Saturday, 23 April 2016

বাংলাদেশের নৌশক্তি ঠেকাতে মরিয়া ভারত

২৩ এপ্রিল ২০১৬




যখন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্যে সাবমেরিন কেনার কথা প্রকাশ হলো, তখন এদেশের বহুল বিক্রিত কিছু পত্রিকায় সাবমেরিনের বিরুদ্ধে লেখা শুরু হলো। নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীকে টার্গেট করা ওই মহল কি চাইছে, সেটা বুঝতে কষ্ট ছিল না বলেই তখন সাবমেরিনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কিছু লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। বাংলাদেশের নৌবাহিনীর সাবমেরিন কেনার ব্যাপারে পার্শ্ববর্তী দেশের কিছু বলার থাকতে পারে কি? কিন্তু তারা ঠিক সেটাই তখন করেছিলেন। ২০১৩-এর ডিসেম্বরে ভারতীয় নৌবাহিনীর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ‘দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া’ প্রশ্ন করে, “Why would Bangladesh need submarines? This decision by the government there and the ongoing strife in the country is a matter of concern for us”. এভাবে তারা তাদের চিন্তার কথাই শুধু জানান দেননি, এদেশে কারা তাদের পক্ষ হয়ে কাজ করছেন, তাদের মুখোশ উন্মোচনেও তারা সাহায্য করেছেন।


দিল্লীতে চিন্তায় আছেন অনেকে...
২০১৫-এর ফেব্রুয়ারীতে ‘দ্যা ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনে এক লেখায় বাংলাদেশের ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনীর পরিকল্পনা নিয়ে লিখেন Wikistrat-এর গবেষক পুষন দাস। সাবমেরিন সম্পর্কে তিনি লিখেন, “The addition of offensive vessels like submarines, however, suggests that Dhaka still views India and Myanmar’s interest in the region as a threat or that it wants to harness capabilities that will help it to be taken a serious regional player”. পরিষ্কারভাবেই দিল্লী এখন চিন্তা করতে শুরু করেছে যে বাংলাদেশ দিল্লীর কথা মোতাবেক চলছে না। যদি এখানে পরিষ্কার না হয় যে দিল্লীতে অনেকে বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন, তাহলে “based on its envisaged “Force Goal 2030,” the possible rise of a regional naval power in the Bay of Bengal is sure to ruffle a few feathers in New Delhi” – এই কথাগুলি সেটা একেবারেই খোলাসা করে দিচ্ছে। সাবমেরিন ক্রয়ের ঘোষণা দিল্লীকে নাড়া দিয়েছে এটা নিশ্চিত। তবে এর মাঝেই বাংলাদশকে নিচু করতেও সুযোগ ছাড়েননি পুষন দাস। তিনি বলেন, “Dhaka is supposed to have approached India to help provide it with two submarines sometime in 2013. The Indian Navy, itself down to historically low submarine numbers, was in no position to meet the request. The Indian recommendation was to approach Russia, but China was willing and able to step in and meet the demand”. এই কথাগুলি উপরের কথাগুলির সাথে সাংঘর্ষিক। যদি বাংলাদেশের নৌশক্তি ভারতে জন্যে চিন্তার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে ভারত কেন চাইবে বাংলাদেশ সাবমেরিন কিনুক? আর বাংলাদেশই বা কেন ভারতের কাছে ছুটে যাবে সাবমেরিনের জন্যে? যেখানে ভারত থেকে কোন ধরনের সামরিক অস্ত্র কেনার কোন নীতিই নেই বাংলাদেশের, সেক্ষেত্রে এধরনের উদ্ভট দাবি ভারতীয় হীনমন্যতাকেই সম্মুখে নিয়ে আসে।

আর ভারত যে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টায় সফল হচ্ছে না, সেটা পুষন দাসের সুপারিশসমূহ দেখলেই বোঝা যায়। তিনি সুপারিশ করেন, “When the Bangladesh Navy eventually does acquire the capability to operate in the air, surface and under water it will be of paramount importance for India to engage and develop ties to not only better gauge Bangladesh’s intent but also to create a regional ally instead of a competitor. Any other outcome has the potential to produce a naval competition in the Bay of Bengal that Bangladesh can ill afford and India certainly does not need”. এই কথাগুলির মাধ্যমে পুষন বলছেন যে, বাংলাদেশকে আটকাতে না পারলে বরং পক্ষে রাখার চেষ্টা করাটাই ভারতের জন্যে উত্তম। যৌথ মহড়ার আয়োজন করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে অধীনে রাখার কথা তিনি বলেছেন। তবে তিনি শেষে এ-ও বলে দিচ্ছেন যে ভারতকে বঙ্গোপসাগরে বন্ধু হিসেবে না পেলে বাংলাদেশের বিপদ হবে। এই কথার মাঝে দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে ভারতের পিছে চলার এবং না মানলে বিপদের হুমকি দিচ্ছেন।
 
আটলান্টিকের ওপাড় থেকে লবিং
পুষন দাস সরাসরি ভারতের হয়ে লিখলেও ভারতের পক্ষের বিভিন্ন লবি অন্য স্থান থেকেও লেখা পকাশ করছে, যা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করছে। ২০১৫-এর ডিসেম্বর মাসে কানাডার Center for International Maritime Security (CIMSEC)-এর পক্ষ থেকে পল প্রাইস বঙ্গোপসাগরের ম্যারিটাইম ব্যালান্স নিয়ে একটা লেখা লিখেন। তার লেখার ধরনটাও ছিল পুষনের মতোই। প্রথমে তিনি “But the maritime capabilities of the People’s Republic of Bangladesh, a country that occupies a geopolitically interesting location between South Asia and Southeast Asia, merits some attention.”- এই কথাগুলির মাধ্যমে পাঠকের দৃষ্টি টেনে আনেন বাংলাদেশের দিকে। আর শেষ করেন, “it is clear that this country does not receive sufficient attention in analyses of South Asian security. An emergent Bangladesh is unlikely to challenge India for supremacy in the Bay of Bengal, but it could tip the balance of power one way or the other in the struggle between China and India. Accordingly, other powers with a stake in Asia should keep an eye on Bangladesh’s fleet expansion and modernization.” – এই কথাগুলি দিয়ে। এখানেও পুষনের মতোই বাংলাদেশকে ছোট করার চেষ্টা করেন তিনি। বাংলাদেশের সামরিক জাহাজ নির্মাণের পরিকল্পনাকে হাস্যস্পদ প্রমাণ করতে তিনি বলে যে, বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণের সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতা হচ্চে ১৯৮৭ সালে থাইল্যান্ডের একটা ফিশিং ট্রলার আটক করে সেটা মডিফাই করে স্যালভেজ ভেসেলে রূপান্তর করা! এটা বিশ্বাস করা অবান্তর যে ওরকম একটা আন্তর্জাতিক ইন্সটিটিউটে বসে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে এতোটা কম জানেন এবং সেই স্বল্পজ্ঞান নিয়েই তিনি লিখতে বসেছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে। শুধু এই স্যালভেজ ভেসেলই নয়, তিনি এ-ও বলেন যে, “Claims of ‘dominion’ over those waters, coupled with a few heavy-handed confrontations, could be sufficient to jeopardize relations between Bangladesh and India at a time when the latter loans the former an average of almost $1 billion a year for infrastructure projects”. এই কথাগুলির মানে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, বাংলাদেশ “প্রতিবছর ভারতের কাছ থেকে গড়ে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ” নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে! আর এই ঋণ বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশ বিপদে পড়ে যাবে! এটাও তিনি না জেনে লিখেছেন, সেটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার লেখাতে বরং দিল্লীর চিন্তাবিদদের ছায়া পাওয়া যায়। দিল্লীর পলিসি অনুসরণ করেই প্রাইস এখানে বাংলাদেশকে হুমকি প্রদান করছেন।

দুর্বল রাষ্ট্র অন্যের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে
বিশাল, কিন্তু কৌশলগত দিক থেকে দুর্বল রাষ্ট্র* হবার কারণে ভারত অনেক সমস্যায় রয়েছে। এর উপরে অভ্যন্তরীন সমস্যার কারণে ভেতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে মরছে ভারত। ভারতের এই অবস্থার কথা এখন সারা বিশ্ব জানে; তাই ভূরাজনৈতিক পূর্বাভাষে অনেকেই সামনের দিনগুলিতে ভারতের অস্তিত্ব দেখতে পান না। কারণ তারা বুঝতে পারছেন যে ভারতের দুর্বলতার সুযোগ নিতে কেউ কেউ কার্পণ্য করবে না, বিশেষত এর প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি। তবে আপাততঃ ভারত টিকে থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে। মোদীর বারাক ওবামাকে জড়িয়ে ধরার পর থেকে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের লক্ষ্য যে এক, সেটা বুঝতে খুব কষ্ট করতে হয় না। দুর্বল রাষ্ট্র হবার কারণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক বছরে ভারতের সবচাইতে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০১৬ সালে বঙ্গোপসাগরে অনুষ্ঠেয় ‘এক্সারসাইজ মালাবার’ অনুষ্ঠিত হবে ফিলিপাইন সাগরে। এর ঘোষণা মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের কমান্ডার নিজেই দিয়েছেন দিল্লী সফরে এসে। নিজের কাজে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ব্যবহার করছে; আর ভারত নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে। প্যাসিফিকে ভারতীয় নৌশক্তি যাওয়া মানে হলো যুক্তরাষ্ট্র এখন অরও সহজে তার সামরিক শক্তিকে ‘অপেক্ষাকৃত কম দরকারী’ এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে তাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মোতায়েন করতে পারবে। এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলি যে মুসলিম দেশগুলি, সেটা আজ সবারই জানা। অর্থাৎ ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে। ঠিক একই নীতির অংশ হিসেবে বঙ্গোপসাগরে তথা ভারত মহাসাগরে নৌশক্তি হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঠেকানোর চেষ্টায় রয়েছে ভারত। কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে অক্ষম এই বিশাল রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার নিজের পতনকে ত্বরান্বিত করছে মাত্র।



*পড়ুনঃ “শক্তিশালী ভারতের ভয়” – সাম্প্রতিক দেশকাল, ০১ অক্টোবর ২০১৫

Monday, 18 April 2016

ঢাকার ভূকৌশলগত গুরুত্ব – আমরা কতটুকু বুঝি?

১৮ই এপ্রিল ২০১৬

 
ঢাকা যে ভূকৌশলগত দিক থেকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তিনটি প্রধান নদীকে একত্রে চিন্তায় না নিয়ে আসলে বোঝা সম্ভব নয়। ঢাকা উপদ্বীপ হচ্ছে হৃতপিন্ড, আর নদীগুলি হচ্ছে ধমনী; নৌযান ও পণ্য হচ্ছে হৃতপিন্ডের দ্বারা ধমনীর মাঝ দিয়ে পাম্প করা রক্ত!


ঢাকা শহরের গুরুত্ব নিয়ে কাউকে একটা রচনা লিখতে বললে তিনি কি কি লিখবেন? তিনি অবশ্যাবশ্যই শহরটির অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঢাকা শহরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়েছিল কি এইসব কারণে; নাকি অন্য কোন কারণে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ হবার পরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি যোগ হয়েছে এই লিস্টে? উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে মরুভূমির মাঝে পানির উতস না থাকলে সেখানে শহর হয় না। আমাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে এমন কিছু ব্যাপার ঘেঁটে দেখতে হবে, যেগুলি ভূমন্ডলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলির অন্যতম, যেমন ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, জলবায়ু, ইত্যাদি, যেগুলি কিনা আমাদের আলোচনাতে আসা বেশিরভাগ বিষয়বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করে; যে বিষয়গুলি ভূকৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

শক্তির কেন্দ্র

ঢাকা বলতে আমরা শুধু ঢাকা শহর বলে ফুলস্টপ দিলে ভুল করবো। ঢাকা হলো এর আশেপাশের পুরো এলাকা, যেখানে রয়েছে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং আশেপাশের এলাকা। এই বৃহত্তর ঢাকা অবস্থিত তিনটি বিশাল নদীর মাঝখানের এক উপদ্বীপে। এর পশ্চিমে রয়েছে যমুনা নদী, যা ব্রহ্মপুত্র নদের মূল প্রবাহ, দক্ষিণে রয়েছে পদ্মা বা গঙ্গা নদী, আর পূর্বে রয়েছে মেঘনা নদী, যা সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীর সম্মিলিত প্রবাহ। নাব্যতা দেওয়া গেলে যমুনা নদী দিয়ে একটি জাহাজ ভারতের আসাম রাজ্য হয়ে আরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত যেতে পারবে। অন্তত একসময় সেটা কিন্তু স্বাভাবিকই ছিল। পদ্মা নদী দিয়ে একটি জাহাজ একসময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং উত্তর প্রদেশ হয়ে দিল্লী যেতে পারতো। এখন সেটা ফারাক্কার কৃত্রিম বাঁধের ফলে সম্ভব হয় না। সুরমা আর কুশিয়ারা নদীর মাধ্যমে ঢাকা যুক্ত ছিল সিলেট, মেঘালয়, আসাম এবং ত্রিপুরার সাথে। আবার ঢাকার সাথে ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক শহরগুলির রয়েছে চমতকার যোগাযোগ। শুধু তা-ই নয়। মেঘনা অববাহিকার মাধ্যমে সমুদ্রের সাথে রয়েছে সরাসরি যোগাযোগ। এই পুরো এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিপাত কমতে থাকে গঙ্গা নদী দিয়ে উত্তর-পশ্চিমে যেতে থাকলে। এই এলাকার বেশিরভাগ অঞ্চলই নদী-বিধৌত সমভূমি, যার ফলশ্রুতিতে এখানকার মাটি স্বাভাবিকভাবেই খুব উর্বর। বৃষ্টিপাতের কারণে এখানে প্রচুর ফসল ফলে, যার কারণে এখানে জনসংখ্যা বেশি। অর্থাৎ অনেক বড় জনসমষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা রয়েছে এই তিন নদী অববাহিকার। এই নদী অববাহিকার উতপাদিত পণ্যের সাথে সমুদ্রের যোগাযোগের দরজা হচ্ছে ঢাকা। এভাবে ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং জলবায়ুগত কারণে তিন নদীর মাঝের এই এলাকার শক্তিশালী অবস্থান এখানে একটি শহর চেয়েছিল।

প্রাচীনকাল থেকেই ঢাকা অঞ্চল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের দুয়ার হলেও এখানে একটা শহর স্থাপনের গুরুত্ব মুঘল সাম্রাজ্যের আমলারাই বুঝেছিলেন। আর তাঁরা এ-ও বুঝেছিলেন যে এখানে শহর প্রতিষ্ঠা না করলে ভারত মহাসাগরে নতুন আসা ইউরোপিয়ানরা এখানকার কর্তৃত্ব নেবার চেষ্টা করবে। সপ্তদশ শতকে মুঘল সম্রাটের সাথে ইস্তাম্বুলে আসীন মুসলিম বিশ্বের খলিফার বেশ নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রে ইউরোপিয়ানদের অভিপ্রায় সম্পর্কে মুঘল সম্রাট জানতেন। ঢাকার কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে মুঘলরা এই অতি গুরুত্বপূর্ণ নদী অববাহিকা ইয়রোপিয়ানদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। হাজার হোক, সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর ৬০%-এর বেশি খরচ দিত বাংলা। আর ঢাকা দাঁড়িয়ে ছিল বাংলা, তথা সমগ্র উত্তর ভারত আর আসামের চাবি হিসেবে। ঢাকার নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে, সে এই তিন নদীর অববাহিকা নিয়ন্ত্রণ করবে। বৃটিশরা এখানে এসে ঠিকই বুঝেছিল যে তারা ঢাকা এতো সহজে নিতে পারবে না। অন্তত নিজেরা এখানে শক্তিশালী না হতে পারলে ঢাকার কৌশলগত শক্তিকে তাদের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। ঠিক একারণেই ঢাকার এই কর্তত্বপূর্ণ অবস্থানকে বাইপাস করার লক্ষ্যে বৃটিশরা কোলকাতা, সূতানটী ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করে নতুন ব্যবসাকেন্দ্র কোলকাতা। বাংলার নবাবের রাজধানী তখন ছিল মুর্শিদাবাদ। কোলকাতায় অবস্থানের ফলে মুর্শিদাবাদে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করাটা বৃটিশদের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছিল।

