Saturday 3 December 2022

কাতারে ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২এর ভূরাজনীতি

০৩রা ডিসেম্বর ২০২২

বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২ নিয়ে সংবাদ সন্মেলনে ফিফা প্রধান জিয়ানি ইনফানটিনো। কাতারের মানুষের সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়ানো নয়; বরং কাতারের মানুষকে নিজেদের সংস্কৃতি ফেলে দিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতি নিতে চাপ দেয়ার ব্যাপারটাই তার কথায় ফুটে উঠেছে। খেলার অনুষ্ঠান হলেও পশ্চিমা আদর্শের ক্রান্তিলগ্নে বিশ্বকাপের এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমারা তাদের আদর্শগুলিকে সার্বজনীন, সর্বোন্নত এবং ইসলামের আদর্শ থেকে উন্নততর প্রমাণ করার সুযোগটা হাতছাড়া করেনি।

কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে সমালোচনা যেন থামছেই না। আসর বসার ১২ বছর আগেই আয়োজক হিসেবে কাতার কতটুকু যোগ্যতাসম্পন্ন, তা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। ‘এনপিআর’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১০ সালে থেকেই কাতারের আবহাওয়া এবং দেশটার পক্ষে ভোট দেয়া ফিফা কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ব্যাপারে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। পশ্চিমারা কাতারের মানবাধিকার নিয়েও খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না। তবে তারা বেশি সমালোচনা করছে সমকামিতার বিরুদ্ধে কাতারের শক্ত অবস্থান, মানবাধিকার নিশ্চিত না করা এবং অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার না দেয়ার ব্যাপারে। মোটকথা কাতার নিয়ে আলোচনার কোনকিছুই খেলা নিয়ে ছিল না; ছিল রাজনীতি নিয়ে।

ফিফার প্রাক্তন প্রধান সেপ ব্ল্যাটার ‘বিবিসি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, ভেন্যু হিসেবে কাতারকে নেয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। তবে তিনি কারণ হিসেবে সমকামিতা বা মানবাধিকারের ব্যাপারগুলিকে সামনে আনেননি। তার কথায়, বিশ্বকাপ একটা অনেক বড় টুর্নামেন্ট, যা আয়োজন করার জন্যে একটা বড় দেশ প্রয়োজন। ব্ল্যাটারের চিন্তাটা অমূলক ছিল না। কারণ কাতারের ২৮ লক্ষ অধিবাসীর মাঝে মাত্র ৩ লক্ষ কাতারের নাগরিক; বাকিরা অভিবাসী কর্মী। এই কর্মীদের ব্যবহার করেই দেশটা বিশ্বকাপের মতো বিশাল আয়োজনকে সম্ভব করতে পেরেছে। কর্মীদের অধিকার নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সমালোচনা। ২০২১ সালে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন কারণে সাড়ে ৬ হাজারেরও বেশি অভিবাসী কর্মীর মৃত্যু হয়েছে সেখানে। বিশ্বকাপের মাঝে কাতারের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে, স্টেডিয়ামগুলি তৈরি করতে গিয়ে প্রায় ৫’শ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু পশ্চিমা আদর্শের দূতরা অনেকেই ব্ল্যাটারের মতো চিন্তা করেনি। এবারের বিশ্বকাপে বড় রাজনীতি হলো সমকামিদের বিরুদ্ধে কাতারের শক্ত অবস্থান। ‘এনপিআর’ বলছে যে, কাতারে সমকামিতার শাস্তি হলো ৭ বছরের কারাদন্ড। কাতারের প্রাক্তন ফুটবলার এবং ফিফা বিশ্বকাপের দূত খালিদ সালমান জার্মান টেলিভিশন ‘জেডডিএফ’কে বলেন যে, সমকামিতা হলো মস্তিষ্কের একটা সমস্যা; আর সমকামিরা কেউ যদি কাতারে ভ্রমণ করে, তাহলে তাদেরকে কাতারের আইন মেনে চলতে হবে। তিনি বলেন যে, তিনি খুব একটা ইসলামিক ব্যক্তিত্ব নন; তবে সমকামিতা ইসলামে পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ। তার এই বক্তব্যগুলির বিরুদ্ধে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরসহ অনেকেই ব্যাপক সমালোচনা করে। ‘বিবিসি’ সালমান খালিদএর সাথে এক সাক্ষাতে সমকামিতার ব্যাপারটাকে আলোচনায় নিয়ে আসলে ফিফার কর্মকর্তারা বাধা দিয়ে আলোচনা বন্ধ করে দেন।

‘বিবিসি’ বলছে যে, সমকামিদের সমর্থনে ওয়েলস ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন গ্যারেথ বেইল সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি তার হাতে ‘ওয়ান লাভ’ চিহ্ন সম্বলিত একটা ব্যান্ড পড়বেন; যা কিনা সমকামিতাকে সমর্থন করবে। ইংল্যান্ড ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন হারি কেইনও একই সিদ্ধান্ত নেন। আর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার দলীয় এমপি লিউক পোলার্ড পার্লামেন্টে বলেন যে, যেহেতু কাতারের সমকামিরা নিরাপদে নেই এবং অভিবাসীদের মানবাধিকার সেখানে নিশ্চিত করা হয়নি, তাই তিনি মনে করেন যে, তার পক্ষেও কাতারে গিয়ে খেলা দেখাটা নিরাপদ নয়।

ফিফার প্রধান জিয়ানি ইনফানটিনো বিশ্বকাপ শুরুর আগে এক সংবাদ সন্মেলনে কাতারকে ভেন্যু হিসেবে নির্বাচনের পক্ষে সাংবাদিকদের সাথে বিতর্কে জড়ান। তিনি বলেন যে, ইউরোপিয়রা বাকি বিশ্বে যা করেছে, সেটার কারণে অন্যদেরকে শেখানোর আগে আগামী ৩ হাজার বছর ইউরোপিওদের উচিৎ ক্ষমা চাওয়া। কাতারে অভিবাসী কর্মীদের অধিকারের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে তিনি তার ছোটকালে সুইজারল্যান্ডে অভিবাসী কর্মী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরে বলেন যে, সেখানে ইতালিয় বলে এবং লাল চুল থাকার কারণে তাকে হেয় করা হতো। তবে ইনফানটিনোর যুক্তি ছিল, শুধুমাত্র সমালোচনা না করে কাতারের মতো দেশগুলির মানুষের শিক্ষার জন্যে পশ্চিমাদের বিনিয়োগ করা উচিৎ। বিশেষ করে কাতারকে দূরে সরিয়ে না দিয়ে বরং পাশে রেখে তাদের উপরে চাপ সৃষ্টি করে তাদের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটানো।

ফিফার প্রধান ইনফানটিনো সমকামিতা এবং মানবাধিকারের মতো পশ্চিমা চিন্তাগুলির সমালোচনা করেননি। বরং তিনি বলেছেন যে, কাতারের মতো দেশগুলিতে বিশ্বকাপের মতো অনুষ্ঠান আয়োজন করে তাদেরকে পশ্চিমা ধ্যানধারণায় অভ্যস্ত করানো। কাতারের মানুষের সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়ানো নয়; বরং কাতারের মানুষকে নিজেদের সংস্কৃতি ফেলে দিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতি নিতে চাপ দেয়ার ব্যাপারটাই তার কথায় ফুটে উঠেছে। ইনফানটিনো সাংবাদিকদেরকে বলেন যে, স্টেডিয়ামে মদ খাওয়ার ব্যাপারে কাতার সরকারকে রাজি করাতে তারা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা অবাক ব্যাপার যে, ইনফানটিনো এড়িয়ে যান যে, ফ্রান্স, স্পেন এবং পর্তুগালের মতো ইউরোপিয় দেশগুলিতেও যে স্টেডিয়ামে মদ খাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ২০১৯ সালেও ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এগনেস বুজিন এই নিষেধাজ্ঞাকে আরও কঠোর করার ব্যাপারে মতামত দিয়েছেন।

কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রধান কর্মকর্তা নাসের আল-খাতার ‘আল জাজিরা’র সাথে এক সাক্ষাতে সমকামিতার ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে পশ্চিমা চিন্তাগুলিকেই প্রতিফলিত করে বলেন যে, সকলেরই অধিকার রয়েছে তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার। বিশ্বকাপ একটা খেলার অনুষ্ঠান। পৃথিবীতে অনেক জায়গা রয়েছে নিজেদের মতামত প্রকাশের। খেলাকে খেলা হিসেবেই দেখা উচিৎ। তিনি মদ খাওয়ার ব্যাপারটাকেও পশ্চিমা চিন্তাকে প্রতিফলিত করেই বলেন যে, সকল দেশেরই কিছু আইনকানুন রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ নিজের এবং অন্যের জন্যে ক্ষতির কারণ না হয়, ততক্ষণ কোন সমস্যা হবার কথা নয়।

ব্রিটিশ সরকারের ওয়েবসাইট বলছে যে, কাতার ব্রিটেনে ৪০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে এবং এবছরের মে মাসে কাতারের আমির তার লন্ডন সফরে আরও ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে ইউরোপের জ্বালানি সমস্যা নিরসনেও কাতার ইউরোপের পাশে দাঁড়িয়েছে। কাতারে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনীদের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি। তাহলে এরপরেও কেন বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে কাতার পশ্চিমা আদর্শকে পুরোপুরিভাবে অনুসরণ না করার জন্যে সমালোচিত হচ্ছে? প্রকৃতপক্ষে সমকামিতা এবং মদের ব্যাপারগুলি কাতারের ইস্যু নয়; বরং পশ্চিমা আদর্শের সাথে কাতারের মুসলিম জনগণের ধর্মীয় আবেগের সাথে সংঘর্ষ। খেলার অনুষ্ঠান হলেও পশ্চিমা আদর্শের ক্রান্তিলগ্নে বিশ্বকাপের এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমারা তাদের আদর্শগুলিকে সার্বজনীন, সর্বোন্নত এবং ইসলামের আদর্শ থেকে উন্নততর প্রমাণ করার সুযোগটা হাতছাড়া করেনি।

No comments:

Post a Comment