Monday 18 April 2016

ঢাকার ভূকৌশলগত গুরুত্ব – আমরা কতটুকু বুঝি?

১৮ই এপ্রিল ২০১৬

 
ঢাকা যে ভূকৌশলগত দিক থেকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তিনটি প্রধান নদীকে একত্রে চিন্তায় না নিয়ে আসলে বোঝা সম্ভব নয়। ঢাকা উপদ্বীপ হচ্ছে হৃতপিন্ড, আর নদীগুলি হচ্ছে ধমনী; নৌযান ও পণ্য হচ্ছে হৃতপিন্ডের দ্বারা ধমনীর মাঝ দিয়ে পাম্প করা রক্ত!


ঢাকা শহরের গুরুত্ব নিয়ে কাউকে একটা রচনা লিখতে বললে তিনি কি কি লিখবেন? তিনি অবশ্যাবশ্যই শহরটির অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঢাকা শহরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়েছিল কি এইসব কারণে; নাকি অন্য কোন কারণে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ হবার পরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি যোগ হয়েছে এই লিস্টে? উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে মরুভূমির মাঝে পানির উতস না থাকলে সেখানে শহর হয় না। আমাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে এমন কিছু ব্যাপার ঘেঁটে দেখতে হবে, যেগুলি ভূমন্ডলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলির অন্যতম, যেমন ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, জলবায়ু, ইত্যাদি, যেগুলি কিনা আমাদের আলোচনাতে আসা বেশিরভাগ বিষয়বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করে; যে বিষয়গুলি ভূকৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

শক্তির কেন্দ্র

ঢাকা বলতে আমরা শুধু ঢাকা শহর বলে ফুলস্টপ দিলে ভুল করবো। ঢাকা হলো এর আশেপাশের পুরো এলাকা, যেখানে রয়েছে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং আশেপাশের এলাকা। এই বৃহত্তর ঢাকা অবস্থিত তিনটি বিশাল নদীর মাঝখানের এক উপদ্বীপে। এর পশ্চিমে রয়েছে যমুনা নদী, যা ব্রহ্মপুত্র নদের মূল প্রবাহ, দক্ষিণে রয়েছে পদ্মা বা গঙ্গা নদী, আর পূর্বে রয়েছে মেঘনা নদী, যা সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীর সম্মিলিত প্রবাহ। নাব্যতা দেওয়া গেলে যমুনা নদী দিয়ে একটি জাহাজ ভারতের আসাম রাজ্য হয়ে আরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত যেতে পারবে। অন্তত একসময় সেটা কিন্তু স্বাভাবিকই ছিল। পদ্মা নদী দিয়ে একটি জাহাজ একসময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং উত্তর প্রদেশ হয়ে দিল্লী যেতে পারতো। এখন সেটা ফারাক্কার কৃত্রিম বাঁধের ফলে সম্ভব হয় না। সুরমা আর কুশিয়ারা নদীর মাধ্যমে ঢাকা যুক্ত ছিল সিলেট, মেঘালয়, আসাম এবং ত্রিপুরার সাথে। আবার ঢাকার সাথে ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক শহরগুলির রয়েছে চমতকার যোগাযোগ। শুধু তা-ই নয়। মেঘনা অববাহিকার মাধ্যমে সমুদ্রের সাথে রয়েছে সরাসরি যোগাযোগ। এই পুরো এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিপাত কমতে থাকে গঙ্গা নদী দিয়ে উত্তর-পশ্চিমে যেতে থাকলে। এই এলাকার বেশিরভাগ অঞ্চলই নদী-বিধৌত সমভূমি, যার ফলশ্রুতিতে এখানকার মাটি স্বাভাবিকভাবেই খুব উর্বর। বৃষ্টিপাতের কারণে এখানে প্রচুর ফসল ফলে, যার কারণে এখানে জনসংখ্যা বেশি। অর্থাৎ অনেক বড় জনসমষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা রয়েছে এই তিন নদী অববাহিকার। এই নদী অববাহিকার উতপাদিত পণ্যের সাথে সমুদ্রের যোগাযোগের দরজা হচ্ছে ঢাকা। এভাবে ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং জলবায়ুগত কারণে তিন নদীর মাঝের এই এলাকার শক্তিশালী অবস্থান এখানে একটি শহর চেয়েছিল।

