Saturday 10 December 2022

শি জিনপিংএর মধ্যপ্রাচ্য সফর নতুন কি দেখাচ্ছে?

১০ই ডিসেম্বর ২০২২
 
আরব নেতাদের সাথে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ইরাক এবং আফগানিস্তানের ব্যর্থতা যেমন মার্কিনীদের বন্ধুদের কাছে ওয়াশিংটনের মূল্যকে কমিয়েছে, তেমনি ওয়াশিংটনের নিজস্ব রাজনৈতিক কোন্দলের মাঝেই মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে মার্কিন রাজনীতিবিদদের অর্থহীন আদর্শিক অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বকে ‘নিরপেক্ষ’ নীতিতে এগুতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। পশ্চিমাদের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বের বন্ধনটা এখন নিতান্তই স্বার্থের। পশ্চিমা আদর্শের ক্রান্তিলগ্নে বাস্তবতাই এখন মধ্যপ্রাচ্য এবং চীনাদের উভয়ের সামনেই বাতিঘর-স্বরূপ।

গত ৯ই ডিসেম্বর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপংএর সৌদি আরব সফরের সময় সৌদি যুবরাজ এবং বাস্তবিক শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান বা ‘এমবিএস’ বলেন যে, চীনের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্কের ‘নতুন যুগ’ শুরু হয়েছে। এর আগের দিন দুই দেশের মাঝে কৌশলগত সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সৌদি বাদশাহ সালমান দুই দেশের মাঝে প্রতি দুই বছর অন্তর শীর্ষ বৈঠক করার ব্যাপারে সম্মত হন। ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই ঘোষণাটা এমন সময়ে এলো, যখন হোয়াইট হাউজের সাথে সৌদিদের সম্পর্কের বেশকিছুটা ভাটা যাচ্ছে। পাঁচ মাস আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় এরকম স্বতস্ফূর্ততা দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ওয়াশিংটনের চোখ রাঙানো উপেক্ষা করেই চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু পর থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এক সংবাদ সন্মেলনে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান বলেন যে, তারা মনে করছেন না যে, রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে কোন একটা পক্ষকেই সমর্থন করে যেতে হবে; অথবা একজনের সাথে সম্পর্ক ভালো করার অর্থ এই নয় যে, বাকিদেরকে দূরে ঠেলে দিতে হবে।

শি জিনপিংএর সফরের সময় বেশকিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মাঝে জ্বালানি ছাড়াও রয়েছে ‘গ্রীন হাইড্রোজেন’, তথ্য প্রযুক্তি, পরিবহণ এবং কন্সট্রাকশন। চীনা কোম্পানি ‘হুয়াই’ সৌদি আরবে ‘ক্লাউড কম্পিউটিং’, ডাটা সেন্টার এবং ‘হাই-টেক কমপ্লেক্স’ তৈরি করা ক্ষেত্রে সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয় যে, বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে চীনাদের সাথে সৌদিরা সহযোগিতা করবে এবং একইসাথে তেলের বাইরে অন্যান্য সেক্টরে এবং শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তিতে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। তবে চীনাদের অর্থনীতি যখন মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল, তখন সহযোগিতার কেন্দ্রে যে জ্বালানি থাকবে, তা বোঝাই যায়। ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘এরাব গালফ স্টেটস ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক রবার্ট মগিয়েলনিকি ‘রয়টার্স’কে বলছেন যে, অনেকগুলি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও জ্বালানির ব্যাপারগুলিই সম্পর্কের মূল চাবিকাঠি হবে। তবে দুই দেশের প্রযুক্তিগত চুক্তিগুলি ওয়াশিংটনকে যথারীতি বিচলিত করবে। নিরপত্তার কথা বলে মার্কিনীরা আরও আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে চীনা কোম্পানির ‘ফাইভ-জি’ প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক স্থাপনের ব্যাপারে বাধা দিচ্ছে; যা আরব দেশগুলি আমলে নেয়নি।

