Sunday 12 June 2022

ভারতে নবী (সাঃ)কে অবমাননার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?

১২ই জুন ২০২২
মালদ্বীপের সৈকতে ময়লার ঝুড়িতে মোদির ছবি। যদিও বিজেপি সরকার তার মুসলিম বিদ্বেষী নীতি বাস্তবায়নে মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্বের ‘রেড লাইন’ কোথায়, তা বুঝতে পেরেছে; তথাপি মুসলিম বিশ্বের জনগণের ‘রেড লাইন’ তাদের কাছে পরিষ্কার না হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটা এড়িয়ে যাবার উপায় নেই যে, উগ্র হিন্দুবাদী ভারত তৈরির আকাংক্ষা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সুস্থ্য মস্তিষ্কের চিন্তা বেশিরভাগক্ষেত্রেই অবহেলিত হবে; যার ফলশ্রুতিতে আবারও হয়তো মুসলিম বিশ্বের সেকুলার নেতৃত্ব তাদের জনগণের কাছ থেকে চাপ অনুভব করবে। প্রতি ক্ষেত্রেই মুসলিম বিশ্বের জনগণের মাঝে নেতৃত্বের হাহাকার জেঁকে বসবে; যা কিনা ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ।

 
ভারতের বিজেপি সরকারের দুই মুখপাত্র ও রাজনীতিবিদ নুপুর শর্মা এবং নাভীন জিনদালের নবী মুহাম্মদ (সাঃ)কে নিয়ে করা অবমাননাকর মন্তব্যের উপর ভর করে পুরো মুসলিম বিশ্বে যখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তখন এই ঘটনার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে মাত্র। গত ২৬শে মে নুপুর শর্মা এক ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে রাসূল (সাঃ) এবং তার স্ত্রী আয়েশা (রাঃ)কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। এই মন্তব্যের মারাত্মক সমালোচনা শুরুর পর বিজেপির আরেক মুখপাত্র নাভীন জিনদাল টুইটারে তার সহকর্মীকে সমর্থন দেন। ‘সিএনএন’এর খবরে বলা হচ্ছে যে, ঘটনার স্পর্শকাতরতা অনুধাবন করে বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া শর্মার কথাগুলি কি ছিল, তা পরিষ্কার করে বলা থেকেও বিরত থেকেছে। শর্মা পরবর্তীতে এক টুইটার বার্তায় তার এই মন্তব্য তুলে নেন। পুরো মুসলিম বিশ্ব থেকে চাপ আসার পর ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ৫ই জুন নুপুর শর্মার সদস্যপদ স্থগিত করে এবং নাভীন জিনদালকে দল থেকে বহিষ্কার করে। প্রশ্ন উঠেছে যে, বিজেপির অধীনে ভারতীয় মুসলিম নাগরিকদের উপর চরম অত্যাচারের খবরের ব্যাপারে মুসলিম বিশ্ব থেকে এতকাল কোন চাপ না আসলেও এখন কেন চাপ আসা শুরু হয়েছে?

সারা মুসলিম বিশ্বে প্রতিক্রিয়া

বার্তা সংস্থা ‘এএফপি’ জানাচ্ছে যে, ৫ই জুন ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেঙ্কাইয়াহ নাইডু কাতার সফর করার সময় ভারতের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানানো হয়। একই দিনে ইরানের বার্তা সংস্থা ‘ইরনা’ জানায় যে, সেদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে ইরানের ‘সরকার এবং জনগণের পক্ষ থেকে’ প্রতিবাদ জানানো হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টা দেশ নিয়ে গঠিত ‘গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল’ বা ‘জিসিসি’র সেক্রেটারি জেনারেল নায়েফ ফালাহ আল হাজরাফএর পক্ষ থেকেও বিবৃতি দেয়া হয়। ৫৭টা মুসলিম দেশ নিয়ে গঠিত ‘ওআইসি’র পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে জাতিসংঘকে অনুরোধ জানানো হয় যাতে করে ভারতের মুসলিমদের রক্ষা করার জন্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়। ৬ই জুন ভারতের বার্তা সংস্থা ‘পিটিআই’ জানায় যে, সোদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্দান, বাহরাইন, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের সাথে ইন্দোনেশিয়াও যোগ দিয়েছে নিন্দা জানাতে। তবে একইসাথে সৌদি আরব এবং কুয়েত বিজেপির মুখপাত্রকে দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার মোদি সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়।

