২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫
ফ্রান্সিস ড্রেইক (Sir Francis Drake, 1540-1596) ইতিহাসে কি হিসেবে পরিচিত? সেটা অবশ্য নির্ভর করছে সেই ইতিহাস কে রচনা করেছিল। কারণ স্প্যানিশ-পর্তুগীজ-ফ্রেঞ্চদের কাছে ড্রেইক ছিলেন একজন জসদস্যু; আর ব্রিটিশদের কাছে তিনি একজন জাতীয় বীর। তিনি আসলে কি করতেন? ড্রেইক ইংল্যান্ডের শত্রু দেশের বাণিজ্য জাহাজ এবং বাণিজ্য কেন্দ্র হামলা করে লুট করতেন। ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ (রানী ছিলেন ১৫৫৮ খ্রিঃ-১৬০৩ খ্রিঃ) ড্রেইককে পছন্দ করতেন বলেই তিনি তাকে জলদস্যুতার জন্যে সাজা দেননি। বরং যখন স্পেনের সাথে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ (১৫৮৫ খ্রিঃ-১৬০৪খ্রিঃ) বেধে গেল, তখন এলিজাবেথ তাকে ভাইস এডমিরাল পদে নিয়োগ দেন। এর আগেই পৃথিবী প্রদক্ষিণের (১৫৭৭ খ্রিঃ-১৫৮০খ্রিঃ) পরপরেই ড্রেইককে নাইট উপাধি দেন রানী। স্প্যানিশদের কাছ থেকে সমুদ্রের দখল নিতে ইংল্যান্ডের জন্যে ড্রেইকের অবদান অনস্বীকার্য। ড্রেইকের আসল অবদান অবশ্য স্প্যানিশদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করা বা দস্যুবৃত্তি নয়। ১৫৭৭ সালে দুনিয়া প্রদক্ষিণের মিশনে বের হবার সময় ড্রেইক বেশ কিছু সম্ভান্ত বংশীয় যুবককে তার সাথে নেন। এই ব্যাপারটার গুরুত্ব অনেকে না বুঝলেও স্প্যানিশ নীতিনির্ধারকেরা ঠিকই বুঝেছিলেন। তারা যেটা সন্দেহ করেছিলেন তা হচ্ছে, ড্রেইক ইংলিশ নৌবাহিনীর অফিসার কোর তৈরি করার জন্যেই তার সাথে ওই যুবকদের নিয়েছিলেন। ড্রেইকের মিশনে রানী এলিজাবেথ নিজেও গোপনে বিনিয়োগ করেছিলেন, যা কিনা ওই মিশনের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়। ড্রেইক এই মিশনের মাধ্যমে রয়্যাল নেভির অফিসার কোর তৈরি করার যে ট্র্যাডিশন তৈরি করেছিলেন, সেটা পরবর্তীতে ব্রিটিশদের সমুদ্রের রানী বানাতে ব্যাপক সাহায্য করেছিল।
শুধুই বাণিজ্য, নাকি আরও কিছু?
এখানে একটা ব্যাপার কিছুটা অদ্ভুত ঠেকলেও বিশেষভাবে বিবেচ্য। ড্রেইকের মিশনটা কি বেসামরিক ছিল, নাকি সামরিক ছিল? প্রাইভেট ছিল, নাকি সরকারী ছিল? এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে হলে কিছু ব্যাপার ক্ষতিয়ে দেখতে হবে। ড্রেইক কয়েকবার স্প্যানিশদের আমেরিকান উপনবেশের বিরূদ্ধে মিশনে বের হন। ষোড়শ শতকে ক্যাথোলিক স্প্যানিশ এবং পর্তুগীজরা তাদের আমেরিকান কলোনিগুলিতে আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস, সোনা, রূপা, চিনি, ইত্যাদির একচেটিয়া ব্যবসা করতো। ইংলিশ এবং ফ্রেঞ্চরা এই ব্যবসা থেকে ছিল বঞ্চিত। স্প্যানিশ-পর্তুগীজরা শক্তি দিয়ে এই বাণিজ্য রক্ষা করতো। কাজেই এই বাণিজ্যে ভাগ বসাতে হলেও শক্তির প্রয়োজন হতো। নব্য পুঁজিবাদের এই সময়ে মার্কেন্টিলিস্ট পলিসি অনুসরণ করতো সবাই – অর্থাৎ অর্থনীতি ছিল রপ্তানি নির্ভর; কমদামে বেসিক পণ্য আমদানী করে বেশি দামে ফিনিশড গুডস রপ্তানি করেই চলতো এসব দেশের অর্থনীতি। এই নীতিতে একে অপরকে নিজের আফ্রিকান এবং আমেরিকান বাণিজ্য কেন্দ্রের কাছে আসতেই দিত না; ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ জাহাজ দেখলেই স্প্যানিশ-পর্তুগীজরা আক্রমণ করে বসতো, অথচ এসব দেশের মধ্যে তখন যুদ্ধাবস্থা ছিল না! ইংল্যান্ড থেকে যেসব জাহাজ আমেরিকায় বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতো, তারা গোপনে ইংল্যান্ড ছাড়তো। কিন্তু তারা ইংল্যান্ড ছাড়ার আগেই স্প্যানিশ চর মারফত স্প্যানিশ সরকার খবর পেয়ে যেত এবং স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূত এলিজাবেথের কাছে আর্জি নিয়ে যেত সেই মিশন বন্ধ করার জন্যে। এই ধরনের প্রতিযোগীতার কারণে ড্রেইক এবং অন্যান্য যারা আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতো, তারা তাদের জাহাজগুলিকেই শুধু অস্ত্রসজ্জিত করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাদের নাবিকদের সিলেক্ট করার ক্ষেত্রেও একই রকম সাবধানতা অবলম্বন করতো। তাদের জাহাজের নাবিকদের বেশিরভাগই অস্ত্র চালনায় দক্ষ হতো। অথচ তারা কিন্তু ‘বাণিজ্যের’ উদ্দেশ্য নিয়েই বের হতো সমুদ্রে।
একচেটিয়া ব্যবসার রক্ষার্থে