শি জিনপিং আরও বলেন যে, তেল ও গ্যাসের মূল্য শোধ মার্কিন ডলারের বদলে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে করার ক্ষেত্রে সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে চীনারা ‘সাংহাই পেট্রোলিয়াম এন্ড ন্যাচারাল গ্যাস এক্সচেঞ্জ’কে পুরোপুরি ব্যবহার করতে চাইছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সৌদি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ বলছে যে, চীনের কাছ থেকে সৌদিরা যা আমদানি করছে, তার মূল্য পরিশোধ করতে হয়তো স্বল্প পরিমাণে তেলের বাণিজ্য ইউয়ানে করা যেতে পারে। কিন্তু মূল বাণিজ্য ইউয়ানে করার জন্যে এটা এখনই হয়তো সঠিক সময় নয়। কারণ সৌদিদের বেশিরভাগ সম্পদ এবং রিজার্ভ রয়েছে মার্কিন ডলারে। সৌদিরা প্রায় ১’শ ২০ বিলিয়ন ডলার মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করে রেখেছে। আর সৌদিদের নিজস্ব মুদ্রা রিয়ালএর মূল্যমানও নির্ধারিত হয় ডলারের মূল্যমানের সাথে সঙ্গতি রেখে। ‘সৌদি প্রেস এজেন্সি’ বলছে যে, সৌদি আরবের সাথে চীনের ২০২১ সালের বাণিজ্যের মূল্যমান ছিল প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলারে।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, শি জিনপিংএর সফর শুধুমাত্র সৌদি আরবের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলি ছাড়াও পুরো মধ্যপ্রাচ্যের অনেক নেতারাই জড়ো হয়েছিলেন শি জিনপিংএর সাথে বৈঠকে যোগ দিতে; যাদের মাঝে ছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি, তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদ, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, সুদানের বাস্তবিক শাসক আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি, মরক্কোর প্রধানমন্ত্রী আজিজ আখান্নুশ এবং লেবাননের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নজিব মিকাতি।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে শি জিনপিংএর এই সফর ছিল সমাজতান্ত্রিক চীনের জন্যে সবচাইতে বড় কূটনৈতিক পদক্ষেপ। তবে ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, চীনারা এমন এক অঞ্চলের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে, যেখানকার নেতৃবৃন্দ বহু বছর ধরে মার্কিন নিরাপত্তা সহায়তার উপরে নির্ভরশীল। তবে মানবাধিকার, জ্বালানি নীতি এবং মার্কিন নিরাপত্তার নিশ্চয়তার মতো ইস্যুতে সৌদিদের সাথে হোয়াইট হাউজের দূরত্ব তৈরি হবার সময়েই চীনারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে মনোযোগী হয়েছে।

‘সিএনএন’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সৌদিদের সাথে চীনাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো উভয় দেশই একে অপরের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। অপরদিকে সৌদিরা অনেকেই তাদের রাজনীতিতে পশ্চিমাদের হস্তক্ষপের ব্যাপারে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। সৌদি বিশ্লেষক আলি শিহাবি এক টুইটার বার্তায় বলছেন যে, মার্কিন রাজনীতিবিদেরা সৌদি আরবকে সংজ্ঞায়িত করছে মানবাধিকার দিয়ে; অথচ মার্কিনীরা নিজেরাই তাদের বিশাল সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও ইরাক এবং আফগানিস্তানে ব্যর্থ হয়েছে। সৌদিরা চীন, ভারত এবং রাশিয়ার সাথে জ্বালানির ব্যাপারে সহযোগিতা, আর অস্ত্রের ব্যাপারে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে; একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উঁচুনিচুর মাঝ দিয়েই সম্পর্ককে এগিয়ে নিচ্ছে।

চীনাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি মূলতঃ আগ্রাসী নয়। জ্বালানির জন্যে মধ্যপ্রাচ্যের উপরে নির্ভরশীলতা শি জিনপিংকে সৌদি আরবে ডেকে এনেছে। ডলারকে ইউয়ান দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রচেষ্টাগুলি আপাততঃ দ্বিতীয় সাড়িতেই থাকছে। যদিও আপাতঃ দৃষ্টিতে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাবকে প্রতিস্থাপন করতে চীনাদের অগ্রগামী দেখা যাচ্ছে, তথাপি এটা রাজনৈতিক প্রভাব নয়। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে চীনাদের কোন বক্তব্য নেই। আর নিরাপত্তার দিক থেকেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি চীনের উপরে নির্ভরশীল নয়। ইরাক এবং আফগানিস্তানের ব্যর্থতা যেমন মার্কিনীদের বন্ধুদের কাছে ওয়াশিংটনের মূল্যকে কমিয়েছে, তেমনি ওয়াশিংটনের নিজস্ব রাজনৈতিক কোন্দলের মাঝেই মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে মার্কিন রাজনীতিবিদদের অর্থহীন আদর্শিক অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বকে ‘নিরপেক্ষ’ নীতিতে এগুতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। পশ্চিমাদের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বের বন্ধনটা এখন নিতান্তই স্বার্থের। পশ্চিমা আদর্শের ক্রান্তিলগ্নে বাস্তবতাই এখন মধ্যপ্রাচ্য এবং চীনাদের উভয়ের সামনেই বাতিঘর-স্বরূপ।

1 comment:

  1. অসংখ্য ধন্যবাদ।
    যথার্থ বিশ্লেষন৷
    কিন্তু জিসিসি - চায়না সামিট এ ইউএই অংশগ্রহণ করেনি৷ এর কারন কি হতে পারে?

    ReplyDelete