৬ই জুন ‘ইজিপ্ট টুডে’র এক খবরে বলা হচ্ছে যে, মিশরের সর্বোচ্চ ধর্মীয় সংস্থা ‘আল আজহার’ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, বিজেপির নেতৃত্বের বক্তব্য সন্ত্রাসের শামিল। এধরনের মন্তব্য পুরো বিশ্বকে মারাত্মক বিপর্যয়ের মাঝে ফেলা দেয়া ছাড়াও যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিবৃতিতে বলা হয় যে, ভারতের কিছু রাজনীতিবিদেরা নিজেদের ভোট বাড়াতে এধরনের কথা বলছে। সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। সৌদি আরবের ‘জেনারেল প্রেসিডেন্সি অব দ্যা এফেয়ার্স অব দ্যা গ্র্যান্ড মস্ক’এর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের বক্তব্যকে নিকৃষ্টতম কর্মকান্ড বলে আখ্যা দেয়া হয়। ‘সৌদি আরবের ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ’এর পক্ষ থেকে বলা হয় যে, এর মাধ্যমে বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাবে। এর দু’দিন আগে ওমানের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আহমাদ বিন হামাদ আল খলিল এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, এধরনের মন্তব্য সকল মুসলিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শামিল। তিনি ভারতীয় পণ্য বয়কট করারও আহ্বান জানান। বার্তা সংস্থা ‘এএফপি’র এক খবরে বলা হয় যে, কুয়েতের ‘আল আরাবিয়া কোঅপারেটিভ সোসাইটি’র এক সুপারস্টোরের কর্মচারীরা সেখানকার ভারতীয় পণ্য শেলফ থেকে সড়িয়ে ট্রলিতে করে জমিয়ে আলাদা করেছে। প্লাস্টিকে মুড়িয়ে রাখা চাল এবং মসলার প্যাকেটের উপর লিখে দেয়া হয় যে, ‘আমরা ভারতীয় পণ্য সড়িয়ে ফেলেছি’। কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন যে, তারা পুরো কোম্পানিজুড়ে ভারতীয় পণ্য বয়কট করার চিন্তা করছে। ‘দ্যা মালদিভস জার্নাল’ বলছে যে, মালদ্বীপে হুলহুমালে দ্বীপের সৈকতে এবং হাউজিং প্রকল্প এলাকায় ময়লার ঝুড়ির উপর নরেন্দ্র মোদির ছবি লাগানো হয়েছে। ছবিতে মোদির চেহারার উপর জুতার ছাপ দেয়া ছিল। কুয়েতেও ডাস্টবিনের উপর একই ছবি দেখা গেছে। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র বলে খ্যাত প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ১০ই জুন শুক্রবার জুমআর নামাজের পর হাজারো মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে।

 
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি। ভারত সফরের সময় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে আলিঙ্গন করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির নেতৃত্বও যথারীতি বাস্তববাদীই থেকেছে। তারা নুপুর শর্মার বিরুদ্ধে নেয়া বিজেপির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু এই মুসলিম দেশগুলির কোনটাই ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজেপি সরকারের অত্যাচার নিয়ে কোন কথাই বলেনি। ভারতের মুসলিমদের উপর অত্যাচারের খবরাখবর যাতে দিল্লীর সাথে অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত থাকার লক্ষ্যের উপর কোন বিরুপ প্রভাব না ফেলে, সেব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব সর্বদাই খেয়াল রেখেছে। ঠিক একারণেই এই দেশগুলির পক্ষ থেকে নবী (সাঃ)কে অবমাননার বিষয়ে ভারত সরকারের সমালোচনা অনেকের কাছেই অদ্ভূত ঠেকেছে।