প্রাচীনকাল থেকেই ঢাকা অঞ্চল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের দুয়ার হলেও এখানে একটা শহর স্থাপনের গুরুত্ব মুঘল সাম্রাজ্যের আমলারাই বুঝেছিলেন। আর তাঁরা এ-ও বুঝেছিলেন যে এখানে শহর প্রতিষ্ঠা না করলে ভারত মহাসাগরে নতুন আসা ইউরোপিয়ানরা এখানকার কর্তৃত্ব নেবার চেষ্টা করবে। সপ্তদশ শতকে মুঘল সম্রাটের সাথে ইস্তাম্বুলে আসীন মুসলিম বিশ্বের খলিফার বেশ নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রে ইউরোপিয়ানদের অভিপ্রায় সম্পর্কে মুঘল সম্রাট জানতেন। ঢাকার কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে মুঘলরা এই অতি গুরুত্বপূর্ণ নদী অববাহিকা ইয়রোপিয়ানদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। হাজার হোক, সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর ৬০%-এর বেশি খরচ দিত বাংলা। আর ঢাকা দাঁড়িয়ে ছিল বাংলা, তথা সমগ্র উত্তর ভারত আর আসামের চাবি হিসেবে। ঢাকার নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে, সে এই তিন নদীর অববাহিকা নিয়ন্ত্রণ করবে। বৃটিশরা এখানে এসে ঠিকই বুঝেছিল যে তারা ঢাকা এতো সহজে নিতে পারবে না। অন্তত নিজেরা এখানে শক্তিশালী না হতে পারলে ঢাকার কৌশলগত শক্তিকে তাদের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। ঠিক একারণেই ঢাকার এই কর্তত্বপূর্ণ অবস্থানকে বাইপাস করার লক্ষ্যে বৃটিশরা কোলকাতা, সূতানটী ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করে নতুন ব্যবসাকেন্দ্র কোলকাতা। বাংলার নবাবের রাজধানী তখন ছিল মুর্শিদাবাদ। কোলকাতায় অবস্থানের ফলে মুর্শিদাবাদে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করাটা বৃটিশদের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছিল।

ঢাকার মৃত্যু

আস্তে আস্তে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে ব্রিটিশরা বাংলার নবাবীত্ব পেয়ে গেলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত শক্তি হিসেবে ঢাকার মৃত্যু ঘটে। চার’শ বছর আগে মুঘলরা যে চিন্তা করে ঢাকাকে এখানকার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন, সেট আবারও বাস্তবায়ন শুরু হয় বিংশ শতাব্দীতে এসে। ব্রিটিশরা দেশ বিভাগের সময়ে ঢাকাকে বাংলা বিভাগ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিল সফলভাবে। কিন্তু যেটা নিয়ে বেশিরভাগ মহলেই বিতর্ক হয় না তা হলো ঢাকার শক্ত ভূকৌশলগত প্রাকৃতিক অবস্থান আর কোলকাতার কৃত্রিম রাজনৈতিক অবস্থান। ব্রিটিশ ভারতে কোলকাতা ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক কেন্ত্র ছিল ১৯০৯ সাল পর্যন্ত, যার পরে সেটা দিল্লীতে চলে যায়। তবে অর্থনৈতিক দিক থেকে কোলকাতা সবার উপরেই থাকে বাংলার গুরুত্বের জন্য। কারণ বাংলা ছিল পুরো ভারতের আসল শক্তি। তবে কৃত্রিম স্থানে অবস্থানের জন্যে কোলকাতার পক্ষে পুরো বাংলা এবং আসামের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কোলকাতা থেকে আসাম পর্যন্ত সামরিক রসদ যেতে জাহাজগুলিকে কোলকাতা থেকে সুন্দরবনের মাঝে দিয়ে খুলনা, গাবখান চ্যানেল, বরিশাল, চাঁদপুর, আরিচা, সিরাজগঞ্জ, চিলমারী হয়ে আসাম যেতে হতো। অথচ ঢাকা থেকে সেটা আরও কতো সহজে হতে পারতো, যদি ব্রিটিশরা কোলকাতার স্থানে ঢাকাকে রাজধানী করতো। আসলে বাংলাকে শক্তিশালী রাখার পক্ষপাতি তারা ছিল না বলেই প্রাকৃতিক সকল শক্তি এখান থেকে সড়িয়ে দিয়েছিল তারা। পরবর্তীতে সেই লাইনেই তারা ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ করে মূলত বাংলাকে, তথা তিন নদীর কৌশলগতভাবে শক্তিশালী অববাহিকাকে দুই ভাগ করেছিল।
  
