Saturday 31 December 2022

ইউক্রেন যুদ্ধ - ২০২৩ সালের সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি

৩১শে ডিসেম্বর ২০২২

যুদ্ধক্ষেত্রে এখনও এতটা স্থবিরতা আসেনি যে, কোন একটা পক্ষ শান্তির জন্যে মরিয়া হয়ে যাবে। তবে ইউক্রেনের যুদ্ধ সক্ষমতা পুরোপুরিভাবে নির্ভর করছে পশ্চিমা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার সক্ষমতার উপর। ইউক্রেনিয়রা নিশ্চিত যে তাদের দেশের দখলীকৃত অঞ্চল ফেরত পাবার অর্থই হবে বিজয়। কিন্তু পশ্চিমারা একমত নয় যে, প্রকৃত বিজয় কোনটা। এই অনিশ্চয়তার মাঝে ইউরোপের নিরাপত্তাও অনেকটাই ঝুলে থাকবে।

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ‘বিবিসি’ কয়েকজন বিশ্লেষকের মতামত তুলে ধরেছে; যাদের মাঝে কিছুটা মতৈক্য থাকলেও মতানৈক্যই বেশি। ব্রিটেনের ‘স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইন্সটিটিউট’এর এসোসিয়েট ডিরেক্টর মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, রুশরা যতটা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে চাইছে, ইউক্রেনিয়রা ততটাই আক্রমণে যেতে চাইছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন লেঃ জেনারেল বেন হজেস বলছেন যে, যদিও এখনই ইউক্রেনের জন্যে বিজয় উৎসব করা ঠিক হবে না, তথাপি যুদ্ধের গতি এখন তাদের পক্ষেই রয়েছে। শীতকালে যুদ্ধের গতি কিছু কম হতে পারে। তবে পশ্চিমা সহায়তার কারণে ইউক্রেনিয়রা রুশদের চাইতে অপেক্ষাকৃত সহজে শীতকাল অতিক্রম করতে পারবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর নেভাল এনালিসিস’এর ডিরেক্টর মাইকেল কফম্যান রাশিয়া-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রিডল’এর এক লেখায় একমত পোষণ করে বলছেন যে, শীতকালে অপারেশন চালানো কঠিন হলেও ইউক্রেনিয়রা হয়তো আক্রমণে যাবে। একইসাথে ইউক্রেনিয়রা হয়তো রাশিয়ার ভেতরে দূরবর্তী কৌশলগত টার্গেটে হামলা করতে থাকবে। এগুলির মূল উদ্দেশ্য হলো, রাশিয়াকে শীতকাল বা শীতকালের পর আক্রমণে যাওয়ায় বাধা দেয়া। ইউক্রেন যুদ্ধ এখন পর্যন্ত প্রমাণ করেছে যে, প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি করার মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে দ্রুতি আনার সুযোগ তৈরি করা যায়।

মাইকেল ক্লার্কের কথায়, ইউক্রেনিয়রা এই মুহুর্তে পূর্বাঞ্চলের ডনবাসে বড় রকমের সাফল্যের খুব কাছে রয়েছে। ক্রেমিনা এবং সাতোভে শহর দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে ইউক্রেনিয়রা। এই শহরগুলি রুশদের লজিস্টিকসের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই অঞ্চলে খুব বেশি ভালো রাস্তা নেই। এই শহরদু’টা ইউক্রেনিয়দের হাতে চলে গেলে রুশদেরকে প্রায় ৬০কিঃমিঃএরও বেশি দূরের এলাকায় পিছিয়ে যেতে হবে; যেখানে তার হয়তো প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান তৈরির জন্যে ভৌগোলিক সহায়তা পেতে পারে। ক্লার্কের সাথে একমত ইস্রাইলি সামরিক বিশ্লেষক ডেভিড গেন্ডেলমান; যিনি বলছেন যে, এই অঞ্চলে ইউক্রেনিয় সফলতা রুশদের উত্তরের পুরো ফ্রন্টলাইনকেই বিপদে ফেলে দেবে।

ক্লার্ক মনে করছেন যে, একই সময়ে ইউক্রেনিয়দের পক্ষে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খেরসনের আশেপাশে নতুন করে আক্রমণ শুরু করাটা কঠিন হতে পারে। তবে হঠাৎ করে ইউক্রেনিয়রা সেখানে আক্রমণ করলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। কারণ এর আগেও সেটা তারা সফলভাবে করেছে। অপরদিকে রুশরা তাদের নতুন করে মোবিলাইজ করা ৩ লক্ষ সেনাকে ব্যবহার করে শীতের পরপরই আক্রমণে যেতে চাইতে পারে। তবে এই আক্রমণে রুশদের লক্ষ্য কি হতে পারে, তা নিশ্চিত নয়। বরং স্বল্প সময়ের একটা ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাই বেশি থাকবে।

