Sunday 18 December 2022

চীনকে নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থির করছে

১৮ই ডিসেম্বর ২০২২
 
অরুণাচল প্রদেশে চীনের সাথে দ্বন্দ্বের কয়েকদিনের মাঝেই ভারত 'অগ্নি-৫' ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ভারতীয়রা বলছে যে, এর পাল্লা বেইজিং পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এতকাল দিল্লীর চিন্তাবিদেরা চীনের সাথে স্থিতাবস্থায় থাকার নীতি অনুসরণ করলেও ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে ভারত দ্রুতই আধুনিক অস্ত্রের জন্যে ওয়াশিংটনের দিখে ঝুঁকছে। পশ্চিমা অস্ত্রের উপরে ভারতের নির্ভরশীলতা এবং দক্ষিণ এশিয়াতে চীনকে মোকাবিলায় ভারতের সামরিক শক্তি প্রদর্শন অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে; যা প্রতিবেশী দেশগুলির প্রতিরক্ষা নীতিকেও প্রভাবিত করবে।

গত ১৩ই ডিসেম্বর ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, গত ৯ই ডিসেম্বর ভারত এবং চীনের সেনাবাহিনীর সদস্যরা অরুণাচল প্রদেশের ‘তাওয়াং সেক্টর’ নামের সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। এতে উভয় পক্ষের সেনারা স্বল্প আহত হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং পার্লামেন্টে বলেন যে, চীনা সৈন্যদের আগ্রাসী মনোভাবকে ভারতীয় সেনারা রুখে দিয়েছে। দুই পক্ষের মাঝে হাতাহাতি লড়াইয়ে ভারতীয় সেনাদের প্রতিরোধের মুখে চীনারা নিজেদের ব্যারাকে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। একই দিনে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এব্যাপারে সরাসরি কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।

অরুণাচল প্রদেশে দুই দেশের মাঝে দ্বন্দ্বের পরপরই ভারত পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণে সক্ষম ‘অগ্নি-৫’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ‘দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৫ হাজার কিঃমিঃ। ভারতের সামরিক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ‘এএনআই’ বলছে যে, ভারতীয় গবেষকেরা এই ক্ষেপণাস্ত্রের মাঝে কিছু ধাতুর পরিবর্তে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে এর ওজন প্রায় ২০ শতাংশ কমিয়ে এনেছেন। এর ফলশ্রুতিতে এর পাল্লা ৭ হাজার কিঃমিঃ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব; যা কিনা চীনের রাজধানী বেইজিংকেও এর টার্গেটের মাঝে যোগ করবে। তবে এই পাল্লা পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হবে কিনা, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর। চীন এবং পাকিস্তানের দুই ফ্রন্টের হুমকি মোকাবিলায় ভারত আক্রান্ত হলে প্রত্যুত্তর দেয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাইছে। এর অংশ হিসেবে তারা ভূমি থেকে ছোঁড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও সাবমেরিন থেকে ছোঁড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও ডেভেলপ করছে।

ভারতের ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা অরুণাচল প্রদেশে চীনাদের সাথে দ্বন্দ্বে বিজয় দাবি করছে। ‘দ্যা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এক লেখায় ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ‘বিজেপি’র জন্মদাতা সংস্থা ‘আরএসএস’এর সদস্য এবং ‘ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’এর বোর্ড অব গভর্নরের সদস্য রাম মাধব বলছেন যে, লাদাখের সমস্যা যেখানে দুই বছর ধরে ঝুলে আছে, সেখানে অরুণাচল প্রদেশের দ্বন্দ্ব মাত্র দুই ঘন্টার মাঝে সমাধান হয়েছে। লাদাখের চাইতে অরুণাচল প্রদেশে ভারতের সামরিক অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী; যা এখন চীনকে মেনে নিতে হবে। কয়েক দশক ধরে ভারত চীনের সাথে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চললেও ২০১৭ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের চীন নীতিতে পরিবর্তন এনেছেন। ১৯৯৩, ১৯৯৫, ২০০৫ এবং ২০১২ সালের সীমানা সমঝোতায় শান্তির কথা বলা হলেও শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। মোদির নীতি হলো ‘সশস্ত্র সহাবস্থান’, যা একসময় মাও সে তুংএর নীতি ছিল। এই নীতির হিসেবে ভারত কূটনীতিকে এগিয়ে নেবার সাথেসাথে সামরিক অবস্থানকেও শক্তিশালী করছে।