প্রথমে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে গিয়ে তারা ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে আনা পণ্য বিক্রি করতো এবং সেখান থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস দিয়ে জাহাজ ভর্তি করতো। এরপরে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এই ক্রীতদাসদের তারা আমেরিকায় স্প্যানিশ উপনিবেশগুলিতে বিক্রি করতো, যেখানে আদিবাসীদের নির্মমভাবে নিধনের কারণে চাষাবাদ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজের জন্যে জনবলের বড়ই অভাব ছিল। আফ্রিকার উপকূলে এলেই পর্তুগীজরা ইংলিশ জাহাজগুলিকে আক্রমণ করে বসতো। ইংলিশরা নিজেদেরকে রক্ষা করেই জোরপূর্বক আফ্রিকায় তাদের বাণিজ্য সম্পন্ন করতো; আবার আমেরিকাতে গিয়েও জোরপূর্বক তারা বাণিজ্য করতো। স্প্যানিশ উপনিবেশের অধিকর্তারা তাদের সরকারের নির্দেশের বিরূদ্ধে না গিয়ে ইংলিশ জাহাজকে বাণিজ্য করতে না দিলে ইংলিশরা তাদের জাহাজ থেকে উপকূলে অস্ত্রধারী নাবিকদের নামিয়ে দিত। তারা পরে অস্ত্রের মুখে বাণিজ্য করতো। ড্রেইক এবং বাকিরা এরকম অস্ত্রের মুখে বাণিজ্য করেই ক্ষান্ত হননি। তারা সরাসরি স্প্যানিশ জাহাজে হামলা করে জাহাজ লুট করেছেন, জাহাজের নাবিকদের মাঝে কিছু লোককে বন্দী করে পরবর্তীতে আলোচনায় ব্যবহার করেছেন, এবং যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই স্থলভাগে সৈন্য নামিয়ে (উভচর উভিযান) ব্যাপক লুটতরাজ এবং ক্ষতিসাধন করেছেন। এই ব্যাপারগুলি ইংলিশরা খারাপ চোখে দেখেনি। তারা চেয়েছে আমেরিকার নতুন বাজারে বাণিজ্য করতে, কারণ সেই বাণিজ্যের মাঝেই তারা নিজেদের সমৃদ্ধি দেখতে পেয়েছিল। স্প্যানিশ-পর্তুগীজদের একচেটিয়া বাণিজ্য তারা দেখতে আগ্রহী ছিল না। অন্যদিকে স্প্যানিশ-পর্তুগীজরা মনে করতো যে – আমরাই আমেরিকায় প্রথম এসেছি; আমরাই সেই ভূমি খুঁজে পেয়েছি অনেক কষ্ট করে; যদি কারও বাণিজ্য করার অধিকার সেখানে থাকে, তাহলে সেটা আমাদের। এটা ছিল একটা এলাকার বাণিজ্যসহ পুরো ভূমি কপিরাইট করার এক অনন্য উদাহরণ। আপাতদৃষ্টে এই মনোপলি ব্যাবসার বিরূদ্ধে ইংলিশদের একটা ভালো জাতি মনে হলেও পরবর্তীতে সারা বিশ্বে নিজেদের বাণিজ্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশরা ঠিক এই কাজটাই করেছে; তখন অবশ্য ব্রিটিশদের কাছে এটা মনে হয়েছে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার যুক্তিযুক্ত সংগ্রাম।
বাণিজ্যের জন্যে জাহাজ, নাকি যুদ্ধের জন্যে?
ইংলিশ রাজ দেখেছেন তার দেশের উন্নতির দিকগুলি। যেকারণে তিনি তার দেশের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখেছেন। যেখানেই দরকার হয়েছে, সেখানেই তিনি ব্যবসায়ীদের সাথে অংশীদারীত্বে গিয়েছেন - ব্যবসা করার জন্যে নয়, বরং দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্যে। দেশের স্বার্থ এখানে সরকারী-বেসরকারী মালিকানার উর্ধে ছিল সবসময়। নিজের দেশের বাণিজ্যকে রক্ষা করার জন্যে সবকিছু করেছেন ইংলিশ রাজ। এমনকি যখন তারা এটা বুঝতে পেরেছেন যে স্প্যানিশ সমুদ্র বাণিজ্যে ভাগ বসানোর মাঝেই তাদের উন্নতি নিহিত, তখন তারা স্প্যানিশদের বিরূদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেও পিছপা হননি। এই ব্যাপারগুলিকে খুব হিংসাত্মক মনে হলেও এটা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে এরকম হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা পুঁজিবাদ স্বাভাবিকভাবেই তৈরি করে। কাজেই যতদিন পৃথিবীতে পুঁজিবাদী শাসন চালু থাকবে, ততদিন সব দেশেরই নিজের বাণিজ্যিক স্বার্থকে নিজেরই দেখতে হবে। এখানে লজ্জা পেয়ে অভদ্রতা মনে করে কেউ যদি অন্য কোন বাণিজ্য-শক্তিকে ছাড় দিয়ে বসে, সেটা হবে কৌশলগত দিক থেকে বিরাট এক ভুল। ব্রিটিশরা লজ্জা করেনি বলেই ছোট্ট একটা দেশ হয়েও তারা দুনিয়ার রাজা বনে গিয়েছিল। বাণিজ্য করা এবং বাণিজ্য রক্ষার মাঝে তারা কোন পার্থক্য করেনি। দুই-ই তাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেকারণে তাদের বাণিজ্য জাহাজের বহর দেখলে বোঝা সম্ভব ছিল না যে সেগুলি বাণিজ্যের জন্যে, নাকি যুদ্ধের জন্যে তৈরি। তাদের বাণিজ্য জাহাজের সব নাবিকেরাই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত থেকেছে সর্বদা। যেসব জাহাজ সরাসরি বিপক্ষের যুদ্ধজাহাজের বিরূদ্ধে যুদ্ধে নামেনি, সেসব জাহাজ সৈন্য পরিবহণ করেছে এবং উভচর অভিযানে অংশ নিয়েছে। বিপক্ষের সম্পদবাহী বাণিজ্য জাহাজ দখলের মাঝে তারা তাদের দেশের উন্নতিই শুধু দেখেনি, বরং এটা ছিল পরবর্তীতে বিংশ শতকের অর্থনৈতিক অবরোধ এবং যুদ্ধের চিন্তার শুরু। বিশেষ করে সমুদ্র বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল একটা দেশকে কুপোকাত করতে হলে সেই দেশের সমুদ্র বাণিজ্যকেই যে কুপোকাত করতে হবে, এই থিওরিটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি কারুর। বিপক্ষের বাণিজ্য জাহাজ আক্রমণ থেকে লজ্জাবশতঃ দূরে থাকলে নিজেদেরই ক্ষতি – এটা ইউরোপিয়দের মাঝে ব্রিটিশরাই প্রথম বুঝেছিল। নিজের উপরে এই থিওরি কার্যকর হলে কেমন লাগে, সেটাও অবশ্য ব্রিটিশরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান সাবমেরিন বহর ব্রিটেনকে না খাইয়ে মারার উপক্রম করেছিল।
দেশের স্বার্থ কি সরকারী-বেসরকারী বা সামরিক-বেসামরিকের মাঝে আলাদা?