মাইকেল ক্লার্কের সাথে দ্বিমত পোষণ করে জেনারেল বেন হজেস বলছেন যে, ইউক্রেনিয়রা খুব সম্ভবতঃ শীতকালের মাঝেই দক্ষিণের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের জন্যে আক্রমণ শুরু করবে। এর কারণ, রুশরা খেরসন ছেড়ে দিয়ে সামরিক এবং মনোবলের দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে; আর অপদিকে ইউক্রেনিয়দের মাঝে একদিকে যেমন আশার সঞ্চার হয়েছে, অপরদিকে তাদের লজিস্টিকসের অবস্থা যথেষ্ট ভালো হয়েছে। হজেস মনে করছেন যে, ২০২৩ সালের মাঝেই পুরো ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ইউক্রেনিয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। মাইকেল কফম্যান বলছেন যে, খেরসনের আশেপাশে রুশরা অত্যন্ত শক্ত প্রতিরক্ষা তৈরি করেছে; যেগুলি অতিক্রম করতে গেলে ইউক্রেনিয়দের অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতির সন্মুখীন হতে হবে এবং আক্রমণ হবে ধীরগতির।
 

ডেভিড গেন্ডেলমান বলছেন যে, রুশরা তাদের মোবিলাইজ করা ৩ লক্ষ সেনার বেশিরভাগই এখনও যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করেনি। অপরদিকে খেরসন ছেড়ে আসার পর রুশদের বেশকিছু ইউনিট বেকার হয়ে গেছে। এই বাহিনীগুলিকে ব্যবহার করে রুশরা নতুন করে আক্রমণে যেতে পারে। এক্ষেত্রে বড় কোন কৌশলগত লক্ষ্য নিয়ে আক্রমণে না গেলেও সেটা হতে পারে অত্যন্ত ধীরগতির আক্রমণ; যেখানে ক্ষয়ক্ষতি হবে অনেক। রুশরা ইতোমধ্যেই বাখমুত এবং আভদিভকা এলাকায় এরূপ কৌশল বাস্তবায়ন করেছে। একইরকমের মিশন তারা শুরু করতে পারে ক্রেমিনা-সাতোভে এলাকায়। একইসাথে ইউক্রেনের ভেতরের অবকাঠামোর উপর হামলা হয়তো অব্যাহত থাকবে। অপরদিকে ইউক্রেনিয়রা হয়তো দক্ষিণ-পূর্বে মেলিটোপোল-বেরদিয়ানস্কএর দিকে আক্রমণ শুরু করতে পারে; যাতে করে ক্রিমিয়ায় অবস্থিত রুশ সেনাদেরকে ডনবাস অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়। এই সম্ভাবনা চিন্তা করেই রুশরা মেলিটোপোল অঞ্চলের প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করছে।

মাইকেল কফম্যান বলছেন যে, ইউক্রেনিয়দের সমস্যা বিস্তর। একদিকে তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে তারা দোটানায় পড়েছে যে, তারা ফ্রন্টলাইনে তাদের সেনাদের রক্ষা করবে, নাকি শহরগুলিকে রক্ষা করবে। ইউক্রেনিয়দের গোলাবারুদের ঘাটতিও রয়েছে প্রবল। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে যে হারে গোলাবারুদ ব্যবহার করছে, পশ্চিমা দেশগুলির গোলাবারুদ উৎপাদন করার সক্ষমতা তার থেকে কম। মার্কিনীরা তাদের স্টক থেকে গোলাবারুদ ইউক্রেনকে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ইউক্রেনকে গোলাবারুদ সরবরাহ করতে গিয়ে পশ্চিমা দেশগুলি মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদে গোলাবারুদের ঘাটতির সমস্যায় পড়েছে। তবে রুশদের গোলাবারুদের ঘাটতির খবরও শোনা যাচ্ছে। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, গোলাবারুদ উৎপাদনের চাইতে খরচের পরিমাণ বেশি। এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার গোলাবারুদ কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে, তা সামনের কয়েক মাসের মাঝেই পরিষ্কার হবে। রুশরা অধিক সেনা এবং যথেষ্ট গোলাবারুদ যোগাড় করতে পারলে আক্রমণে যেতে পারে। তবে যথেষ্ট গোলাবারুদ পাওয়া না গেলে তারা ছোট ছোট আক্রমণের মাঝেই নিজেদেরকে সীমিত রাখতে পারে। মোটকথা, উভয় পক্ষেরই ফেব্রুয়ারির পর বড় আকারের আক্রমণে যেতে পারার সক্ষমতা কম।

ইউক্রেন যুদ্ধ হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা কম। কফম্যান মনে করছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে এখনও এতটা স্থবিরতা আসেনি যে, কোন একটা পক্ষ শান্তির জন্যে মরিয়া হয়ে যাবে। অগাস্টের পর থেকে ইউক্রেনিয়রা সাফল্য পাচ্ছে। এই মুহুর্তে একটা যুদ্ধবিরতি রুশদের পক্ষে যাবে। এতদিন পর্যন্ত ইউক্রেনিয়রা আশাতীত সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে; আর রুশরা প্রচলিত ধারণার কাছাকাছিও সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। তবে ইউক্রেনের যুদ্ধ সক্ষমতা পুরোপুরিভাবে নির্ভর করছে পশ্চিমা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার সক্ষমতার উপর। ‘ডয়েচে ভেলে’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনিয়রা নিশ্চিত যে তাদের দেশের দখলীকৃত অঞ্চল ফেরত পাবার অর্থই হবে বিজয়। কিন্তু পশ্চিমারা একমত নয় যে, প্রকৃত বিজয় কোনটা। এই অনিশ্চয়তার মাঝে ইউরোপের নিরাপত্তাও অনেকটাই ঝুলে থাকবে।

No comments:

Post a Comment