রাম মাধব ভারতের সামরিক অবস্থানকে শক্তিশালী বললেও সকলে তার সাথে একমত নন। অনেকেই বলছেন যে, ভারতের সামরিক সক্ষমতাকে একটা ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বড়সড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ভারতীয় থিঙ্কট্যাংক ‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’এর সিনিয়র ফেলো মিহির শর্মা ‘ব্লুমবার্গ’এর এক লেখায় বলছেন যে, বহু বছর ধরে ভারতের সামরিক শক্তিতে কম বিনিয়োগ করা হয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে ভারতের সামরিক সক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে গিয়েছে। বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী যদি চীন হয়, তাহলে ভারতের অবস্থান আরও দুর্বল। কিন্তু সমস্যা হলো, পাকিস্তানকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে ভারতে জনসমর্থন আদায় করা গেলেও চীনের কথা বলে সেটা এখনও ততটা সম্ভব নয়। কাজেই চীনকে মাথায় রেখে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করাটা খুব একটা সহজ নয়। অপরদিকে সমরাস্ত্রের জন্যে পশ্চিমাদের উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভর করাটাও ভারতের জন্যে মোটেই সমীচিন নয়। কারণ এতে ভারতকে পশ্চিমা প্রক্সি মনে করে চীনারা আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। আর যেখানে ভারত সামরিক দ্বন্দ্বের জন্যে মোটেই প্রস্তুত নয়, সেখানে চীনকে উস্কে দেয়াটা আত্মহত্যার সামিল। একারণেই ভারতীয় নেতারা একদিকে যেমন চীনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, অপরদিকে পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করছেন; যদিও দিল্লীর সকল নীতি নির্ধারকেরাই জানেন যে, পশ্চিমা সামরিক সহায়তা ছাড়া ভারতের চলবে না। কিন্তু নিজেদের সমরাস্ত্র উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াবার কথাগুলি যত ভালোই মনে হোক না কেন, চীনের আগ্রাসনকে মোকাবিলায় কয়েক দশক সময় নিয়ে নিজেদের প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়ন করার অবস্থানে নেই ভারত। এই মুহুর্তে চ্যালেঞ্জ হলো, জনগণকে বোঝানো যে, কেন ভারত তার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে পশ্চিমাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনবে।

ভারতের সাথে দ্বন্দ্বকে চীনারা পুরোপুরি ভিন্নভাবে দেখছে। প্যারিসে চীনা রাষ্ট্রদূত লু শে সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময়কালে বলেন যে, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ বলে প্রকৃতপক্ষে কোন কনসেপ্ট নেই। এটা যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছে ভারতসহ বিভিন্ন দেশকে ব্যবহার করে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে। একসময় সবাই ‘প্যাসিফিক’ বা ‘এশিয়া-প্যাসিফিক’ অঞ্চল নিয়ে কথা বলতো; ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’কে নিয়ে কেউ কথা বলেনি। এখন এখানে ভারত মহাসাগরকে এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে যে, চীনকে নিয়ন্ত্রণে তার ‘এশিয়া-প্যাসিফিক’ অঞ্চলের বন্ধুরা যথেষ্ট নয়। ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ বলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ভারত এবং ফ্রান্সকে তাদের কৌশলের মাঝে যুক্ত করেছে। ভারতের ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনারা ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সখ্যতাকে ন্যাটোর সাথে তুলনা দিলেও ভারতীয়রা তা অস্বীকার করছে। দিল্লী বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে গঠিত ‘কোয়াড’ কোন সামরিক সংস্থা নয়; যদিও কোয়াডের ছত্রছায়ায় বঙ্গোপসাগরে নিয়মিতই বড় আকারের নৌমহড়া চলছে। বেশিরভাগ চীনা বিশ্লেষকেরাই ভারতের সাথে চীনের সম্পর্কের অবনতিকে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের আরও কাছাকাছি যাবার কারণ হিসেবে দেখছেন।

