১০ই নভেম্বর ২০১৬
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদীর উপরে ১৯৩০-এর দশকে নির্মিত হয়েছিল হুভার ড্যাম বা হুভার বাঁধ। সেসময়ের চরম অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার পেছনে এই বাঁধের গুরুত্ব ছিল বিপুল। হাজার পাঁচেক মানুষ এখানে কাজ করেছিল, যাদের থাকার জায়গা দিতে সেখানে একটা শহর তৈরি করা হয়েছিল। ৩৩ লক্ষ কিউবিক মিটার কনক্রিট ব্যবহার করা হয়েছিল এতে; ব্যবহার করা হয়েছিল অনেক নতুন নতুন প্রযুক্তি, যা কিনা এর আগে কোনদিন ব্যবহার করা হয়নি। ১৯৩৬ সালে বাঁধটি যখন চালু করা হয়, তখন এটি ছিল পৃথিবীর সবচাইতে বড় কনক্রিট স্থাপনা। বাঁধ ১,৩৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত উতপাদন করে সেই বিদ্যুত বিক্রি করে বাঁধের ঋণ শোধ করা হয়েছিল। বাঁধের মূল সুফল পেয়েছিল ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ। ১০ লক্ষ একর চাষের জমিতে সেচের ব্যবস্থা হয়েছিল। ছয়টি মার্কিন কোম্পানি একত্রিত হয়ে বাঁধটি তৈরি করে এমন সময়, যখন পুরো পশ্চিমা বিশ্বে কাজের হাহাকার চলচিল। হ্যাঁ, এগুলি অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক সুফল বয়ে এনেছিল। কিন্তু হুভার ড্যাম কি আসলেই শুধুমাত্র একটা অর্থনৈতিক স্থাপনা ছিল? আজ কিন্তু এই ড্যামের চাইতে অনেক বড় বড় ড্যাম তৈরি হয়ে গেছে? এটাকি তাহলে আজ গুরুত্বহীন? এই ব্যাপারটা বুঝতে হলে একটু ভিন্ন দিক থেকে চিন্তা করে দেখতে হবে।
হুভার ড্যাম থেকে গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার
হুভার ড্যাম তৈরি করেছিল সেই আমেরিকা, যা কিনা ড্যাম তৈরি করার পাঁচ বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, এবং আরও চার বছরের মাথায় পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী দেশরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। চীনের ইয়াংজি নদীর উপরে তৈরি Three Gorges Dam দেখে সারা বিশ্বের মানুষ যেমন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল, হুভার ড্যাম তার চাইতে কয়েক গুণ বেশি প্রভাব ফেলেছিল। এই স্থাপনা মার্কিনীদের material power-এর সক্ষমতার জানান দিয়েছিল। আর মার্কিনীরাও তাদের ক্ষমতাকে নতুন করে টের পেয়েছিল। এই ক্ষমতার আস্বাদন পুরোপুরি পেতে অবশ্য তাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জেতা অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। হুভার ড্যাম ছিল একটা Springboard, যার উপরে পা দিয়ে তারা এক লাফে মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিতে আমেরিকানদের রাজি করানোটা খুবই কঠিন ছিল। তারা মনে করতো যে ওটা ইউরোপিয়ানদের যুদ্ধ, আমেরিকার যুদ্ধ নয়। দুনিয়াটাকে মার্কিনীরা তখনও তাদের করে নিতে শেখেনি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। যখন হিটলার পুরো ইউরোপ দখল করে নিচ্ছিল, তখন মার্কিনীরা চেয়ে চেয়ে দেখছিল। শুধুমাত্র জাপানের আক্রমণই মার্কিনীদের যুদ্ধে নামিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই জানতেন যে মার্কিনীদের যুদ্ধে জড়াতেই হবে। আর কেউ কেউ আবার মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন যে জাপানীর মার্কিনীদের আক্রমণ করে বসেছিল – কারণ তারা মনে করতেন যে জাপানীরা আক্রমণ না করলে তো এই অলস মার্কিনীদের দিয়ে মহাসাগর পাড়ি দেয়ানো যাবে না। কিন্তু মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যুদ্ধ করতে পারার মতো মানসিক সক্ষমতা তাদেরকে দিয়েছিল সেই হুভার ড্যাম। এই ড্যাম মার্কিনীদের সেই আত্মবিশ্বাস গড়ে দিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাম হয়ে যায় গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার (Arsenal of Democracy)। হুভার ড্যাম তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখা মার্কিন ব্যবসায়ী হেনরি জে. কাইজার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বিরাট সংখ্যক জাহাজ নির্মান করেন। তার শিপইয়ার্ডে ৮০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছিল। হুভার ড্যাম কাইজারের মতো আরও অনেক লোক তৈরি করেছিল, যারা পরবর্তীতে বিশ্বযুদ্ধ জয়ে বিরাট অবদান রেখেছিল।
অধঃপতনের পথে….
