Friday 25 November 2022

ইরানের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের নতুন মোড়?

২৬শে নভেম্বর ২০২২

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসমূহ। ইরান নতুন করে ইউরেনিয়াম প্রসেসিং শুরু করার পরিকল্পনা করছে। ইরান তার এই কর্মকান্ড চালাচ্ছে ফোরদাউ-এর ভূগর্ভস্থ স্থাপনায়, যে জায়গাটা বোমা মেরে ধ্বংস করাটা বেশ কঠিন হতে পারে। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে চীন যখন যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন ইউক্রেন যুদ্ধ মার্কিনীদের সামরিক সক্ষমতাকে বিভক্ত করেছে। এমতাবস্থায় ওয়াশিংটনে অনেকেই চাইছে না মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক দায়িত্ব বেড়ে যাক। কিন্তু ইরানের বাস্তবতা ওয়াশিংটনকে তার নীতির পরিবর্তন করতে বাধ্য করছে; যা কিনা মার্কিন সামরিক বাহিনীর বৈশ্বিক অবস্থানকে চাপের মাঝে ফেলছে।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা পরমাণু প্রকল্পের বিষয়ে ইরানের সহযোগিতা যথেষ্ট নয় বলে বিবৃতি দেয়ার পর গত ২২শে নভেম্বর ইরান বলে দিয়েছে যে, দেশটা নতুন করে ইউরেনিয়াম প্রসেসিং শুরু করার পরিকল্পনা করছে। ‘এরাব নিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৫ সালে ইরানের সাথে পশ্চিমাদের চুক্তির আগ পর্যন্ত ইরান ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম প্রসেস করছিল; চুক্তি মোতাবেক যা ৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল। এখন ইরান সেটাকে ৬০ শতাংশে উন্নীত করতে চাইছে। তবে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্যে এটাকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে; যা থেকে ইরান এখনও বেশ কিছুটা দূরেই রয়েছে। চুক্তি মোতাবেক ইরান ইউরেনিয়াম প্রসেসিংএর জন্যে প্রথম জেনারেশনের ‘আইআর-১’ সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করতে পারার কথা। তবে এখন ইরান নতুন জেনারেশনের ‘আইআর-২এন’, ‘আইআর-৪’ এবং ‘আইআর-৬’ সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করছে; যা কিনা ইরানের ইউরেনিয়াম প্রসেসিং সক্ষমতাকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এই সিদ্ধান্ত ইরানকে পারমাণবিক বোমা তৈরির দিকে নিয়ে যাবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো হেনরি রোম ‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে বলছেন যে, ইরান তার এই কর্মকান্ড চালাচ্ছে ফোরদাউ-এর ভূগর্ভস্থ স্থাপনায়, যে জায়গাটা বোমা মেরে ধ্বংস করাটা বেশ কঠিন হতে পারে। পেন্টাগনের কর্মকর্তারা এটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যথেষ্টই নিম্নমুখী। পারমাণবিক ইস্যু ছাড়াও ইরান অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়েছে, যেখানে পশ্চিমারা ইরানের সরকারবিরোধীদের সমর্থন দিচ্ছে। অপরদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে ইরান রাশিয়াকে সুইসাইড ড্রোন সরবরাহ করে চলেছে। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা বলছেন যে, ইরান হয়তো খুব শিগগিরই রাশিয়ার জন্যে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন শুরু করতে পারে। এছাড়াও ইরাকের অভ্যন্তরে ইরানের হস্তক্ষেপ নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্ব রয়েছে।

‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, প্রায় ১৮ মাস ধরে পারমাণবিক ইস্যুতে যখন ইরানের সাথে পশ্চিমাদের আলোচনা চলমান ছিল, তখন পশ্চিমাদের দৃষ্টি ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীনের সাথে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার দিকে। কিন্তু এখন হয়তো মার্কিনীদের সাথে ইরানের সম্পর্কে নতুন মোড় আসতে যাচ্ছে; যেখানে সংঘাতই প্রাধান্য পাবে। ইরান ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির সাথে পারমাণবিক চুক্তি করে; যা থেকে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে আসেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্রাম্পের নীতিকে পরিবর্তন করার কথা বললেও এটা এখন পরিষ্কার যে, ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি এখন একটা মৃত বিষয়।

বাইডেন প্রশাসন কিছুদিন আগেই ইরানের উপরে নতুন করে অবরোধ আরোপ করেছে এবং ইরানের সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদেরকে খোলাখুলিভাবে সমর্থন দেয়া শুরু করেছে। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কারবি ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, ইরানের সাথে এখন কোন কূটনীতি নেই। পারমাণবিক আলোচনা থমকে রয়েছে এবং এব্যাপারে এখন হোয়াইট হাউজের কোন আগ্রহই নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা ‘দ্যা নিউ নিয়র্ক টাইমস’কে বলছেন যে, হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা বৈঠকগুলিতে এখন ইরানের সাথে আলোচনা চালিয়ে নেয়ার বিষয়ে কোন কথা হয় না; বরং কথা হয় কিভাবে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পকে পিছিয়ে দেয়া যায়; কিভাবে ইরানের সরকারবিরোধীদেরকে যোগাযোগ সুবিধা দেয়া যায়; কিভাবে ইরান থেকে রাশিয়ায় অস্ত্রের সরবরাহকে ব্যাহত করা যায়। তবে যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে রাশিয়ার এই সরবরাহ রুটকে ব্যাহত করতে উদ্যত হয়, তাহলে রাশিয়াও ইউক্রেনের সাথে পশ্চিমাদের সামরিক সরবরাহ রুটের উপর হামলা করতে পারে। হেনরি রোম বলছেন যে, হোয়াইট হাউজ একসময় বলতো যে, তারা ইরান ইস্যুকে একটা বাক্সের ভেতরে ভরে রাখতে চায়। কিন্তু এখন মার্কিন সরকারের এই নীতি চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে।

অপরপক্ষে ইরান জানে যে, পশ্চিমাদের সাথে পারমাণবিক ইস্যুতে চুক্তি করার সাথেসাথেই ইরানকে বোমা তৈরির উপযোগী সকল ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করতে হবে। এই ব্যাপারটা ইরানের কট্টরপন্থীদের কাছে মোটেই পছন্দের ছিল না বিধায় তারা পারমাণবিক আলোচনার ঘোর বিরোধী ছিল। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রেও কট্টরপন্থীরা ইরানের সাথে যেকোন আলোচনার বিরোধী। ইরানের সাথে আলোচনায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিনিধিত্ব করা রবার্ট ম্যালি গত সপ্তাহে বলেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে ইরান কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যার ফলে ইরানের সরকার শুধু তার জনগণ থেকেই দূরে সরে যায়নি; তারা ইউরোপের সাথেও দূরত্ব তৈরি করেছে। অথচ ইউরোপিয় দেশগুলিই ইরান ইস্যুতে আলোচনা চালিয়ে নেবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।

তবে প্রশ্ন হলো, ইস্রাইলে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে নতুন ডানপন্থী সরকার ক্ষমতা নেবার পর ইরানের ব্যাপারে ইস্রাইলের নীতির পরিবর্তন হবে কিনা। নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করে ফেলার লক্ষ্যে ইরানের উপরে সামরিক হামলার পক্ষপাতি। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তাদের মতে, ইরান যদি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষমও হয়, তদুপরি ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে এই বোমাকে ব্যবহার করার সক্ষমতা তৈরি করতে ইরানের আরও দুই বছর লাগবে।

তবে মার্কিনীরা যে ইস্রাইলকে আস্বস্ত করতে ব্যস্ত, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সামরিক কর্মকান্ডে। মার্কিন ডানপন্থী মিডিয়া ‘ফক্স নিউজ’ বলছে যে, গত ২১শে নভেম্বর ইস্রাইলি বাহিনীর চিফ অব স্টাফ আভিভ কোচাভি ওয়াশিংটনে মার্কিন সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভানের সাথে কয়েক দফা আলোচনার পর সামনের সপ্তাহগুলিতে উভয় দেশ বিমান বাহিনীর যৌথ মহড়ার ব্যাপারে পরিকল্পনা করছে। এই মহড়ার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হবে ইরানের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধে সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত করা। মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ইস্রাইল যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু ছিল এবং আছে; আর ইস্রাইলের সাথে সহযোগিতা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

ভূরাজনৈতিক দিক থেকে চীন যখন যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন ইউক্রেন যুদ্ধ মার্কিনীদের সামরিক সক্ষমতাকে বিভক্ত করেছে। এমতাবস্থায় ওয়াশিংটনে অনেকেই চাইছে না মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক দায়িত্ব বেড়ে যাক। কিন্তু ইরানের বাস্তবতা ওয়াশিংটনকে তার নীতির পরিবর্তন করতে বাধ্য করছে; যা কিনা মার্কিন সামরিক বাহিনীর বৈশ্বিক অবস্থানকে চাপের মাঝে ফেলছে।

No comments:

Post a Comment