দেশের স্বার্থের মাঝে সরকারী-বেসরকারী অথবা সামরিক-বেসামরিক কিছু নেই; দেশের স্বার্থ মানেই সেটাকে রক্ষা করতে হবে সর্বশক্তি দিয়ে – এটাই ছিল ড্রেইকের সময়ের পুঁজিবাদী সমাজের নীতিনির্ধারকদের চেতনা। এই চেতনার উপরে নির্ভর করেই তারা দুনিয়া শাসন করেছে এবং যেসব জাতির উপরে ছড়ি ঘুরিয়েছে, সেসব জাতির মাঝে যাতে এই চেতনাগুলির জন্ম না হয়, সেটার ব্যবস্থা করেছে। এমন এক বিশ্বব্যবস্থার জন্ম তারা দিয়েছে, যেখানে সমুদ্র বাণিজ্য থাকবে অল্প কিছু কোম্পানির হাতে, যেগুলির মালিকানা থাকবে পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলির হাতে। আর এই বিশ্বব্যবস্থা এমন একটা নিয়ম করে রাখবে, যার কারণে ওই বাণিজ্যকে চ্যালেঞ্জ করার একমাত্র পদ্ধতি থাকবে বেসামরিক-বাণিজ্যিক, যা কিনা বেশিরভাগ আপশ্চিমা দেশের জন্যে পুঁজিভিত্তিক অর্থনৈতিক কারণে সম্ভব হবে না। কাজেই যেকোন মুহূর্তে খুব সহজেই যেকোন দেশের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া বা অর্থনৈতিক যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হবে। অথচ ব্রিটিশসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলি যখন নিজেদের বাণিজিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তখন কিন্তু সামরিক-বেসামরিক কোন আলাদা কিছু ছিল না। আমরা সকলেই ভুলে যাই যে ভারতীয় উপমহাদেশ প্রথম একশ’ বছর শাসন করেছে ব্রিটিশ সরকার নয়, বরং ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি, যা কিনা প্রাচ্যে ব্রিটিশদের সকল বাণিজ্যের দেখভাল করতো। তারা সৈন্য এবং যুদ্ধজাহাজ দিয়ে উপমহাদেশের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি দখল করেছে এবং সকল ধরণের কূটকৌশল অবলম্বন করেছে এই দেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করে দেশের বাণিজ্যসহ স্থলভূমি দখল করে এদেশের মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করতে। তাহলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কি সরকারী প্রতিষ্ঠান ছিল, নাকি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ছিল? সামরিক প্রতিষ্ঠান ছিল, নাকি বেসামরিক? আজ আমাদের দেশের এফবিসিসিআই যদি ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো কাজ করতে যায়, তাহলে শুধু উদ্ভটই শোনাবে না, পশ্চিমা শক্তিগুলি তাদের কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক সকল শক্তিকে কাজে লাগাবে এই ধরনের কার্যকলাপের বিরূদ্ধে। যে কাজটা পশ্চিমা দেশগুলি একসময় নির্দ্বিধায় করেছে, সেটাকে তারা আজ খারাপ বলবে – এটা হতে পারে না। বরং তারা চায় না যে তাদের পথ অনুসরণ করে তাদেরই সাম্রাজ্য অন্য কেউ দখল করে নিক। চীনারা যখন এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় তাদের বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য বৃদ্ধি করে, পশ্চিমা দেশগুলি তখন এই বিপদটাই দেখে। চীনারাও গত কয়েকশ’ বছরের ইতিহাস ভুলে না গিয়ে তাদের বাণিজ্য জাহাজের পিছনে পিছনে যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে ভুলেনি। তারা পশ্চিমা ক্রীতদাসের শৃংখল থেকে বের হয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টায় রত।
বিখ্যাত মার্কিন জিওস্ট্র্যাটেজিস্ট এবং জিওপলিটিশিয়ান আলফ্রেড মাহান একটা জাতিকে ম্যারিটাইম জাতিতে পরিণত করতে ‘রিজার্ভের’ কথা বলেছিলেন। এই রিজার্ভে তিনি বলেছিলেন সেই জাতির সী-ফেয়ারিং মানুষের সংখ্যার কথা – অর্থাৎ কত মানুষ সমুদ্র-চারণের উপরে নির্ভরশীল। সেই দেশের সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনা করা ছাড়াও সেই জাহাজ তৈরি এবং মেরামতের দক্ষ জনশক্তিকে মাহান রিজার্ভের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ষোড়শ শতকে ব্রিটিশ নাবিক এবং পরবর্তীতে রয়্যাল নেভির এডমিরাল ফ্রান্সিস ড্রেইক যখন তার জাহাজে সম্ভ্রান্ত যুবকদের ট্রেনিং দিচ্ছিলেন, তখন কিন্তু তিনিও এই ‘রিজার্ভ’ তৈরি করছিলেন। এই রিজার্ভই পবর্তীতে ব্রিটিশদের নৌবাহিনীকে করেছে জগদ্বিখ্যাত। মাহান সামরিক সমুদ্রশক্তিকে বেসামরিক সমুদ্রশক্তির পিছনে রেখেছিলেন। কারণ তার কথায় বাণিজ্য জাহাজ ছাড়া একটা জাতি খামোকা যুদ্ধজাহাজ বানাবে না। আর বাণিজ্য জাহাজ চালাতে না জানলে সেই জাতি সমুদ্রকেও চিনবে না এবং যুদ্ধজাহাজও চালাতে শিখবে না; অর্থাৎ সেই জাতির ম্যারিটাইম জাতি হবার কোন সম্ভাবনাই থাকবে না।
আসলে চিন্তার ভিত্তিটা কোথায়?
