Saturday 1 July 2023

ফ্রান্সে আবারও বিক্ষোভ… সামাজিক অবিচার, নাকি দুর্বল রাষ্ট্রের উদাহরণ?

০১লা জুলাই ২০২৩

সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্সে ‘ইয়েলো ভেস্ট’ আন্দোলন এবং পেনশন সংস্কারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পর এবারের বর্ণবাদ-বিরোধী বিক্ষোভ শুধুমাত্র সামাজিক অবিচারকেই তুলে ধরে না, রাষ্ট্রের দুর্বলতাকেও সামনে নিয়ে আসে।

গত ২৭শে জুন ফ্রান্সের নঁতেরে শহরে ১৭ বছর বয়সী এক যুবককে পুলিশ গুলি করে হত্যা করার পর থেকে পুরো ফ্রান্স জুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। ভিডিওতে ধারণ করা এই ঘটনায় দেখা যায় যে, পুলিশ একটা ট্রাফিক সিগনালে খুব কাছে থেকে কাউকে গুলি করছে। সকাল ৯টার দিকে দু’জন পুলিশ গাড়িটা আটকাবার পর চালক গাড়ি চালিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করলে পুলিশ তার বুকে গুলি করে। প্রতিবাদের কারণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ফ্রান্সের ‘সোশালিস্ট পার্টি’র নেতা অলিভিয়ের ফাউরে ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, পুলিশের কথায় কেউ যদি না থামে, এর অর্থ এই নয় যে, তাকে গুলি করা যাবে। প্রত্যেক ব্যক্তিরই সুবিচার পাবার অধিকার রয়েছে।

নিহত যুবকের স্মরণে শোকমিছিল থেকেই শুরু হয় বিক্ষোভ। পহেলা জুলাই পর্যন্ত চার দিনের বিক্ষোভে ফ্রান্সজুড়ে ১৩’শ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভবন এবং গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ছাড়াও বিভিন্ন দোকানপাটে লুটপাট হয়েছে। ফ্রান্সজুড়ে সাঁজোয়া গাড়িসহ প্রায় ৪৫ হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সরকার বলছে যে, কঠোর অবস্থান নেবার কারণে সহিংসতা কিছুটা হলেও কমে আসছে। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ এই বিক্ষোভকে অযৌক্তিক বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং নাগরিকদেরকে তাদের সন্তানদের বিক্ষোভের দায় নিতে বলেন। একইসাথে তিনি ‘টিকটক’ এবং ‘স্ন্যাপচ্যাট’এর মতো সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে সহিংসতা ছড়ানো বন্ধ করার পদক্ষেপ নেবার কথা বলেন। সংবেদনশীল তথ্য সোশাল মিডিয়া থেকে সরিয়ে না দেয়ার জন্যে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলিকে তিনি দোষারোপ করেন।

নঁতেরে শহরের সরকারি উকিল পাসকাল প্রাশ সাংবাদিকদের বলেন যে, প্রাথমিক তদন্তে তার মনে হয়েছে যে, আইনগতভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার যে শর্তগুলি রয়েছে, সেগুলি উপেক্ষিত হয়েছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী একজন পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার অর্থ হলো বিচারক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যথেষ্ট শক্ত প্রমাণ পেয়েছেন। তবে বিচারকার্য শুরু করার আগে এতে যথেষ্ট সময় দেয়া হয়।