ঢাকার মৃত্যু

আস্তে আস্তে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে ব্রিটিশরা বাংলার নবাবীত্ব পেয়ে গেলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত শক্তি হিসেবে ঢাকার মৃত্যু ঘটে। চার’শ বছর আগে মুঘলরা যে চিন্তা করে ঢাকাকে এখানকার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন, সেট আবারও বাস্তবায়ন শুরু হয় বিংশ শতাব্দীতে এসে। ব্রিটিশরা দেশ বিভাগের সময়ে ঢাকাকে বাংলা বিভাগ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিল সফলভাবে। কিন্তু যেটা নিয়ে বেশিরভাগ মহলেই বিতর্ক হয় না তা হলো ঢাকার শক্ত ভূকৌশলগত প্রাকৃতিক অবস্থান আর কোলকাতার কৃত্রিম রাজনৈতিক অবস্থান। ব্রিটিশ ভারতে কোলকাতা ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক কেন্ত্র ছিল ১৯০৯ সাল পর্যন্ত, যার পরে সেটা দিল্লীতে চলে যায়। তবে অর্থনৈতিক দিক থেকে কোলকাতা সবার উপরেই থাকে বাংলার গুরুত্বের জন্য। কারণ বাংলা ছিল পুরো ভারতের আসল শক্তি। তবে কৃত্রিম স্থানে অবস্থানের জন্যে কোলকাতার পক্ষে পুরো বাংলা এবং আসামের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কোলকাতা থেকে আসাম পর্যন্ত সামরিক রসদ যেতে জাহাজগুলিকে কোলকাতা থেকে সুন্দরবনের মাঝে দিয়ে খুলনা, গাবখান চ্যানেল, বরিশাল, চাঁদপুর, আরিচা, সিরাজগঞ্জ, চিলমারী হয়ে আসাম যেতে হতো। অথচ ঢাকা থেকে সেটা আরও কতো সহজে হতে পারতো, যদি ব্রিটিশরা কোলকাতার স্থানে ঢাকাকে রাজধানী করতো। আসলে বাংলাকে শক্তিশালী রাখার পক্ষপাতি তারা ছিল না বলেই প্রাকৃতিক সকল শক্তি এখান থেকে সড়িয়ে দিয়েছিল তারা। পরবর্তীতে সেই লাইনেই তারা ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ করে মূলত বাংলাকে, তথা তিন নদীর কৌশলগতভাবে শক্তিশালী অববাহিকাকে দুই ভাগ করেছিল।
  
মীর জুমলার মতো লোকেরা অর্ধেক ভর্তি গ্লাসকে অর্ধেক খালি হিসেবে দেখেছিলেন, এবং বাকিটা ভরার জন্যে উদগ্রীব ছিলেন সবসময়। তাঁরা ঢাকার গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝেছিলেন।

আবার বেঁচে ওঠার চিন্তা

মুঘলরা যখন ঢাকাকে রাজধানী বানিয়েছিল, তখন ঢাকায় স্থাপন করা হয় লালবাগ কেল্লা। এটা শুধু কোন দর্শনীয় স্থান নয়, এটা ছিল কৌশলগত অবস্থানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক দুর্গ, যার হাতে ছিল পুরো বাংলার নিয়ন্ত্রণের চাবি। কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ঢাকার আশেপাশের নদীগুলির জন্যে। যারা প্রাণভয়ে ঘুমাতে পারেন না, তাদের কাছে ঢাকা হচ্ছে তিন নদীর মাঝে নিরাপদ এক স্থান, যেটাকে দখল করা কঠিন। আর অন্যদের কাছে ঢাকা হচ্ছে এমন এক কৌশলগত ঘাঁটি, যেটার উপর নির্ভর করে পুরো বাংলা শুধু নয়, পুরো উত্তর ভারত, এমনকি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ব্যাপারটা হচ্ছে অর্ধেক গ্লাস পানির মতো – অর্ধেক ভর্তি, না অর্ধেক খালি? মীর জুমলা ঢাকাকে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে বিশাল রিভারাইন ফোর্স গঠন করে আসাম আক্রমণ করেছিলেন। আর শায়েস্তা খান এই ঢাকাকে ব্যবহার করেই চট্টগ্রাম দখল করে বাংলার শাসনের অধীনে এনেছিলেন। তাঁরা গ্লাসকে সবসময় অর্ধেক খালি হিসেবেই দেখেছিলেন; তাই গ্লাস পুরোপুরি ভরার চিন্তায় বিভোর ছিলেন; মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলেন না। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মুঘলদেরকে সমুদ্র হাতছানি দিয়ে ডাকেনি। তাই তারা উত্তাল বঙ্গোপসাগরে ইউরোপিয়ানদের চ্যালেঞ্জ করেননি। মুঘলরা ম্যারিটাইম দেশ হিসেবে বাংলাকে চিন্তা করেননি। তবে চার’শ বছর পর আমরা অনেক দেরীতে হলেও এ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছি।

 
 
লালবাগ কেল্লাকে শুধুমাত্র দর্শনীয় স্থান হিসেবে চিন্তা না করে আমাদের আজ চিন্তা করতে হবে যে কোন চিন্তার উপরে নির্ভর করে এই কেল্লা নির্মিত হয়েছিল? এই কেল্লার ইট-পাথরের মাঝেই রয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর।

এর আগে একটি লেখায় রিভারাইন ফোর্স নিয়ে লিখেছি। এই পুরো রিভারাইন ফোর্সের কেন্দ্রবিন্দুতে ঢাকা। আর এই শক্তিকে বুঝতে হলে ঢাকাকে চিন্তা করতে হবে হৃতপিন্ড হিসেবে, আর প্রধান নদীগুলিকে চিন্তা করতে হবে ধমনী হিসেবে; নদীর নৌযানগুলি এবং তাদের পরিবহণ করা পণ্যকে রক্ত হিসেবে। হৃতপিন্ড না থাকলে ধমনী যেমন শুকিয়ে যাবে; তেমনি ধমনী না থাকলে হৃতপিন্ডের অস্তিত্বই প্রশ্নের সন্মুখীন হবে। এই হৃতপিন্ডই রক্ত পাম্প করবে ধমনী বরাবর; আর ধমনী সেটাকে নিয়ে সজোরে ফেলবে সমুদ্রে, যেখানে হবে এই শক্তির আসল বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা নিয়ে নতুন রচনা লেখার এটাই সময়। লালবাগ কেল্লার বিল্ডিংগুলিকে আবার নতুন করে বুঝতে হবে আমাদের। কারণ সেই পুরোনো ইট-পাথরের মাঝেই রয়েছে আমাদের শক্তির সূত্র।

Tuesday, 29 March 2016

আদর্শিক যুদ্ধের পুনরাবির্ভাবঃ আমরা কতটুকু প্রস্তুত?

৩০শে মার্চ ২০১৬
 

ষোড়শ শতকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উত্তরের ছোট্ট জায়গা আচেহ যে ভূমিকা নিয়েছিল, তা আজ নতুন করে দেখতে হচ্ছে ২১ শতকের চোখ দিয়ে

ইন্দোনেশিয়া – সাড়ে চার’শ বছর আগের কথা

১৫১১ সালে মালয় উপদ্বীপে (বর্তমান মালেশিয়া) যখন পর্তুগীজরা জেঁকে বসে, তখন থেকেই বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উত্তর উপকূলের ছোট্ট আচেহ রাজ্যের সুলতানগণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এই পশ্চিমা বিষফোঁড়া থেকে উদ্ধার পেতে। ছোট হলেও তারাই ইন্দোনেশিয়াতে প্রথম ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাই তাদের দায়িত্ব তারা বেশ ভালোই বুঝেছিলেন। কৌশলগত দিক থেকে মালাক্কা প্রণালী যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তারা বুঝতে দেরি করেননি। কিন্তু বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরেও তারা কেউই পর্তুগীজদের বিরূদ্ধে পেরে উঠছিলেন না। পর্তুগীজরা মালয়ের লোকদেরকে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করাতে পেরেছিল, এবং মালয়ের সৈন্যদের ব্যবহার করেই তারা আচেনীজ মুসলিমদের যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারছিল। অবশেষে আসে ১৫৬৪ সাল। আচেহ সুলতানাতের সুলতান আলাউদ্দিন আল-কাহহার পর্তুগীজদের উত্থান রোধ করতে ইস্তাম্বুলে সুলতান সুলাইমান (যাকে ইউরোপীয়রা সন্মান করে বলতো Suleiman the Magnificent) বরাবর তার দূত পাঠান। আচেহ-র সুলতানরা ১৫৩০-এর দশক থেকেই সুলাইমানকে ইসলামের খলিফা বলে মানতেন। আল-কাহহার জানতেন যে খলিফা হিসেবে সুলাইমান তাকে ফিরিয়ে দেবেন না। সুলাইমান কথা রাখলেও তার সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। ১৫৬৬ সালে সুলাইমান পরলোকগমণ করেন। তবে সুলাইমান জীবিত থাকা অবস্থাতেই বেশ কয়েক’শ মুসলিম যোদ্ধা জাহাজে চেপে আচেহ-র পথে পাড়ি জমান। এসব যোদ্ধাদের মাঝে ছিল তুর্কী, সোয়াহিলি (তাঞ্জানিয়া-কেনিয়ার উপকূলের মানুষ), সোমালি, সিন্ধি (বর্তমান পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলের মানুষ), ভারতের গুজরাট, সুরাট এবং মালাবার উপকূলের মুসলিমগণ। তবে এই সাহায্য পর্তুগীজদের বিরূদ্ধে যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে পারেনি।

নতুন খলিফা দ্বিতীয় সেলিম ১৫৬৬-৬৭ সালে লোহিত সাগর থেকে ১৫টি জাহাজের এক শক্তিশালী নৌবহর প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যাত্রার সাথেসাথেই ইয়েমেনের আদেনে বিদ্রোহের খবর চলে আসায় গুরুত্ব বুঝে এই নৌবহরকে ইয়েমেনের দায়িত্ব দেওয়া হলো। কিন্তু খলিফা সেলিম আচেনীজদের দায়িত্ব ভুলে যাননি। তিনি কুরতোগলু হিজির রাইস-এর অধীনে দু’টা জাহাজ পাঠানের সিদ্ধান্ত নেন। এই দু’টা জাহাজই ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস পরিবর্তন করে ফেলে। এই জাহাজ দু’টিতে খুব বিশাল সংখ্যক সৈন্য না থাকলেও ছিল ইঞ্জিনিয়ারের একটা দল, যারা কামান তৈরি করার পদ্ধতি জানতেন। ষোড়শ শতকে কামান ছিল খুবই শক্তিশালী একটা অস্ত্র, যা ছাড়া আচেনীজদের পক্ষে পর্তুগীজদের মোকাবিলা করা ছিল অসম্ভব। এই ইঞ্জিনিয়াররা আচেনীজদের কামান তৈরিতে সাহায্য করলেন এবং সপ্তদশ শতকের শুরুর নাগাদ আচেনীজ সুলতান ইসকান্দার মুদা-র হাতে ছিল ১,২০০ কামান এবং আরও ৮০০ ছোট ধরনের কামান। এই কামানের বহরের মাধ্যমে সুলতান মুদা পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং তাদের আগ্রাসন রুখে দেন, যদিও মালয়রা উলটো পক্ষ নেয়ার কারণে পর্তুগীজদের কৌশলগত মালাক্কা প্রণালী বিতাড়িত করতে ব্যর্থ হন তিনি।

তবে পর্তুগীজরা বুঝে গিয়েছিল যে ভারত মহাসাগরে তাদের বাণিজ্যের মনোপলি রচনা করার পেছনে সবচাইতে বড় বাধা হলো আচেনীজ সুলতানের ইস্তাম্বুলে আসীন খলিফার সাথে যোগাযোগ রক্ষা, যা কিনা মহাসাগরের বিশাল জলরাশিকে বাধা না ভেবে আলিঙ্গন করেছিল। খলিফার নির্দেশে জাহাজে করে আসা মুসলিম ইঞ্জিনিয়াররা ছোট্ট আচেনীজ সালতানাতকে রাতারাতি বিরাট সামরিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। ইয়েমেনের বিদ্রোহের সময়ে খলিফা দ্বিতীয় সেলিম ইচ্ছে করলে আচেহ-তে জাহাজ না-ও পাঠাতে পারতেন। কিন্তু তিনি দুনিয়ার মুসলিমদের প্রতি তার আদর্শিক দায়িত্বের গুরুত্ব তিনি ভুলে যাননি। তিনি এমন একটি দল পাঠিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে আচেনীজরা নিজেরাই তাদের বাহিনী তৈরি করে নিতে পেরেছিল। যদি খলিফা শুধু যুদ্ধাস্ত্র পাঠাতেন, তাহলে আচেনীজরা বছরের পর বছর খলিফার দিকে চেয়ে থাকতেন এবং ভারত মহাসাগরের ওপাড় থেকে সাহায্য আসতে আসতে বছর পার হয়ে যেতো। ইঞ্জিনিয়ারদের পাঠানোর মাধ্যমে খলিফা যে কাজটি করেছিলেন, সেটা একটা বিশেষ ধরনের কৌশলগত চিন্তা। এই চিন্তা পরবর্তীতে আরও অনেকেই অনুসরণ করলেও সেটা এই আদর্শিক যোগাযোগের গুরুত্বকে ছাপিয়ে যাবে না।
  
আচেনীজরা যখন ষোড়শ শকতে পর্তুগীজদের সাথে যুদ্ধের জন্যে ইস্তাম্বুলে খলিফার নিকটে সাহায্য চেয়েছিলেন, তখন খলিফা দ্বিতীয় সেলিমের হস্তক্ষেপের আদর্শিক সিদ্ধান্ত ইন্দোনেশিয়া এবং মালেশিয়ার পরবর্তী পাঁচ শতকের ইতিহাস পরিবর্তন করেছিল

