২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৪
অগাস্ট ২৯, ২০১৩। চট্টগ্রামে জমকালো এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তিন-তিনটি যুদ্ধজাহাজ আর দুইটি ম্যারিটাইম
প্যাট্রোল বিমানের কমিশনিং করলেন। তিনটি জাহাজ আর দু’টি বিমানই নতুন তৈরি। এর আগে নৌবাহিনীর এরকম অনুষ্ঠান আর
কখোনো হয়নি। কিন্তু পরের দিন সকালে পত্রিকার হেডলাইন ছিল এই কমিশনিং নয়; বরং এই
কমিশনিং অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছিলেন সেটাই। কি এমন বলেছিলেন তিনি সেই
অনুষ্ঠানে? সেটাই আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় – সাবমেরিন। নৌবাহিনীর জন্য সাবমেরিন কেনার ঘোষণা দেন
প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এটা কি আসলেই নতুন কোন খবর? সম্ভবত নয়। কারণ ২০১৩-এর
জানুয়ারী মাসেই প্রধানমন্ত্রী খুলনায় নৌবাহিনীর আরও একটি জাহাজের কমিশনিং
অনুষ্ঠানে এই কথাই বলেছিলেন। তবে ২০১৩ সালেই হয়তো এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যে
কারণে প্রধানমন্ত্রী দু’বার এই
ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও কথা রয়েছে। আরও দুই বছর আগে ২০১১ সালের মার্চ মাসে
খুলনায় নৌবাহিনীর আরও দু’টি জাহাজের
কমিশনিং অনুষ্ঠানে ২০২০ সালের মধ্যে সাবমেরিন ক্রয়ের কথা বলেছিলেন। এরও এক বছর আগে
২০১০ সালের এপ্রিলে নৌবাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে ২০১৯
সালের মধ্যে নৌবাহিনীকে একটি ত্রিমাত্রিক ডিটারেন্ট ফোর্স হিসেবে গড়ে তোলার জন্য
ঘাঁটি সহ সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা তাঁর সরকারের রয়েছে। তার মানে কথাগুলি নতুন নয়।
তাহলে এতবার মনে করিয়ে দেয়া কেন? আরও একটু পিছন থেকে ঘুরে আসি তাহলে।
১০ বছরের পরিকল্পনা
আগের টার্মে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার প্রায় সাথে সাথেই ২০০৯ সালের
প্রথম ভাগে নৌবাহিনী তাদের ১০ বছরের একটা পরিকল্পনা (২০১৯ সাল পর্যন্ত) আর্মড
ফোর্সেস ডিভিশনের কাছে পাঠায়। সেখানে অনেক কিছুর মধ্যে একটি সাবমেরিন কেনার কথাও
বলা হয়েছিল। যেহেতু আমাদের কোন প্রতিরক্ষা নীতি নেই, আর বেশিরভাগ কেনাকাটার
ব্যাপার আলোচনা বহির্ভূত থাকে, তাই এই ব্যাপারগুলি নিয়ে কথা বলার জন্য আমাদের
প্রকাশিত খবরের উপরেই নির্ভর করতে হবে। আর এই খবরের উপরেই আমরা বলতে পারি যে ২০০৮
সালের নভেম্বরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে বিরোধপূর্ণ সমুদ্রে মিয়ানমারের
নৌবাহিনীর সাথে গ্যাস রিগ বসানো নিয়ে উত্তেজনা কিছুটা হলেও এই ১০ বছরের পরিকল্পনায়
প্রভাব ফেলেছে। সাবমেরিন এই পরিকল্পনার লিস্টের প্রথম আইটেম ছিল না। তবে এই দশ
বছরের মধ্যে পাঁচ বছর যেতে না যেতেই লিস্টের প্রথম দিকে যা যা ছিল (৩টা ফ্রিগেট,
৩টা লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফট, ১২টা প্যাট্রোল ক্র্যাফট, ২টা ল্যান্ডিং ক্রাফট
উইটিলিটি (এলসিইউ), একটা হাইড্রোগ্রাফি জাহাজ, একটা উদ্ধারকারী জাহাজ, ৪টা মিসাইল
বোট, ৩টা ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান এবং ৪টা
হেলিকপ্টার) তার বেশিরভাগই যোগার হয়ে গেছে, বা যোগারের পথে রয়েছে! এখানে কিন্তু