সকলেই ঘটনার সুযোগ নিচ্ছে

সাংবাদিক এবং লেখক দেবাশিষ রায় চৌধুরী ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের প্রতিনিধিরা যখন নবী মুহাম্মদ (সাঃ)কে অবমাননা করেছে, তখন ভারতের সেকুলার রাজনীতিবিদেরাও চুপ থেকেছে। শুধুমাত্র এক সপ্তাহ পর মুসলিম বিশ্ব থেকে প্রতিবাদ আসার পরেই তারা মুখ খুলেছেন। মুসলিম বিশ্ব থেকে ভারত সরকারের উপর চাপ আসায় ভারতের মুসলিমরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও সেটা খুব বেশি হলে স্বল্প সময়ের জন্যে। এই উত্তেজনা যখন ঠান্ডা হয়ে আসবে, তখনই বোঝা যাবে যে, ভারতের মুসলিম জনগণের নিরাপত্তার চাইতে বাণিজ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মোদি সরকার তখন হয়তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথা বলে কিছু ব্যক্তিকে কারাবন্দী করবে। আর উগ্রবাদী হিন্দু এবং সরকারি শক্তিকে আবারও মুসলিমদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, মোদি আবারও মুসলিম দেশগুলি সফর করে তাদের নেতৃত্বকে আলিঙ্গন করবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ নবী মুহাম্মদ (সাঃ)কে নিয়ে কথা না বলবে, ততক্ষণ সকলকিছু স্বাভাবিক থাকবে। বিজেপির ৮ বছরের শাসনের মাঝে ভারতের মুসলিমদের উপর চরম অত্যাচার হলেও মুসলিম বিশ্ব থেকে কোন প্রতিবাদই আসেনি। উল্টো সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব দিল্লীর সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করেছে।

ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুরা বিজেপির মুখপাত্রকে বরখাস্ত করার মোদির সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। এদের কেউ কেউ মোদিকে কাপুরুষ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ‘শেইম অন মোদি’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে। তারা অনেকেই টুইটারে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালনা শুরু করেছে। কেউ কেউ মুসলিম দেশগুলির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের ডাক দিচ্ছে। কাতারের সমালোচনা করে কেউ কেউ ‘কাতার এয়ারলাইন্স’কে বয়কটের ডাকও দিয়েছে।

তবে নুপুর শর্মা এবং নাভীন জিনদালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীনরা দেখাতে চেয়েছে যে, তারা পুরো মুসলিম বিশ্বের সাথে সংঘাতে যাবার জন্যে প্রস্তুত নয়। এতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের দুর্বলতাটাও প্রকাশ পায়। সকলেই এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করতে চাইছে। জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদার পক্ষ থেকেও ভারতকে হুমকি দেয়া হয়েছে। ‘সিএনএন’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ভারতের প্রভাবশালী থিংকট্যাংক ‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’এর ফেলো মোহাম্মদ সিনান সিয়েচ বলছেন যে, এটা আল কায়েদার রিক্রুটিং প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর ফেলো হাসান আল হাসান বলছেন যে, মোদি সর্বদাই চেষ্টা করেছেন যাতে করে তার অভ্যন্তরীণ হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার ফলাফল দেশের বাইরে চলে না যায়; এবং সেটা যেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে ভারতের সম্পর্ককে সমস্যায় না ফেলে।

 
১০ই জুন ২০২২। ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র বলে খ্যাত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাস্তায় হাজারো মানুষের বিক্ষোভ। প্রতিবাদ শুধু সরকার নয়, বরং সকল প্রকারের ধর্মীয় সংস্থার পক্ষ থেকে এমনকি বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকেও এসেছে। এটা বলে দিচ্ছে যে, পুরো মুসলিম বিশ্বের জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বলেই এখানে কূটনীতিকদের জড়িত হতে হয়েছে; যা এর আগে দেখা যায়নি। অর্থাৎ মুসলিম বিশ্বের জনগণের এই প্রতিক্রিয়া মুসলিম দেশগুলির সেকুলার নেতৃত্বের বাস্তবাদী থাকার নীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে বলেই বিজেপিকে ছাড় দিতে হয়েছে।


ভারতের মুসলিমদের কি হবে?