আদর্শিক কারণেই আচেনীজরা সাহায্য পেয়েছিল এবং নিজেরা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে বছরের পর বছর। যে অনুপ্রেরণা বা motivation এখানে কাজ করেছে, সেটা এসেছিল সেই আদর্শিক কারণেই; অর্থনৈতিক বা অন্য কোন কারণে হলে এই যুদ্ধের ধরণ হতো পুরোপুরি অন্যরকম। আচেনীজদের পক্ষে খলিফা দ্বিতীয় সেলিমের আদর্শিক হস্তক্ষেপের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। আচেনীজদের সাথে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের কারণে পর্তুগীজরা মালেশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয়। পর্তুগীজ-স্প্যানিসরা ছিল ক্যাথোলিক, এবং তারা পুরো ষোড়শ শতক জুড়ে খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের পৃথিবীব্যাপী স্বার্থরক্ষা করেছে। ব্রিটিশ-ডাচ-ফরাসীরা সপ্তদশ শতক থেকে উঠতে থাকে, যাদের উত্থান মূলত হয়েছিল সেকুলার আদর্শ থেকে, অর্থাৎ মধ্যযুগের ইউরোপের খ্রীস্টান ধর্মান্ধতা থেকে বাঁচার জন্যেই তাদের (সেকুলারদের) উত্থান ছিল। কাজেই খ্রীস্ট ধর্ম প্রচারে ব্রিটিশ-ডাচ-ফরাসীরা ছিল অপেক্ষাকৃত কম উতসাহী। ধর্মান্তরিত না করে বরং সেকুলার মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়াতেই তারা বেশি আগ্রহী ছিল। অন্যদিকে পর্তুগীজ-স্প্যানিসরা যেখানে থেকেছে, সেখানেই ক্যাথোলিক খ্রীস্টান সম্প্রদায় তৈরি করতে তারা ভোলেনি। ঠিক একারণেই ফিলিপাইনে বেশিরভাগই ক্যাথোলিক; ল্যাটিন আমেরিকাতেও; অথচ প্রায় দু’শ বছর ব্রিটিশ শাসনে থাকার পরেও ভারতের খুব কম লোকই খ্রীস্টান। ডাচরা ইন্দোনেশিয়া দখলে নিয়েছিল; ব্রিটিশরা নিয়েছিল মালেশিয়া-সিঙ্গাপুর। কিন্তু এখনো মালেশিয়া-ইন্দোনেশিয়াতে বেশিরভাগ মানুষই মুসলিম। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল এবং মালেশিয়া (যেখানে বর্তমানে সবচাইতে বেশি মুসলিম থাকে) পর্তুগীজদের অধীনে চলে গেলে এই এলাকার অমুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে থেকে বড়সড় একটা ক্যাথোলিক খ্রীস্টান সমাজ তৈরি হতে পারতো, কারণ ইন্দোনেশিয়া-মালেশিয়ার সবাই তখনো ইসলাম নেয়নি। একই এলাকায় মুসলিম-ক্যাথোলিক সম্প্রদায়ের বিস্ফোরন্মুখ বসবাস এখানকার ইতিহাস পরিবর্তন করে দিতে পারতো, যেটা হয়েছিল নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে; সাবেক যুগোস্লাভিয়ার ক্ষেত্রে। ষোড়শ শতকে খলিফার আদর্শিক সিদ্ধান্ত মহাসাগর পেরিয়ে যে কৌশলগত ভূমিকা রেখেছিল, সেটা নিয়ে আরও কিছু চিন্তা-ভাবনার দরকার এখন এসেছে, কারণ একুশ শতকের যুদ্ধক্ষেত্র এমন কিছু কৌশল দেখবে, যার সাথে ষোড়শ শতকের বহু মিল পাওয়া যাবে।
 
প্রায় সবাই ভিয়েতনাম যুদ্ধের বাইরের অংশটুকুই দেখেছে। কিন্তু যেটা খুব অল্প লোকের কাছে বোধগম্য ছিল তা হলো - যুক্তরাষ্ট্র খুব সফলতার সাথে কমিউনিজমের অগ্রযাত্রাকে আটকে দিয়েছিল ভিয়েতনামের মাটি কামড়ে এক যুগ পরে ত্থাকার কারণে। আদর্শিক যুদ্ধের ফলাফল বেশিরভাগের কাছেই স্পষ্ট হয় না।

ভিয়েতনাম – দৃশ্যত যা অদৃশ্য
  
ষোড়শ শতকের আদর্শিক যুদ্ধের চার’শ বছর পরে আসা যাক। ইন্দোনেশিয়া-মালেশিয়া থেকে বেশি দূরে নয়। ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলেছে এক যুগ ধরে। ৫৮ হাজার মার্কিন সেনার জীবনাবসান হলো; কিন্তু কিসের জন্যে? অনেকেই প্রশ্ন করলো। সবাই বললো – মার্কিনীরা হেরেছে সেই যুদ্ধ। কিন্তু আদর্শিক দিক থেকে দেখলে অন্য একটা ছবি পাওয়া যাবে। ভিয়েতনামে হাজার হাজার সৈন্য বলি দেয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াকে কমিউনিজমের হাতে চলে যেতে দেয়নি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র খুব সফলতার সাথে কমিউনিজমের অগ্রযাত্রা থামিয়েছে। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামীদের ব্যবহার করেছে ভিয়েতনামীদেরই বিরূদ্ধে। ত্রিশ লক্ষ ভিয়েতনামীর লাশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছিল তুচ্ছ। এক যুগ ধরে চলা এই যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শকে রক্ষা করেছে, কারণ এই পুরো এলাকা কমিউনিস্ট হয়ে গেলে সেটা বাকি বিশ্বের জন্যে উদাহরণ হিসেবে কাজ করতো। চার শতকের ব্যবধানের দুই আদর্শিক যুদ্ধ থেকে আমরা যা পাই তা হচ্ছে, প্রথমতঃ মহাসাগরের বিশাল জলরাশির পক্ষেও আদর্শিক যুদ্ধকে থামানো সম্ভব নয়; এটার কোন ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক বাউন্ডারি নেই। দ্বিতীয়তঃ আদর্শিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে ‘ক্ষয়ক্ষতি’-র হিসেব অন্য রকম; সকল ক্ষতিই এর কাছে তুচ্ছ। আদর্শিক শক্তি যখন সিদ্ধান্ত নেয় যে এটা করতে হবে, তখন এটা করতেই হবে! আর তৃতীয়তঃ আদর্শিক যুদ্ধের অনুপ্রেরণা লম্বা সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার শক্তি যোগায়। অন্ততঃ এক পক্ষের মূল আদর্শিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবার আগ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এধরনের আদর্শিক যুদ্ধ যখন বর্তমান সময় এবং সামনের দিনগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, তখন আমাদের এই যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া দরকার; কারণ এধরনের যুদ্ধই পৃথিবীকে গ্রাস করবে। যারা আগে থেকেই সেটা নিয়ে চিন্তা করবেন, তারা নিঃসন্দেহে এগিয়ে থাকবেন; চিন্তায় পিছিয়ে থাকা মানে হেরে যাওয়া। 
 
জর্জ ফ্রীডম্যান প্রথম সাড়ির পশ্চিমা চিন্তাবিদদের একজন। তিনি খুব চমতকারভাবে বর্ণনা করেছেন কিভাবে ২১ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে যুদ্ধ বাজিয়ে রেখে বিশ্বব্যাপী তাদের কর্তিত্ব বজায় রাখবে।

 
এখানে মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যানের কিছু কথা না তুলে পারছিনা। তিনি তার “The Next 100 Years” বইতে লিখেন যে “The United States had the ultimate aim of preventing the emergence of any major power in Eurasia. The paradox however, is as follows. The goal of these interventions was never to achieve something whatever the political rhetoric might have said, but to prevent something. The United States wanted to prevent stability in areas where another power might emerge. Its goal was not to stabilize, but to destabilize.” ফ্রীডম্যানের এই কথাগুলি বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অদ্ভুত ঠেকবে, কারণ কেউই ২-৪-৫ বছরের বেশি সামনে চিন্তা করার ক্ষমতা রাখেন না। ফ্রীডম্যান শুধু বর্ণনা করেছেন কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার আদর্শকে দুনিয়াতে টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত, এমনকি যে যুদ্ধ সবাই জানে যে যুক্তরাষ্ট্র জিততে পারবে না, সেটাও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে আদর্শিক কারণে। যুদ্ধ জয় মার্কিন নীতির অংশ নয়, বরং তার আদর্শকে টিকিয়ে রাখাই তার মূল নীতি। তাই “The United States also has no interest in winning a war outright. As with Vietnam and Korea, the purpose of these conflicts is simply to block a power, to destabilize the region, not to impose order. In due course, even outright American defeat is acceptable.” হেরে যাওয়া যুদ্ধও মার্কিনীরা করবে, কারণ সেটা তাদেরকে আরও কয়েক যুগ দুনিয়ার উপরে নিজেদের শাসন কায়েম রাখতে সহায়তা করবে। ফ্রীডম্যান সামনের দিনগুলি নিয়ে বলেছেন যে, “There will be numerous Kosovos, Iraqs in unanticipated places and in unexpected times. …… the interventions would be quite rational. It would never appear to really yield anything near a solution and will always be done with insufficient force to be decisive.” এর মানে হচ্ছে বহু ছোট ছোট যুদ্ধ ইউরেশিয়াকে (ইউরোপের বলকান থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া-সহ পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) ব্যস্ত রাখবে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র খুব কম শক্তি ক্ষয় করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। স্পেশাল ফোর্স এবং এধরনের কিছু বাহিনী ব্যবহার করে কম খরচে যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে, যেখানে মার্কিনীদের হয়ে মূল যুদ্ধ করবে স্থানীয় লোকজন*। ঠিক যেভাবে উপরে বর্ণনা করা ষোড়শ শতকের মালয়ের যুদ্ধে পর্তুগীজরা মালয়ের মানুষদের ব্যবহার করেছিল; ঠিক যেভাবে মার্কিনীরা দক্ষিণ ভিয়েতনামীদের সামরিক বাহিনী গড়ে দিয়েছিল উত্তর ভিয়েতনামীদের বিরূদ্ধে লড়াই করার জন্যে; ঠিক যেভাবে মাত্র কয়েক হাজার ব্রিটিশ সৈন্য কোটি মানুষের ভারতকে দু’শ বছর শাসন করেছিল; ঠিক সেটাই এখন মার্কিনীরা করছে ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, সোমালিয়া, মালি, সুদান এবং আরও অনেক মুসলিম দেশে। এই লিস্টে মুসলিম দেশের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা এখনো বাকি আছে, তারা যদি মনে করেন যে তারা নিরাপদ, তাহলে তারা মারাত্মক ভুল করবেন।
 
সিরিয়ার যুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে গুলতি বা sling, যার মাধ্যমে নিজেদের তৈরি গ্রেনেডগুলি আসাদ বাহিনীর উপরে ছুঁড়ে দেয়া যায়। প্রাচীন পদ্ধতি হলেও এটা সিরিয়াতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত, কারণ এখানে বছরের পর বছর যুদ্ধ হচ্ছে শহরের অলিতে-গলিতে; এখানে খোলা মাঠে বীরের বেশে ট্যাঙ্ক চালানোর সম্ভাবনা সীমিত।

সিরিয়া – আজকের আদর্শিক যুদ্ধ

এবারে বর্তমানে সংবাদপত্রের শিরোনামে থাকা একটা যুদ্ধ সামনে আনা যাক, যার রয়েছে আদর্শিক সকল লক্ষণ। পাঁচ বছর ধরে চলছে সিরিয়ার যুদ্ধ। একবার এগিয়ে থাকছে সিরিয়ার সরকার; আরেকবার বিদ্রোহীরা। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার কোন লক্ষণ নেই, যদিও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সীমাহীন। পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের রক্তের নহর বয়ে গেছে; স্বজন-হারার কান্নার জন্যে চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ হয়েছে দেশছাড়া। এতে জড়িয়ে গেছে সাগর-মহাসাগরের ওপারের মানুষ; রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক সীমানা কাউকে যুদ্ধে জড়ানো থেকে আটকাতে পারেনি। কেউ হাল ছাড়ার পাত্র নয়; সকল ক্ষতি উপেক্ষা করে মাটি কামড়ে পড়ে আছে সবাই বছরের পর বছর। এখানে আবার যুক্তরাষ্ট্র বেনামে বিদ্রোহীদের কাউকে কাউকে এমন অস্ত্র দিচ্ছে, যা কিনা যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে পারবে না**; অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র চায় না যে বিদ্রোহীরা সামরিক জয় পেয়ে যাক। আবার যখন রাশিয়ার বিমান বাহিনীর মূল আক্রমণ আইসিস নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উপরে না হয়ে সিরিয় বিদ্রোহীদের উপরে শাণিত হয়, তখন রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের একই লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হওয়া প্রকাশ হয়ে যায়। মুখে অত্যাচারী বাশার আল-আসাদের বিরূদ্ধে কথা বললেও আলোচনার টেবিলে বসে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সাথে একত্রে আসাদ সরকারের থাকার পক্ষে রায় দেয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্র পরিষ্কার জানে যে আসাদ সরকারকে ক্ষমতায় রাখা মানেই হচ্ছে যুদ্ধকে লম্বা করা। যুদ্ধকে জিইয়ে রাখার এই প্রবণতা উপরে বর্ণিত আদর্শিক যুদ্ধের আলোচনাকেই মনে করিয়ে দেয়। শান্তিপূর্ণ সিরিয়া যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আদর্শিক হুমকির জন্ম দিতে পারে, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকান্ডে পরিষ্কার হচ্ছে। সেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতোই যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বে একটা আদর্শিক উত্থানের উদাহরণ তৈরি করতে চাচ্ছে না, যা কিনা তার বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্বে অবসান ঘটাতে পারে।

সিরিয় বিদ্রোহীদের ব্যবহৃত সবচাইতে শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে tunnel bomb. এই যুদ্ধের আগে মানুষ ভুলেই গিয়েছিল এর কথা। অনেক পুরাতন অস্ত্র এবং কৌশল সিরিয়াতে পুণরায় আবির্ভূত হয়েছে।

সিরিয়ার যুদ্ধ যে কতটা একগুঁয়ে রকমের, তা আরও পরিষ্কার হবে যখন আমরা দেখবো সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সিরিয়ার পুরো যুদ্ধটাই হচ্ছে শহর এলাকার দখল নিয়ে। অর্থাৎ যেখানে জনবসতি, সেখানেই যুদ্ধ। খোলা জায়গায় ট্যাঙ্ক নিয়ে দৌড়াদৌড়ি এই যুদ্ধের জন্যে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার হাতে কোন শহরের পতন হয়, সে এগিয়ে যায়। কাজেই শহরের ভগ্ন বিল্ডিংগুলি দখলে রাখতে দু’পক্ষই সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছে। মাসের পর মাস ধরে একই এলাকায় যুদ্ধ চলছে। শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার হয়ে যায় গৌণ। বাড়িতে তৈরি করা অস্ত্র যখন বিল্ডিং-এর আড়াল থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটাই তখন শত্রুর জন্যে হয়ে যাচ্ছে প্রাণঘাতী। বিল্ডিংগুলি সৈন্যদেরকে সাঁজোয়া যানের মতো রক্ষা করছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত বিল্ডিং-এর বেজমেন্টে স্থাপন করা হয়েছে অস্ত্রের কারখানা, যেখানে লেদ মেশিনে তৈরি হচ্ছে মর্টার, আর্টিলারি রকেট, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি আর্টিলারি, এন্টি-ম্যাটেরিয়েল স্নাইপার রাইফেল, শক্তিশালী বিস্ফোরক, গ্রেনেড লঞ্চার, প্রাচীনযুগে ব্যবহৃত ক্যাটাপাল্ট-এর আধুনিক সংস্করণ, ইত্যাদি। এসব অস্ত্র তৈরি জন্যে ধারণা এবং প্রযুক্তি আসছে সীমানা পার হয়ে। প্যালেস্টাইনের মানুষ অস্ত্র চোরাচালানের জন্যে সুরঙ্গ খুঁড়তে বিশেষজ্ঞ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সিরিয় বিদ্রোহীরা সেটাকে নিয়ে গেছে আরও এক ধাপ। তারা শতশত মিটার সুরঙ্গ খুঁড়ে নিয়ে গেছে সিরিয় সরকারী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটির নিচে, যেটা কিনা বিদ্রোহীরা বহুদিন ধরেও দখলে নিতে পারছিলো না। সেই সুরঙ্গের ভেতরে ৪০ থেকে ৬০ টন বিস্ফোরক ভরে দিয়ে – বুম!! মোটামুটি একটা ভূমিকম্পসম বিস্ফোরণের পরে বিদ্রোহীদের এগুনোর পথ খুলে যায়। এধরনের আক্রমণ বিদ্রোহীরা বেশকিছু শহরে করেছে; মাসের পর মাস ধরে চলেছে গোপন খোঁড়াখুঁড়ি; এ মহা ধৈর্য্যের এক ব্যাপার। Moral Cause না থাকলে এ ধরনের চেষ্টা চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরিখা যুদ্ধের সময় এধরনের tunnel bomb ব্যাপক আকারে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই ইতিহাস আবার নতুন করে লিখা হচ্ছে।
 