এই সামরিক-বেসামরিক আলোচনার ইতি টানতে ষোড়শ শতকে তৈরি ব্রিটেনের ‘এডমিরালটি এন্ড ম্যারিন এফেয়ার্স’ অফিসের দিকে তাকাতে হবে। এই অফিস তাদের ম্যারিটাইম সকল কিছু দেখাশুনা করতো, যার সর্বোচ্চ পদাধারী ছিলেন লর্ড হাই এডমিরাল, যিনি বেশিরভাগ সময়েই ছিলেন একজন রাজনৈতিক ব্যাক্তি। তার দায়িত্ব বর্তমান যুগের বাণিজ্য, নৌ, নৌবাহিনী এবং কোস্ট-গার্ড একত্র করে মন্ত্রণালয় তৈরি করলে সেটার সমান হতে পারে। তার অধীনে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন ভাইস এডমিরাল অব ইংল্যান্ড, যিনি ছিলেন আসলে নেভি-এর চীফ অব স্টাফ। নৌবাহিনীর ব্যাপারে তিনি সিভিলিয়ান লর্ড হাই এডমিরালকে উপদেশ দিতেন। এই দু’জনের নিচে একই এডমিরালটি অফিসের অধীনে ছিল অর্ডন্যান্স, ট্রেজারার, সার্ভেয়র, কন্ট্রোলার এবং ক্লার্ক, যারা জাহাজ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতেন এবং ম্যারিটাইম শক্তি ধরে রাখার জন্যে সব ধরনের রিজার্ভের দিকে খেয়াল রাখতেন। নৌ-বিষয়ক সকল কিছু একটা অফিসের অধীনে হওয়াতে সমুদ্রকেন্দ্রিক জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে সবসময় একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এই নীতিই কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমানে চালু আছে। এই নীতির সুবিধা হিসেবে উদাহরণস্বরূপ বলা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাহাজের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে। ব্রিটেনের বেশিরভাগ ফিশিং ট্রলারই মিলিটারি সার্ভিসের জন্যে উপযুক্ত ছিল এবং শত শত জাহাজ নৌবহরে শুধু যুক্তই হয়নি, বেসামরিক জাহাজের ডিজাইন কপি করে হাজার হাজার জাহাজ তৈরি করা হয়েছিল যেগুলি যুদ্ধের সময়ে জার্মান সাবমেরিনের হাত থেকে আটলান্টিক নৌ-বাণিজ্যপথ রক্ষা করতে এন্টি-সাবমেরিন জাহাজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, অথবা নৌপথ নিরাপদ রাখতে মাইন-সুইপার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, অথবা প্যাট্রোল বোট হিসেবে ব্রিটিশ উপকূল রক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়েও ব্রিটিশরা অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সিভিলিয়ান লাইনার জাহাজ সৈন্য পরিবহণের জন্যে প্রস্তুত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আটলান্টিক মহাসাগরের পরিবহণ জাহাজের কনভয়গুলির কমান্ডার থাকতেন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ নৌবাহিনী অফিসার। এগুলি সম্ভব হতো না কোনদিনই যদি ব্রিটিশদের ম্যারিটাইম চিন্তায় সরকারী-বেসরকারী বা সামরিক-বেসামরিক চিন্তার বিভেদ থাকতো।
বাংলাদেশ ইতিহাসের এমন একটা অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে সমুদ্র নিয়ে। আমরা চিন্তা কোন ভিত্তির উপরে করবো, সেটার উপরে নির্ভর করবে চিন্তাটা কতটা শক্তিশালী হবে। অন্যের তৈরি করে দেওয়া ভিত্তির উপরে দাঁড়াতে চাইলে অন্যের স্বার্থই দেখা হবে। তবে এটাও জেনে রাখা প্রয়োজন যে নিজেদের ভিত্তি নিজেরা তৈরি করতে চাইলে যেসব বাধা আসবে সামনে, সেগুলি অতিক্রম করার মতো শক্ত নীতি-নির্ধারনী ভূমিকা নিতে পারার মতো স্বাধীনতা আমাদের নেতৃত্বের থাকতে হবে।
ফ্রান্সিস ড্রেইক কে ছিলেন সেটা নিয়ে একেক দেশের মানুষের মাঝে দ্বিমত থাকলেও তিনি যে ব্রিটেনকে একটা ম্যারিটাইম দেশ হিসেবে তৈরি করতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন, সেটা অস্বীকার করার উপায় কারুরই নেই। |
ফ্রান্সিস ড্রেইক (Sir Francis Drake, 1540-1596) ইতিহাসে কি হিসেবে পরিচিত? সেটা অবশ্য নির্ভর করছে সেই ইতিহাস কে রচনা করেছিল। কারণ স্প্যানিশ-পর্তুগীজ-ফ্রেঞ্চদের কাছে ড্রেইক ছিলেন একজন জসদস্যু; আর ব্রিটিশদের কাছে তিনি একজন জাতীয় বীর। তিনি আসলে কি করতেন? ড্রেইক ইংল্যান্ডের শত্রু দেশের বাণিজ্য জাহাজ এবং বাণিজ্য কেন্দ্র হামলা করে লুট করতেন। ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ (রানী ছিলেন ১৫৫৮ খ্রিঃ-১৬০৩ খ্রিঃ) ড্রেইককে পছন্দ করতেন বলেই তিনি তাকে জলদস্যুতার জন্যে সাজা দেননি। বরং যখন স্পেনের সাথে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ (১৫৮৫ খ্রিঃ-১৬০৪খ্রিঃ) বেধে গেল, তখন এলিজাবেথ তাকে ভাইস এডমিরাল পদে নিয়োগ দেন। এর আগেই পৃথিবী প্রদক্ষিণের (১৫৭৭ খ্রিঃ-১৫৮০খ্রিঃ) পরপরেই ড্রেইককে নাইট উপাধি দেন রানী। স্প্যানিশদের কাছ থেকে সমুদ্রের দখল নিতে ইংল্যান্ডের জন্যে ড্রেইকের অবদান অনস্বীকার্য। ড্রেইকের আসল অবদান অবশ্য স্প্যানিশদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করা বা দস্যুবৃত্তি নয়। ১৫৭৭ সালে দুনিয়া প্রদক্ষিণের মিশনে বের হবার সময় ড্রেইক বেশ কিছু সম্ভান্ত বংশীয় যুবককে তার সাথে নেন। এই ব্যাপারটার গুরুত্ব অনেকে না বুঝলেও স্প্যানিশ নীতিনির্ধারকেরা ঠিকই বুঝেছিলেন। তারা যেটা সন্দেহ করেছিলেন তা হচ্ছে, ড্রেইক ইংলিশ নৌবাহিনীর অফিসার কোর তৈরি করার জন্যেই তার সাথে ওই যুবকদের নিয়েছিলেন। ড্রেইকের মিশনে রানী এলিজাবেথ নিজেও গোপনে বিনিয়োগ করেছিলেন, যা কিনা ওই মিশনের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয়। ড্রেইক এই মিশনের মাধ্যমে রয়্যাল নেভির অফিসার কোর তৈরি করার যে ট্র্যাডিশন তৈরি করেছিলেন, সেটা পরবর্তীতে ব্রিটিশদের সমুদ্রের রানী বানাতে ব্যাপক সাহায্য করেছিল।
শুধুই বাণিজ্য, নাকি আরও কিছু?
