বের বিভিন্ন জাহাজ মালিকেরা যে আমাদের এই শিল্পে শ্রমিকের নিরাপত্তাহীনতাকে
ভ্রু কুঁচকে দেখছে, সেটা আমরা জানি কি? আমাদের দেশ থেকে স্ক্র্যাপ জাহাজ চীন ও
ভারতে যেতে থাকলে আমরা মহা বিপদে পরে যাবো। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সহ সেক্টরটিকে
সবসময় নজরদারির মাঝে রাখাটা জরুরি। আর বিদ্যুত, গ্যাস, তেল শোধনাগার, ইত্যাদির
গুরুত্ব বোঝাবার নেই। এগুলি যে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, তা কাউকে বলে বোঝাতে
হবে না।
বাজারের মাছে ফরমালিন পরীক্ষা করা হচ্ছে। একটি জাতিকে সারাজীবনের জন্যে পঙ্গু করে দেবার জন্যে তাদের একটি জেনারেশনকে ধারাবাহিকভাবে বিষ খাওয়াতে পারলেই যথেষ্ট। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ জাতীয় নিরাপত্তার অংশ। |
কৌশলগত
দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও কিছু কিছু ব্যাপার দীর্ঘমেয়াদে দেশের অনেক
ক্ষতি করতে পারে। তাই সেসব দিকে সবসময় খেয়াল রাখা জরুরি। যেমন মাদক চোরাচালান রোধ
করা। মাদক দেশে অবাধে আসতে দিলে একটা পুরো জেনারেশন ধ্বংস হয়ে যাবে; যারা একসময় দেশের
জন্যে সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে যাবে। এরপর রয়েছে খাদ্যে ভেজাল ও দূষন রোধ করা। একটা
পুরো জাতিকে পঙ্গু করে ফেলার জন্যে তাদের শিশুদের প্রতিদিন কিছু কিছু করে বিষ
খাওয়ালেই হবে; তারা সারাজীবনে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। পুরো জাতির পুষ্টির
চাহিদা পূরণ করাটাও একইভাবে জরুরি। সময়মত দেশের একটি জেনারেশনের ভিটামিন ও
প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা না গেলে সেই জেনারেশন থেকে মেধাসম্পন্ন বা সুস্বাস্থ্যের
নাগরিক তৈরি করা যাবে না; যাবে না শক্তিশালী দেশ তৈরি করা। নদনদীর সম্পদ,
সামুদ্রিক সম্পদ, বনজ সম্পদ এগুলি দেশের জন্যে অনেক বড় আশীর্বাদ। এগুলি ধ্বংসের
হাত থেকে রক্ষা করাও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এত
কথা? বুঝে কয়জন?
তাহলে
এটা বোঝা যাচ্ছে যে দেশের নিরাপত্তা দেওয়া মানে দেশের আর্থ-সামাজিক সবদিক দিয়ে
নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই নিরাপত্তা দিতে শুধু অস্ত্র দিয়ে হবে না। এখানে দেশের
সব ধরনের সম্পদই কাজে লাগতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দেশের মানবসম্পদ।
দেশের স্বার্থ দেশের মানুষকে বোঝার শক্তি দিতে হবে। কারো একার পক্ষে দেশের
সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়; সকল নাগরিককেই এখানে দরকার। সকল নাগরিকের মাঝে
আবার দেশের নেতৃস্থানীয় মানুষের দায়িত্ব সবচাইতে বেশি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের
রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দেশের স্বার্থ বুঝতে পারার ঘাটতি
আমাদের সকলের মাঝেই রয়েছে।
No comments:
Post a Comment