Sunday 6 March 2022

ইউক্রেন যুদ্ধে শরণার্থী চ্যালেঞ্জ ইউরোপের জাতিগত বিদ্বেষকে সামনে নিয়ে আসছে

০৬ই মার্চ ২০২২

 
‘ইউরোপিয়ান’ শব্দটা একটা কোড হয়ে গিয়েছে। জনগণ কোন সংঘাত নিয়ে মাথা ঘামাবে, সেটার মাপকাঠিও হয়ে গেছে সেটা। সিরিয়া, সোমালিয়া বা অন্যান্য স্থানের ভয়াবহ সংঘাতগুলি পশ্চিমা মিডিয়াতে সেভাবে উঠে আসেনি; যেভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধ উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকানদের ক্রীতদাস হিসেবে রাখা এবং ইউরোপিয়দের হাতে আফ্রিকার উপনিবেশ তৈরির সেই ইতিহাসগুলিই যেন ইউক্রেনের যুদ্ধের মাঝে নতুন করে দেখা দিচ্ছে। একুশ শতকেও ইউরোপের চিন্তায় জাতিগত বিদ্বেষ শক্তভাবে প্রোথিত রয়েছে।


গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরু করার পর থেকে বিদেশীরা ছাড়াও বহু ইউক্রেনিয়ান দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ২৬শে ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিদিন দেড় লাখের বেশি মানুষ দেশ ছেড়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে ৬ই মার্চ পর্যন্ত আনুমানিক ১৪ লক্ষাধিক মানুষ ইউরোপের দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছে। এর মাঝে সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ গিয়েছে পোল্যান্ডে; হাঙ্গেরিতে দেড় লক্ষ; মলদোভায় ১ লাখের বেশি; স্লোভাকিয়ায় ১ লাখ; রোমানিয়ায় ৬৩ হাজার; রাশিয়ায় ৫৩ হাজার। এছাড়াও আরও অন্যান্য দেশে গিয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৩৪ হাজারের মতো। যুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝে এই শরণার্থী চ্যালেঞ্জ ইউরোপের গভীর কিছু সমস্যাকে সামনে নিয়ে এসেছে।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, পোল্যান্ডে বহু স্বেচ্ছাসেবক সীমান্ত অঞ্চলে আসতে শুরু করেছে ইউক্রেনিয় শরণার্থীদের জন্যে পরিবহণ ও থাকার ব্যবস্থা করার জন্যে। স্বেচ্ছাসেবীরা খাবার, চা এবং পানি নিয়ে শরণার্থীদের জন্যে অপেক্ষা করছে। সোশাল মিডিয়াতে হাজারো মানুষ শরণার্থীদের সহায়তা দেবার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শরণার্থীদের জন্যে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টারও কমতি নেই। শরণার্থীদের ব্যাপারে পোলিশ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের মহানুভবতায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। কারণ গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে পোলিশ আইনশৃংখলা বাহিনী বেলারুশের সীমানায় মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীদেরকে জোরপূর্বক দেশে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল। সীমান্ত অঞ্চলে মানবিক সহায়তা এবং সাংবাদিকদের পৌঁছাতে বাধা দেয়া হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে শতশত মানুষ খোলা আকাশের নিচে থাকতে বাধ্য হয়। প্রচন্ড ঠান্ডায় বেশ ক’জন মৃত্যুবরণও করেছিল। এনজিও ‘গ্রুপা গ্রানিকা’র আনা আলবোথ বলছেন যে, সীমান্ত এলাকায় তারা এতো বেশি খাবার এনে রেখেছিলেন যে, খাবার নষ্ট হচ্ছে। কারণ তাদের আশানুরূপ সংখ্যক শরণার্থী আসেনি। শরণার্থীদের জন্যে চাকুরি, ইউক্রেনিয় ভাষার শিক্ষক এবং ক্লাসরুপে কমপিউটারের ব্যবস্থা করা কষ্টসাধ্য হতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন ৫ই মার্চ পোল্যান্ড সফরকালে বলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের মানবিক সহায়তা হিসেবে ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন সহায়তার জন্যে চেষ্টা করছে হোয়াইট হাউজ।

অপরদিকে ২৬ লক্ষ জনগণের ছোট্ট দেশ মলদোভার প্রধানমন্ত্রী নাতালিয়া গাভরিলিতা জাতিসংঘকে আরও সহায়তা দিতে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলছেন যে, ৬ই মার্চ পর্যন্ত মোট ২ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ ইউক্রেন থেকে মলদোভায় ঢুকেছে। এর মাঝে ১ লক্ষ ২০ হাজার এখানে রয়েছে গেছে; যাদের মাঝে ৯৬ হাজার ইউক্রেনিয়। তিনি বলেন যে, মলদোভার মতো ছোট দেশের জন্যে এটা অনেক বড় সংখ্যা।