‘সিএনএন’এর এক প্রতিদেবনে বলা হচ্ছে যে, নবী (সাঃ)কে অবমাননার ঘটনা ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলিমদের কাছে নতুন কোন ব্যাপার হয়ে আসেনি। কারণ গত ৮ বছর ধরে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের অধীনে তারা মারাত্মক অত্যাচারের শিকার হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারতে উগ্রবাদী হিন্দুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কর্মকান্ড বেড়েছে। গত জানুয়ারি মাসেই ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের জ্যেষ্ঠ বিজেপি নেতা পূজা শাকুন পান্ডে ভারতকে রক্ষা করতে মুসলিমদের নিধন করে ফেলার কথা বলেন। তিনি বলেন যে, তারা যদি ২০ লক্ষের মতো মুসলিম হত্যা করে ফেলতে পারে, তাহলে একটা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসেই দক্ষিণের কর্ণাটক রাজ্যে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পড়া নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৮ সালে বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন যে, বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিমরা হলো ‘পিঁপড়া’র মতো এবং এদেরকে উৎপাটন করার জন্যে তারা ব্যবস্থা নেবেন। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মাঝে বহু মুসলিমকে হিন্দুত্ববাদীরা গরুর গোশত খাওয়ার ‘অপরাধে’ হত্যা করেছে বলে বলছে মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’। ২০১৯ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব বিল পাস হয়; যার মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ থেকে সংখ্যালঘুদেরকে ভারতে আশ্রয় দেয়ার কথা বলা হয়। অপরদিকে লক্ষ লক্ষ মুসলিমের ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিল ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে উত্তর প্রদেশে নতুন আইন করা হয়, যার মাধ্যমে হিন্দুদের পক্ষে ইসলাম গ্রহণ করার কঠিন করে ফেলা হয়।

মুসলিম দেশগুলি যদি ভারতকে এতটাই গুরুত্ব দেয় এবং মুসলিমদের উপর অত্যাচারের ব্যাপারে এতদিন চুপ থাকে, তাহলে এখন কেন তারা মুখ খুলছে? দেবাশিষ রায় চৌধুরী বলছেন যে, হয়তো মুসলিম নেতৃত্ব নিজেদের দেশের জনগণকে ঠান্ডা রাখার জন্যেই ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। কুয়েতের মিডিয়া বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্যসংকটে নিজেদের সুরক্ষা দিতে ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার পর কুয়েতের সরকার দিল্লীকে তাদের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছে। ভারতের মোট বহির্বাণিজ্যের ১৫ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টা দেশের সাথে হয়ে থাকে। ভারতের মোট জ্বালানি তেলের এক তৃতীয়াংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে বিশ্বব্যাপী ভারতের মোট ১ কোটি ৩৫ লক্ষ প্রবাসীর মাঝে প্রায় ৮৭ লক্ষই বাস করে ‘জিসিসি’ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিতে। এই প্রবাসীদের কাছ থেকে বছর প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে; যা কিনা ভারতের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৬৫ শতাংশ। বুঝতে বাকি থাকে না যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মধ্যপ্রাচ্যের উপর যেমন অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যও ভারতের সাথে বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি জনবলের সংকটের কারণে বিদেশী শ্রম, বিশেষ করে ভারতীয় নাগরিকদের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল।