বাসাবাড়ির জ্বালানি গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা বানিয়েছে 'Hell Cannon'। এটাই আসাদের বাহিনীর বিরূদ্ধে বিদ্রোহীদের ব্যবহৃত সবচাইতে কার্যকর আর্টিলারি। সারা দুনিয়া অবাক হয়ে চেয়ে রইলো কিভাবে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কিছু না থাকা সত্ত্বেও বছরের পর বছর যুদ্ধে চালিয়ে নিচ্ছে, যা আদর্শিক যুদ্ধের একটা লক্ষণ।


যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন কোন আর্টিলারি ছিলনা বিদ্রোহীদের হাতে। এখন তাদের হাতে রয়েছে নিজেদের তৈরি শতশত মর্টার, রকেট, এবং উদ্ভট এক আর্টিলারি, যার নাম ‘জাহান্নামের কামান’ (Hell Cannon)। এই কামানের গোলা তৈরি করা হচ্ছে সিরিয়াতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত রান্না করার গ্যাস সিলিন্ডার থেকে। শহুরে এলাকায় বিল্ডিং-এর মাঝে শত্রুর শক্তিশালী ঘাটিকে মাটির সাথে গুড়িয়ে দিতে এই অস্ত্র বিশেষ পারদর্শিতা দেখাচ্ছে। তবে দেড় কিলোমিটার পাল্লার এই অস্ত্র খোলা জায়গায় খুবই দুর্বল। তারা যে আর্টিলারি রকেট তৈরি করছে, তা হুবহু প্যালেস্টাইনে তৈরি রকেটের মতো। সিরিয়ার ইঞ্জিনিয়াররা এখন সবচাইতে বড় যোদ্ধা। কেউ কেউ আবার কোন বিশেষ শিক্ষা ছাড়াই ইঞ্জিনিয়ার বনে গেছেন ইন্টারনেট ঘেটে ঘেটে। সিরিয় সেনাবাহিনীর অস্ত্র দখল করা ছাড়াও আসাদের বিমান বাহিনীর ফেলা অবিস্ফোরিত বোমাগুলিকে কুড়িয়ে নিয়ে বিদ্রোহীরা নিজেদের কারখানায় কাজে লাগাচ্ছে। লেদ মেশিনে তৈরি মর্টারের গোলা এখন সিরিয় সরকারী বাহিনীর জন্যে ত্রাস। মর্টার হলো indirect গোলা বর্ষণের এক অস্ত্র, যার মাধ্যমে বিল্ডিং বা দেয়ালের ওপারে আশ্রয় নেয়া শত্রুর উপরে গোলা বর্ষণ করা যায়। অর্থাৎ মর্টার সিরিয়ার শহরের ভেতরে যুদ্ধের জন্যে সবচাইতে শক্তিশালী অস্ত্র।

‘Age of Empires’ কম্পিউটার গেম দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে কেউ কেউ তৈরি করেছেন মধ্যযুগীয় অস্ত্র trebuchet, যা কিনা একটা গোলাকে অনেক দূরে ছুঁড়ে দিতে পারে। এই অস্ত্রের হলিউড ভার্সন দেখতে পাবেন ‘Lord of the Rings’ ছবিতে, যেখানে বিরাট এক যন্ত্র ব্যবহৃত হয় বিশাল পাথরের চাং দুর্গের ভেতরে ছুঁড়তে। সিরিয়ার যন্ত্রগুলি ছোট, কিন্তু বাড়িতে তৈরি কয়েক কেজি ওজনের বোমাগুলিকে বেশ কিছুদূরে ছুঁড়ে দেবার জন্যে এটা বেশ ভালোই কার্যকরী। Trebuchet-এর মতোই কিছুটা কম জটিল catapult, যেগুলি একই কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এগুলি সংখ্যায় কম হলেও sling বা গুলতির ব্যাপক প্রচলন হয়েছে সিরিয়াতে। প্রায় প্রতি রাস্তার আনাচে কানাচে ঘরে তৈরি গ্রেনেড দূরে ছুঁড়ে মারতে ব্যবহৃত হচ্ছে গুলতি। প্যালেস্টাইনের যুবকরা ইস্রাইলি সেনাদের বিরূদ্ধে গুলতি ব্যবহার করছে অনেকদিন ধরে, তবে সিরিয়ার গুলতিগুলি গ্রেনেড ছুঁড়ে আরও অনেক সাংঘাতিক হয়েছে। প্রাচীন যুগের এই অস্ত্র এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক যুদ্ধে, যেখানে আদর্শকে জয়ী করা আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের বড়াই থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত জার্মান leFH-18 ১০৫মিমি আর্টিলারিও সিরিয়াতে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে; দেখা গেছে অতি পুরাতন Mosin Nagant rifle (১৮৮০-এর দশকে ডিজাইন করা), MAS-36 rifle (১৯৩৬ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), M1 Garand rifle (১৯৩৬ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), PTRS-41 14.5mm sniper rifle (১৯৩৮ সালে ডিজাইন করা), Beretta 1938/44 submachine gun (১৯৩৮ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), STG-44 assault rifle (১৯৪৩ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), Browning M1919 7.62mm medium machine gun (১৯১৯ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), Degtyaryov DP-28 light machine gun (১৯২৮ সালে অপারেশনে গিয়েছিল), ইত্যাদি। বাকি বিশ্ব যখন বিলিয়ন ডলার খরচ করে স্টিলথ বিমান তৈরিতে মগ্ন, তখন কিছু লোক অদর্শকে কেন্দ্র করে প্রাচীন প্রযুক্তি ব্যবহারে যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে সকল সমরবিদদের চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে।


সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ট্যাবলেট এবং app ব্যাবহার করে নিজেদের ওয়ার্কশপে বানানো একটা মর্টার টার্গেটিং করছে। একুশ শতকের আদর্শিক যুদ্ধে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে অলিতে-গলিতে।

তবে একুশ শতকের মানুষের প্রযুক্তি জ্ঞানকে কম করে দেখলে কিন্তু হবে না। যুদ্ধের প্রথম দিকে ডিজাইন করা অস্ত্র আর পরের দিকে ডিজাইন করা অস্ত্রের মাঝে বিস্তর ফারাক। অভিজ্ঞতা মানুষকে বানিয়েছে বিশেষজ্ঞ। তারা এখন এন্টি-ম্যাটেরিয়েল স্নাইপার রাইফেল পর্যন্ত তৈরি করে ফেলছে গ্যারেজের ওয়ার্কশপে। সিরিয়াতে মর্টার, রকেট এবং Hell Cannon-এর টার্গেটিং করতে ব্যবহৃত হচ্ছে স্মার্টফোন app-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। এই Hell Cannon-এর projectile-এর আবার ব্যবহৃত হচ্ছে delayed action fuse, অর্থাৎ গোলাটা আঘাত হানার সাথে সাথেই বিস্ফোরিত হয় না; কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হলেই তবে ফাটে। এতে ফাটার আগে গোলাটা কোন দুর্গ-প্রমাণ বিল্ডিং-এর উপরে পরে ভরবেগের কারণে একেবারে নিচের দিকে চলে যায়; তারপর ফাটে। এতে পুরো বিল্ডিং-ই ধ্বসে যায়। তবে এই কামানের ধ্বংস-ক্ষমতা সিরিয়া এবং রাশিয়ার বিমান শক্তির কাছেধারেও পৌঁছেনি। উঁচু দিয়ে ওড়া হেলিকপ্টার থেকে ফেলা ব্যারেল বোমাতে শত শত মানুষের মৃত্যুর হয়েছে। বিদ্রোহীরা বিমান-ধ্বংসী মিসাইল তেমন একটা পাচ্ছে না, তাই আকাশ থেকে তাদের উপরে প্রতিনিয়ত বোমা পড়ছে। এ থেকে রক্ষা পেতে বিদ্রোহী ইঞ্জিনিয়াররা এখন বিমান-ধ্বংসী রকেট ডিজাইনে মনোনিবেশ করেছেন। আইডিয়াটা হচ্ছে, wire-guided একখানা রকেট যদি আস্তে চলা হেলিকপ্টারের কাছাকাছি নিয়ে ফাটিয়ে দেয়া যায়, তাহলে সেটা বিস্ফোরণের ধাক্কায় বিধ্বস্ত হবে। আর সেটা না হলেও প্রথম রকেটটা কাছাকাছি বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলে এর সাথেসাথে আরও কমপক্ষে তিনটি রকেট টার্গেটিং করা খুব সহজ হয়ে যাবে। ২০১৫-এর শেষের দিকে বিদ্রোহীরা এই নতুন অস্ত্র নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সিরিয়ার যুদ্ধের বিশাল এক প্রমাণ্য দলিল এখন ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে – ছবি, ভিডিও, ইন্টারভিউ, ঘোষণা, ইত্যাদি।

তবে এখানে সিরিয়ার প্রতিবেশী ইরাকের সাথে সিরিয়ার যুদ্ধের কিছু ট্যাকটিক্যাল পার্থক্য রয়েছে। ইরাকে roadside bomb বা improvised explosive device (IED) খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, কারণ মার্কিন সৈন্যরা সেখানে শুধু রাস্তা পাহাড়া দিত। ইরাকের রাস্তায় মার্কিন গাড়ির বহরের উপরে হামলা করার জন্যে কিছু অস্ত্র (নিরাপত্তার কারণে এখানে নাম উল্লেখ করছি না) খুব সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে, যা কিনা পশ্চিমারা সোভিয়েত আমলের সবচাইতে বাজে ডিজাইনের অস্ত্র বলতো। সেগুলিও সিরিয়াতে ব্যবহৃত হচ্ছে না একই কারণে। কিন্তু সিরিয় সরকারী বাহিনী শহরাঞ্চলে বিল্ডিং পাহাড়া দিচ্ছে, তাই ইরাকে ব্যবহৃত সফলতম অস্ত্রগুলি সিরিয়া যুদ্ধে তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু প্যালেস্টাইন, লেবানন এবং লিবিয়া থেকে কিন্তু অনেক প্রযুক্তি সিরিয়া পৌঁছে গেছে। এই প্রযুক্তির বিস্তার হচ্ছে আদর্শের বিস্তারের সাথেসাথেই। যুদ্ধকে চালিয়ে নেবার পেছনে প্রযুক্তি এবং আদর্শের আদান-প্রদান ষোড়শ শতকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, একুশ শতকেও তা-ই হচ্ছে।

সিরিয়ার বিদ্রোহীরা নিজেদের অস্ত্র নিজেরা বানিয়ে নিয়ে চালিয়ে নিচ্ছে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ; কারণ তারা বিশ্বাস করে যে তাদের পথই সঠিক। তাদের সাথে আদর্শিক টানে দূরদূরান্ত থেকে যোগ দেয়া মানুষের সাথে এসেছে চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান, প্রযুক্তি; যা কিনা যুদ্ধের ময়দানে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা তৈরি করছে। পশ্চিমা আদর্শিক শক্তিরা কিন্তু এগুলি খুবই গুরুত্বের সাথে দেখছে। এখানে পেশাদারী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী এখনো ব্যাপকহারে সীমানা পেরোয়নি; তারপরেও অপ্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই যুদ্ধ চালাচ্ছে বীরদর্পে। কিন্তু সামনের দিনগুলিতে মিলিশিয়ারা যে বড় কোন সাহায্য ছাড়াই যুদ্ধ করে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না। আদর্শিক শক্তির vortex যে কাউকেই motivate করে ফেলতে পারে; উপরে আলোচিত ষোড়শ এবং বিংশ শতকের যুদ্ধগুলি এর স্বাক্ষী। আজ থেকে দুই দশক আগেই আদর্শিক vortex-এর sucking power-কে উপলব্ধি করে মার্কিন চিন্তাবিদ স্যামুয়েল হান্টিংটন তার “Clash of Civilizations and the Remaking of World Order” বইতে পশ্চিমা শক্তিদের জন্যে উপদেশ দিয়েছিলেন বেশকিছু; যার মাঝে ছিল – “to restrain the development of conventional and unconventional military power of Islamic and Sinic countries”. যারা আজ বুঝবেন না, আগামীকাল তারা সেটাই বুঝবেন আরও অনেক কবর রচিত হবার পর। সেই কবরগুলির দায়ভার কি তারা নেবেন?


-----------------------------------------
*পড়ুনঃ ‘মার্কিন স্পেশাল ফোর্স ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ – সাম্প্রতিক দেশকাল, ২২শে অক্টোবর ২০১৫

**পড়ুনঃ ‘সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহঃ মার্কিন দু’মুখো নীতির নেপথ্যে’ – সাপ্তাহিক মৌবাজার, ২৬শে মার্চ ২০১৬

Tuesday, 23 February 2016

রিভারাইন ফোর্স নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে

২৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৬


নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কোন বাহিনী খুব একটা বেশি দেখা যায় না। তবে নদী-কেন্দ্রিক বাহিনীর ইতিহাস পৃথিবীতে কম নয়। বিশেষ করে নদী-কেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে ওঠার স্থানগুলিতে এরকম বাহিনীর আবির্ভাব দেখা গেছে বেশ নিয়মিতই। তবে নদী থাকলেই যে নদী-কেন্দ্রিক বাহিনী থাকবে, তা কিন্তু নয়। বাহিনীর দরকার হয়েছে সর্বদাই রাজনৈতিক কারণে। রাজনীতিই নদীকে খুঁজে পেয়েছে শক্তি এবং সম্পদ গড়ার কেন্দ্রে। আর সেখানেই শুরু হয়েছে নদী নিয়ে টানাটানি। নদী মানেই পানি; আর পানি মানেই শক্তি। সেই শক্তি নিয়েই রাজনীতির খেলায় নদী পরিণত হয়েছে সামরিক কর্মকান্ডের উতসভূমিতে। উদাহরণস্বরূপ ইউরোপের দানিয়ুব নদীর কথা বলা যায়। বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, হাঙ্গেরী, অস্ট্রিয়া, জার্মানি – এই সব দেশগুলিই এই নদীর পানিতে সিক্ত হয়েছে, এবং ইতিহাসের অনেক বড় বড় রাজনৈতিক এবং সামরিক সঙ্ঘাত এই নদী বরাবর সংঘটিত হয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্ববহ হওয়ায় এবং একে একটা শক্ত ভৌগোলিক বাধা হিসেবে চিন্তা করার কারণে অনেক রাজনৈতিক শক্তিই এই নদীকে মানচিত্রে খুঁজে ফিরেছে। নদী হয়েছে রাজনৈতিক শক্তিকে ভৌগোলিকভাবে নির্দিষ্ট আকৃতি দানের সীমানা প্রাচীর। যে নদী এই প্রাচীর রচনা করেছে বা প্রাচীর দিয়ে যে নদীকে কাটাকুটি করা হয়েছে, সেখানেই রাজনীতির খেলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি। ইন্দোচীনের মেকং নদী, ভারতীয় উপমহাদেশের গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র, আফ্রিকার নীলনদ, উত্তর আমেরিকার সেন্ট লরেন্স এবং হাডসন নদী, দক্ষিণ আমেরিকার পারানা-প্যারাগুয়ে-উরুগুয়ে-রিও ডে লা প্লাটা নদী – এরকম বেশ কিছু উদাহরণ দেয়া যাবে, যেখানে রাজনৈতিক সীমানা নদীকে কেন্দ্র করে বা নদীকে উপেক্ষা করে তৈরি করা, যার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন সময়ে নদীকে নিয়ে হয়েছে সংঘাত।