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিনীদের চিন্তাগুলিকে material রূপ দিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল হুভার ড্যাম এবং তার ঠিক পরবর্তী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখন ছিল মার্কিন চেতনার উচ্ছ্বাসের সময়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে টানা ৪৫ বছর ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝ দিয়ে এই চেতনার উল্লম্ফন আমরা দেখেছি। প্রযুক্তিগত উত্তরণের পথে তারা বিরাট সাফল্য দেখিয়েছে। তখন ছিল আদর্শিক যুদ্ধের চরম অবস্থা; জিততে না পারলে জীবনটাই বৃথা। সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। আফগানিস্তানে হঠাত যুদ্ধে হেরে যাবার ফলাফল যে এটা হতে পারে, তা ছিল সকলের কল্পনার বাইরে। রাতারাতি মার্কিনীরা সেই শত্রুকে হারালো, যার ভয় দেখিয়ে তারা শিশুদের ঘুম পাড়াতো, ব্যাংকার-স্টক ব্রোকারদের সামরিক ট্রেনিং দিতো, মাল্টিবিলিয়ন ডলার খরচ করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতো। শত্রু নাই তো অস্ত্রের উদ্দেশ্যও নাই। ২০০১ সাল থেকে অফিশিয়ালি এমন এক শত্রুকে মার্কিনীরা ধরে নিয়ে এলো, যার আসলে কোন শারীরিক অস্তিত্ব নেই। যার অস্তিত্ব নেই তাকে তারা মারবে কি করে? এখানেই হয়ে গেল সমস্যা। এই শত্রুকে মার্কিনীরা খুঁজে পাচ্ছে না; বুঝতে পারছে না। একুশ শতকের আমেরিকা এগুলি বুঝতে পারছে না। হুভার ড্যাম এখন অনেক পুরোনো কথা। সেই ড্যাম এখন আর আমেরিকানদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় না। ফেসবুক সেলফি, কিম কার্দাশিয়ান, বা WWE Wrestling এখন তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প-হিলারির প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট-এ এন্টারটেইনমেন্ট না থাকলে মানুষ সেটা দেখে না। অনুষ্ঠানের টিআরপি বেশি গুরুত্বপূর্ণ; ব্যবসা তো করতে হবে তাই না? অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়; কি আর করা? এই আমেরিকা এখন আর কিসিঞ্জার-ব্রেজিনস্কিদের মতো মারদাঙ্গা আদর্শিক চিন্তাবিদদের রাষ্ট্র নয়।
চিন্তার অধঃপতনের সাথে সাথে material power-এরও অধঃপতন হয়েছে। এই মুহুর্তে পৃথিবীর কোথাও আরেকটা যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়ে সেখান থেকে সফলভাবে বের হয়ে আসার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তার অর্থনীতি এখন আমদানি-নির্ভর। তারা এখন তেমন কিছুই তৈরি করে না; সব আমদানি করে। এমনকি গণতন্ত্রের অস্ত্রাগারের অবস্থাও এখন খারাপের দিকে। একটা যুদ্ধবিমান (F-35) এবং একটা যুদ্ধজাহাজ (Littoral Combat Ship) ডিজাইন করতে গিয়ে তাদের যা অবস্থা হয়েছে, তাতে এটা অস্ত্রাগার থেকে কোন একসময় ভাগাড়ে রূপ নিতে পারে। অবশ্য মার্কিন নেতৃত্বের ভাগাড়-সদৃশ প্রতিযোগিতাই দেখিয়ে দিয়েছে তারা কোন দিকে যাচ্ছে। একটা ক্ষয়িষ্ণু শক্তির করুণ চেহারা দিনে দিনে ফুটে উঠছে। ক’দিন আগেই ফিলিপাইনকে হারিয়েছে তারা। এর আগে হারিয়েছে থাইল্যান্ডকে। এই দুই দেশই ছিল তাদের বহুকালের স্যাটেলাইট দেশ। বিভিন্ন অঞ্চলে মার্কিনীরা “বন্ধু” দেশের উপরে নির্ভর করছে পুলিশম্যানের কাজ করার জন্যে। এই আমেরিকা হুভার ড্যামের আমেরিকা নয়। এই আমেরিকা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতি-ধর্ম বিদ্বেষযুক্ত কটূক্তিতে আসক্ত আমেরিকা। তবে হুভার ড্যামের একটা ব্যাপারের সাথে এখানে মিল পাওয়া যাবে – সেই ড্যাম তৈরিতে মাত্র ৩০ জন কালো চামড়ার মানুষকে নেয়া হয়েছিল। এটাই বলে দেয় যে মার্কিন সভ্যতা কিসের উপরে প্রতিষ্ঠিত। ডোনাল্ড ট্রাম্প একুশ শতকে ওই ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতারই হাল ধরতে যাচ্ছেন।