নবী (সাঃ)কে অবমাননার ফলে মোদির বিজেপি সরকারের অবস্থান অভ্যন্তরীণভাবে পরিবর্তন হচ্ছে না ঠিকই; তবে ঘটনার বাস্তবতার চাপ মোকাবিলা করতে বিজেপি সরকার যে তাদের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডায় কিছুটা ছাড় দিয়ে বাস্তববাদীও হতে পারে সেটার প্রমাণ মিলেছে আবারও। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির নেতৃত্বও যথারীতি বাস্তববাদীই থেকেছে। তারা নুপুর শর্মার বিরুদ্ধে নেয়া বিজেপির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু এই মুসলিম দেশগুলির কোনটাই ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজেপি সরকারের অত্যাচার নিয়ে কোন কথাই বলেনি। ভারতের মুসলিমদের উপর অত্যাচারের খবরাখবর যাতে দিল্লীর সাথে অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত থাকার লক্ষ্যের উপর কোন বিরুপ প্রভাব না ফেলে, সেব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব সর্বদাই খেয়াল রেখেছে। ঠিক একারণেই এই দেশগুলির পক্ষ থেকে নবী (সাঃ)কে অবমাননার বিষয়ে ভারত সরকারের সমালোচনা অনেকের কাছেই অদ্ভূত ঠেকেছে। এই প্রতিবাদ শুধু সরকার নয়, বরং সকল প্রকারের ধর্মীয় সংস্থার পক্ষ থেকে এমনকি বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকেও এসেছে। এটা বলে দিচ্ছে যে, পুরো মুসলিম বিশ্বের জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বলেই এখানে কূটনীতিকদের জড়িত হতে হয়েছে; যা এর আগে দেখা যায়নি। অর্থাৎ মুসলিম বিশ্বের জনগণের এই প্রতিক্রিয়া মুসলিম দেশগুলির সেকুলার নেতৃত্বের বাস্তবাদী থাকার নীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে বলেই বিজেপিকে ছাড় দিতে হয়েছে। যদিও বিজেপি সরকার তার মুসলিম বিদ্বেষী নীতি বাস্তবায়নে মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্বের ‘রেড লাইন’ কোথায়, তা বুঝতে পেরেছে; তথাপি মুসলিম বিশ্বের জনগণের ‘রেড লাইন’ তাদের কাছে পরিষ্কার না হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটা এড়িয়ে যাবার উপায় নেই যে, উগ্র হিন্দুবাদী ভারত তৈরির আকাংক্ষা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সুস্থ্য মস্তিষ্কের চিন্তা বেশিরভাগক্ষেত্রেই অবহেলিত হবে; যার ফলশ্রুতিতে আবারও হয়তো মুসলিম বিশ্বের সেকুলার নেতৃত্ব তাদের জনগণের কাছ থেকে চাপ অনুভব করবে। প্রতি ক্ষেত্রেই মুসলিম বিশ্বের জনগণের মাঝে নেতৃত্বের হাহাকার জেঁকে বসবে; যা কিনা ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ।

5 comments:

  1. সুন্দর বিশ্লেষণ

    ReplyDelete
  2. উপমহাদেশে কি বড় কোনো যুদ্ধ লাগতে পারে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. যুদ্ধ অসম্ভব নয়। ২০ কোটি মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে সেটার ফলাফল ভালো হবার কথা নয়। সেই মানুষগুলিকে যদি তাদের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে বঞ্চিত করা হয়, তাহলে সেই সংঘাত দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে যাবে নিশ্চিত। বড় সংঘাতের সম্ভাবনা থাকবে একারণেই। এখানে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্র সংঘাতে জড়িয়ে যেতে পারে; কারণ এখানে অনেকেরই অনেক রকম স্বার্থ থাকবে।

      বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা হলো ১৬৪৮ সালের 'ওয়েস্টফালিয়ান সিস্টেম'। এর মাঝে আন্তর্জাতিক সীমানা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় এবং সেই সীমানার মাঝে সকল জাতিগোষ্ঠীর দায়িত্ব দেয়া হয় এঁকে দেয়া রাজনৈতিক সীমানা দিয়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া একটা 'জাতিরাষ্ট্রে'র উপর। এই জাতিরাষ্ট্র সেই সীমানাকে রক্ষা করে চলে এবং সেই সীমানাকে পবিত্র মনে করে সীমানা রক্ষার্থে দরকার হলে তার নিজের দেশের মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এবং ওয়েস্টফালিয়ান সিস্টেমের নিয়ম অনুযায়ী অন্য রাষ্ট্রের এখানে কিছুই বলার অধিকার নেই।

