Saturday 18 June 2022

পাকিস্তানের সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা উঠছে কেন?

১৮ই জুন ২০২২

 
মে ২০২২। ইস্রাইলের প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত পাকিস্তানিদের ইস্রাইল সফররত গ্রুপ।  পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবিরা ইসলাম নয়, বরং জাতীয় স্বার্থকে চিন্তার কেন্দ্রে রাখছেন। পাকিস্তান ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে কিনা, সেটা পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের ব্যাপার। যখন ইস্রাইল কোন আলোচনাতেই ছিল না, তখন ইমরান খানই হঠাত করে পাকিস্তান ইস্রাইলের সম্পর্কের ব্যাপারটা তুলে এনেছেন; যা কিনা এই বিষয়টাকে খোলা আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

গত মে মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত পাকিস্তানিদের একটা দল ইস্রাইল সফর করে। এই সফরের মূল আয়োজক ছিল ‘শারাকা’ নামের একটা গ্রুপ, যারা ২০২০ সাল থেকে আরব দেশগুলির সাথে ইস্রাইলের স্বাক্ষরিত ‘আব্রাহাম একর্ড’এর উপর ভিত্তি করে মুসলিম দেশগুলির সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পিছনে কাজ করছে। পাকিস্তানি পত্রিকা ‘দ্যা নিউজ’ বলছে যে, পাকিস্তানিদের ঐ গ্রুপের নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান লবির সদস্য আনীলা আলী। আর এই গ্রুপের মাঝে ছিলেন সাংবাদিক আহমেদ কুরাইশি, যিনি সরকারি পাকিস্তান টেলিভিশনের একজন টক-শো সঞ্চালক। ‘জিও টিভি’র সাথে এক সাক্ষাতে আনীলা আলী বলেন যে, তাদের সফরের সাথে পাকিস্তানের কোন সম্পর্ক নেই; বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের সাথে ইহুদীদের সম্পর্কোন্নয়ন।

‘এনপিআর’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, পাকিস্তানের পাসপোর্টে এখনও ইস্রাইল ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। যারা ইস্রাইল গিয়েছেন, তারা মার্কিন পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এটার আয়োজক ছিল মার্কিন মুসলিম মহিলাদের একটা সংস্থা। এই সফর ইস্রাইলে খুব একটা আলোচিত না হলেও পাকিস্তানে এ নিয়ে তুমুল ঝড় বয়ে চলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আসন্ন মধ্যপ্রাচ্য সফরের আগে অনেকেই ধারণা করছেন যে, সৌদিদের সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে চলেছে। যদিও পাকিস্তান সৌদি আরব দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত, তথাপি পাকিস্তান হয়তো সৌদিদের পথে হাঁটতে পারবে না।

পাকিস্তানি সাংবাদিক কুনওয়ার খুলদুনে শহীদ ইস্রাইলের ‘হারেতস’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, সৌদি আরবের কারণেই ইস্রাইলের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ হয়তো অবশ্যম্ভাবী। তিনি মনে করছেন যে, সৌদি আরবের পর সুন্নী মুসলিম দেশগুলির মাঝে পাকিস্তান ইস্রাইলের বিরুদ্ধে শেষ বাধা হিসেবে থাকতে পারে না। পাকিস্তানের সবচাইতে শক্ত জাতীয়তাবাদীরাও এখন ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পক্ষপাতী। ইস্রাইল সফরকারী আহমেদ কুরাইশিকে এখন পাকিস্তানের সাংবাদিকদের মাঝেই অনেকে সমর্থন দিচ্ছেন। পাকিস্তানের পরিবেশবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িতরা এবং কৃষিবিদদের কেউ কেউ এখন বলছেন যে, ইস্রাইলের কাছ থেকে পাকিস্তান প্রযুক্তি নিয়ে নিজেদের পরিবেশ এবং কৃষির উন্নয়ন করতে পারে। মাত্র এক দশক আগেও ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা পাকিস্তানে করা যেতো না। সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিই পাকিস্তানকে এই পথে হাঁটাচ্ছে। তবে তার ধারণা যে, ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে গেলে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ সামাল দেয়ার চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেব্যাপারে পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃবৃন্দ এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা মনে করছেন যে, ইস্রাইলকে স্বীকৃতি দিতে গেলে তারা জনগণের যে আক্রোশের শিকার হবে, সেটাকে সেনাবাহিনী যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবেই কাজটা করা সম্ভব। রাজনীতিবিদেরা নিরাপত্তা চাইছেন সেনাবাহিনীর কাছ থেকে; আর সেনাবাহিনী নিরাপত্তা চাইছে ওয়াশিংটন এবং রিয়াদের কাছ থেকে। খুলদুনে শহীদ বলছেন যে, খুব শিগগিরই হয়তো পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ‘আইএমএফ’এর ঋণের মতো সুন্দর কিছু প্রস্তাব দেয়া হবে; যেগুলির সাথে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রস্তাবও থাকবে। এছাড়াও সামনের দিনগুলিতে নির্বাচনী প্রচারণা হিসেবে সৌদি আর্থিক সহায়তায় আমদানি করা গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যের উপর ভর্তুকির ঘোষণা এবং পবিত্র আল আকসা মসজিদে যেতে দেয়ার দাবি হয়তো আসতে থাকবে।
 