ভারতের ডানপন্থী সরকার চীনের সাথে সীমান্ত সংঘাতকে চীনের আগ্রাসী মনোভাব হিসেবে দেখছে। অপরদিকে চীনারা ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতাকে চীন বিরোধী জোট হিসেবে দেখছে। এতকাল দিল্লীর চিন্তাবিদেরা চীনের সাথে স্থিতাবস্থায় থাকার নীতি অনুসরণ করলেও ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে ভারত দ্রুতই আধুনিক অস্ত্রের জন্যে ওয়াশিংটনের দিখে ঝুঁকছে। পশ্চিমা অস্ত্রের উপরে ভারতের নির্ভরশীলতা এবং দক্ষিণ এশিয়াতে চীনকে মোকাবিলায় ভারতের সামরিক শক্তি প্রদর্শন অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে; যা প্রতিবেশী দেশগুলির প্রতিরক্ষা নীতিকেও প্রভাবিত করবে।

12 comments:

  1. আপনি আগের পোস্টের এক কমেন্ট এ উল্লেখ করেছেন যে, ভারত এর ' চিন্তাগত অপারগতা ' বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের পথে প্রধান বাধা।
    এই রকম অবস্থায় ভারত যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমাদের সসহায়তায় চিনকে কতটা মোকাবেলা করতে পারবে?

    ভারতকে কি দুটি ফ্রন্টে লড়তে হতে পারে?
    কাশ্মীর এ CT তে ব্যস্থ আর্মি কতটা তৈরি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভারতের কিছুই করার নেই। অন্যদের কাজে সে শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখাবে। চীনের সাথে সংঘাত শুরু হলে ভারত সরাসরিই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইবে। আর তখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করবে। অর্থাৎ ভারত কি মনে করছে, সেটা চিন্তা করাটা অর্থহীন হয়ে যাবে।

      ভারতের নিরাপত্তাহীনতা এবং দুশ্চিন্তা গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এর কারণেই ভারত পশ্চিমাদের কথা শুনতে বাধ্য হয়। ভারতের নিজস্ব কোন মৌলিক চিন্তা নেই; যা আছে, সেগুলি কোন মৌলিক চিন্তা নয়; বরং সারভাইভাল ইন্সটিঙ্কট বা প্রবৃত্তি। সকল পশুপাখিরও এই প্রবৃত্তি থাকে। একারণে তারা নিজেদের এবং তাদের সন্তানদের রক্ষা করতে চায়। পশুদের থেকে মানুষকে আলাদা করে চিন্তা; প্রবৃত্তি নয়।

      Delete
    2. ভারতকে দুই ফ্রন্টে লড়তে হবে কিনা, তা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের উপর। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যদি পাকিস্তানকে বিরত রাখতে পারে, তাহলেই ভারতকে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হবে না। ভারত পাকিস্তানের সীমানা থেকে সেনা সড়িয়ে চীন এবং বাংলাদেশের সীমানায় মোতায়েন করতে পারবে।

      যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বিরত রাখতে পারে বিভিন্ন পন্থায়। যেমন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন; আইএমএফএর মাধ্যমে অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ; সৌদি আরবের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ; তুরস্কের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ; ইত্যাদি।

      Delete
  2. ভারতের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা চিনের সামনে কতটা দুর্বল প্রতিপন্ন করবে, সামনে যদি যুদ্ধ হয়?

    ReplyDelete
    Replies
    1. চীনের সাথে সংঘাতের সময় ভারতের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা অনেক ক্ষেত্রেই কাজে আসবে না চীনের জন্যে। কারণ ভারত সরকার জনগণের মাঝে জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে বিরোধী চিন্তাগুলিকে পদদলিত করতে পারবে। আর চীনা রাজনৈতিকভাবে মোটেই শক্তিশালী রাষ্ট্র নয়; তারা ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগাতে সক্ষম নয়। চীন যদি একটা আদর্শিক শক্তি হতো, তাহলে তার পক্ষে সেটা সম্ভব হলেও হতে পারতো।

      Delete
  3. পাকিস্তানকে ইউএস কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?
    যেখানে ইউএস ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিনত হচ্ছে দিনে দিনে আর পাক জনগনের মত পরিবর্তন হচ্ছে পাক আর্মি নিয়ে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এখানে কয়েকটা ব্যাপারকে একটু গভীরভাবে দেখাটা গুরুত্বপূর্ণ -