প্রমাণ হয়ে যায় যে বর্তমান সরকারের কাছে নৌবাহিনী কতটা গুরুত্ব পেয়েছে। আর যেহেতু
এখন প্রথম দিকের লিস্টের বেশিরভাগই ক্রয় হয়ে গেছে, কাজেই সাবমেরিনের দিকে দৃষ্টি
দেয়াই যায়, তাই না? ২০১৩-এর ডিসেম্বরেই খবর বেরোয় যে প্রায় ২০৩ মিলিয়ন ডলার খরচ
করে কেনা হচ্ছে সাবমেরিনদু’টি। শুধু তা-ই নয়, ২০১২ সালের প্রথম দিকে সামরিক ভূমি সেনানিবাস
অধিদপ্তর থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার
মগনামার ৪১৯ দশমিক ৮৫ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়। আর ২০১৩ সাল
নাগাদ এই ঘাঁটি তৈরির কাজ শুরু হয়ে যাবার কথা।
ফিরে দেখা
তবে কি সুযোগ বুঝে হুট করেই নৌবাহিনী এই সাবমেরিনের কথা পেড়েছিলেন? সম্ভবত
নয়। কারণ একটা নৌবাহিনী গড়তে সময় লাগে। অনেক দিনের পরিচালনার মাঝেই খুব সম্ভবত
তাঁরা সাবমেরিনের অভাব অনুভব করেছিলেন। এটা ২০০৯ সালের চিন্তা বলে চালালে ভুল করা
হবে। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ততকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পাকিস্তান
সফরে যান। সেই সফরকে উপজীব্য করে সেই বছরেরই জুন মাসে ভারতীয় একটি পত্রিকা (ডিএনএ)
খবর ছাপায় যে পাকিস্তান বাংলাদেশকে দু’টি পূরনো সাবমেরিন ‘উপহার’ হিসেবে দিতে ‘রাজি’ হয়েছে। কয়েকদিনের
মধ্যেই বাংলাদেশ নৌবাহিনী সংবাদ সন্মেলন করে এই খবরের প্রতিবাদ জানায় এবং সেই সফরে
সাবমেরিন নিয়ে কোন কথা হয়নি বলে জানায়। তবে একই বছরের (২০০৬ সাল) অগাস্ট মাসে
ততকালীন বাংলাদেশ নৌবাহিনী চীফ অব স্টাফ রিয়ার এডমিরাল এম হাসান আলী খান পাকিস্তান
সফর করেন, এবং সেখানে পাকিস্তানের সাবমেরিন তৈরি প্রোগ্রামে বেশ আগ্রহ দেখান বলে
খবর প্রকাশ করা হয়। এই সফরের কিছুদিন আগে একই বছরের মে মাসে নৌবাহিনী প্রধান
প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটিতে বলেন যে একটি সাবমেরিন ও দু’টি ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান ক্রয়ের মাধ্যমে সরকার
নৌবাহিনীকে ত্রিমাত্রিক রূপ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নৌপ্রধান এ-ও বলেন
যে নৌবাহিনীর অফিসারদের এরই মধ্যে ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। এরও দু’বছর আগে ২০০৪ সালের মার্চ মাসে জাতীয় সংসদে প্রতিরক্ষা
মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন যে ২০১২ সালের মধ্যে
সরকার নৌবাহিনীর জন্য ৪টি সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে। তখন বলা হয়েছিল যে এই
৪টি সাবমেরিন কিনতে ১,২০০ কোটি টাকা খরচ হবে। হাফিজ উদ্দিন সাহেবের কথার পরে ৯
বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, এখনো সেই সাবমেরিন নিয়েই আমরা লিখে যাচ্ছি; যদিও এখন
বেশ শিওর হয়েই লিখছি। ২০১৪-এর ১৭ই ফেব্রুয়ারী নৌবাহিনীর বার্ষিক মহড়া শেষে প্রধানমন্ত্রীর
প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন যে ২০১৫ সালে সাবমেরিনগুলি আমাদের
নৌবহরে যোগ হচ্ছে। তার মানে ২০১৯ সালের মধ্যে সাবমেরিনের বহর তৈরি বলতে প্রথম
সাবমেরিনগুলি ২০১৯ সালেই যে পাওয়া যাবে, তা কিন্তু নয়। সাবমেরিন ফোর্স গঠন করতে
সময় লাগে। প্রথম কয়েক বছর শুধু ট্রেনিং-এই সময় চলে যাবে। মোটামুটি বুঝে নেবার পরেই