রাজনৈতিক সীমানা নদী থেকে সড়ে গেলেই আবার সেখান থেকে সংঘাত চলে গেছে – এমন উদাহরণও রয়েছে। যেমন, বর্তমান পোল্যান্ডের সীমানা মাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তৈরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেও পোল্যান্ডের সীমানা বর্তমান বেলারুশের অনেকটা ভেতরে ছিল। একারণে প্রিপইয়াত নদীর বেশ কিছু অংশ এবং তার সাথে প্রিপইয়াত জলাভূমির কিছু অংশ পোল্যান্ডের অধীন ছিল। ১৯২০-এর দশকে পোল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধ করে; আর সেই যুদ্ধের কেন্দ্রে থাকে প্রিপইয়াত জলাভূমি। এই জলাভূমি আমাদের দেশের হাওড় অঞ্চলের মতো। সেখানে অন্য কোন যোগাযোগের পদ্ধতি না থাকায় পোল্যান্ড ‘রিভার ফ্লোটিলা’ বা নদী-কেন্দ্রিক নৌবাহিনী তৈরি করেছিল। এরকম জলাভূমিতে যুদ্ধ করা খুব কষ্টকর বলেই সোভিয়েতরা সুযোগ বুঝে ১৯৩৯ সালে জার্মানরা পোল্যান্ড আক্রমণ করার সময়ে প্রিপইয়াত নদীর পুরোটা দখলে নিয়ে ফ্রন্টলাইন আরও পশ্চিমে ঠেলে দিয়ে বাগ নদীতে নিয়ে আসে। আজকের দিন পর্যন্ত সেই বাগ নদীই পোল্যান্ড এবং বেলারুশের সীমানা। প্রিপইয়াত জলাভূমি পুরোটাই বেলারুশের। কাজেই পোল্যান্ডের রিভার ফ্লোটিলাও আজ নেই।

কলম্বিয়ার নৌবাহিনীর Patrullera de Apoyo Fluvial (PAF) or Riverine Support Patrol Boat পৃথিবীর সবচাইতে অন্যরকম যুদ্ধজাহাজের একটি। উপরের ডিজাইনটি এর চতুর্থ জেনারেশনের সংস্করণ। বর্মাবৃত এই জাহাজ ছোট ছোট বোটের এসল্ট ইউনিটকে সাপোর্ট দেয়।

কলম্বিয়ার জঙ্গলে…

তবে পুরো নদী নিজের দেশের ভেতরে থাকলেই যে সেখানে সংঘর্ষের সম্ভাবনা নেই, তা কিন্তু নয়। সংঘর্ষের কারণ নদী না হলেও সংঘর্ষ নদীকে কেন্দ্র করেই হতে পারে। তখন রাজনৈতিক কারণেই নদী-কেন্দ্রিক বাহিনী তৈরি করা লাগতে পারে। সবচাইতে চমতকার উদাহরণ হলো কলম্বিয়া। প্রায় ছয় দশক ধরে কলম্বিয়াতে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গী গোষ্ঠীর আবির্ভাবের কারণে কলম্বিয়া নদী-কেন্দ্রিক বাহিনী গঠনের এক্সপার্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৫৬ সালে গঠন করা হয় Flotilla Avispa (Wasp Flotilla), যা কিনা কলম্বিয়ার নদী-কেন্দ্রিক বাহিনীর মূল। গত ছয় দশকে এই বাহিনী কখনোই ভেঙ্গে ফেলা হয়নি, বা এর শক্তিকে কমিয়ে ফেলা হয়নি। বর্তমানে কলম্বিয়ার রয়েছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যারিন ফোর্স (সদস্যসংখ্যা ২৩,০০০-এর উপরে) এবং পৃথিবীর সর্ববৃহত ‘রিভারাইন ফোর্স’ বা নদীকেন্দ্রিক বাহিনী। কলম্বিয়ার ম্যাগডালেনা নদী কলম্বিয়ার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হলেও এই নদী বরাবর জঙ্গী গোষ্ঠীরা অবস্থান নেয়ায় এই নদীকে রক্ষা করতে হচ্ছে তাদের। এর উপরে আবার রয়েছে রাজনৈতিক সীমানা নির্ধারণকারী নদী, যেগুলিকে নিয়ে কলম্বিয়া সংঘাতে জড়িয়েছে আরও আগে থেকে। ১৯৩২ সালে কলম্বিয়ার সাথে পেরুর সীমানা যুদ্ধ হয়, যা Leticia Conflict নামে পরিচিত। পেরু কলম্বিয়ার দুর্গমতম অঞ্চলের কিছু অংশ দখল করে নেয়। উদ্ভট রকমের সীমানা হওয়ায় কলম্বিয়ার পক্ষে তার পূর্ব এবং দক্ষিণ সীমানা রক্ষা করা ছিল অসম্ভবের কাছাকাছি; পেরুর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেরকমই ছিল। উভয় দেশের কাছেই তাদের ওই দুর্গম সীমানা রক্ষার্থে একমাত্র পদ্ধতি ছিল নদী-কেন্দ্রিক বাহিনী। কিন্তু তাদের দেশের অভ্যন্তর থেকে ওই নদীগুলিতে কিছুই পাঠানো যায় না!! সেই নদীতে জাহাজ পাঠানোর একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে আমাজন নদী, যা কিনা ব্রাজিলের অধীনে। অর্থাৎ উভয় দেশই ব্রাজিলের কাছে অনুমতি চেয়েছে আমাজনের ভেতর দিয়ে তাদের যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর জন্যে! কাজেই এদের সংঘাতের চাবি ব্রাজিলের হাতে ছিল অনেকটা। পেরু আমাজন নদীর মোহনায় পাহাড়া দিয়েছে, যাতে কলম্বিয়ার জাহাজ আমাজনের ভেতর দিয়ে গিয়ে কলম্বিয়া-পেরু সীমানা পর্যন্ত না পৌঁছে। পেরু সেসময় কলম্বিয়ার চাইতে সামরিক দিক থেকে বেশি শক্তিশালী থাকায় কলম্বিয়া বিরাট সমস্যায় পড়েছিল। তবে তারা সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছে।

কলম্বিয়া নদী-কেন্দ্রিক বাহিনী গঠনে বেশ নতুন নতুন কিছু চিন্তার আবির্ভাব ঘটিয়েছে। তাদের ডিজাইন এবং তৈরি করা Patrullera de Apoyo Fluvial (PAF) or Riverine Support Patrol Boat একটা সম্পূর্ণ নতুন জিনিস। একেবারেই অগভীর পানিতে (২.৫ ফুট থেকে প্রায় ১.৩ ফুট) চলতে সক্ষম এই জাহাজগুলি জবরজং বর্মে মোড়া, শক্তিশালী অস্ত্র বহণ করে, এমনকি হেলিকপ্টার নামার প্ল্যাটফর্মও রয়েছে এতে। Nodriza (mothership) নামে পরিচিত এই জাহাজগুলিকে নিয়ে তারা অনেকদিন ধরে আস্তে আস্তে এগিয়েছে। এখন তারা তৈরি করছে এর চতুর্থ জেনারেশনের ডিজাইন। কলম্বিয়ার অভ্যন্তরের গৃহযুদ্ধে সরকারী বাহিনীর সাফল্যের পিছনে বিরাট অবদান রয়েছে এই Nodriza-এর। এই জাহাজগুলি কোন অপারেশনে গিয়ে বেশ কয়েকদিন দুর্গম অঞ্চলে অবস্থান করতে পারে। এর সাথে ছোট দ্রুতগামী এসল্ট বোটের একটি বা দুইটি স্কোয়াড থাকে (৪টি বা ৮টি বোট), যেগুলিকে বিভিন্ন অপারেশনে সাপোর্ট দেয় এই জাহাজ। জাহাজের ভেতরে এই এসল্ট বোটের ক্রু-দের থাকার জায়গা থাকে, সাথে বোট চালানোর জ্বালানিও থাকে; অর্থাৎ এটা হচ্ছে একটা ফ্লোটিং বেইস। কোন সৈন্য আহত হলে তাকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দ্রুত সড়িয়ে নেবার ব্যবস্থাও থাকছে। এই জাহাজ এবং এর সাথের এসল্ট বোটগুলি গুরুত্বপূর্ণ নদীপথের আশপাশের এবং উপকূলীয় ভূমিতে কর্তৃত্ব রাখতে অতুলনীয়। তবে এই জাহাজ সবধরনের নদী-কেন্দ্রিক মিশনের জন্যে উপযুক্ত নয়। নদীর পাড় যদি অনেক শক্তিশালী স্থলবাহিনীর হাতে থাকে, তাহলে বড় ধরনের উভচর অভিযান চালাতে যে সংখ্যক সৈন্য পরিবহণ করতে হবে, সেটার জন্যে আমাদের কলম্বিয়া থেকে বের হতে হবে।

১৯৩৮ সালে তৈরি ব্রাজিলের নৌবাহিনীর রিভার মনিটর Parnaiba এখনো চলছে। সাম্প্রতিককালে এতে হেলিডেক যোগ করে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। তবে আসল ব্যাপার হলো একে এখনো প্রতিস্থাপন করা যায়নি।

ব্রাজিলের নদী পাহাড়া

ব্রাজিলের নৌবাহিনী নদীপথে ব্যবহার করছে বেশ কয়েকটি পরিবহণ জাহাজ, যেগুলি বড় সংখ্যক সৈন্য পরিবহণে সক্ষম। আমাজনের দুর্গম অঞ্চলে সৈন্য নেবার পদ্ধতি এটাই। একই সাথে তাদের রয়েছে কয়েকটি রিভার হসপিটাল শিপ। আরও রয়েছে বড় বড় কিছু amphibious warfare ship, যেগুলি আমাজন নদীতে উভচর অপারেশন চালাতে পারে। আমাজন নদী থেকে কিছু দূরে ব্রাজিলের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পারানা নদীতে টহল দেয় ১৯৩৮ সালে তৈরি monitor ship ‘Parnaiba’, যা পৃথিবীর সবচাইতে পুরোনো যুদ্ধজাহাজগুলির মধ্যে একটি। ৫৫মিটার এবং ৭২০টনের এই জাহাজে ৭৬মিমি, ৪০মিমি এবং ২০মিমি কামান বহণ করার পাশাপাশি একটা হেলিকপ্টার নামার ব্যবস্থাও এতে রয়েছে। ৫.২ফুট ড্রাফটের এই জাহাজটি বলিভিয়া এবং প্যারাগুয়ের সাথে ব্রাজিলের নদী-কেন্দ্রিক সীমানা পাহাড়া দেয়। ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত পারানা নদী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে ব্রাজিলের জাহাজগুলিকে সমুদ্রে যেতে হলে প্যারাগুয়ে এবং আর্জেন্টিনার অনুমতি লাগে। এই নদীকে কেন্দ্র করে উনিশ শতকের শেষের দিকে দক্ষিণ আমেরিকার সবচাইতে ধ্বংসাত্মক ‘প্যারাগুয়ে যুদ্ধ’ (১৮৬৪-১৮৭০) হয়েছিল। যাই হোক, এতো বছরে ব্রাজিল কিন্তু তাদের ওই পুরোনো মনিটর জাহাজটিকে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেনি; শুধু আরও উন্নত করেছে। নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন ডিজাইন নিয়ে এগুনোর সেই চেষ্টাটা দেখার জন্যে আমাদের যেতে হবে অন্য মহাদেশে; আরেক নদীতে; ইউরোপের রোমানিয়াতে; দানিয়ুব নদীতে।

শক্তির দিক বিচারে রোমানিয়ার নৌবাহিনীর রিভার মনিটরগুলি পৃথিবী-সেরা। দানিয়ুব নদী পাহাড়ায় এরাই সেরা।

দানিয়ুবের দানব

রোমানিয়ার দক্ষিণ সীমানা থেকে এর পূর্বাঞ্চল দিয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে দানিয়ুব। রোমানিয়া অনেকদিন যাবতই river monitor তৈরি করছে। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে ‘Smardan’-class-এর (৫১মিটার, ৩৭০টন। ৪ফুট১১ইঞ্চি ড্রাফট) পাঁচটি এবং ১৯৯০-এর দশকে রোমানিয়া ‘Mihail Kogălniceanu’-ক্লাসের (৫২মিটার, ৫২২টন, ৫ফুট৩ইঞ্চি ড্রাফট) তিনটি মনিটর যুদ্ধজাহাজ তৈরি করে। শেষোক্ত জাহাজগুলি দুইটি ১০০মিমি কামান এবং ৮০টি ১২২মিমি রকেট ছাড়াও ৩০মিমি এবং ১৪.৫মিমি কামানে সজ্জিত। একেবারে ভাসমান আর্টিলারি যাকে বলে আরকি। ‘Smardan’-class-এর জাহাজগুলিও একটি ১০০মিমি কামান, ৮০টি ১২২মিমি রকেট সহ ২৩মিমি ও ১৪.৫মিমি কামানে সজ্জিত। দুই ক্লাসের জাহজই আবার কাঁধে বহণযোগ্য বিমান ধ্বংসী মিসাইল নেয়। এই জাহাজগুলির ড্রাফট মাত্র ৫ ফুটের মতো; অর্থাৎ যুদ্ধের সময়ে অনেক অগভীর পানিতে আবির্ভূত হয়ে এগুলি অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। নদীপথে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও ব্যাপক আকারে উভচর অভিযানের মাধ্যমে নদীর অপর পাড়ে ব্রিজহেড গড়ার অপারেশনে এসব জাহাজ বিশেষ উপযোগী। এই জাহাজগুলি উভচর অভিযানের সময়ে শত্রুপক্ষের ফর্মেশনের উপরে রকেট এবং কামানের মাধ্যমে ইনিডিরেক্ট ফায়ারিং যেমন করতে পারবে, তেমনি নদীতীরে শত্রুদের স্থির বা চলমান যেকোন লক্ষ্যবস্তুতে সরাসরি কামানের গোলাবর্ষণ (ডিরেক্ট ফায়ারিং) করতে পারবে। কলম্বিয়ার PAF যুদ্ধজাহাজগুলির ফায়ার সাপোর্ট যেখানে কম হয়ে হতে যেতে পারে, সেখানে রোমানিয়ার এই river monitor-গুলি যথেষ্ট শক্তিশালী হতে পারে। তবে PAF-এর মতো এই monitor-গুলি কোন রিভার এসল্ট বোটের গ্রুপকে সাপোর্ট দিতে পারে না। দ্রুতগামী জিআরপি এসল্ট বোট নিয়ে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের পোস্টে লিখেছি। এখানে সেই একই বোট নিয়ে আবার লিখছি না। তবে যদি দ্রুততার স্থানে বর্মাবৃত বোটের দরকার হয় রিভার এসল্ট অপারেশনে? এটা দরকার হতে পারে যখন শত্রুরা সংখ্যায় বেশি এবং যথেষ্ট পরিমাণে অস্ত্রে সজ্জিত, যেমন হেভি মেশিন গান, মর্টার, রকেট লঞ্চার, গ্রেনেড ইত্যাদি। এধরনের পরিবহণ খুঁজতে হলে আমাদের আবার এশিয়াতে ফেরত আসতে হবে; ইন্দোচীনের মেকং নদীতে।