      ১। যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল হয়ে যাওয়ার অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শিক দুর্বলতা। বিভিন্ন সমস্যার আদর্শিক সমাধান দিতে না পারা এবং আদির্শিক দিক থেকে নিজেই নিজের কথার বিপরীতে কাজ না করা পারাটা এই দুর্বলতার অংশ। উদাহারণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই অভ্যন্তরীণ সমস্যায় পড়েছে; কারণ তার নিজের দেশের মানুষই জাতীয়তাবাদী হয়ে যাচ্ছে এবং 'আমেরিকা ফার্স্ট'এর মতো নীতিতে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। আবার আফগানিস্তানে পশ্চিমা আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে প্রায় দুই দশক পর ব্যর্থ হয়ে সমস্যার সমাধান না দিয়েই সেই দেশ থেকে পালিয়েছে।

      ২। দুর্বল হওয়ার অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন অথর্ব হয়ে গেছে। দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রও দুনিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী দেশ। এবং এখনও যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছেও কোন দেশ নেই। আদির্শিক দুর্বলতার কারণে বিশ্বব্যবস্থার উপরে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব কমে গেছে। কিন্তু কোন একটা দেশের উপরে চাপ সৃষ্টি করে নিজের স্বার্থ আদায় করে নেবার শক্তি এখনও যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্টই রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তুরস্ক যখন নিজের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে গিয়ে নিজস্ব সামরিক শক্তি তৈরি করতে চাইছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের জন্যে প্রযুক্তি পাওয়া কষ্টকর করে দিয়েছে নানা রকমের অবরোধের মাধ্যমে। এখন নিজেদের 'এফ-১৬' যুদ্ধবিমানের আপগ্রেডের জন্যে তুরস্কের নেতৃত্ব ওয়াশিংটনের পিছনে ঘুরছে।

      ৩। পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট দুর্বল একটা দেশ। তারা নিয়মিতভাবে আইএমএফএর পশ্চিমা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চলতে বাধ্য হয়েছে। এগুলির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম।

      ৪। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা তৈরি। তাদের নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া চিন্তাই করতে পারে না। তারা বহু যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শিক উদ্দেশ্যগুলিকে বাস্তবায়ন করেছে। যদিও পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র বহুবার পিছন থেকে ছুরি মেরেছে, তারপরেও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়তে পারছে না।

      ৫। যুক্তরাষ্ট্র সুপারপাওয়ার হলেও সে সর্বশক্তিমান নয়। তার নিয়ন্ত্রণ এবং ইচ্ছার বাইরেও অনেক কিছুই হয়। যেমন, পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তি হয়েছে এবং পারমাণবিক ওয়ারহেড ডেলিভারি করার জন্যে যথেষ্ট শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রও ডেভেলপ করেছে। সৌদি আরব পাকিস্তানের এই সামরিক প্রকল্পগুলিকে অর্থায়ন করেছে; অথচ সৌদি আরবের সরকারও যুক্তরাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ। আবার চীনের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তান নিজস্ব 'জেএফ-১৭' যুদ্ধবিমান ডেভেলপ করেছে; যেটার মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোন কম্পোনেন্ট নেই।

      ৬। যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা রয়েছে পাকিস্তানের উপরে চাপ দিয়ে নিজের স্বার্থ বাস্তবায়ন করা। পাকিস্তানের নেতৃত্ব যদি এমন মনে করতে থাকে যে, আপাততঃ যুক্তরাষ্ট্রের কথা শুনলেই পাকিস্তানের নিজস্ব স্বার্থের জন্যে ভালো, তাহলেই ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই স্বস্তিতে থাকবে। মনে রাখতে হবে যে, লাদাখে চীনের সাথে ভারতের ২০২০ সালের দ্বন্দ্বের মাঝে পাকিস্তান চুপচাপ থেকেছিল। এবং সেই সুযোগে ভারত পাকিস্তান সীমানা থেকে সামরিক শক্তি কমিয়ে চীনের সীমানায় মোতায়েন করেছি।

      কাজেই, যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব আদর্শিক দুর্বলতার কারণেই সে যা চাইবে সেটাই যে বাস্তবায়ন করতে পারবে, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও অনেক কিছুই ঘটতে পারে এবং নিয়মিতই ঘটে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র সর্বশক্তিমান নয়; যদিও অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে সেটাই মনে করে থাকে।

      Delete
    2. ধন্যবাদ। এত সুন্দর করে বোঝানোর জন্য।

      Delete
  4. পাকিস্তানে টিটিপি বিরোধী CT উপলক্ষে আমেরিকা আবার যুদ্ধে যোগ দিতে যাচ্ছে।
    এটা কি আফগানিস্তান থেকে পালানোর পর অন্যপথে, আফগান পলিসি তে প্রভাব রাখতে ইউ এস সক্রিয় হচ্ছে?
    কতটুকু সফলতা পেতে পারে?
    thank you.