এখানে একটা ব্যাপার কিছুটা অদ্ভুত ঠেকলেও বিশেষভাবে বিবেচ্য। ড্রেইকের মিশনটা কি বেসামরিক ছিল, নাকি সামরিক ছিল? প্রাইভেট ছিল, নাকি সরকারী ছিল? এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে হলে কিছু ব্যাপার ক্ষতিয়ে দেখতে হবে। ড্রেইক কয়েকবার স্প্যানিশদের আমেরিকান উপনবেশের বিরূদ্ধে মিশনে বের হন। ষোড়শ শতকে ক্যাথোলিক স্প্যানিশ এবং পর্তুগীজরা তাদের আমেরিকান কলোনিগুলিতে আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস, সোনা, রূপা, চিনি, ইত্যাদির একচেটিয়া ব্যবসা করতো। ইংলিশ এবং ফ্রেঞ্চরা এই ব্যবসা থেকে ছিল বঞ্চিত। স্প্যানিশ-পর্তুগীজরা শক্তি দিয়ে এই বাণিজ্য রক্ষা করতো। কাজেই এই বাণিজ্যে ভাগ বসাতে হলেও শক্তির প্রয়োজন হতো। নব্য পুঁজিবাদের এই সময়ে মার্কেন্টিলিস্ট পলিসি অনুসরণ করতো সবাই – অর্থাৎ অর্থনীতি ছিল রপ্তানি নির্ভর; কমদামে বেসিক পণ্য আমদানী করে বেশি দামে ফিনিশড গুডস রপ্তানি করেই চলতো এসব দেশের অর্থনীতি। এই নীতিতে একে অপরকে নিজের আফ্রিকান এবং আমেরিকান বাণিজ্য কেন্দ্রের কাছে আসতেই দিত না; ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ জাহাজ দেখলেই স্প্যানিশ-পর্তুগীজরা আক্রমণ করে বসতো, অথচ এসব দেশের মধ্যে তখন যুদ্ধাবস্থা ছিল না! ইংল্যান্ড থেকে যেসব জাহাজ আমেরিকায় বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতো, তারা গোপনে ইংল্যান্ড ছাড়তো। কিন্তু তারা ইংল্যান্ড ছাড়ার আগেই স্প্যানিশ চর মারফত স্প্যানিশ সরকার খবর পেয়ে যেত এবং স্প্যানিশ রাষ্ট্রদূত এলিজাবেথের কাছে আর্জি নিয়ে যেত সেই মিশন বন্ধ করার জন্যে। এই ধরনের প্রতিযোগীতার কারণে ড্রেইক এবং অন্যান্য যারা আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতো, তারা তাদের জাহাজগুলিকেই শুধু অস্ত্রসজ্জিত করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাদের নাবিকদের সিলেক্ট করার ক্ষেত্রেও একই রকম সাবধানতা অবলম্বন করতো। তাদের জাহাজের নাবিকদের বেশিরভাগই অস্ত্র চালনায় দক্ষ হতো। অথচ তারা কিন্তু ‘বাণিজ্যের’ উদ্দেশ্য নিয়েই বের হতো সমুদ্রে।
আটলান্টিক মহাসাগরে বাণিজ্য ছিল ক্রীতদাস বাণিজ্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই বাণিজ্যের দখল নিতেই ইউরোপিয় দেশগুলির মাঝে হয় তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা |
একচেটিয়া ব্যবসার রক্ষার্থে
প্রথমে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে গিয়ে তারা ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে আনা পণ্য বিক্রি করতো এবং সেখান থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস দিয়ে জাহাজ ভর্তি করতো। এরপরে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এই ক্রীতদাসদের তারা আমেরিকায় স্প্যানিশ উপনিবেশগুলিতে বিক্রি করতো, যেখানে আদিবাসীদের নির্মমভাবে নিধনের কারণে চাষাবাদ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজের জন্যে জনবলের বড়ই অভাব ছিল। আফ্রিকার উপকূলে এলেই পর্তুগীজরা ইংলিশ জাহাজগুলিকে আক্রমণ করে বসতো। ইংলিশরা নিজেদেরকে রক্ষা করেই জোরপূর্বক আফ্রিকায় তাদের বাণিজ্য সম্পন্ন করতো; আবার আমেরিকাতে গিয়েও জোরপূর্বক তারা বাণিজ্য করতো। স্প্যানিশ উপনিবেশের অধিকর্তারা তাদের সরকারের নির্দেশের বিরূদ্ধে না গিয়ে ইংলিশ জাহাজকে বাণিজ্য করতে না দিলে ইংলিশরা তাদের জাহাজ থেকে উপকূলে অস্ত্রধারী নাবিকদের নামিয়ে দিত। তারা পরে অস্ত্রের মুখে বাণিজ্য করতো। ড্রেইক এবং বাকিরা এরকম অস্ত্রের মুখে বাণিজ্য করেই ক্ষান্ত হননি। তারা সরাসরি স্প্যানিশ জাহাজে হামলা করে জাহাজ লুট করেছেন, জাহাজের নাবিকদের মাঝে কিছু লোককে বন্দী করে পরবর্তীতে আলোচনায় ব্যবহার করেছেন, এবং যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই স্থলভাগে সৈন্য নামিয়ে (উভচর উভিযান) ব্যাপক লুটতরাজ এবং ক্ষতিসাধন করেছেন। এই ব্যাপারগুলি ইংলিশরা খারাপ চোখে দেখেনি। তারা চেয়েছে আমেরিকার নতুন বাজারে বাণিজ্য করতে, কারণ সেই বাণিজ্যের মাঝেই তারা নিজেদের সমৃদ্ধি দেখতে