ভিয়েতনামে মার্কিন নৌবাহিনী Armored Troop Carrier (ATC) তৈরি করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপকহারে তৈরি করা LCM-6 ল্যান্ডিং ক্রাফটকে ওয়ার্কশপে নিয়ে পরিবর্তনের (conversion) মাধ্যমে। এর উপরের কভারটি দেওয়া হয়েছিল মর্টার রাউন্ড থেকে বাঁচার জন্যে, আর বডির উপরে লোহা দিয়ে স্ট্রাকচার বানানো হয়েছিল এন্টি-ট্যাঙ্ক রকেট থেকে বাঁচার জন্যে।

মেকং নদীর বদ্বীপে এসল্ট ফোর্স

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের গুরুত্বপূর্ণ নদীপথগুলিকে সচল রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক করে যে পুরো মেকং নদীর বদ্বীপ থেকে কমিউনিস্ট গেরিলাদের উতখাত করতে হবে। তারা পুরো উপকূলে নৌ-অবরোধ দেয়া ছাড়াও বদ্বীপ অঞ্চলে Mobile Riverine Force (MRF) নামে এক বাহিনী গঠন করে ১৯৬৭ সালে। MRF-এর নৌবাহিনীর অংশকে বলা হতো Task Force 117 (TF-117) এবং এতে ছিল চারটি River Assault Division, যার প্রতিটিতে ছিল ১৩টি করে Armored Troop Carrier (ATC), তিনটি করে monitor, একটি Command and Control Boat (CCB) এবং ৮টি করে Assault Support Patrol Boat (ASPB)। ATC, monitor এবং CCB – এই তিনটি জলযানই তৈরি করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত LCM-6 ল্যান্ডিং ক্রাফটকে ওয়ার্কশপে নিয়ে পরিবর্তনের (conversion) মাধ্যমে। ৫৬ফুট লম্বা এবং সাড়ে তিন ফুট ড্রাফটের ATC-গুলি মোটাগুলি ৪০ জনের মতো একটা প্লাটুন পরিবহণ করতো, এবং তাতে একইসাথে ২০মিমি কামান, দু’টা ১২.৭মিমি হেভি মেশিন গান এবং গ্রেনেড লঞ্চার থাকতো। “Tango” বোট নামে পরিচিত এই বোটের বডিতে আলগাভাবে রডের তৈরি স্ট্রাকচার লাগিয়ে দেওয়া হয়, যেগুলি নদীর পাড় থেকে কেউ রিকোয়েললেস রাইফেল বা এন্টি-ট্যাঙ্ক রকেট ছুঁড়লে সেটা থেকে বোটকে বাঁচাতো। এর উপরে ত্রিকোণাকৃতির একপ্রকার ক্যানভাসের ঢাকনা দিয়ে দেওয়া হয়, যেটা বোটের উপরে ছুঁড়ে দেওয়া গ্রেনেডকে বোটের পাশে পানিতে ফেলে দিতে সাহায্য করতো। Monitor-গুলির ক্ষেত্রে অবশ্য ল্যান্ডিং ক্রাফটের সামনের র‌্যাম্প সড়িয়ে চোখা করে দেওয়া হয়। ATC-এর অস্ত্রের উপরে এই বোটগুলিতে থাকতো ৪০মিমি কামান এবং ৮১মিমি মর্টার। ৬০ ফুট লম্বা এই বোটগুলিকে “নদীর ব্যাটলশিপ” বলে ডাকতো অনেকেই। তবে রোমানিয়ার নৌবাহিনীর মনিটরগুলির কাছে এগুলি যে কিছুই না, সেটা বলাই বাহুল্য। কিছু মনিটর জাহাজকে মার্কিনরা Flame Thrower দিয়ে সজ্জিত করে, যেগুলিকে তারা সিগারেট লাইটারের ব্র্যান্ডের নামানুসারে “Zippo Boat” বলে ডাকতো! CCB-গুলি মনিটরের মতোই ছিল, শুধু ৮১মিমি মর্টারের স্থানে এতে থাকতো রেডিও এবং যোগাযোগ যন্ত্রপাতি। CCB এবং মনিটরে নৌচলাচলে সুবিধার জন্যে রাডার থাকতো। এই একই ল্যান্ডিং ক্রাফট থেকে ১০,০০০ গ্যালন জ্বালানি পরিবহণের জন্য রিফুয়েলার বোট, সার্জারির যন্ত্রপাতিসহ হসপিটাল বোট এমনকি আহতদের সড়ানোর জন্যে হেলিকপ্টার প্ল্যাটফর্ম বোটও (বোটের বেশিরভাগটাই হেলিপ্যাড থাকতো) তৈরি করা হয়েছিল। ASPB-গুলি ছিল ভিয়েতনামকে মাথায় রেখে ডিজাইন করা বোট। ৫০ ফুটের এই বোটগুলি শক্ত খোলে তৈরি ছিল বলে পানিতে মাইন বিস্ফোরণ সহ্য করতে পারতো বেশ। মাইন সুইপার হিসেবেও এই বোটগুলি ব্যবহার হতো। ৮২মিমি মর্টার, ২০মিমি কামান এবং মেশিন গান থাকতো এগুলিতে। 
ভিয়েতনামের একটি Mobile Riverine Base or MRB, যেখানে ঘাঁটিটি ছিল কনভার্ট করা ল্যান্ডিং শিপ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তৈরি করা হয়েছিল। পাশের ছোট বোটগুলি হলো ATC, CCB এবং monitor, যেগুলি সবগুলিই কনভার্ট করা ল্যান্ডিং ক্রাফট। জাহাজের উপর থেকে হেলিকপ্টার অপারেট করতো।


এই বোটগুলি একটা ভাসমান ঘাঁটির (Mobile Riverine Base or MRB) সাথে যুক্ত থাকতো, যেখান থেকে তারা মিশন পরিচালনা করতো। এই ঘাঁটিগুলি প্রধান নদীর মুখে অবস্থান করতো; সেখান থেকে এসল্ট ফোর্স আক্রমণে যেত। সেই ঘাঁটির প্রধান জাহাজ ছিল দুইটি ব্যারাক শিপ, যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তৈরি ট্যাঙ্ক ল্যান্ডিং শিপ (Landing Ship Tank or LST) থেকে পরিবর্তন (conversion) করে তৈরি করা। এর সাথে থাকতো দুইখানা ফ্লোটিং ব্যারাক যেগুলি নিজে চলতে পারতো না, একটা রিপেয়ার শিপ (LST থেকে পরিবর্তন করে তৈরি) যা ছোট বোটগুলিকে মেরামতের কাজ করতো, একটা নেট লেয়িং শিপ (Net Laying Ship) যা জাল বিছিয়ে পানির নিচে দিয়ে ফ্রগম্যানদের আক্রমণ থেকে ঘাঁটিকে রক্ষা করতো, এবং দুইখানা টাগবোট, যা পানিতে কোনকিছু ঠেলাঠেলি বা টানাটানির কাজ করতো। পুরো ঘাঁটিটি জায়গা পরিবর্তন করতে পারতো; যখন যেখানে দরকার চলে যেত এবং মিশন শেষ করে আবার স্থান পরিবর্তন করতো। এখানে ঘাঁটির বড় জাহাজগুলির ড্রাফট ছিল ৮ফুট থেকে ১১ফুট, অর্থাৎ এই ঘাঁটি শুধু বড় নদীর মুখে অবস্থান করতো। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মার্কিন নৌবাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তৈরি করা অনেকগুলি জাহাজ ব্যবহার করেছে এই নদী-কেন্দ্রিক বাহিনী তৈরি করতে। জাহাজ এবং ছোট বোটের এই বাহিনী ছিল নৌবাহিনীর অধীনে, কিন্তু এদের দ্বারা পরিবাহিত সেনারা ছিল মার্কিন সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের। মেকং নদীর বদ্বীপে এসল্ট অপারেশন চালানোর জন্যে TF-117-কে তৈরি করা হয়েছিল। তবে এই বাহিনী নদীতে পাহাড়ার কাজ করতো না; সেই কাজ করতো Task Force 116 (TF-116). এসল্ট ফোর্সের কাজ শুরুর আগেই এই TF-116 কাজ শুরু করে।
 
গ্লাস-ফাইবারে তৈরি ৩১ ফুট লম্বা Patrol Boat River (PBR) ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে সবচাইতে বেশি সংখ্যক তৈরি করা হয়েছিল। এগুলি সর্বক্ষণ মেকং নদীর বদ্বীপ পাহাড়া দিতো। আর মাত্র ৯ইঞ্চি গভীর পানিতে চলতে পারতো!

মেকং রিভার প্যাট্রোল

TF-116 বা River Patrol Force কাজ করা শুরু করে ১৯৬৬ সাল থেকে। এর প্রধান বোট ছিল গ্লাস-ফাইবারে তৈরি ৩১ ফুট লম্বা Patrol Boat River (PBR). ওয়াটার জেটে চলা এই বোটগুলি মাত্র ৯ ইঞ্চি পানিতে চলতে সক্ষম ছিল! অস্ত্র হিসেবে এই বোটগুলি ১২.৭মিমি এবং ৭.৬২মিমি মেশিন গান এবং গ্রেনেড লঞ্চার ব্যবহার করতো। এসল্ট ফোর্সের বোটগুলি যেখানে ঘন্টায় ১২ থেকে ১৬ নটিক্যাল মাইলের বেশি গতিতে চলতে পারতো না, সেখানে এই ছোট্ট PBR বোটগুলি ২৫ থেকে ২৯ নটিক্যাল মাইল বেগে চলতে পারতো। ভিয়েতনামি গেরিলাদের ব্যবহার করা বোট এরা তাড়া করতো; তাদেরকে নদীর মাঝে ও পাড় ঘেঁষে ধাওয়া করতো; সারাদিন ধরে নদীতে টহল দিয়ে ছোট-বড় সকল নৌকায় অস্ত্র, সামরিক জনবল ও অন্যান্য সাপ্লাই-এর চালান ধরার জন্যে তল্লাশি করতো। অত্যন্ত অগভীর নদী-নালাও এদের প্যাট্রোল থেকে রক্ষা পেত না। ভিয়েতনামে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ২৫০টি এরকম বোট তৈরি করা হয়েছিল। মোট পাঁচটি River Division পাঁচটি স্থান (নদীর তীর বা ভাসমান কোন ঘাঁটি) থেকে অপারেট করতো, যেগুলির একেকটিতে দুইটি করে সেকশন থাকতো। একেকটি সেকশনে ১০টি করে এভাবে ২০টি বোট থাকতো প্রতি ডিভিশনে। এগুলিকে সাপোর্ট দেবার জন্যে ৫টি জাহাজ মোটামুটি সবসময়েই প্রস্তুত ছিল। এই জাহাজগুলি ছিল সেই TF-117-এর ঘাঁটির মতোই, অর্থাৎ কেন্দ্রে থাকতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তৈরি করা ট্যাঙ্ক ল্যান্ডিং শিপ, যেগুলিকে পরিবর্তন করে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই জাহাজগুলির ডেকের উপরে হেলিপ্যাড বসানো হয়েছিল যেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে সৈন্য পাঠানো হতো।
  
মার্কিন নৌবাহিনী তাদের বেশকিছু ল্যান্ডিং শিপকে রকেট লঞ্চার দিয়ে সাজিয়ে ফায়ার সাপোর্ট শিপ বানিয়ে ফেলে। এই জাহাজগুলি উভচর অভিযানের সময়ে বেশ ব্যাপক পরিমাণে ধ্বংসজজ্ঞ চালাতে সক্ষম ছিল।


মেকং-এর মাইন সুইপার এবং ফায়ার সাপোর্ট শিপ

TF-116 এবং TF-117-এর যে ফোর্সগুলির কথা বলা হয়েছে, তা ছাড়াও মেকং বদ্বীপ অঞ্চলে স্পেশাল ফোর্সের সৈন্যরা অপারেট করতো। এরা আলাদা ঘাঁটিতে থাকতো এবং বিভিন্ন ধরনের নৌযান ছাড়াও হেলিকপ্টার ব্যবহার করতো। এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মিশন রয়েছে নদী-কেন্দ্রিক বাহিনী তৈরিতে, যেটা মেকং বদ্বীপ অঞ্চলে দেখা গিয়েছিল। TF-116-এর অধীনে ছিল Mine Division 112 (Mine Squadron 11, Detachment Alpha), যার কাজ ছিল প্রধান সমুদ্রবন্দর সায়গনের সাথে সমুদ্রের সংযোগ করা প্রধান নদীপথকে মাইন থেকে মুক্ত রাখা। ৫৭ ফুট লম্বা কাঠের তৈরি Mine Sweeping Boat (MSB)-গুলি দেখতে পল্কা হলেও এগুলির কাজ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নদীতে মাইনসুইপিং করে এরা সমুদ্রবন্দরকে সচল রেখেছিল। মার্কিনীরা অনেক ধরনের মাইনসুইপারের সাথে এই MSB-গুলি তৈরি করেছিল ১৯৫০-এর দশকে কোরিয়ার যুদ্ধের সময়ে।

রিভার এসল্ট ফোর্সের জন্যে ফায়ার সাপোর্ট দিতে গিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনী এক সমস্যায় পড়ে। মেকং-এর জংলা যায়গার মাটিতে আর্টিলারি ফায়ার করার পরে নরম মাটিতে ডুবেই যেত। তাই তারা কিছু পন্টুন ডিজাইন করে, যেগুলি টাগবোট দিয়ে টেনে নিয়ে বিভিন্ন সুবিধাজনক যায়গায় নিয়ে যেত এবং সেখান থেকে ইনডিরেক্ট ফায়ার সাপোর্ট দিত। তবে এই বাইরেও উপকূলের কাছাকাছি ফায়ার সাপোর্ট দিতে তাদের ছিল ফায়ার সাপোর্ট শিপ।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন নৌবাহিনীর সবচাইতে আলাদা রকম ইউনিটগুলির অন্যতম ছিল Inshore Fire Support Division 93 (IFSDIV93), যেটার দায়িত্ব ছিল উভচর অভিযানের সময় স্থলভাগের উপরে গোলাবর্ষণ। এই ইউনিটের ফ্ল্যাগশিপ ছিল USS Carronade, যেটা কিনা ১৯৫০-এর দশকে কোরিয়ার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে ডিজাইন করা হয়েছিল এই কাজের জন্যেই। ৭৫ মিটার লম্বা এই জাহাজ প্রতি মিনিটে ২৪০টা আর্টিলারি রকেট নিক্ষেপে সক্ষম ছিল। এর সাথে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তৈরি ৬৩ মিটার লম্বা তিনটি Landing Ship Medium (Rocket) বা LSM(R); এগুলিও সমান সংখ্যক রকেট নিক্ষেপ করতে পারতো। চারটি জাহাজেই রকেটের সাথে সাথে একটি করে ৫ ইঞ্চি কামান ছিল। LSM(R)-গুলি কোরিয়ার যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় এবং যুদ্ধশেষে ডিকমিশন করে ফেলা হয়। ভিয়েতনামে এই জাহাজগুলি আবারও ব্যাপকভাবে ব্যবহার হলেও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরার সাথে সাথেই ডিকমিশন করে ফেলা হয়। 