শুধু ঠিক করে বলা যাবে পরবর্তী করণীয় কি হওয়া উচিত।
এতকাল এই বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে অর্থের সঙ্কুলান যে প্রধান ব্যাপার ছিল
সেটা বলাই বাহুল্য। বিরাট অঙ্কের বাজেটের বিনিময়ে যে সাবমেরিন পাওয়া যাবে, সেটা যে
নৌবাহিনীর লিস্টের প্রথমে ছিল না, তা আগেই বলেছি। তাহলে গরীব এই দেশে এত্ত খরচ করে
যে সাবমেরিন কেনা হবে, তা দিয়ে আসলে আমরা কি সম্পাদন করতে পারবো? নৌবাহিনীর মিশন
হলো - সাগরে আমাদের নিজস্ব এলাকার (টেরিটোরিয়াল সী, কন্টিগুয়াস জোন এবং
এক্সক্লুসিভ ইকনমিক জোন) সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং নদী ও সমুদ্রপথের নিরাপত্তা
নিশ্চিত সহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করা। এই মিশনে সাবমেরিন কোথায় সহায়তা
করবে সেটা বেশিরভাগ মানুষের জন্যেই আবিষ্কার করা খুব কম বললেও কষ্টসাধ্য। তাই এই
ব্যাপারটা পাঠোদ্ধারের একটা চেষ্টা চালানো যাক।
সাবমেরিন দরকার আছে কি?
সাবমেরিন একটি স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত সমরাস্ত্র। এটির একটি বড় ব্যবহার হয়
পরোক্ষ যুদ্ধে; মানে সরাসরি শত্রুর বাহিনীর সাথে যুদ্ধ না করে অন্যকোনভাবে শত্রুকে
ঘায়েল করা, বা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা যাতে শত্রুপক্ষ যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য
হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নৌবাহিনীর ‘ইউ-বোট’
(জার্মানীতে সাবমেরিনকে বলা হয় ‘ইউ-বোট’) ব্যবহারের কথা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বৃটেনের সামুদ্রিক
বানিজ্য ধংস করে ফেলা যাতে বৃটেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে না পারে। এই একই ধরনের কৌশল
ছিল ১৯৭১ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর, যখন তারা বঙ্গোপসাগর অবরোধ করে রেখেছিল, যাতে
পাকিস্তানীরা বাংলাদেশে তাদের সৈন্যদের কাছে কোন ধরনের সাপ্লাই না পাঠাতে পারে। বিমানবাহী
যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন সমৃদ্ধ ভারতীয় নৌবাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল, তাই তাদের
বঙ্গোপসাগর অবরোধ দিতে খুব বেশি কষ্ট হয়নি। এখানে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান
বিশেষ ভুমিকা রেখেছিল। ’৭১-এর এই শিক্ষা প্রমাণ করে যে বঙ্গোপসাগর ফানেলের মতো
হওয়াতে বাংলাদেশকে অবরোধ দেয়া খুব কঠিন কাজ না। বাংলাদেশের ৯০% বাণিজ্য চট্টগ্রাম
বন্দরের মাধ্যমে হয়। কাজেই যেকোন বহিশত্রু বাংলাদেশের উপরে বোমা না ফেলে বরং এই
বন্দর অবরোধ করে আমাদের না খাইয়ে মারার চেষ্টা করবে। এরকম কোন পরিস্থিতি যদি তৈরি
হয়, তাহলে এই অবরোধ ভাঙ্গার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হবে সাবমেরিন। শুধু সাবমেরিনই পারবে
চুপিসারে অবরোধ করা শত্রু নৌবহরকে ফাঁকি দিয়ে খোলা সমুদ্রে যেতে, এবং সম্ভব হলে
শত্রুর বড় কোন জাহাজ ঘায়েল করতে, যাতে সে বঙ্গোপসাগরের অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়। এখন
নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে নৌবাহিনীর মিশনের কোথায় সাবমেরিন কাজ করছে। এটিতো একটি মিশন