এদিকে গত ৩রা মার্চ দেশটার উগ্র ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান সীমান্ত শহর বেরেগসুরানিতে সাংবাদিকদেরকে বলেন যে, তার দেশ জানে কারা অভিবাসী, আর কারা শরণার্থী। অভিবাসীদেরকে থামিয়ে দেয়া হবে; তবে শরণার্থীদের ঢুকতে দেয়া হবে। অরবান এতদিন যাবত শরণার্থীদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর নীতিতে ছিলেন। ২০১৫ সালে শরণার্থী ঠেকাতে হাঙ্গেরি সরকার সার্বিয়ার সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছিল। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে অরবানের সরকার শরণার্থীদেরকে দেশে ঢুকতে বাধা দিতে নতুন আইন করেছিল। এখন সরকারি সমর্থনে পুরো হাঙ্গেরি থেকে মানবিক সহায়তা দিতে জনগণ সীমান্ত অঞ্চলে আসছে। 


‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মাত্র ছয় সপ্তাহ আগেই পোল্যান্ডের বেলারুশ সীমানায় সিরিয়া, ইরাক এবং আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের ঠেকাতে দেয়াল তৈরি করা হচ্ছিলো। অথচ এখন হঠাত করেই ইউরোপ তার সীমানা খুলে দিয়েছে। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলছেন যে, শরণার্থীদের আসতে কোন সমস্যা নেই। ইইউ মনে করছে যে, প্রায় ৪০ লক্ষ শরণার্থী ইউক্রেন থেকে আসতে পারে; যা হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচাইতে বড় শরণার্থী সমস্যা। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন রেফেউজিস এন্ড এক্সাইলস’এর ডিরেক্টর ক্যাথারিন উলার্ড বলছেন যে, কতবড় পরিবর্তনই না হয়েছে! তিনি বলছেন যে, ২০১৫ সালে ১০ লক্ষ সিরিয় শরণার্থীর মাঝে কোন দেশকে কতজন রাখতে দেয়া হবে, তা নিয়ে ইইউএর সদস্য দেশগুলির মাঝে মারাত্মক রাজনৈতিক বিরোধ তৈরি হয়েছিল। ইইউএর দেশগুলি এবারে ইউক্রেনিয় শরণার্থীদের কমপক্ষে ১২ মাসের থাকার ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছেছে। এর মাঝে শরণার্থীদের বাসস্থান, স্বাস্থ্য সুবিধা, শিক্ষা এবং চাকুরির ব্যাপারেও ঐকমত্য হয়েছে। উলার্ড বলছেন যে, ইইউএর দেশগুলির পরিষ্কার দু’মুখো নীতি দৃশ্যমান। ২০১৫ সালে পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরি সিরিয় শরণার্থীদের ঠেকাতে তাদের দক্ষিণের সীমানায় দেয়াল তুলেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, দেশগুলির অভিবাসন নীতি নির্ভর করেছে ধর্ম, জাতি এবং শরণার্থীদের উৎস দেশের উপর। এই ব্যবস্থা যথেষ্টই পক্ষপাতদুষ্ট।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, পোল্যান্ডের সীমানায় আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত থেকে আসা শরণার্থীদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে; কারণ তারা ইউক্রেনের নাগরিক নন। শরণার্থীদের কেউ কেউ বলছেন যে, তাদের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়েছে। ইউক্রেনের লেভিভ রেলস্টেশনে এক আফ্রিকান মহিলাকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয় এই বলে যে, শুধু মহিলারাই ট্রেনে উঠতে পারবে! পোলিশ সাহায্য সংস্থা ‘গ্রুপা জাগরানিকা’র স্বেচ্ছাসেবক জ্যান মস বলছেন যে, মেদিকা শহরে শরণার্থীদের ঢোকার সময় তাদেরকে জাতি ভিত্তিতে আলাদা করা হচ্ছিলো। পোলিশ এবং ইউক্রেনিয়দেরকে গাড়ির লাইনে অতি দ্রুততার সাথে যাবার ব্যবস্থা করা হচ্ছিলো। অথচ অন্যদেরকে পায়ে হেঁটে তিন ধাপ পেরিয়ে ঢোকানো হচ্ছিলো, যা ১৪ থেকে ৫০ ঘন্টা পর্যন্ত লাগছিলো।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর এক লেখায় সিনিয়র ফেলো রাশাওন রে বলছেন যে, শ্বেতাঙ্গদের জন্যে ‘ইউরোপিয়ান’ শব্দটা একটা কোড হয়ে গিয়েছে। জনগণ কোন সংঘাত নিয়ে মাথা ঘামাবে, সেটার মাপকাঠিও হয়ে গেছে সেটা। সিরিয়া, সোমালিয়া বা অন্যান্য স্থানের ভয়াবহ সংঘাতগুলি পশ্চিমা মিডিয়াতে সেভাবে উঠে আসেনি; যেভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধ উঠে এসেছে। করোনাভাইরাসের টেস্ট, চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিন পাবার ক্ষেত্রেও কোন জাতি বা দেশের মানুষদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, তা সকলেই দেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকানদের ক্রীতদাস হিসেবে রাখা এবং ইউরোপিয়দের হাতে আফ্রিকার উপনিবেশ তৈরির সেই ইতিহাসগুলিই যেন ইউক্রেনের যুদ্ধের মাঝে নতুন করে দেখা দিচ্ছে। রাশাওন রেএর কথায় পরিষ্কার যে, একুশ শতকেও ইউরোপের চিন্তায় জাতিগত বিদ্বেষ শক্তভাবে প্রোথিত রয়েছে।

No comments:

Post a Comment