    ReplyDelete
    Replies
    1. তথাকথিত 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ'টা হলো মুসলিম বিশ্বে নিজের প্রভাব ধরে রাখার এবং মুসলিম বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার মার্কিন কৌশল; এটা পাকিস্তান হোক, বা অন্য যেকোন দেশেই হোক। যেখানেই এই তথাকথিত সন্ত্রাস দেখা যাবে, সেখানেই যুক্তরাষ্ট্র ছুটে এসে নির্দেশ-উপদেশ দেবে, অস্ত্র বিক্রি করবে এবং সরকারগুলির উপরে চাপ সৃষ্টি করে নিজের স্বার্থ বাস্তবায়ন করবে।

      আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসার পর এই তথাকথিত 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ' যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে প্রধান ফোকাস নয়। কারণ তারা দুই দশক এই যুদ্ধে বিনিয়োগ করে দেউলিয়া হয়েছে; আর এর মাঝে চীন এবং রাশিয়া মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কাজেই এখন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে 'গ্রেট পাওয়ার' প্রতিযোগিতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

      তবে এটা মনে করাটা ঠিক নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বকে ভুলে গেছে। তথাকথিত 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ' ব্যর্থতায় পরিণত হবার পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ব্যাক-আপ কৌশল হলো চীন এবং রাশিয়াকে (মূলতঃ চীনকে) নিয়ন্ত্রণ করা; যাতে করে চীন মুসলিম বিশ্বকে শক্তিশালী না করতে পারে। কারণ মুসলিম বিশ্ব চীনের উপরে নির্ভরশীল হলে পশ্চিমারা মুসলিম বিশ্বের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাবে। আর মুসলিম বিশ্বের কাছে রয়েছে দুনিয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমি (মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া), সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ (সুয়েজ খাল, বাব-এল-মান্ডেব, হরমুজ, মালাক্কা), সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ (তেল, গ্যাস, ইউরেনিয়াম, লিথিয়াম, পটাসিয়াম, স্বর্ণ, কৃষিজ দ্রব্য, পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটা নদী, সবচাইতে বড় তরুণ জনগোষ্ঠী, ইত্যাদি। এই মুসলিম বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ হারালে পশ্চিমা আদর্শের বিরোধী শক্তি তৈরি হবে, যা কারুর পক্ষেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।

      কাজেই যুক্তরাষ্ট্র, তথা পশ্চিমারা নিশ্চিত করতে চাইবে মুসলিম বিশ্ব যেন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং বিভক্ত থাকে। মুসলিম বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ হারালে তারা পুরো দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারাবে। কারণ চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রকে যেভাবে চ্যালেঞ্জ করছে, একত্রিত মুসলিম বিশ্বের চ্যালেঞ্জ হবে এর চাইতে এক'শ গুণ বেশি শক্তিশালী।

      Delete
  5. TTP কে নিয়ে পাকিস্তানের অন্দরে যুদ্ধ বাধতে চলেছে, সঙ্গে আফগানিস্তানের যুদ্ধ বাধতে পারে, যেখানে আমেরিকার সক্রিয় ভুমিকা নিতে পারে৷
    এইরকম অবস্থায়, দক্ষিন এশিয়া ভু-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন হতে পারে?
    আফগানিস্তানের নবশাসক এর ট্রান্সন্যাশনাল উদ্যেশ্য আছে কি?
    পাকিস্তানে যদি টিটিপি সাথে লড়াইয়ে, তাদের কেমন ভুমিকা হতে পারে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. যুদ্ধের সম্ভাবনা থাকলে সেটা ভারত আর চীনের মাঝে। সেসময় পাকিস্তান আর বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে সেটা চিন্তা করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভারত যদি চীনের সাথে যুদ্ধে 'সেভেন সিস্টার্স' রাজ্যগুলি রক্ষা করতে বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে সামরিক ট্রানজিট চায় এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সেই ট্রানজিট দিতে চাপ সৃষ্টি করে, তাহলে কি পরিস্থিতি হতে পারে, সেটা নিয়ে চিন্তা করাটা বেশি জরুরি। আর সেরকম একটা পরিস্থিতিতে পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং তুরস্কের কি ভূমিকা হতে পারে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

      Delete