পেয়েছিল। স্প্যানিশ-পর্তুগীজদের একচেটিয়া বাণিজ্য তারা দেখতে আগ্রহী ছিল না। অন্যদিকে স্প্যানিশ-পর্তুগীজরা মনে করতো যে – আমরাই আমেরিকায় প্রথম এসেছি; আমরাই সেই ভূমি খুঁজে পেয়েছি অনেক কষ্ট করে; যদি কারও বাণিজ্য করার অধিকার সেখানে থাকে, তাহলে সেটা আমাদের। এটা ছিল একটা এলাকার বাণিজ্যসহ পুরো ভূমি কপিরাইট করার এক অনন্য উদাহরণ। আপাতদৃষ্টে এই মনোপলি ব্যাবসার বিরূদ্ধে ইংলিশদের একটা ভালো জাতি মনে হলেও পরবর্তীতে সারা বিশ্বে নিজেদের বাণিজ্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশরা ঠিক এই কাজটাই করেছে; তখন অবশ্য ব্রিটিশদের কাছে এটা মনে হয়েছে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার যুক্তিযুক্ত সংগ্রাম।
স্প্যানিশদের বাণিজ্য জাহাজগুলির হাত থেকে বাণিজ্যের কতৃত্ব ছিনিয়ে নেবার জন্যে ব্রিটিশরা তাদের বাণিজ্য জাহাজগুলিকে সাজাতো যুদ্ধজাহাজের আঙ্গিকে; নাবিকগুলিকেও তারা সেভাবেই নিত। |
বাণিজ্যের জন্যে জাহাজ, নাকি যুদ্ধের জন্যে?
ইংলিশ রাজ দেখেছেন তার দেশের উন্নতির দিকগুলি। যেকারণে তিনি তার দেশের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখেছেন। যেখানেই দরকার হয়েছে, সেখানেই তিনি ব্যবসায়ীদের সাথে অংশীদারীত্বে গিয়েছেন - ব্যবসা করার জন্যে নয়, বরং দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্যে। দেশের স্বার্থ এখানে সরকারী-বেসরকারী মালিকানার উর্ধে ছিল সবসময়। নিজের দেশের বাণিজ্যকে রক্ষা করার জন্যে সবকিছু করেছেন ইংলিশ রাজ। এমনকি যখন তারা এটা বুঝতে পেরেছেন যে স্প্যানিশ সমুদ্র বাণিজ্যে ভাগ বসানোর মাঝেই তাদের উন্নতি নিহিত, তখন তারা স্প্যানিশদের বিরূদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেও পিছপা হননি। এই ব্যাপারগুলিকে খুব হিংসাত্মক মনে হলেও এটা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে এরকম হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা পুঁজিবাদ স্বাভাবিকভাবেই তৈরি করে। কাজেই যতদিন পৃথিবীতে পুঁজিবাদী শাসন চালু থাকবে, ততদিন সব দেশেরই নিজের বাণিজ্যিক স্বার্থকে নিজেরই দেখতে হবে। এখানে লজ্জা পেয়ে অভদ্রতা মনে করে কেউ যদি অন্য কোন বাণিজ্য-শক্তিকে ছাড় দিয়ে বসে, সেটা হবে কৌশলগত দিক থেকে বিরাট এক ভুল। ব্রিটিশরা লজ্জা করেনি বলেই ছোট্ট একটা দেশ হয়েও তারা দুনিয়ার রাজা বনে গিয়েছিল। বাণিজ্য করা এবং বাণিজ্য রক্ষার মাঝে তারা কোন পার্থক্য করেনি। দুই-ই তাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেকারণে তাদের বাণিজ্য জাহাজের বহর দেখলে বোঝা সম্ভব ছিল না যে সেগুলি বাণিজ্যের জন্যে, নাকি যুদ্ধের জন্যে তৈরি। তাদের বাণিজ্য জাহাজের সব নাবিকেরাই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত থেকেছে সর্বদা। যেসব জাহাজ সরাসরি বিপক্ষের যুদ্ধজাহাজের বিরূদ্ধে যুদ্ধে নামেনি, সেসব জাহাজ সৈন্য পরিবহণ করেছে এবং উভচর অভিযানে অংশ নিয়েছে। বিপক্ষের সম্পদবাহী বাণিজ্য জাহাজ দখলের মাঝে তারা তাদের দেশের উন্নতিই শুধু দেখেনি, বরং এটা ছিল পরবর্তীতে বিংশ শতকের অর্থনৈতিক অবরোধ এবং যুদ্ধের চিন্তার শুরু। বিশেষ করে সমুদ্র বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল একটা দেশকে কুপোকাত করতে হলে সেই দেশের সমুদ্র বাণিজ্যকেই যে কুপোকাত করতে হবে, এই থিওরিটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি কারুর। বিপক্ষের বাণিজ্য জাহাজ আক্রমণ থেকে লজ্জাবশতঃ দূরে থাকলে নিজেদেরই ক্ষতি – এটা ইউরোপিয়দের মাঝে ব্রিটিশরাই প্রথম বুঝেছিল। নিজের উপরে এই থিওরি কার্যকর হলে কেমন লাগে, সেটাও অবশ্য ব্রিটিশরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান সাবমেরিন বহর ব্রিটেনকে না খাইয়ে মারার উপক্রম করেছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত, ১৮০৫ সাল। যদি কোম্পানি হয় বেসরকরারী সংস্থা, তাহলে তারা ভারতে রাজনীতি এবং সমরনীতিতে কি করছিল? তাহলে ১৮০৫ সালের এই ম্যাপ কি বেসরকারী না সরকারী?? |
দেশের স্বার্থ কি সরকারী-বেসরকারী বা সামরিক-বেসামরিকের মাঝে আলাদা?