      কিন্তু এটা একটা অবাস্তব সমাধান। ১৬৪৮ সালে ইউরোপে এই সমাধান দেয়া হয়েছিল ৩০ বছরব্যাপী যুদ্ধ শেষ হবার পর। সেখানে যুদ্ধরত ক্যাথোলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের মাঝে সংঘাত বন্ধে এই সমাধান দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় থেকে আজ অবধি ইউরোপে বেশিরভাগ সময় যুদ্ধ করেই কেটেছে। তারা নিজেরাই সেই সিস্টেমের মাঝে দেয়া শর্তগুলি পূরণ করেনি। অথচ ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমে তারা সেই সমাধানটাই সারা দুনিয়াতে স্থাপন করেছে। বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্র তৈরি করার সাথেসাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরি করা হয়েছে; যাদের কাজ হলো ওয়েস্টফালিয়ান সিস্টেমকে মেনে চলতে সকলকে বাধ্য করা। যদিও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি যাতে সেই সিস্টেমকে বাইপাস করে চলতে পারে, সেই ব্যবস্থাটা রাখা হয়েছে। অর্থাৎ শক্তি থাকলে একটা রাষ্ট্র সেই সিস্টেম মানতে বাধ্য নয়।

      Delete
  3. আহমেদ শরীফ ভাই, আমার একটা অন্য বিষয় সচলায়তনের প্রশ্ন ছিল, ভারত কি U.N.S.C. এর permanent membership পেতে যাচ্ছে বা অদূর ভবিষ্যতে কি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে? আর যদি পেয়ে যায় তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কি অবস্থা হবে? পাকিস্তানি এম্বেসেডর আব্দুল বাছিত কয়েক দিন আগে এই প্রশ্ন তুলেছেন যে বিলাওয়ালের আমেরিকা সফরের সময় এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ধন্যবাদ প্রশ্নের উত্তর দিবেন প্লিজ।🙂

    ReplyDelete
    Replies
    1. জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য অর্থ কি? এর অর্থ হলো - সকলের উপরে যেসব নিয়ম খাটবে, তা আমার উপরে খাটবে না; এবং আমি ইচ্ছামতো অনেক কিছুই করতে পারবো, যদি ঐ পরিষদের বাকিরা বাধা না দেয়।

      এধরণের স্বেচ্ছারী গোত্র তৈরি করার অর্থ হলো কিছু রাষ্ট্রকে এক্সক্লুসিভ রাখা। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ তৈরির সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যারা দুনিয়া চালাতো তাদেরকে (অর্থাৎ ব্রিটেন এবং ফ্রান্স)কে এই এই গ্রুপে রেখেছে। সাথে ঢুকিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৯১ সাল থেকে রাশিয়া) এবং চীনকে (প্রথমে জাতীয়তাবাদী চীন এবং ১৯৭১ সাল থেকে কমিউনিস্ট চীন)। ১৯৭১ সালে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পরেই কমিউনিস্ট চীনকে এই গ্রুপে নেয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জিতেছে, তারাই গ্রুপের অংশ। অথচ বিশ্বযুদ্ধের জয়ী পক্ষে কিন্তু আরও দেশ ছিলো। তাহলে এই পাঁচটাকে রাখা হলো কেন? কারণ এটা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার অংশ। এখানে পরিবর্তন আনতে হলে পুরো ব্যালান্স অব পাওয়ারেই পরিবর্তন হতে হবে। আর সেটা করার মতো শক্তি বা সামর্থ্য যুক্তরাষ্ট্রের এখন আছে কিনা, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ এই মুহুর্তে রাশিয়া এবং চীনকে রাজি করিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কোন কিছুই করা সম্ভব নয়।

      Delete