শুধু। নৌবহরে সাবমেরিন থাকলেই কেবল সাবমেরিন কিভাবে খুঁজে পেতে হয় আর ঘায়েল করতে
হয়, সেটা প্র্যাকটিস করা সম্ভব। আর নৌবহরে সাবমেরিন পাবার পরে প্র্যাকটিসের
মাধ্যমেই বাংলাদেশ নৌবাহিনী বুঝতে পারবে বঙ্গোপসাগরে কিভাবে শত্রুপক্ষের চট্টগ্রাম
বন্দর-অবরোধকারী সাবমেরিন খুঁজে বের করে ধংস করতে হবে। আর এইসব মিশনের উপরেও
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো সাবমেরিন একটা ‘ডিটারেন্ট’ – মানে এটা সাথে থাকলে শত্রু আমাদের সাথে যুদ্ধে যাবার
আগে দু’বার চিন্তা
করবে। যুদ্ধ না করে কুটনৈতিকভাবে কোনকিছু পাবার ক্ষেত্রে এই ডিটারেন্ট একটি বিরাট
ভুমিকা রাখবে।
শেষ কথা অর্থনীতি
সাবমেরিন কেনার জন্যে যে চীন ছাড়া খুব একটা গত্যন্তর নেই বাংলাদেশের, সেটা
মোটামুটি বলাই যায়। ২০০৪ সালে মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ যে ১,২০০ কোটি টাকা
(তখনকার ২০০ মিলিয়ন ডলার) ব্যয়ে ৪টি সাবমেরিন ক্রয়ের কথা বলেছিলেন, সেটা কতটুকু
বাস্তবসম্মত ছিল তা প্রশ্ন করাই যায়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক একটি প্রতিরক্ষা
ম্যাগাজিনে সাক্ষাতকার দেবার সময় নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল জহির উদ্দিন আহমেদ
বলেন যে ২০১০ সালে জার্মান নৌবাহিনীর সাথে কথা হয়েছিল তাদের ‘টাইপ-২০৬’ সাবমেরিন কেনার জন্য। আবার এরই মধ্যে ইটালির নৌবাহিনীর সাথেও কথা হয়েছিল
তাদের ‘ইমপ্রুভড
সাউরো-ক্লাস’ সাবমেরিন
কেনার জন্য (যেগুলি ২০১৬ সাল নাগাদ ইটালি ডিকমিশন করবে)। কিন্তু কোনটিই শেষ
পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। পাশ্চাত্যে তৈরি সমরাস্ত্রের দুর্মূল্য বাজারে ঘোরাঘুরি করে
আমরা হারে হারে টের পেয়েছি। এত্তগুলি টাকা সরকার খরচ করার আগে চিন্তা করবে যে
কিস্তিতে টাকাটা ফেরত দেওয়া যায় কিনা। আর এই কিস্তিতে পেতে হলে আন্ত-সরকার চুক্তি
করতে হবে। কাজেই অর্থনৈতিক দিক থেকে চিন্তা করলে চীনের কাছে নৌকা ভেড়ানোই সবচেয়ে
সহজ হয়। আমরা এখন মোটামুটি জানি যে চীনা নৌবাহিনীর ‘মিং-ক্লাস’ (টাইপ-০৩৫জি) সাবমেরিন বাংলাদেশ কিনেছে। ‘মিং-ক্লাস’ ১৯৫০-এর দশকের ডিজাইনের উপরে তৈরি; যদিও চীনারা ‘৮০-এর আর ’৯০-এর দশকে
তাতে অনেক নতুন নতুন প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়েছে, যে অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে তাদের
অধিকতর নতুন সাবমেরিন তৈরিতে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশ ‘মিং-ক্লাসের’ যে সাবটাইপ (টাইপ-০৩৫জি) পেতে যাচ্ছে, সেগুলি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে
তৈরি। তার মানে এখন সেই সাবমেরিনগুলির বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছর। তবে সেগুলি চীনা নৌবহরে
কিন্তু এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। যুদ্ধাবস্থায় এই সাবমেরিনগুলি এমন মিশনে ব্যবহৃত হবে,
যেখানে সাবমেরিন-ধ্বংসী নজরদারী অপেক্ষাকৃত কম। কোন নৌবহরের পক্ষেই সম্পূর্ণ
সমুদ্র সার্বক্ষণিক নজরদারীতে রাখা সম্ভব নয়। কাজেই এই সাবমেরিনগুলি যুদ্ধের সময়
কোন না কোন কাজ পাবেই।
বুড়ো সাবমেরিনের গুরুত্ব কতটুকু?