হুভার ড্যাম এবং পদ্মা সেতু
এখন আসি আমাদের কথায়। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির কেলেংকারির কথা যখন তুঙ্গে, তখন না বুঝলেও এখন মানুষ বুঝতে পারছে যে আলোচনার বিষবস্তু আসলে ছিল এই সেতু তৈরিতে দুর্নীতি হয়ছিল কিনা সেটা নয়, বরং এই সেতু আদৌ তৈরি হবে কি হবে না, সেটা। তারা এই প্রশ্নটি তুলেছিল, কারণ তারা বঙ্গোপসাগরের ফানেলের গোড়ায় একটা Springboard দেখতে পাচ্ছিল; তারা দেখতে পাচ্ছিল হুভার ড্যামের প্রতিচ্ছবি। পদ্মা সেতু ভারত মহাসাগরে একটা ভূমিকম্পের জন্ম দেবে, যার থেকে সৃষ্ট সুনামি পুরো মহাসাগরের উপকূল ছাপিয়ে যাবে। রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকদের আত্মবিশ্বাসকে উঠিয়ে ধরতে এই সেতু যে কাজটি করবে, তা পরিমাপ করা দুষ্কর। এই Springboard জন্ম দেবে এমন আরও অনেক Springboard-এর। এর আগের লেখায় একটা Springboard নিয়ে আলোচনা করেছি, যা কিনা বহুদূর নিয়ে যেতে পারে খুব অল্প সময়ের মাঝেই।
চিন্তার উত্তরণ নিয়ে অনেক লিখেছি। এখন চিন্তাকে material রূপ দেয়ার সময়। Material Progress-এর পথে যতো বাধা আসবে সব সাফ করতে হবে কঠোরভাবে। যারা গুলশানের রক্তাক্ত ঘটনা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের পরেও বুঝে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে আসল টার্গেট কারা, তারা হয়তো কখনোই বুঝবেন না। বুঝতে বাকি থাকা উচিত নয় যে এই জঘন্য ব্যাপারগুলি ঘটানো হচ্ছে ভারত মহাসাগরে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের উত্থান ঠেকাতে। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলি যখন মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে চোখের পানি ফেলছে, তখন প্রশ্ন করতেই হয় যে “তাদের নেতা” কি আসলেই “আমাদের নেতা” কিনা? তারা এমন চিন্তা করে কারণ স্ট্যাচু অব লিবার্টি তাদের তীর্থ। প্রভূর সুখ-দুঃখের ভাগীদার হতে তাধিং তাধিং করে নাচতে নাচতে সাত-সমুদ্র তারা পাড়ি দিয়ে দেয়; বাংলাদেশের জন্যে তারা একটা নদী বা খালও পাড়ি দেবে না। তাদের জন্যে পদ্মা সেতু Springboard নয়, বরং হুভার ড্যামের প্রতিযোগী। পদ্মা সেতুতে তারা ভারত মহাসাগরে মার্কিন কর্তৃত্বের ধ্বংসের ছায়া দেখতে পায়। আর ভারত মহাসাগরে কর্তৃত্ব হারানোর চিন্তায় মার্কিনীদের সারা দুনিয়ার উপরে কর্তৃত্ব ছুটে যায়; ঘুম হারাম হয়। আটলান্টিকের ওপারের ক্ষয়িষ্ণু রাষ্ট্রের নেতৃত্ব আমাদের জন্যে কাঁসার পাতে কয় দানা বাশি ভাত রেখেছে, সেটা আজ আমাদের চিন্তা নয়। বরং চিন্তা হচ্ছে আর কি কি Springboard আমরা নিয়ে আসবো, যা কিনা আমাদের material শক্তিকে অপ্রতিরোধ্য গতি দেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদীর উপরে ১৯৩০-এর দশকে নির্মিত হয়েছিল হুভার ড্যাম বা হুভার বাঁধ। সেসময়ের চরম অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার পেছনে এই বাঁধের গুরুত্ব ছিল বিপুল। হাজার পাঁচেক মানুষ এখানে কাজ করেছিল, যাদের থাকার জায়গা দিতে সেখানে একটা শহর তৈরি করা হয়েছিল। ৩৩ লক্ষ কিউবিক মিটার কনক্রিট ব্যবহার করা হয়েছিল এতে; ব্যবহার করা হয়েছিল অনেক নতুন নতুন প্রযুক্তি, যা কিনা এর আগে কোনদিন ব্যবহার করা হয়নি। ১৯৩৬ সালে বাঁধটি যখন চালু করা হয়, তখন এটি ছিল পৃথিবীর সবচাইতে বড় কনক্রিট স্থাপনা। বাঁধ ১,৩৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত উতপাদন করে সেই বিদ্যুত বিক্রি করে বাঁধের ঋণ শোধ করা হয়েছিল। বাঁধের মূল সুফল পেয়েছিল ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ। ১০ লক্ষ একর চাষের জমিতে সেচের ব্যবস্থা হয়েছিল। ছয়টি মার্কিন কোম্পানি একত্রিত হয়ে বাঁধটি তৈরি করে এমন সময়, যখন পুরো পশ্চিমা বিশ্বে কাজের হাহাকার চলচিল। হ্যাঁ, এগুলি অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক সুফল বয়ে এনেছিল। কিন্তু হুভার ড্যাম কি আসলেই শুধুমাত্র একটা অর্থনৈতিক স্থাপনা ছিল? আজ কিন্তু এই ড্যামের চাইতে অনেক বড় বড় ড্যাম তৈরি হয়ে গেছে? এটাকি তাহলে আজ গুরুত্বহীন? এই ব্যাপারটা বুঝতে হলে একটু ভিন্ন দিক থেকে চিন্তা করে দেখতে হবে।
হুভার ড্যাম থেকে গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার
হুভার ড্যাম তৈরি করেছিল সেই আমেরিকা, যা কিনা ড্যাম তৈরি করার পাঁচ বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, এবং আরও চার বছরের মাথায় পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী দেশরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। চীনের ইয়াংজি নদীর উপরে তৈরি Three Gorges Dam দেখে সারা বিশ্বের মানুষ যেমন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল, হুভার ড্যাম তার চাইতে কয়েক গুণ বেশি প্রভাব ফেলেছিল। এই স্থাপনা মার্কিনীদের material power-এর সক্ষমতার জানান দিয়েছিল। আর মার্কিনীরাও তাদের ক্ষমতাকে নতুন করে টের পেয়েছিল। এই ক্ষমতার আস্বাদন পুরোপুরি পেতে অবশ্য তাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জেতা অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। হুভার ড্যাম ছিল একটা Springboard, যার উপরে পা দিয়ে তারা এক লাফে মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিতে আমেরিকানদের রাজি করানোটা খুবই কঠিন ছিল। তারা মনে করতো যে ওটা ইউরোপিয়ানদের যুদ্ধ, আমেরিকার যুদ্ধ নয়। দুনিয়াটাকে মার্কিনীরা তখনও তাদের করে নিতে শেখেনি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। যখন হিটলার পুরো ইউরোপ দখল করে নিচ্ছিল, তখন মার্কিনীরা চেয়ে চেয়ে দেখছিল। শুধুমাত্র জাপানের আক্রমণই মার্কিনীদের যুদ্ধে নামিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই জানতেন যে মার্কিনীদের যুদ্ধে জড়াতেই হবে। আর কেউ কেউ আবার মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন যে জাপানীর মার্কিনীদের আক্রমণ করে বসেছিল – কারণ তারা মনে করতেন যে জাপানীরা আক্রমণ না করলে তো এই অলস মার্কিনীদের দিয়ে মহাসাগর পাড়ি দেয়ানো যাবে না। কিন্তু মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যুদ্ধ করতে পারার মতো মানসিক সক্ষমতা তাদেরকে দিয়েছিল সেই হুভার ড্যাম। এই ড্যাম মার্কিনীদের সেই আত্মবিশ্বাস গড়ে দিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাম হয়ে যায় গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার (Arsenal of Democracy)। হুভার ড্যাম তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখা মার্কিন ব্যবসায়ী হেনরি জে. কাইজার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বিরাট সংখ্যক জাহাজ নির্মান করেন। তার শিপইয়ার্ডে ৮০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছিল। হুভার ড্যাম কাইজারের মতো আরও অনেক লোক তৈরি করেছিল, যারা পরবর্তীতে বিশ্বযুদ্ধ জয়ে বিরাট অবদান রেখেছিল।
অধঃপতনের পথে….