দেশের স্বার্থের মাঝে সরকারী-বেসরকারী অথবা সামরিক-বেসামরিক কিছু নেই; দেশের স্বার্থ মানেই সেটাকে রক্ষা করতে হবে সর্বশক্তি দিয়ে – এটাই ছিল ড্রেইকের সময়ের পুঁজিবাদী সমাজের নীতিনির্ধারকদের চেতনা। এই চেতনার উপরে নির্ভর করেই তারা দুনিয়া শাসন করেছে এবং যেসব জাতির উপরে ছড়ি ঘুরিয়েছে, সেসব জাতির মাঝে যাতে এই চেতনাগুলির জন্ম না হয়, সেটার ব্যবস্থা করেছে। এমন এক বিশ্বব্যবস্থার জন্ম তারা দিয়েছে, যেখানে সমুদ্র বাণিজ্য থাকবে অল্প কিছু কোম্পানির হাতে, যেগুলির মালিকানা থাকবে পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলির হাতে। আর এই বিশ্বব্যবস্থা এমন একটা নিয়ম করে রাখবে, যার কারণে ওই বাণিজ্যকে চ্যালেঞ্জ করার একমাত্র পদ্ধতি থাকবে বেসামরিক-বাণিজ্যিক, যা কিনা বেশিরভাগ আপশ্চিমা দেশের জন্যে পুঁজিভিত্তিক অর্থনৈতিক কারণে সম্ভব হবে না। কাজেই যেকোন মুহূর্তে খুব সহজেই যেকোন দেশের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া বা অর্থনৈতিক যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হবে। অথচ ব্রিটিশসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলি যখন নিজেদের বাণিজিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তখন কিন্তু সামরিক-বেসামরিক কোন আলাদা কিছু ছিল না। আমরা সকলেই ভুলে যাই যে ভারতীয় উপমহাদেশ প্রথম একশ’ বছর শাসন করেছে ব্রিটিশ সরকার নয়, বরং ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি, যা কিনা প্রাচ্যে ব্রিটিশদের সকল বাণিজ্যের দেখভাল করতো। তারা সৈন্য এবং যুদ্ধজাহাজ দিয়ে উপমহাদেশের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি দখল করেছে এবং সকল ধরণের কূটকৌশল অবলম্বন করেছে এই দেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করে দেশের বাণিজ্যসহ স্থলভূমি দখল করে এদেশের মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করতে। তাহলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কি সরকারী প্রতিষ্ঠান ছিল, নাকি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ছিল? সামরিক প্রতিষ্ঠান ছিল, নাকি বেসামরিক? আজ আমাদের দেশের এফবিসিসিআই যদি ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো কাজ করতে যায়, তাহলে শুধু উদ্ভটই শোনাবে না, পশ্চিমা শক্তিগুলি তাদের কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক সকল শক্তিকে কাজে লাগাবে এই ধরনের কার্যকলাপের বিরূদ্ধে। যে কাজটা পশ্চিমা দেশগুলি একসময় নির্দ্বিধায় করেছে, সেটাকে তারা আজ খারাপ বলবে – এটা হতে পারে না। বরং তারা চায় না যে তাদের পথ অনুসরণ করে তাদেরই সাম্রাজ্য অন্য কেউ দখল করে নিক। চীনারা যখন এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় তাদের বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য বৃদ্ধি করে, পশ্চিমা দেশগুলি তখন এই বিপদটাই দেখে। চীনারাও গত কয়েকশ’ বছরের ইতিহাস ভুলে না গিয়ে তাদের বাণিজ্য জাহাজের পিছনে পিছনে যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে ভুলেনি। তারা পশ্চিমা ক্রীতদাসের শৃংখল থেকে বের হয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টায় রত।
বিখ্যাত মার্কিন জিওস্ট্র্যাটেজিস্ট এবং জিওপলিটিশিয়ান আলফ্রেড মাহান একটা জাতিকে ম্যারিটাইম জাতিতে পরিণত করতে ‘রিজার্ভের’ কথা বলেছিলেন। এই রিজার্ভে তিনি বলেছিলেন সেই জাতির সী-ফেয়ারিং মানুষের সংখ্যার কথা – অর্থাৎ কত মানুষ সমুদ্র-চারণের উপরে নির্ভরশীল। সেই দেশের সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনা করা ছাড়াও সেই জাহাজ তৈরি এবং মেরামতের দক্ষ জনশক্তিকে মাহান রিজার্ভের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ষোড়শ শতকে ব্রিটিশ নাবিক এবং পরবর্তীতে রয়্যাল নেভির এডমিরাল ফ্রান্সিস ড্রেইক যখন তার জাহাজে সম্ভ্রান্ত যুবকদের ট্রেনিং দিচ্ছিলেন, তখন কিন্তু তিনিও এই ‘রিজার্ভ’ তৈরি করছিলেন। এই রিজার্ভই পবর্তীতে ব্রিটিশদের নৌবাহিনীকে করেছে জগদ্বিখ্যাত। মাহান সামরিক সমুদ্রশক্তিকে বেসামরিক সমুদ্রশক্তির পিছনে রেখেছিলেন। কারণ তার কথায় বাণিজ্য জাহাজ ছাড়া একটা জাতি খামোকা যুদ্ধজাহাজ বানাবে না। আর বাণিজ্য জাহাজ চালাতে না জানলে সেই জাতি সমুদ্রকেও চিনবে না এবং যুদ্ধজাহাজও চালাতে শিখবে না; অর্থাৎ সেই জাতির ম্যারিটাইম জাতি হবার কোন সম্ভাবনাই থাকবে না।
ব্রিটিশরা যখন দুনিয়ার দখল নিয়েছিল, তখন তারা সামরিক-বেসামরিক বা সরকারী-বেসারকারীর মাঝে দাগ টানেনি। কিন্তু তাদের উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা দেবার সময় কিন্তু এই দাগগুলি টেনে দিতে তারা ভুলেনি |
আসলে চিন্তার ভিত্তিটা কোথায়?