ডিটারেন্ট হিসেবে চিন্তা করলে ‘মিং-ক্লাস’ সাবমেরিনও
বাংলাদেশের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ভারতীয় নৌবহরের সাথে পাল্লা দেবার প্রশ্ন
এখনো আসেনা। তাই যে কারনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানেই কথা
নিয়ে যাই - মিয়ানমার। মিয়ানমারের নৌবহরের সাবমেরিন-ধ্বংসী ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত।
এই ‘মিং-ক্লাস’ সাবমেরিনের ভারতীয় নৌবহরকে এড়াতে যত না কষ্ট করতে হবে,
তার সিকিভাগ করতে পারলেই মিয়ানমারের নৌবাহিনী কাহিল হয়ে যাবে। মিয়ানমারের নৌবাহিনী
সাবমেরিন কিনলেও আমাদের নৌবাহিনীরও ঐ একই দশা হবে! ভারতীয় নৌবাহিনী ইতোমধ্যেই
বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনা নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা মিডিয়ার সন্মুখে জানিয়েছে। যদিও
সাবমেরিনগুলি চীনা হওয়াটা সেই উদ্বেগের প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায়, তারপরেও
সাবমেরিন মানেই সাবমেরিন। আর যেই সাবমেরিন নিয়েই কথা বলি না কেন, সমুদ্রে সাবমেরিন
খোঁজা হলো খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতো। তাই একটা দেশের বন্দর থেকে একটা সাবমেরিন
সমুদ্রের দিকে যাত্রা করা মানেই প্রতিবেশী দেশের মাথাব্যাথা শুরু হয়ে যাওয়া। যতক্ষণ
পর্যন্ত সেই সাবমেরিনের অবস্থান ঠিক ঠিক জানা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ঘুম হারাম
হয়ে যাবে। আপনার নিজের ঘরের ভেতরে একজন অদৃশ্য মানবের কথা চিন্তা করুন, যার
নিঃশাসের শব্দ আপনি পাচ্ছেন, কিন্তু জানেন না সে কোথায়! সে আপনার কোন ক্ষতি না
করলেও আপনি যতক্ষন পর্যন্ত জানতে না পারবেন সে কোথায় আছে, ততক্ষন পর্যন্ত আপনি
শান্তি পাবেন না।
আর অপরদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে সাবমেরিন-ধ্বংসী কৌশলে দক্ষ করে গড়ে তুলতে
এই পুরোনো সাবমেরিনও অবদান রাখতে পারবে। ‘সং-ক্লাসের’ সাবমেরিন (টাইপ-০৩৯) অপেক্ষাকৃত নতুন এবং ‘মিং-ক্লাস’ থেকে অনেক বেশী সক্ষম; ১৯৯৯ সাল থেকে এগুলি চীনা নৌবাহিনীতে সার্ভিসে
এসেছে। থাইল্যান্ড আর পাকিস্তানের কাছে এই সাবমেরিন বিক্রয়ের অফার দেয়া হয়েছিল বলে
জানা যায়। ‘ইউয়ান-ক্লাস’ (টাইপ-০৪১) আরও নতুন ও আধুনিক। আমাদের জন্যে শেষ
পর্যন্ত হয়তো অর্থনৈতিক দিকটাই বলে দিয়েছে আমরা কোন সাবমেরিন পেতে পারি। আর কিনলেই
সব শেষ হয়ে যাচ্ছে না। কেনার পরে রয়েছে সাবমেরিনের রক্ষণাবেক্ষণ। সাবমেরিন এমন
একটি জাহাজ যার সবকিছুই আলাদা। এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের
ঘাঁটি দরকার হয়। আর এর সাথে আলাদা ধরনের ট্রেনিং তো রয়েছেই। এই সবকিছুই খরচের
খাতাকে প্রসারিত করবে। আর একটি বা দু’টি সাবমেরিন সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখতে চাইলে দু’টি সাবমেরিনে কখনোই হবে না। যেকোন সময়ে কোন না কোন একটি