মীর জুমলার মতো লোকেরা অর্ধেক ভর্তি গ্লাসকে অর্ধেক খালি হিসেবে দেখেছিলেন, এবং বাকিটা ভরার জন্যে উদগ্রীব ছিলেন সবসময়। তাঁরা ঢাকার গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝেছিলেন।

আবার বেঁচে ওঠার চিন্তা

মুঘলরা যখন ঢাকাকে রাজধানী বানিয়েছিল, তখন ঢাকায় স্থাপন করা হয় লালবাগ কেল্লা। এটা শুধু কোন দর্শনীয় স্থান নয়, এটা ছিল কৌশলগত অবস্থানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক দুর্গ, যার হাতে ছিল পুরো বাংলার নিয়ন্ত্রণের চাবি। কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ঢাকার আশেপাশের নদীগুলির জন্যে। যারা প্রাণভয়ে ঘুমাতে পারেন না, তাদের কাছে ঢাকা হচ্ছে তিন নদীর মাঝে নিরাপদ এক স্থান, যেটাকে দখল করা কঠিন। আর অন্যদের কাছে ঢাকা হচ্ছে এমন এক কৌশলগত ঘাঁটি, যেটার উপর নির্ভর করে পুরো বাংলা শুধু নয়, পুরো উত্তর ভারত, এমনকি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ব্যাপারটা হচ্ছে অর্ধেক গ্লাস পানির মতো – অর্ধেক ভর্তি, না অর্ধেক খালি? মীর জুমলা ঢাকাকে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে বিশাল রিভারাইন ফোর্স গঠন করে আসাম আক্রমণ করেছিলেন। আর শায়েস্তা খান এই ঢাকাকে ব্যবহার করেই চট্টগ্রাম দখল করে বাংলার শাসনের অধীনে এনেছিলেন। তাঁরা গ্লাসকে সবসময় অর্ধেক খালি হিসেবেই দেখেছিলেন; তাই গ্লাস পুরোপুরি ভরার চিন্তায় বিভোর ছিলেন; মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলেন না। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মুঘলদেরকে সমুদ্র হাতছানি দিয়ে ডাকেনি। তাই তারা উত্তাল বঙ্গোপসাগরে ইউরোপিয়ানদের চ্যালেঞ্জ করেননি। মুঘলরা ম্যারিটাইম দেশ হিসেবে বাংলাকে চিন্তা করেননি। তবে চার’শ বছর পর আমরা অনেক দেরীতে হলেও এ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছি।

 
 
লালবাগ কেল্লাকে শুধুমাত্র দর্শনীয় স্থান হিসেবে চিন্তা না করে আমাদের আজ চিন্তা করতে হবে যে কোন চিন্তার উপরে নির্ভর করে এই কেল্লা নির্মিত হয়েছিল? এই কেল্লার ইট-পাথরের মাঝেই রয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর।

এর আগে একটি লেখায় রিভারাইন ফোর্স নিয়ে লিখেছি। এই পুরো রিভারাইন ফোর্সের কেন্দ্রবিন্দুতে ঢাকা। আর এই শক্তিকে বুঝতে হলে ঢাকাকে চিন্তা করতে হবে হৃতপিন্ড হিসেবে, আর প্রধান নদীগুলিকে চিন্তা করতে হবে ধমনী হিসেবে; নদীর নৌযানগুলি এবং তাদের পরিবহণ করা পণ্যকে রক্ত হিসেবে। হৃতপিন্ড না থাকলে ধমনী যেমন শুকিয়ে যাবে; তেমনি ধমনী না থাকলে হৃতপিন্ডের অস্তিত্বই প্রশ্নের সন্মুখীন হবে। এই হৃতপিন্ডই রক্ত পাম্প করবে ধমনী বরাবর; আর ধমনী সেটাকে নিয়ে সজোরে ফেলবে সমুদ্রে, যেখানে হবে এই শক্তির আসল বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা নিয়ে নতুন রচনা লেখার এটাই সময়। লালবাগ কেল্লার বিল্ডিংগুলিকে আবার নতুন করে বুঝতে হবে আমাদের। কারণ সেই পুরোনো ইট-পাথরের মাঝেই রয়েছে আমাদের শক্তির সূত্র।

No comments:

Post a Comment