এই সামরিক-বেসামরিক আলোচনার ইতি টানতে ষোড়শ শতকে তৈরি ব্রিটেনের ‘এডমিরালটি এন্ড ম্যারিন এফেয়ার্স’ অফিসের দিকে তাকাতে হবে। এই অফিস তাদের ম্যারিটাইম সকল কিছু দেখাশুনা করতো, যার সর্বোচ্চ পদাধারী ছিলেন লর্ড হাই এডমিরাল, যিনি বেশিরভাগ সময়েই ছিলেন একজন রাজনৈতিক ব্যাক্তি। তার দায়িত্ব বর্তমান যুগের বাণিজ্য, নৌ, নৌবাহিনী এবং কোস্ট-গার্ড একত্র করে মন্ত্রণালয় তৈরি করলে সেটার সমান হতে পারে। তার অধীনে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন ভাইস এডমিরাল অব ইংল্যান্ড, যিনি ছিলেন আসলে নেভি-এর চীফ অব স্টাফ। নৌবাহিনীর ব্যাপারে তিনি সিভিলিয়ান লর্ড হাই এডমিরালকে উপদেশ দিতেন। এই দু’জনের নিচে একই এডমিরালটি অফিসের অধীনে ছিল অর্ডন্যান্স, ট্রেজারার, সার্ভেয়র, কন্ট্রোলার এবং ক্লার্ক, যারা জাহাজ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতেন এবং ম্যারিটাইম শক্তি ধরে রাখার জন্যে সব ধরনের রিজার্ভের দিকে খেয়াল রাখতেন। নৌ-বিষয়ক সকল কিছু একটা অফিসের অধীনে হওয়াতে সমুদ্রকেন্দ্রিক জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে সবসময় একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এই নীতিই কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমানে চালু আছে। এই নীতির সুবিধা হিসেবে উদাহরণস্বরূপ বলা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাহাজের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে। ব্রিটেনের বেশিরভাগ ফিশিং ট্রলারই মিলিটারি সার্ভিসের জন্যে উপযুক্ত ছিল এবং শত শত জাহাজ নৌবহরে শুধু যুক্তই হয়নি, বেসামরিক জাহাজের ডিজাইন কপি করে হাজার হাজার জাহাজ তৈরি করা হয়েছিল যেগুলি যুদ্ধের সময়ে জার্মান সাবমেরিনের হাত থেকে আটলান্টিক নৌ-বাণিজ্যপথ রক্ষা করতে এন্টি-সাবমেরিন জাহাজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, অথবা নৌপথ নিরাপদ রাখতে মাইন-সুইপার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, অথবা প্যাট্রোল বোট হিসেবে ব্রিটিশ উপকূল রক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়েও ব্রিটিশরা অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সিভিলিয়ান লাইনার জাহাজ সৈন্য পরিবহণের জন্যে প্রস্তুত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আটলান্টিক মহাসাগরের পরিবহণ জাহাজের কনভয়গুলির কমান্ডার থাকতেন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ নৌবাহিনী অফিসার। এগুলি সম্ভব হতো না কোনদিনই যদি ব্রিটিশদের ম্যারিটাইম চিন্তায় সরকারী-বেসরকারী বা সামরিক-বেসামরিক চিন্তার বিভেদ থাকতো।
বাংলাদেশ ইতিহাসের এমন একটা অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে সমুদ্র নিয়ে। আমরা চিন্তা কোন ভিত্তির উপরে করবো, সেটার উপরে নির্ভর করবে চিন্তাটা কতটা শক্তিশালী হবে। অন্যের তৈরি করে দেওয়া ভিত্তির উপরে দাঁড়াতে চাইলে অন্যের স্বার্থই দেখা হবে। তবে এটাও জেনে রাখা প্রয়োজন যে নিজেদের ভিত্তি নিজেরা তৈরি করতে চাইলে যেসব বাধা আসবে সামনে, সেগুলি অতিক্রম করার মতো শক্ত নীতি-নির্ধারনী ভূমিকা নিতে পারার মতো স্বাধীনতা আমাদের নেতৃত্বের থাকতে হবে।
আপনার লেখা পড়ে আগ্রহ বোধ করছি এ বিষয়ে।অসাধারণ লিখেছেন।এই নিয়ে পড়াশোনা করার মত কোন বই বা ওয়েবসাইট সাজেস্ট করলে একটু উপকার হত
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ কমেন্ট করার জন্যে।
Deleteআমি প্রাথমিকভাবে শুধু বইয়ের কথা বলবো না। বর্তমানে ওয়েবে অনেক তথ্য আছে এবং বইও আছে। যেকোন একটি টপিক, যেটা আপনি আগ্রহ মনে করছেন, সেটা নিয়ে ওয়েবে খোঁজ করে শুরু করতে পারেন। খোঁজের ফাঁকেই আশা করি আপনি বুঝে ফেলবেন যে কোন বিষয়ে বই আপনার জন্যে ভালো হবে। আমি বলবো যে বিশেষ কোন বিষয়ের সাথে যে ব্যাক্তিগুলির সম্পৃক্ততা রয়েছে, সেই ব্যাক্তিগুলির লেখা বই খোঁজ করতে পারেন। যেমন এই লেখায় ফ্রান্সিস ড্রেইককে নিয়ে লেখা হয়েছে, তবে ড্রেইকের পুরো জীবন নিয়ে লেখা হয়নি; শুধুমাত্র যেটা আমাদের জন্যে প্রযোজ্য, সেটা নিয়ে লেখা হয়েছে।
ধন্যবাদ স্যার।
ReplyDeleteব্রিটিশরা যখন দুনিয়ার দখল নিয়েছিল, তখন তারা সামরিক-বেসামরিক বা সরকারী-বেসারকারীর মাঝে দাগ টানেনি। কিন্তু তাদের উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা দেবার সময় কিন্তু এই দাগগুলি টেনে দিতে তারা ভুলেনি - এই দাগগুলি যদি একটু বলতেন তাইলে আরও বেশ কিছু ধারণা পেতাম।