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিনীদের চিন্তাগুলিকে material রূপ দিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল হুভার ড্যাম এবং তার ঠিক পরবর্তী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখন ছিল মার্কিন চেতনার উচ্ছ্বাসের সময়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে টানা ৪৫ বছর ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝ দিয়ে এই চেতনার উল্লম্ফন আমরা দেখেছি। প্রযুক্তিগত উত্তরণের পথে তারা বিরাট সাফল্য দেখিয়েছে। তখন ছিল আদর্শিক যুদ্ধের চরম অবস্থা; জিততে না পারলে জীবনটাই বৃথা। সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। আফগানিস্তানে হঠাত যুদ্ধে হেরে যাবার ফলাফল যে এটা হতে পারে, তা ছিল সকলের কল্পনার বাইরে। রাতারাতি মার্কিনীরা সেই শত্রুকে হারালো, যার ভয় দেখিয়ে তারা শিশুদের ঘুম পাড়াতো, ব্যাংকার-স্টক ব্রোকারদের সামরিক ট্রেনিং দিতো, মাল্টিবিলিয়ন ডলার খরচ করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতো। শত্রু নাই তো অস্ত্রের উদ্দেশ্যও নাই। ২০০১ সাল থেকে অফিশিয়ালি এমন এক শত্রুকে মার্কিনীরা ধরে নিয়ে এলো, যার আসলে কোন শারীরিক অস্তিত্ব নেই। যার অস্তিত্ব নেই তাকে তারা মারবে কি করে? এখানেই হয়ে গেল সমস্যা। এই শত্রুকে মার্কিনীরা খুঁজে পাচ্ছে না; বুঝতে পারছে না। একুশ শতকের আমেরিকা এগুলি বুঝতে পারছে না। হুভার ড্যাম এখন অনেক পুরোনো কথা। সেই ড্যাম এখন আর আমেরিকানদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় না। ফেসবুক সেলফি, কিম কার্দাশিয়ান, বা WWE Wrestling এখন তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প-হিলারির প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট-এ এন্টারটেইনমেন্ট না থাকলে মানুষ সেটা দেখে না। অনুষ্ঠানের টিআরপি বেশি গুরুত্বপূর্ণ; ব্যবসা তো করতে হবে তাই না? অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়; কি আর করা? এই আমেরিকা এখন আর কিসিঞ্জার-ব্রেজিনস্কিদের মতো মারদাঙ্গা আদর্শিক চিন্তাবিদদের রাষ্ট্র নয়।
চিন্তার অধঃপতনের সাথে সাথে material power-এরও অধঃপতন হয়েছে। এই মুহুর্তে পৃথিবীর কোথাও আরেকটা যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়ে সেখান থেকে সফলভাবে বের হয়ে আসার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তার অর্থনীতি এখন আমদানি-নির্ভর। তারা এখন তেমন কিছুই তৈরি করে না; সব আমদানি করে। এমনকি গণতন্ত্রের অস্ত্রাগারের অবস্থাও এখন খারাপের দিকে। একটা যুদ্ধবিমান (F-35) এবং একটা যুদ্ধজাহাজ (Littoral Combat Ship) ডিজাইন করতে গিয়ে তাদের যা অবস্থা হয়েছে, তাতে এটা অস্ত্রাগার থেকে কোন একসময় ভাগাড়ে রূপ নিতে পারে। অবশ্য মার্কিন নেতৃত্বের ভাগাড়-সদৃশ প্রতিযোগিতাই দেখিয়ে দিয়েছে তারা কোন দিকে যাচ্ছে। একটা ক্ষয়িষ্ণু শক্তির করুণ চেহারা দিনে দিনে ফুটে উঠছে। ক’দিন আগেই ফিলিপাইনকে হারিয়েছে তারা। এর আগে হারিয়েছে থাইল্যান্ডকে। এই দুই দেশই ছিল তাদের বহুকালের স্যাটেলাইট দেশ। বিভিন্ন অঞ্চলে মার্কিনীরা “বন্ধু” দেশের উপরে নির্ভর করছে পুলিশম্যানের কাজ করার জন্যে। এই আমেরিকা হুভার ড্যামের আমেরিকা নয়। এই আমেরিকা ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতি-ধর্ম বিদ্বেষযুক্ত কটূক্তিতে আসক্ত আমেরিকা। তবে হুভার ড্যামের একটা ব্যাপারের সাথে এখানে মিল পাওয়া যাবে – সেই ড্যাম তৈরিতে মাত্র ৩০ জন কালো চামড়ার মানুষকে নেয়া হয়েছিল। এটাই বলে দেয় যে মার্কিন সভ্যতা কিসের উপরে প্রতিষ্ঠিত। ডোনাল্ড ট্রাম্প একুশ শতকে ওই ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতারই হাল ধরতে যাচ্ছেন।