ফ্রান্সে অ-শ্বেতাঙ্গদের সুবিচার পাওয়া নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এর আগে ২০০৫ সালে প্যারিসের কাছাকাছি এক স্থানে পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্যে উত্তর আফ্রিকার বংশোদ্ভূত দু’জন মুসলিম যুবক এক বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে লুকাতে গেলে বিদ্যুৎপিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করে। ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিক্ষোভ তিন সপ্তাহ ধরে চলে এবং শেষ পর্যন্ত ফরাসি সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। সেই ঘটনায় দু’জন পুলিশ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হলেও ১০ বছরের দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া শেষে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সেই বিক্ষোভের পিছনে বহুদিনের জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিল; যার মাঝে ছিল মুসলিম সংখ্যালঘুদের মাঝে ব্যাপক বেকারত্ব এবং পুলিশের বৈষম্যমূলক জুলুম। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ৯/১১এর ঘটনার পর থেকে ফ্রান্সে মুসলিম-বিদ্বেষী চিন্তার প্রসারকেও সেই বিক্ষোভের একটা কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এবারের ঘটনাও মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধেই ঘটেছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, আলজেরিয় বংশোদ্ভূত নাহেল তার মায়ের একমাত্র সন্তান; যে কিনা পণ্য ডেলিভারি দেয়ার কাজ করতো। একইসাথে গত তিন বছর ধরে সে একটা রাগবি ক্লাবেও খেলতো। ইলেকট্রিশিয়ান হবার জন্যে একটা কলেজেও ভর্তি হয়েছিলো সে; যদিও কলেজে খুব বেশি একটা সময় সে দিতে পারেনি। নাহেলের বিরুদ্ধে পুলিশের কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড না থাকলেও অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গাড়ি চালাবার অভিযোগ ছিল। দরিদ্র্য পরিবারদের নিয়ে কাজ করা এনজিও ‘ওভাল সিটোইয়েঁ’র প্রধান জেফ পুয়েশ ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, নাহেল সমাজে সকলের সাথে মিশে চলার মতো ছেলে ছিলো। মাদকাসক্তি বা অপরাধের সাথে জড়াবার মতো ব্যক্তি সে ছিলো না। নাহেলকে বহণকারী এম্বুলেন্সের মেডিকেল কর্মী মারুয়ানি বলছেন যে, তিনি নাহেলকে দেখেই চিনতে পেরেছেন এবং তিনি জানতেন যে এই ছেলে কারুর দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলার মতো নয়। নাহেলের মা ‘ফ্রান্স ৫ টিভি’র সাথে সাক্ষাতে বলেন যে, পুলিশ হয়তো তার ‘আরব চেহারা’ দেখেই তাকে হত্যা করতে চেয়েছে।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, যুবকের হত্যার ঘটনাটা ফ্রান্সে পুলিশের সাথে দরিদ্র্য এলাকার মানুষের উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ফ্রান্সে অ-শ্বেতাঙ্গ যুবকদের বিরুদ্ধে পুলিশের কৌশল নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। এক যুবক ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের সহিংসতা চলছে; বিশেষ করে কেউ যদি আরব বা কৃষ্ণাঙ্গ হয়। নাহেলের আইনজীবী ইয়াসিনে বুজরুউ অবশ্য পুলিশের বর্ণবাদের বিষয়টাকে সামনে না এনে বলছেন যে, ফ্রান্সের আইন এবং বিচারব্যবস্থা পুলিশকে বিশেষ রকমের সুরক্ষা দিয়ে থাকে; যেকারণে অনেকেই নিজেকে বিচারের উর্ধ্বে মনে করতে থাকে। বুজরুউএর বর্ণবাদকে পাশ কাটিয়ে যাবার এই চেষ্টাটাকেই অনেকে মারাত্মক বলে আখ্যা দিচ্ছেন। ‘আল জাজিরা’র এক লেখায় নিউ ইয়র্কের ‘স্টোন ব্রুক ইউনিভার্সিটির’ প্রফেসর ক্রিস্টাল ফ্লেমিং বলছেন যে, ফ্রান্সের সমাজে বর্ণবাদের কারণে নাহেলের জীবন গেছে। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ জানেন যে, নাহেলের মৃত্যু ব্যাখ্যার বাইরে নয়। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত না তারা ফ্রান্সের বর্ণবাদকে স্বীকার করে না নেবেন, ততদিন পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। ৩০শে জুন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিসের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, সময় এসেছে ফ্রান্সের বর্ণবাদ এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর বর্ণবাদজনিত বৈষম্যের গভীর সমস্যাকে স্বীকার করা। পাল্টা বিবৃতিতে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অভিযোগকে পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করে।

‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক লেখায় ফরাসি সাংবাদিক রোখায়া দিয়াল্লো বলছেন যে, ফ্রান্সের দারিদ্র্যপীড়িত শহরাঞ্চলে পুলিশের দ্বারা অপরাধগুলি দেশটার অনেকগুলি দাঙ্গার মূল কারণ। বহু বছর ধরে মিছিল, প্রতিবাদপত্র, অনুরোধ-আহ্বানে কোন কাজ না হওয়ায় একজন যুবকের সামনে সহিংসতা ছাড়া কোন পথ খোলা থাকে না। প্রশ্ন করতেই হয় যে, এতটা সহিংসতা না হলে নাহেলের হত্যাকান্ডকে নিয়ে কেউ কোন কথা বলতো? রোখায়া দিয়াল্লোর কথাগুলি ফ্রান্সের গভীরের এমন এক সমস্যার কথা তুলে ধরে, যা কিনা ফরাসি রিপাবলিকের সেকুলার স্তম্ভকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্সে ‘ইয়েলো ভেস্ট’ আন্দোলন এবং পেনশন সংস্কারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পর এবারের বর্ণবাদ-বিরোধী বিক্ষোভ শুধুমাত্র সামাজিক অবিচারকেই তুলে ধরে না, রাষ্ট্রের দুর্বলতাকেও সামনে নিয়ে আসে।

No comments:

Post a Comment