  
আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময়ে তৈরি রিভার মনিটর। মার্কিনীরা রিভারাইন ফোর্স গঠন করেছে বেশ কয়েকবার, কিন্তু কখনোই সেটা রেখে দেয়নি; প্রতিবারই ভেঙ্গে ফেলেছে। তারা দরকার হাজির হলেই কেবল রিভারাইন ফোর্স গঠন করেছে।
 
রিভারাইন ফোর্সের স্থায়িত্ব – মার্কিনী বনাম কলম্বিয়া/রোমানিয়া/সার্বিয়া

উপরে বর্ণিত মার্কিনীদের বেশিরভাগ বোটের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে তারা সেগুলিকে কাজ শেষ হয়ে গেলেই অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে বা বিক্রি করে দিয়েছে। মার্কিনীরা কখনোই সবসময়ের জন্যে নদী-কেন্দ্রিক বাহিনী ধরে রাখতে চায়নি। ১৮৩৫ থেকে ১৮৪২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে আদিবাসীদের সাথে সংঘটিত Second Seminole War-এ আমেরিকা প্রথম রিভার ফোর্স তৈরি করে। যুদ্ধ শেষে সেটা তারা রাখেনি। এরপরে ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সালের আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময়েও রিভার ফোর্স তৈরি করা হয়; সেটাও যুদ্ধ শেষে রাখা হয়নি। তাদের এই চিন্তাটা কলম্বিয়া বা রোমানিয়ার বাহিনী থেকে পুরোপুরি আলাদা। আমরা এখানে সার্বিয়ার কথাও আনতে পারি। দানিয়ুব নদী রোমানিয়া থেকে সার্বিয়ায় ঢুকে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডের উপর দিয়ে গিয়ে হাঙ্গেরীতে ঢুকেছে। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই দানিয়ুব এবং সাভা নদী রক্ষায় নৌবাহিনী নিয়োজিত করেছিল। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সার্বিয়ার বিদ্রোহীরা জার্মান-অধিকৃত সার্বিয়াতে দানিয়ুবের নদীপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। যুদ্ধের পর থেকে যুগোস্লাভিয়া এবং পরে সার্বিয়ানরা প্যাট্রোল বোট, এসল্ট ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং মাইনসুইপার তৈরিতে বেশ গুরুত্ব দিতে থাকে। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে তারা প্রতিবেশী দেশ হাঙ্গেরীতে তাদের তৈরি ৩.৫ ফুট ড্রাফটের Nestin-class রিভার মাইনসুইপার বিক্রিও করে। নদীর মাইনসুইপারের ব্যাপারটা সার্বিয়ানদের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেখানে নদীপথের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেশি। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনীরা মাইনসুইপার ব্যবহার করেছিল একই গুরুত্বপূর্ণ কাজে; কিন্তু তারা সার্বদের মতো এই চিন্তাটাকে স্থায়িত্ব দেয়নি। ‘দরকার হলে তৈরি করে নেব’ –এই ধরনের একটা প্রবণতা তাদের মাঝে বিরাজ করেছে; আজও করছে। ২০০৫ সালের দিকে এসে নদী-কেন্দ্রিক এই চিন্তাটা তাদেরকে আবারও ধরে বসেছে; অর্থাৎ তাদের আবারো দরকার পড়েছে।
  
২০০৩ সালে ইরাক দখলে পর মার্কিনীরা আবারও রিভারাইন ফোর্সের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে। এবার তারা কোস্টাল এবং রিভারাইন একত্রে ডেভেলপ করছে। এর জন্যে তাদের রয়েছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।

বাগদাদ থেকে ঢাকা……

২০০৩ সালে ইরাক দখল করে নেবার পরে ইরাকে মার্কিন বাহিনী বুঝতে শেখে যে তাদের জন্যে ইউফ্রেটিস নদী নিয়ন্ত্রণের একটা বাহিনী দরকার। বেশ তাড়াহুড়া করেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের রিভারাইন ফোর্সের আদলে তারা আবারও সেই বাহিনী গঠন করে। Riverine Squadron 1 (RIVRON-1) নামের প্রথম ইউনিটটিকে ২০০৭ সালের মার্চে ইরাকের হাদিথা বাঁধ রক্ষার্থে পাঠানো হয়। ২০১২ সালের জুনে মার্কিন ম্যারিন কোরের Marine Expeditionary Security Group (MESG)-2-এর সাথে মিলে গিয়ে Coastal Riverine Force (CORIVFOR) তৈরি করা হয়। এর দায়িত্ব বর্তায় নদী এবং সমুদ্রবন্দর, উপকূলীয় স্থাপনা এবং মার্কিনীদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ নদী ও উপকূলীয় নৌপথের নিরাপত্তা দেওয়া। অর্থাৎ একদিকে যেমন নৌবাহিনী ও ম্যারিন কোরের সমন্বয়ে এই ফোর্স তৈরি করা হলো, তেমনি উপকূলীয় এবং নদীর অপারেশনকে একত্রে হিসেব করা শুরু হলো। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জন্যে নদী-কেন্দ্রিক যুদ্ধ নতুন না হলেও আজকের এই সেনাদের জন্যে নতুন; তাদের শিখতে হচ্ছে সবকিছুই। ইরাকে মোতায়েনের মাধ্যমে প্রতি নিয়তই তারা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে থাকে। ভিয়েতনামের মতোই এই ফোর্সের মুখরোচক নাম হয় “Brown Water Navy”.

এসময়েই প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় এই বাহিনীর স্থায়িত্ব নিয়ে। তাদের সামরিক চিন্তাবিদদের মাঝে যে প্রশ্নটি আসে তা হলো – আমরা কি এই বাহিনীকে শুধু ইরাকের জন্যেই তৈরি করছি, নাকি বাকি বিশ্বে ব্যবহার করার কথা মাথায় রেখে একে সেভাবেই ডিজাইন করবো? মার্কিনীরা দ্বিতীয় অপশনটাকেই বেছে নিয়েছে। ২০০৬ সালের মার্চে তৈরি করা এক রিপোর্টে রিভার ফোর্স কেমন হওয়া উচিত, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্বের ৩৮টি দেশের একটি লিস্ট তৈরি করা হয়, যেসব দেশের নদী এবং ততসংলগ্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে তাদের রিভারাইন ফোর্স কতটুকু প্রস্তুত, সেটার উত্তর খোঁজা হয়। লিস্টে যেসব দেশের নদীপথ বেশি লম্বা এবং যেসব দেশের বদ্বীপ অঞ্চল বেশি বড়, অর্থাৎ যেগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক বড় ফোর্স লাগতে পারে, সেগুলিকে আলাদাভাবে হাইলাইট করা হয় এই বলে যে সেগুলিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মতো যথেষ্ট শক্তি তাদের নেই এবং ভবিষ্যতেও সেইসব দেশের সরকার ও মানুষের সাহায্য ব্যতীত ওইসব নদী-অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। “গ্যাপ কান্ট্রি” বলে পরিচিত এই দেশগুলিতে ভবিষ্যত অপারেশনের কথা মাথায় রেখেই তারা তাদের হিসেব কষে। নদীপথের মোট দৈর্ঘ্য বিবেচনায় প্রথম সাড়ির ২২টি দেশের মাঝে বাংলাদেশের নাম রয়েছে প্রথম দশের ভেতরে। আর আরেকটি লিস্ট করা হয়েছে বদ্বীপের আকার (বর্গ কিঃমিঃ) হিসেবে, যেখানে রয়েছে মাত্র ১০টি দেশের নাম। এই লিস্টে বাংলাদেশের নাম ‘এক’ নম্বরে! আমাদের বদ্বীপ এলাকাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা যত উদাসীনই হই না কেন, দুনিয়ার উল্টোপাশে যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বেশ চিন্তিত। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নীতি অনুসারে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স Special Wardare Diving Slvage (SWADS) গড়তে সহায়তা করে। বাংলাদেশের নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডকে তারা বেশ নিয়মিতই Metal Shark 38 Defiant, SafeBoats 25ft Defender আর Rigid Hull Inflatable Boat (RHIB) সিরিজের ছোট দ্রুতগামী বোট দিয়ে যাচ্ছে, আবার একই সাথে নিয়মিত যৌথ মহড়াও চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির সাথে সমন্বয় করে এগুনোর ফলে আমাদের স্বার্থ যতটা না রক্ষিত হচ্ছে, তার চাইতে বেশি লাভ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। বাংলাদেশের বদ্বীপের কতটুকু যে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, সেটা বরং আজ চিন্তা করার সময় এসেছে। এদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। 
বাংলাদেশের নদীগুলি দেশের মাঝ দিয়ে ধমনীর মতো প্রবাহিত এবং একইসাথে দেশের স্থলভাগকে সুঁই-সূতা দিতে সেলাই করে রেখেছে। এদেশে রিভারাইন ফোর্স থাকাটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হবার কথা ছিল; কিন্তু তা হয়নি। আমাদের চিন্তা ভুল পথে প্রবাহিত হওয়াটাই এর জন্যে দায়ী।

 
যমুনা নদীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং এর নিরাপত্তা

চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী আর খুলনা অঞ্চলের ম্যারিটাইম গুরুত্ব মোটামুটি অনেকেই বোঝেন। তবে এর সাথে এই অঞ্চলগুলির নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। আর এই অঞ্চলগুলির বাইরের অঞ্চলগুলির নৌ-নিরাপত্তার কোন অস্তিত্বই নেই তাদের কাছে। এই দেশের অভ্যন্তরে ৯০% জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয় নৌপথে। উজানে বেশিরভাগ নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে নদীতে নাব্যতার যে সংকট দেখা দিয়েছে, তার মাঝেও নদীপথের গুরুত্ব যথেষ্ট পরিমাণে কমেনি। বরং এখন অনেকেই নদীপথের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশংকায় নতুন কর্মপদ্ধতি দেখতে চাইছেন। নদী ড্রেজিং-এর মাঝেই সমাধান যে নিহিত, সেটা আজ অনেকেই বুঝতে পারছেন। বাংলাদেশের নদীগুলির প্রকৃত গুরুত্ব খুঁজতে তাকাতে হবে দেশের মধ্যে ধমনীর মতো করে প্রবাহিত পদ্মা-মেঘনা-যমুনার দিকে। যমুনা দিয়েই শুরু করা যাক।

উত্তরাঞ্চলে দেশের বিশাল শস্যক্ষেতে রাসায়নিক সারের সাপ্লাই দিতে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হচ্ছে বাঘাবাড়ি ঘাট এবং তার সাথে সেকেন্ডারি গুরুত্বে রয়েছে নগরবাড়ি ঘাট। উত্তরাঞ্চলে সেচের জন্যে জ্বালানি তেলের সরবরাহও বাঘাবাড়ি দিয়েই হয়। শুষ্ক মৌশুমে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত নাব্যতা রক্ষা বর্তমানে একটা বড় সমস্যা। সেখান থেকে উত্তরে নাব্যতা আরও অনেক খারাপ। গাইবান্ধা এবং কুড়িগ্রাম অঞ্চলে যমুনা নদীতে একসময় তেলের ডিপো ছিল, যা এখন নাব্যতার অভাবে অকার্যকর। তেলের সাপ্লাই নিশ্চিত না হওয়ায় উত্তরাঞ্চলে তেলের উপরে নির্ভর করে বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। জামালপুরের বাহাদুরাবাদ থেকে যমুনা পাড় হয়ে গাইবান্ধার ফুলছড়িঘাট ও বালাসিঘাট পর্যন্ত রেলওয়ের ফেরি ছিল (এখনও আছে), যা এখন নাব্যতার অভাবে কাজ করছে না। উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত নদীবন্দর কুড়িগ্রামের চিলমারী এবং বগুড়ার সারিয়াকান্দিরও শুষ্ক মৌশুমে একই অবস্থা হয়; তবে বর্ষায় এই বন্দরগুলিতে পানি থাকে। যমুনার পূর্বপাড়েও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর গুঠাইল বাজার। এই বন্দরগুলি কৃষিজ পণ্যের জন্যে বিখ্যাত। জামালপুরের সরিষাবাড়ির জগন্নাথগঞ্জে রেলওয়ের ফেরিঘাট রয়েছে, যা যমুনা সার কারখানার সাথে যুক্ত, কিন্তু নাব্যতার কারণে এটা এখন অকার্যকর। তিস্তা নদীর নাব্যতার অবস্থাও যা-তা; তাই রংপুরকে নদীপথে দেশের বাকি অঞ্চলের সাথে যুক্ত করা যাচ্ছে না। দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করার জন্যে যমুনা নদীতে নাব্যতা বৃদ্ধি করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। ব্যাপক খননের মাধ্যমে যমুনা নদীকে অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি ব্যবহার করতে গেলে সেখানে নিরাপত্তার প্রশ্নটাও এসে যাবে। নদীপথ, নদীবন্দর, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (যেমন যমুনা নদীতে বর্তমান বঙ্গবন্ধু সেতু এবং ভবিষ্যতের অন্যান্য সেতু) পাহাড়া দিতে রিভার প্যাট্রোল বা নৌটহলের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীতে কোস্ট গার্ড এবং নৌবাহিনী বর্তমানে যেভাবে টহল দিচ্ছে সেভাবে যমুনাতেও টহলের ব্যবস্থা করতে হবে। কুড়িগ্রামের পূর্বে যমুনাতে সীমানা টহলও এই ফোর্সের কাজ হওয়া উচিত। আলাদা ম্যারিটাইম জোন গঠন করতে হবে এই টহলের জন্যে। বর্তমানে কোস্ট গার্ড এই দায়িত্ব পালন করছে বলে তারাই এই কাজের জন্যে সবচাইতে উপযুক্ত বলে মনে হয়। Harbour Patrol Boat (HPB), High-Speed Patrol Boat (HSPB) ছাড়াও একেবারে অগভীর পানিতে চলার জন্যে উপযোগী বোট এই নদীপথ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং নদীবন্দরগুলির আশেপাশে টহলে দরকার হবে। বাংলাদেশের শিপইয়ার্ডগুলি এধরনের বোট এখন তৈরি করছে।

রিভারাইন ফোর্স (যমুনা)

তবে যমুনাতে টহলই সব নয়। এই নদী দেশের পশ্চিমাঞ্চলের সাথে মধ্যাঞ্চলের সেলাই-সদৃশ। এই সেলাইকে তখনই সেলাই বলা যাবে যখন যে কোন স্থান দিয়ে সামরিক বাহিনীর নদী পারাপারের সুবন্দোবস্ত থাকবে। এর জন্যে দরকার হবে রিভার এসল্ট ফোর্স। যেকোন সময়ে নদী পারাপার নিশ্চিত করা এবং নদীর দুই পাড় নিরাপদ রাখাই হবে এই ফোর্সের প্রধান কাজ এবং এগুলি হবে মূলত বিভিন্ন ল্যান্ডিং ক্রাফট, যেমন LCT, LCU, LCM, LCVP ইত্যাদি, যা নৌবাহিনীই সবচাইতে ভালো হ্যান্ডেল করতে পারবে। এগুলির সংখ্যা এবং আকার হওয়া উচিত কি পরিমাণ সৈন্য এবং রসদ একবারে পরিবহণ করা হবে, সেটার উপরে। এই এসল্ট ফোর্সের সেনারা আসা উচিত সেনাবাহিনী থেকে, যেটা নদীর দুই পাড়ের সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করা সহজ করবে। তবে শুধুমাত্র যমুনা সেতু রক্ষার জন্যে গঠিত ৯৮ কম্পোজিট ব্রিগেড যমুনা নদীর পুরো দৈর্ঘ্যের জন্যে যথেষ্ট না-ও হতে পারে। যমুনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে, যেগুলির নিরাপত্তা দিতে গিয়ে এই ফোর্সের একটি থেকে তিনটি সিকিউরিটি ব্যাটালিয়ন লেগে যেতে পারে। এদের প্রধান কাজ হবে হার্বার ডিফেন্স বা নদীবন্দর রক্ষা। এক্ষেত্রে বন্দরের ভিতরে এবং বাইরে নিরাপত্তা দেওয়াই হবে এই অংশের কাজ। সাথে ৯৮ কম্পোজিটের মতো সেতু রক্ষাও হবে এর দায়িত্ব। এসল্ট ফোর্স হওয়া উচিত আলাদা এবং এর আদর্শ আকৃতি হতে পারে একটা মোবাইল ব্রিগেড।