সাবমেরিন রক্ষণাবেক্ষণ বা অন্য কোন কারণে রেডি থাকবে না। কাজেই রেডি সাবমেরিন
ফোর্স রাখতে হলে ৩-৪টা সাবমেরিন লাগবেই। আর এত্তো খরচের পরে একটি সাবমেরিনও যদি
রেডি রাখা না যায়, তবে সাবমেরিন রাখারই বা দরকার কি? বাংলাদেশের অর্থনীতিই বলে
দেবে ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন ফোর্স কেমন হবে।
আর উপরে সাবমেরিন ধ্বংসী যে ট্রেনিং-এর কথা বলেছি, সেটার গুরুত্ব কিন্তু
বঙ্গোপসাগরে বেড়েই চলেছে। ভারতের সাবমেরিনের আনাগোনার পাশাপাশি কিছুদিনের মধ্যে
অন্যান্য প্রতিবেশীদের সাবমেরিন দেখা গেলেও আশ্চর্য হবার কিছুই থাকবে না। ২০১৩-এর
জুন মাসে আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন জেন’স খবর দেয় যে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর ২০ জনের মত সদস্য
পাকিস্তানের সাবমেরিন ট্রেনিং ঘাঁটি পিএনএস বাহাদুরে এপ্রিল বা মে মাস থেকে
ট্রেনিং নিচ্ছে। মিয়ানমারের রাশিয়া থেকে দু’টা সাবমেরিন ক্রয়ের গুজব শোনা যাচ্ছে বেশকিছুদিন ধরেই। কাজেই
নিজেদের সমুদ্রাঞ্চলে অন্যদের সাবমেরিনের আনাগোনা প্রতিরোধ করাটাও একটা
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হতে চলেছে বৈকি। আমাদের কেনা ‘টাইপ-০৩৫জি’ সাবমেরিনগুলি সাবমেরিন-ধ্বংসী কৌশল মাথায় রেখেই তৈরি করা। ২০১৪ সালের
মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা নিয়ে যে রায় আসতে যাচ্ছে,
তাতেও সাবমেরিনের তথা খোদ নৌবাহিনীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে চলেছে। ১০ বছরের পরিকল্পনার
বেশিরভাগটা ৫ বছরে সম্পন্ন করার কারণও হয়তো এখানেই নিহিত। যেহেতু আমরা এসব
ব্যাপারে খুব কম তথ্য পাই, তাই ‘হয়তো’ বলেই বলতে হচ্ছে। কিন্তু অনেক টাকার ব্যাপার এখানে; তাই
ট্যাক্সপেয়ার জনগণের আস্থা পাবার গুরুত্ব এখন দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা মাথার
ঘাম পায়ে ফেলে টাকা দিচ্ছেন; জানতে চাইতেই পারেন – তাঁদের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে কি করা হচ্ছে। জনগণের
সম্পৃক্ততা আমাদের নৌশক্তিকে আরও বেশি শক্তিশালী করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। উন্নত
বিশ্বের বিশাল সামরিক শক্তিগুলি জনগণকে সাথে নিয়ে এগুতে পারলে আমরা কেন পারবো না? জনগণের
সম্পৃক্ততা দেবে নৈকট্য; নৈকট্য জন্ম দেবে গর্ব করার কাহিনী। আমাদের নৌবাহিনী
আমাদের গর্ব। একে প্রশ্নবিদ্ধ করার অধিকার কারুর নেই।
অনেক ধন্যবাদ ভাই অত্যন্ত সুন্দর এবং বিশ্লেষণধর্মী লেখার জন্য। অনেক কিছু জানতে পারলাম। ভাল থাকবেন।
ReplyDeleteMy pleasure!
DeleteThanks for the comment! :)
আসলেই লিখাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ খুব ভাল লাগলো আপনি লিখে যান (Y)
ReplyDeleteNice article
ReplyDelete