হুভার ড্যাম এবং পদ্মা সেতু
এখন আসি আমাদের কথায়। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির কেলেংকারির কথা যখন তুঙ্গে, তখন না বুঝলেও এখন মানুষ বুঝতে পারছে যে আলোচনার বিষবস্তু আসলে ছিল এই সেতু তৈরিতে দুর্নীতি হয়ছিল কিনা সেটা নয়, বরং এই সেতু আদৌ তৈরি হবে কি হবে না, সেটা। তারা এই প্রশ্নটি তুলেছিল, কারণ তারা বঙ্গোপসাগরের ফানেলের গোড়ায় একটা Springboard দেখতে পাচ্ছিল; তারা দেখতে পাচ্ছিল হুভার ড্যামের প্রতিচ্ছবি। পদ্মা সেতু ভারত মহাসাগরে একটা ভূমিকম্পের জন্ম দেবে, যার থেকে সৃষ্ট সুনামি পুরো মহাসাগরের উপকূল ছাপিয়ে যাবে। রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকদের আত্মবিশ্বাসকে উঠিয়ে ধরতে এই সেতু যে কাজটি করবে, তা পরিমাপ করা দুষ্কর। এই Springboard জন্ম দেবে এমন আরও অনেক Springboard-এর। এর আগের লেখায় একটা Springboard নিয়ে আলোচনা করেছি, যা কিনা বহুদূর নিয়ে যেতে পারে খুব অল্প সময়ের মাঝেই।
চিন্তার উত্তরণ নিয়ে অনেক লিখেছি। এখন চিন্তাকে material রূপ দেয়ার সময়। Material Progress-এর পথে যতো বাধা আসবে সব সাফ করতে হবে কঠোরভাবে। যারা গুলশানের রক্তাক্ত ঘটনা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের পরেও বুঝে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে আসল টার্গেট কারা, তারা হয়তো কখনোই বুঝবেন না। বুঝতে বাকি থাকা উচিত নয় যে এই জঘন্য ব্যাপারগুলি ঘটানো হচ্ছে ভারত মহাসাগরে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের উত্থান ঠেকাতে। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলি যখন মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে চোখের পানি ফেলছে, তখন প্রশ্ন করতেই হয় যে “তাদের নেতা” কি আসলেই “আমাদের নেতা” কিনা? তারা এমন চিন্তা করে কারণ স্ট্যাচু অব লিবার্টি তাদের তীর্থ। প্রভূর সুখ-দুঃখের ভাগীদার হতে তাধিং তাধিং করে নাচতে নাচতে সাত-সমুদ্র তারা পাড়ি দিয়ে দেয়; বাংলাদেশের জন্যে তারা একটা নদী বা খালও পাড়ি দেবে না। তাদের জন্যে পদ্মা সেতু Springboard নয়, বরং হুভার ড্যামের প্রতিযোগী। পদ্মা সেতুতে তারা ভারত মহাসাগরে মার্কিন কর্তৃত্বের ধ্বংসের ছায়া দেখতে পায়। আর ভারত মহাসাগরে কর্তৃত্ব হারানোর চিন্তায় মার্কিনীদের সারা দুনিয়ার উপরে কর্তৃত্ব ছুটে যায়; ঘুম হারাম হয়। আটলান্টিকের ওপারের ক্ষয়িষ্ণু রাষ্ট্রের নেতৃত্ব আমাদের জন্যে কাঁসার পাতে কয় দানা বাশি ভাত রেখেছে, সেটা আজ আমাদের চিন্তা নয়। বরং চিন্তা হচ্ছে আর কি কি Springboard আমরা নিয়ে আসবো, যা কিনা আমাদের material শক্তিকে অপ্রতিরোধ্য গতি দেবে।
I am reading your blogs now. I believe I'll find another point of view for thinking about my surroundings.
ReplyDelete