একই সাথে উভচর অপারেশনে সাহায্য করার জন্যে স্পেশাল ফোর্সের বোটেরও (জিআরপি-তে তৈরি) একটা গ্রুপ দরকার হবে, যে ধরনের বোটের কথা শ্রীলঙ্কা নিয়ে পোস্টে লিখেছি। আর এই রিভার এসল্ট ফোর্সের ফায়ার সাপোর্ট আসবে কিছু ফায়ার সাপোর্ট জাহাজ থেকে, যেগুলি নৌবাহিনীর কাছে থাকাটাই সমীচিন হবে। আমরা এর জন্যে তাকাতে পারি রোমানিয়ার রিভার মনিটরগুলির দিকে। আবার ভিয়েতনামে মার্কিনীদের ব্যবহৃত রকেট ফায়ার সাপোর্ট শিপও আমরা দেখতে পারি, যা কিনা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে ডিজাইন করা, কারণ ল্যান্ডিং ক্রাফট ডিজাইন এমনকি বাণিজ্যিক পরিবহণ জাহাজের নকশা পরিবর্তন করেই এটা বানানো সম্ভব। আমাদের দেশের শিপইয়ার্ডগুলি যেহেতু ল্যান্ডিং ক্রাফট তৈরি করে, তাই এটা খুব একটা কঠিন কাজ হবার কথা নয়। ৩ থেকে ৪টা রিভার মনিটর নদীর প্রায় পুরো দৈর্ঘ্যেই নিরাপত্তা দিতে পারবে বলে আশা রাখি। তবে আমাদের এই মনিটরে আমি এন্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল রাখার পক্ষপাতি, যেহেতু সরাসরি স্থলভাগের শত্রুর সাথে সংঘর্ষের একটা সম্ভাবনা এখানে থাকবে। আর এগুলিকে এসল্ট রিভার ক্রসিং অপারেশনে ইনডিরেক্ট ফায়ার সাপোর্টের ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে একই সংখ্যক রকেট ফায়ার সাপোর্ট শিপ।

রিভারাইন ফোর্সের আরেকটা অংশ গুরুত্বপূর্ণ, যেটা উপরে সার্বিয়ার দানিয়ুব রক্ষার কথা বলতে গিয়ে আলোচনা করেছি, তা হলো মাইনসুইপার। যমুনার প্রতিটি নদীবন্দর মাইনিং করা সম্ভব, কাজেই এগুলিকে মাইন থেকে রক্ষা করাটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নদীর অগভীর পানিতে অপারেট করতে সক্ষম মাইনসুইপার এই ফোর্সের অংশ হওয়া উচিত। মাইন পরিষ্কার না করতে পারলে নদীপথ তো অনিরাপদ হতেই পারে, সাথে এসল্ট ফোর্সও বিপদে পড়তে পারে। এই মাইনসুইপারগুলি শান্তিকালীন সময়ে টহল এবং সার্ভের কাজে লাগানো যেতে পারে। ৪ থেকে ৬টি মাইনসুইপার যমুনার জন্যে যথেষ্ট হতে পারে। যমুনার জন্যে উপসংহারে বলা যায় যে, “রিভারাইন ফোর্স (যমুনা)”-তে থাকা উচিত –

- রিভার প্যাট্রোল ফোর্স (HSB, HSPB, other boats, logistical boats, shore bases)

- রিভার এসল্ট ফোর্স (রিভার এলিমেন্ট) (LCT, LCU, LCM, LCVP)

- রিভার এসল্ট ফোর্স (গ্রাউন্ড এলিমেন্ট) (1 independent army brigade)

- ফায়ার সাপোর্ট গ্রুপ (3-4 river monitors, 3-4 rocket fire support ships)

- স্পেশাল ফোর্স বোট গ্রুপ (Special ops forces and GRP boats)

- মাইনসুইপার ফোর্স (4-6 river minesweepers) এবং

- হার্বার ডিফেন্স (2-3 security battalions)।

রিভারাইন ফোর্স (পদ্মা-মহানন্দা)

যমুনা নদীর এই মডেল আমরা মোটামুটিভাবে কপি করতে পারি পদ্মা, মহানন্দা এবং সুরমা নদীর ক্ষেত্রে। যমুনার মতোই এই নদীগুলিতেও খনন করাটা জরুরি। পদ্মা নদীর পশ্চিমাংশের (পাবনা থেকে পশ্চিমে) কথাই এখানে প্রধানত উল্লেখ করতে চাই। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রবন্দরের সাথে সেলাই করে যুক্ত করেছে এই নদী। পাকশীতে দুইটি সেতু (হার্ডিঞ্জ এবং লালন শাহ সেতু) রয়েছে এই নদীতে, যেগুলির নিরাপত্তা খুবই জরুরী। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট রয়েছে এই নদীতে। এর সাথে যোগ হচ্ছে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র এবং ভবিষ্যতের গঙ্গা ব্যারেজ। পরের দুইটি স্থাপনা তৈরি হলে নদীর গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে যাবে। গঙ্গা ব্যারেজ হয়ে গেলে রাজশাহী এবং কুষ্টিয়াসহ বেশ কিছু শহর দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে নদীপথে যুক্ত হবে। পদ্মা নদীতে সীমানা টহলের ব্যাপারটাও থাকছে। আর মহানন্দা নদী পদ্মার সাথেই যুক্ত, কাজেই একে আলাদা করে দেখার সুযোগ কম। পদ্মার কথা চিন্তা করে “রিভারাইন ফোর্স (পদ্মা-মহানন্দা)”-তে আমরা যমুনার কপি হিসেবে দেখাতে পারি –

- রিভার প্যাট্রোল ফোর্স (HSB, HSPB, other boats, logistical boats, shore bases)

- রিভার এসল্ট ফোর্স (রিভার এলিমেন্ট) (LCT, LCU, LCM, LCVP)

- রিভার এসল্ট ফোর্স (গ্রাউন্ড এলিমেন্ট) (1 independent army brigade)

- ফায়ার সাপোর্ট গ্রুপ (3-4 river monitors, 3-4 rocket fire support ships)

- স্পেশাল ফোর্স বোট গ্রুপ (Special ops forces and GRP boats)

- মাইনসুইপার ফোর্স (4-6 river minesweepers) এবং

- হার্বার ডিফেন্স (1-2 security battalions)।



রিভারাইন ফোর্স (হাওড়)

অন্যদিকে সিলেটের সুরমা নদী এখনই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তবে খনন করা হলে এর গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে ফসলের ক্ষেতে সেচের জন্যে জ্বালানি তেলের ডিপো রয়েছে, আবার সিলেট শহরের দক্ষিণেও রয়েছে রেলের সরবরাহের অধীনে জ্বালানি তেলের ডিপো, যেখানে বিমানের জ্বালানি রাখা হয়। এর পুরোটাই সুরমা নদী ব্যবহার করে করা যায়। এখন সুরমা নদী দিয়ে মূলত বালু, পাথর, কয়লা এবং ছাতকের সিমেন্ট কারখানার সিমেন্ট পরিবহণ হচ্ছে। ঠিকমতো ব্যবহার করা গেলে এই নদী বৃহত্তর সিলেট, তথা সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জের পুরো হাওড় অঞ্চলের অর্থনৈতিক চাবি হতে পারে। তখন হাওড়ে একটা শক্তিশালী রিভা্রাইন ফোর্স দরকার হবে। এই নদী এবং হাওড় যেহেতু অতি গুরুত্বপূর্ণ মেঘনা নদীর সাথে যুক্ত, তাই এর অপারেটিং এরিয়াও বেশ বড় হবে – একেবারে নোয়াখালী থেকে সিলেট পর্যন্ত পুরো নদীপথ। চট্টগ্রাম-ঢাকা নৌপথ এটি। এর মাঝে চাঁদপুর, মেঘনাঘাট, ভৈরব, আখাউড়া, গজারিয়া-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রয়েছে; রয়েছে মেঘনার উপরে এখন পর্যন্ত তৈরি করা চার-চারটি সেতু। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেটের সড়ক ও রেলপথ এই নদীর উপর দিয়ে গিয়েছে। আবার একইসাথে বেশ কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ ফেরী এই নদীর এপাড়-ওপাড় করছে।

তবে হাওড় অঞ্চল হবার কারণে এখানে বড় জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো কঠিন হবে, এবং অপেক্ষাকৃত কম ড্রাফটের বোট বেশি ব্যবহার করতে হবে। এখানে উত্তর-পূর্বের সীমানা পর্যন্ত সবক্ষেত্রে বড় নদী না থাকায় মনিটর বাদ দিয়ে, এবং এলাকা বিশাল থাকায় একটা অতিরিক্ত ব্রিগেডের কথা আমরা চিন্তা করতে পারি। তবে এক্ষেত্রে লজিস্টিক সাপ্লাইয়ের জন্যে বেশি বোট লাগতে পারে, কারণ অনেক স্থানেই বর্ষাকালে সাপ্লাই পাঠানোর একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়াবে নৌপথ। এগুলি শান্তিকালীন সময়ে সাধারণ পরিবহণের কাজ করতে পারে।

“রিভারাইন ফোর্স (হাওড়)”-এ থাকা উচিত –

- রিভার প্যাট্রোল ফোর্স (HSB, HSPB, other boats, logistical boats, shore bases)

- রিভার এসল্ট ফোর্স (রিভার এলিমেন্ট) (LCT, LCU, LCM, LCVP)

- রিভার এসল্ট ফোর্স (গ্রাউন্ড এলিমেন্ট) (2 independent army brigades)

- ফায়ার সাপোর্ট গ্রুপ (6-8 rocket fire support ships)

- স্পেশাল ফোর্স বোট গ্রুপ (Special ops forces and GRP boats)

- মাইনসুইপার ফোর্স (6-8 river minesweepers)

- রিভার লজিস্টিক গ্রুপ (shallow-draft transport ships) এবং

- হার্বার ডিফেন্স (2-3 security battalions)।



রিভারাইন ফোর্স (ম্যানগ্রোভ)

এরপরে আসি খুলনা অঞ্চলের দিকে। এই লম্বা আলোচনার শুরুর দিকে কলম্বিয়ার রিভার ফোর্স নিয়ে কথা বলেছি। তাদের PAF জাহাজগুলিকে কেন্দ্র করে গঠিত রিভার এসল্ট ফোর্সগুলি জংলা যায়গায় বেশি কার্যকর, যেখানে বড় ধরনের সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার সম্ভাবনা কম। ঠিক এই অবস্থাটাই বিরাজ করছে সুন্দরবনসহ বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে। এখানে সীমানা পাহাড়া দেওয়া ছাড়াও রয়েছে মংলা বন্দর এবং এর আশেপাশের স্থাপনাগুলিকে রক্ষার বিরাট দায়িত্ব। এখানে রিভারাইন ফোর্স গঠন করতে গেলে যমুনা-পদ্মা-সুরমার এসল্ট ফোর্সের স্থানে কলম্বিয়া-স্টাইলের এসল্ট ফোর্স বেশি কার্যকর হতে পারে। অপেক্ষাকৃত কম ড্রাফটের বোটও এখানে বেশি দরকার হবে। ৩ থেকে ৪টি রিভার এসল্ট গ্রুপ এখানে তৈরি করা যেতে পারে, যেগুলির কেন্দ্রে থাকবে একটি করে কলম্বিয়া-স্টাইলের এসল্ট সাপোর্ট শিপ এবং সাথে একটি করে স্পেশাল ফোর্স-এর বোট গ্রুপ। আমরা আমাদের এলস্ট সাপোর্ট শিপে এন্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল রাখতে পারি নদীপথে কর্তৃত্ব রাখতে। কলম্বিয়ার PAF-এর মতো জাহাজে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের থাকার জায়গা থাকলে ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে অপারেট করতে অনেক সুবিধা হবে। আর যেহেতু এই অঞ্চল অপেক্ষাকৃত দুর্গম, তাই এখানে ড্রোনসহ বিভিন্ন এয়ার এলিমেন্ট বেশি ব্যবহার করতে হতে পারে।

“রিভারাইন ফোর্স (ম্যানগ্রোভ)”-এ থাকা উচিত –

- রিভার প্যাট্রোল ফোর্স (HSB, HSPB, other boats, logistical boats, fixed & floating bases)

- ফায়ার সাপোর্ট গ্রুপ (3-4 assault support ships)

- স্পেশাল ফোর্স বোট গ্রুপ (3-4 Special ops groups with GRP boats)

- মাইনসুইপার ফোর্স (4-6 river minesweepers)

- ড্রোন এলিমেন্ট এবং

- হার্বার ডিফেন্স (1 security battalion)।

শেষবাক্য…

এছাড়াও বাংলাদেশে আরও বহু নদী এবং নদী-কেন্দ্রিক অঞ্চল আছে, যেগুলির গুরুত্বপূর্ণ অনেক। সেগুলিকে নিরাপত্তা দিতে হয়তো আলাদাভাবে রিভারাইন ফোর্স না-ও লাগতে পারে। কিছুদিন আগে দুবলার চরের নিরাপত্তার ব্যাপারে আলোচনা করেছিলাম এক পোস্টে। রিভারাইন ফোর্স গঠনে সেই গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপের নিরাপত্তা সুসংগঠিত হতে পারে। আর ওই একই পোস্টে উল্লেখ করা নাফ নদী এখানে আলোচনায় আনছি না, কারণ সেটা উপকূলীয় নিরাপত্তার সাথে যুক্ত। সেটা নিয়েও লিখবো আশা রাখি।

বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে ধমনীর মতো প্রবাহিত হওয়া প্রধান নদীগুলি দেশের স্থলভাগকে সুঁই-সূতা দিয়ে যত্ন করে সেলাই করে রেখেছে। আমরা যদি এই সেলাই দুর্বল করে বা খুলে ফেলতে চাই, সেটা আমাদের নিজেদেরই বিপদ। দুর্ভাগ্যজনক যে আমরা সেই সেলাইকে বরং সেলাই হিসেবে না দেখে ডিভাইডার হিসেবে দেখতে শিখেছি। এই চিন্তা পরিবর্তন না করতে পারলে রিভারাইন ফোর্সের গুরুত্ব অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আর সেটা না করতে পারলে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে আমরা মূর্খই থেকে যাবো। বঙ্গোপসাগরের সাথে যুক্ত সৃষ্টার অদ্ভূত সৃষ্টি এই নদীগুলির ভূরাজনৈতিক গুরুত্বকে না বুঝতে পারলে আমাদের সামনে যে ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে, তা আমাদেরকে অবাক করবে বৈকি।