জুন ২০২২। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ 'জেরুজালেম আমাদের' লেখা স্কার্ফ পড়ে পার্লামেন্টে ঢুকছেন। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দায়িত্ব নিতে ভয় পাচ্ছেন বলেই একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। বাস্তবতা হলো, পাকিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের পক্ষে পাকিস্তানের সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করাটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলছেন যে, তার উত্তরসুরীদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এবং কাশ্মিরের ব্যাপারে ভারতের সাথে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে। খুলদুনে শহীদ বলছেন যে, প্রকৃতপক্ষে ইমরান খানকেও এই একই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল; যিনি তা করতে পারেননি। ইমরানের কথাগুলিকে মোকাবিলা করতে ২রা জুন পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ‘জেরুজালেম আমাদের’ এই স্লোগান লেখা স্কার্ফ গলায় জড়িয়ে পার্লামেন্ট ভবনে ঢোকেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা মারইয়াম নাওয়াজ বলছেন যে, জেমাইমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করে পাকিস্তানে শুধুমাত্র ইমরান খানই ইহুদীদের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক করেছেন। আর ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনের ‘পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট’ দলের নেতা ফজলুর রহমান, যিনি এতকাল ইস্রাইলের বিরুদ্ধে খুবই সরব ছিলেন, তিনি এখন বলছেন যে, ইমরান খানই ইস্রাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এগুচ্ছিলেন। ২০২১ সালের জুনে ইমরান খান ক্ষমতায় থাকার সময় বিরোধী রাজনীতিবিদ বিলাওয়াল ভুট্টো অভিযোগ করেন যে, ইমরান সরকারের দু’জন উপদেষ্টা গোপনে ইস্রাইল সফর করে এসেছেন।

এক টুইটার বার্তায় আহমেদ কুরাইশি বলছেন যে, ইমরানের দলের শিরীন মাজারি, যিনি এখন ইস্রাইলের বিপক্ষে কথা বলছেন, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থিংকট্যাংক ‘আইএসএসআই’এর প্রধান থাকার সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি তুরস্কে গিয়ে পাকিস্তানের পণ্যের ইস্রাইলের সহজে ঢোকা নিশ্চিত করতে ইস্রাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলভান শালমএর সাথে আলোচনায় বসেছিলেন; অথচ তখন শিরীন মাজারি কোন প্রতিবাদই করেননি। ‘দ্যা ডন’ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাতে আহমেদ কুরাইশি বলেন যে, শেহবাজ শরীফের সরকার যখন বলছে যে, সরকার তাকে পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে বরখাস্ত করেছে, তখন বোঝা যায় যে, তারা ইমরানের অভিযোগ থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে একই নীতিতে হাঁটছেন।

পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবিরা ইসলাম নয়, বরং জাতীয় স্বার্থকে চিন্তার কেন্দ্রে রাখছেন। আহমেদ কুরাইশি বলছেন যে, পাকিস্তান ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে কিনা, সেটা পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের ব্যাপার। তিনি বলছেন যে, যখন ইস্রাইল কোন আলোচনাতেই ছিল না, তখন ইমরান খানই হঠাত করে পাকিস্তান ইস্রাইলের সম্পর্কের ব্যাপারটা তুলে এনেছেন; যা কিনা এই বিষয়টাকে খোলা আলোচনায় নিয়ে এসেছে। পুরো ব্যাপারটার একটা ধারণা পাওয়া যায় ‘এনপিআর’এর প্রশ্নে ইমরানের সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরীর উত্তরে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানিদের ইস্রাইল সফরে পাকিস্তান সরকার অনুমতি দিয়েছিল কিনা, এই প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন যে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তাদের নীতি হলো ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক না রাখা। খুলদুনে শহীদ বলছেন যে, পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দায়িত্ব নিতে ভয় পাচ্ছেন বলেই একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। বাস্তবতা হলো, পাকিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের পক্ষে পাকিস্তানের সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করাটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment